
আতোয়ার রহমান : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ সম্প্রতি চলমান প্যান্ডেমিক বিষয়কে কেন্দ্র করে তার উপন্যাস লেখার কাজটি শেষ করেছেন। গতবছর টরোন্টোতে তার সাথে এই বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হয় আমার। হাসান জাহিদ টরোন্টোতে বসে লেখার কাজটি শুরু করেছিলেন। আর শেষ করেছেন ঢাকায় অবস্থান করে।
চমকপ্রদ বিষয় হলো, একইসাথে তিনি তার বাংলা উপন্যাসের ইংরেজি ভার্সান লেখাটাও শেষ করেছেন। এটা একইসাথে সাহসী পদক্ষেপ ও বৃহত্তর পরিসরে তার লেখা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দেবার প্রয়াস।
হাসান জাহিদের সাথে ফোনালাপ, ফেসবুক স্ট্যাটাস ও তিনি আমাকে যে সামান্য অংশ পাঠিয়েছেন, সেসব থেকে উপন্যাসটি সম্পর্কে আমার একটা স্বচ্ছ ধারণা এসেছে। একটা ভালো লাগার দোলায় তাই এই সংক্ষিপ্ত রিভিউটা লিখলাম। হাসান জাহিদ শক্তিশালী গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক। তিনি উঁচু মাপের লেখক-এটা প্রমাণিত। আর আমার কাছে তিনি একজন আদর্শবান মানুষ ও নৈতিকতায় সমৃদ্ধ। বিনয়ী ও প্রচারবিমুখ। ঢাকা ও টরন্টোতে বাংলা ইংরেজিতে তার প্রবন্ধ, গল্প ও রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি লিখছেন বহুবছর যাবত।
তার ইংরেজি উপন্যাসের নাম The Endemic: Virus Ornithokeirous. নামটা প্রচলিত রীতিনীতি ছাপিয়ে, উপন্যাসের সাথে মিল রেখে অনেকটা উত্তরাধুনিক ঢংয়ে লেখা তার ঔপন্যাসিক অভিযানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
উপন্যাসের প্রোটাগোনিস্ট একজন মিডিওকার মাঝবয়সী বাঙালি। যিনি ক্যানেডায় আগমনের পূর্বে এক কুকুরখেকো দেশে থেকে অকথ্য নির্যাতনের শিকার হন। তার এক কাঁচাবয়সী সহকর্মী সেই দেশে রহস্যজনকভাবে চিরতরে নিখোঁজ হয়ে যায়। শত ঘা খেয়েও তিনি থাকেন ছোটো দুই ভাইবোনকে মানুষ করতে। তার প্রয়াত পিতামাতার দায়িত্ব তিনি পালন করছিলেন। ছোটো বোন ডাক্তার হয় ও ছোটো ভাই সরকারি চাকরিতে যোগ দেয় এক পর্যায়ে।
হাসান জাহিদ : আশির দশকের গল্পকার।
জন্ম ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ সম্মানসহ এমএ।
বর্তমানে ক্যানেডার টরোন্টো শহরের স্থায়ী বাসিন্দা ও সেই দেশের নাগরিক। ক্যানেডায় তিনি সাংবাদিকতা ও কালচার অ্যান্ড হেরিটেজ বিষয়ে গ্রাজুয়েট।
হাসান জাহিদ পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ে কয়েকটি আলোচিত গ্রন্থের প্রণেতা। ঢাকা, কলকাতা ও টরোন্টোর পত্রপত্রিকায় লিখছেন। তিনি ইকো-ক্যানেডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ।
হাসান জাহিদের গল্প এবং বাংলা/ইংরেজিতে প্রবন্ধ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রপত্রিকায়, সাপ্তাহিক পত্রিকা/সাহিত্য ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। সংগীতশিল্পী হিসেবেও তার পরিচিতি রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: প্রেয়সী ও গোলাপের কাঁটা (গল্পগ্রন্থ), ট্রেন ট্ ুইন্ডিয়া: অন্য এক বাংলার স্মৃতি (অনুবাদ), ভৈরবপুরাণ: শেকড়ের সন্ধানে (অঞ্চলভিত্তিক), জলবায়ু পরিবর্তন: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ ও বিশ^ (পরিবেশ)
