ছবি: সংগৃহীত
পুঞ্জীভূত কোনো খাতে বিনিয়োগ না করে বৈচিত্র্যায়ণ বিনিয়োগকে উৎসাহিত করছে প্রিমিয়ার ব্যাংক। শুধু মুনাফার কথা চিন্তা না করে বেকার সমস্যা সমাধান ও অধিকতর কর্মসংস্থান তৈরিতে এই ব্যাংক বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্যাংকের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন দ্য প্রিমিয়ার ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও মোহাম্মদ আবু জাফর
মোহাম্মদ আবু জাফর
দেশের ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বর্তমান অবস্থা কেমন?
বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। তাই জনসাধারণের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে সুদমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়। গত চার দশকে ইসলামী ব্যাংকিং খাতের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য, যা আমানত, বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স, রপ্তানি, আমদানি এবং অন্যান্য আর্থিক সেক্টরে দৃশ্যমান। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সুদমুক্ত নীতিমালার পাশাপাশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার নীতির জন্য মুসলিম ও অমুসলিম উভয় জনগোষ্ঠীর কাছে এর বিশেষ আবেদন রয়েছে।
বিশেষভাবে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগোষ্ঠীর আস্থা এবং শরিয়াহভিত্তিক পণ্য ও সেবার চাহিদা এই বৃদ্ধির পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।
শরিয়াহসম্মত নীতিমালা পূর্ণাঙ্গভাবে অনুসরণ করে ব্যাংকিং পরিচালনা করলে ফান্ড ডাইভারসনের সুযোগ থাকে না। তাতে সঠিক খাতে বিনিয়োগ নিশ্চিত করা সম্ভব, যা দেশের জিডিপি উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব রাখে। দেশের গ্রাহকদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করে ইসলামী ব্যাংকিং সেবার পরিধি বাড়ানো এই খাতের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সম্ভাবনার তুলনায় দেশে ইসলামী ব্যাংকিং কতটা এগিয়েছে বলে মনে করেন?
এ দেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকিং দেশের আর্থিক খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকিং একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। দেশের সার্বিক আমানতের ২৫ শতাংশ এবং বিনিয়োগের ২৮ শতাংশ ইসলামী ব্যাংকের দখলে।
দেশের রেমিট্যান্সের একটা বড় অংশ আসছে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো থেকে। গত অর্থ বছরে মোট রেমিট্যান্সের ৩৬ শতাংশের বেশি এসেছে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও সংগৃহীত আমানতের ৫২ শতাংশই ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অবদান, যা গ্রামীণ পর্যায়ে প্রায় ৫৮ শতাংশ।
তবে এই সেক্টরে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। সাধারণ গ্রাহকদের কাছে প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের পার্থক্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
বাংলাদেশে ইসলামী মুদ্রা বাজারের অনুপস্থিতির কারণে, ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত তহবিল বিনিয়োগ করে আয় অর্জনে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। এর সমাধানের জন্য পর্যাপ্ত গবেষণার অভাব রয়েছে। দেশের ইউনিভার্সিটিগুলোতে বিশেষায়িত কোর্স থাকা দরকার। মালয়েশিয়ার সেন্ট্রাল ব্যাংকের আদলে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ওপর উচ্চতর ডিগ্রির সুব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক একটা পৃথক আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করা যায়, প্রচলিত সমস্যার উত্তরণ ঘটবে।
২০২৪ সালের শেষদিকে ইসলামী ব্যাংকগুলোর গ্রাহকদের আমানত তুলে নেওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। বর্তমানে এ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে কি?
সাম্প্রতিক সময়ে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ইসলামী ব্যাংকগুলোর ওপর কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। গ্রাহকদের মধ্যে এক রকম আস্থার সংকট ও প্যানিক দেখা দেয়, যা বর্তমানে উন্নতি হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকিং আমানতের পরিমাণ ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত কমবেশি ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখালেও এরপর থেকে তা হ্রাসের প্রবণতা দেখা যায়। মোট ইসলামী ব্যাংকিং আমানতের পরিমাণ ২০২৪ সালের জুনে সর্বোচ্চ পৌঁছেছিল। যা ৪,৪০,৪২৭ কোটি টাকা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। কিন্তু জুলাই থেকে তা কমতে শুরু করে এবং আগস্ট মাসে তা ৪,৩১,৮০৫ কোটি টাকায় পৌঁছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়োপযোগী উদ্যোগে লিকুইডিটি অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। সেপ্টেম্বর মাসে ২,৪৬২ কোটি টাকা (০.৫৭%) বৃদ্ধি পেয়ে আমানত ৪,৩৪,২৬৭ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
আপনাদের ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি কেমন?
আমাদের ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি বেশ ভালো। বিগত রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং টালমাটাল অবস্থার মধ্যেও আমাদের কোনো শাখায় তারল্য সংকটের কারণে কোনো চেক ডিজঅনার হয়েছে—এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই। মূলত ‘সার্ভিস ফার্স্ট’ এই স্লোগানটি অন্তরে ধারণ করে আমাদের জনশক্তি। ফলে দীর্ঘদিন থেকে গ্রাহকের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে এ ব্যাংক। এতে তারল্যের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটিতে আমরা সব সময় স্বস্তিকর অবস্থায় রয়েছি।
বর্তমানে কোন খাতে বিনিয়োগকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে?
আমাদের ব্যাংক পুঞ্জীভূত কোনো খাতে বিনিয়োগ না করে বৈচিত্র্যায়ণ বিনিয়োগকে উৎসাহিত করছে। এ ক্ষেত্রে শিল্প-কারখানা, বিশেষ করে তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, স্পিনিং মিলসসহ অন্যান্য শ্রমঘন খাত যেমন রিয়েল এস্টেট, ট্রেডিং, কৃষি, এসএমই ইত্যাদি খাতে বিনিয়োগকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। শুধু মুনাফার কথা চিন্তা না করে বরং বেকার সমস্যা সমাধান ও অধিকতর কর্মসংস্থান তৈরিতে এ ব্যাংক বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
আপনাদের ব্যাংকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাই?
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ইসলামী ব্যাংকিং বর্তমানে শুধু এ দেশে নয়; বরং সারা বিশ্বেই একটি শক্তিশালী ইমেজ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এ ব্যাংক প্রায় তার সূচনালগ্ন থেকেই ইসলামী ব্যাংকিং সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট রয়েছে। আমাদের এ ব্যাংক দুটি পরিপূর্ণ ইসলামী ব্যাংকিং শাখা, ২৫টি ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডোসহ অনলাইন ইসলামী ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে। আমরা সত্যিকার অর্থে এ দেশে ইসলামী ব্যাংকিং প্রাকটিস করতে চাই, বিশেষ করে ক্রয়-বিক্রয় নিশ্চিত করে যাঁরা এ ব্যাংকে মুনাফা রাখেন, তাঁদের একটি হালাল ইনকামের পাশাপাশি বিপুল কর্মসংস্থান তৈরি এবং বিনিয়োগে আরো বৈচিত্র্যতা আনতে চাই।