
ঝিনাইদহ শহর থেকে মাত্র ২২ কিলোমিটার পেরোলে দেখা মেলে হরিণাকুণ্ডু উপজেলার শড়াতলা গ্রামের। দীর্ঘদিন ধরে শিল্প, সাহিত্য, ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে গ্রামটিতে বসবাসরত আড়াই হাজার মানুষের হৃদয়। তবে এবার সেখানে বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সমাজপতিরা। এমন সিদ্ধান্তে হতবাক হয়েছেন জেলা-উপজেলার সংস্কৃতিপ্রেমি মানুষেরা।
তবে এটিকে সামাজিক অবক্ষয়রোধের ইতিবাচক হিসেবেও দেখছেন অনেকে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো রয়েছে ১০০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প। তাতে বড় করে লেখা আছে ‘সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র ও হকার নিষিদ্ধ করণের নোটিশ’ নামের শিরোনাম। ভেতরে লেখা রয়েছে- ‘গ্রামে সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ করা হলো।
যারা এই নিয়ম ভাঙ্গবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
একই সঙ্গে ৪ হাজার টাকা জরিমানা করার কথাও বলা হয়েছে ওই নোটিশে। সেই সঙ্গে আইন ভঙ্গকারীর পিতা-মাতার বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন সমাজপতিরা। নোটিশে ওই গ্রামে সকল প্রকার হকার ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার কথাও উল্লেখ রয়েছে।
গ্রামের নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ বিবেচনা ও সেখানকার ৯৫ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত এবং ২০ জন চাকরিজীবী থাকায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়।
আরো পড়ুন
হারিয়ে যাওয়ার ২৩ বছর পর পরিবারকে ফিরে পেলেন কুমিল্লার জোসনা
ওই নোটিশে জনপ্রতিনিধি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদরাসার সভাপতি, শিক্ষক, ঈমাম ও সমাজসেবকসহ ১৯ জনের স্বাক্ষর রয়েছে।
সমাজপতিদের এমন সিদ্ধান্তে হতবাক হয়েছেন স্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন তারা। পাশাপাশি এ নিয়ম জারি করা ব্যক্তিদের সামাজিক রীতিবিরোধী আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।
এদিকে ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
ওই গ্রামের পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি মো. এনামুল হক বলেন, ‘গ্রামের লোকেরা আগে উচ্চস্বরে গান-বাজনা বাজাত। এতে অসুস্থ মানুষ, শিক্ষার্থী, নারী ও শিশুসহ অনেকের সমস্যা হত। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বিভিন্ন সময়ে উচ্চস্বরে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নাচগান করে। এতে মানুষের সমস্যা হয়। সেই সঙ্গে হকাররা নানান সময়ে মানুষের কাছ থেকে অধিক টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়। তাই আমরা এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।’
আরো পড়ুন
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত ২০ এপ্রিলের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ
স্থানীয় ইউপি সদস্য তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘বাদ্যযন্ত্র বাজানোর কারণে ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়ার ক্ষতি হয়। তাই তাদের সুবিধার জন্য আমরা গ্রামের সবার মতামত নিয়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
ঝিনাইদহের বিহঙ্গ সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক শাহীনূর আলম লিটন বলেন, ‘আমাদের এলাকা সংস্কৃতির পূণ্যভূমি। আবহমান বাংলা থেকেই এদেশে সংস্কৃতির চর্চা চলে আসছে। গ্রামের সাধারণ মানুষও এর সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধও যে চার মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। ৯০-এর স্বৈারাচারবিরোধী আন্দোলনেও আমরা পথনাটক এবং গানবাজনার মাধ্যমে মানুষকে সম্পৃক্ত করেছিলাম। ২৪-এর ছাত্রজনতার গণআন্দোলনেও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষের ভূমিকা রয়েছে।’
আরো পড়ুন
পানির জন্য তিস্তায় ক্ষোভের পদযাত্রা
তিনি আরো বলেন, ‘একটি ধর্মান্ধ গোষ্ঠী যারা আমাদের সমাজকে পিছিয়ে দেওয়ার জন্য ধর্মকে মানুষের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। একটা এলাকা থেকে বাদ্যযন্ত্র কেউ নিষিদ্ধ করতে পারে না। এটি বেআইনি। এর বিরুদ্ধে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
হরিণাকুণ্ডু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিএম তারিক-উজ-জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘লোকমুখে বিষয়টি শুনেছি। এটি আইনবিরোধী কাজ। এটা করার অধিকার কারো নেই। ইতিমধ্যে এ নিয়ে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছি। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ অরিত্র কুণ্ডু, কালের কন্ঠ