তার সেই ব্যক্তিত্বের সমস্যা তার স্বপ্নের দেশ ক্যানেডাতেও ছায়ার মতো পিছু নিয়েছিল। উন্নত কাউন্সিলিং ও থেরাপি এবং উন্নত মেডিকেশনে তার ডিজঅর্ডার কিছুটা কেটে গেলেও তিনি প্রথমদিকে একধরনের ঘোর আর মিথের জগতে বাস করছিলেন। ক্যানেডার মিথ, কালচার আর ক্যানেডীয় জীবনযাত্রা তাকে দারুন আকর্ষণ করে। এই আকর্ষণে তিনি পড়তে থাকেন মানব বিবর্তন, ভূবিদ্যা ও ইতিহাস সম্পর্কে। এখানে তিনি কালচার ও হেরিটেজে ডিগ্রি নেন। কোনো ভালো সংস্থায় কাজ করার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। সেইসাথে রুজি রোজগারের জন্য ক্লিনিংয়ের কাজ নেন।
একটা বেইজমেন্ট তার আবাস। বই তার সঙ্গী। বেইজমেন্টে মেট তার নিঃসঙ্গ জীবনের সাথী।
এইসময় শুরু হয় বিশ^জুড়ে কোভিড-১৯। নায়ক ডুবে থাকেন লেক অন্টারিও’র লক নেস দানবের সিলূঅ্যাটে আর ওল্ড বে স্টেশনের অ্যাপারিশনের রোমাঞ্চে। আর তিনি মন দেন আদিবাসীদের ওপর গবেষণায় ও ক্যানেডার শেকড়ের অনুসন্ধানে।
তিনি খবর পান তার চিকিৎসক বোন কোভিড রোগীর সেবায় নিয়োজিত থেকে শেষে নিজেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তার জন্তু সদৃশ রোমশ একটা ছেলে সন্তান হয়েছিল; সে-ও মারা যায়। এদিকে, ছোটো ভাইয়ের বউ ভাইরাস উপেক্ষা করে শপিং করে বেড়ায়।
তিনি তার আশির দশকের স্বর্ণালী সময়ে ফিরে যান, মনে পড়ে কোনো একসময় ক্ষণস্থায়ী ছায়ার মতো কোনো এক মায়াবী প্রেম উঁঁকি দিয়েছিল তার কল্পরাজ্যে। সেই প্রেমটা কোনো এক রূপ ধরে তার ফেসবুকে লুকিয়ে ছিল।
একটা প্যারানরমাল অবস্থান, এক জাতের অনতিক্রম্য ঘোর, প্যারামনেশিয়া আর দেজা ভু (a feeling of having already experienced the present situation), ইত্যকার জটিল আবর্তনে ঘুরপাক খেতে থাকেন তিনি।
তার হাতে গোনা কিছু বন্ধু’র সাথে তিনি কান্ট্রিস্টাইল বা কোনো কফি শপে আড্ডা দেন। আলোচনা হয় প্যান্ডেমিক বিষয়ে বা বাঙালিদের হালচাল নিয়ে।
তিনি জানেন, জীবনের স্বাভাবিকত্ব তিনি অনেক আগেই হারিয়েছেন। অপমানিত হয়েছেন, বঞ্চিত-লাঞ্ছিত হয়েছেন। হারিয়েছেন যৌনক্ষমতা। তবে মূল্যবোধটুকু ঠিক রেখেছেন তিনি। প্রচুর পাঠাভ্যাস তাকে জীবনের অবশিষ্ট অংশটুকুতে সৃষ্টিশীল কিছু করার স্বপ্নে বিভোর রেখেছে।
একসময় তিনি কোভিড আক্রান্ত হন। সুস্থ হয়ে ফিরে এসে তিনি মানবতার অবমাননা, মানুষের অদূরদর্শিতার কুফল, প্রকৃতির ওপর হস্তক্ষেপ আর যুদ্ধ-সংঘাত, মানবসৃষ্ট জীবাণু আর সীমা লঙ্ঘনের নানা বিষয়, সর্বোপরি ক্যানেডার ফার্স্ট ন্যাশনস-এর অতীত অত্যাচারিত হবার পটভূমি প্রভৃতি সম্পর্কে লিখতে শুরু করেন।
লেখা সমাপ্ত হবার আগেই তিনি দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হন। তার প্রেমিকাও একইসাথে আক্রান্ত হয়। দু’টি জীবনের সমাপ্তি ঘটে।
উপন্যাসটি সংগ্রহ করুন এই সাইটে:
https://www.rokomari.com/book/389683/virus-ornithokeirous#summary
তিনি যে মহৎ উদ্যোগ নিয়েছিলেন আর তার রেখে যাওয়া সমৃদ্ধ লেখা নিয়ে কান্ট্রিস্টাইলে তার রুমমেট আর গুটিকয় বন্ধু ভারাক্রান্ত মনে আলোচনা চালায়।
উপন্যাসের সেটিংস ক্যানেডা, বাংলাদেশ ও অ্যামেরিকা।
ঔপন্যাসিক হাসান জাহিদ কাহিনি রচনা করেছেন ব্যাক অ্যান্ড ফোর্থ আদলে। ফ্ল্যাশব্যক, ডায়ালগ আর চলতি অ্যাকশন- প্রভৃতির মিশ্রণে আমার যতটুকু বোধগম্য হয়েছে, তাতে আমি মনে করি, এই কাহিনির বাংলা-ইংরেজি দুই ভার্সনই সমান সুখপাঠ্য ও পাঠকপ্রিয়তা পাবে।
আরও জেনেছি যে, দক্ষ কথাশিল্পী তার উপন্যাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্যাটায়ার-হিউমার আর বিচিত্র সব ক্যারেক্টারের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। রেফারেন্স টেনেছেন সুদূর অতীত থেকে। আর আমাদের চেনা-জানার বাইরের অনেক তথ্য-ঘটনা তুলে ধরেছেন সার্থকতার সাথে।
লেখক: টরোন্টোপ্রবাসী গল্পকার ও প্রাবন্ধিক