ঈদুল ফিতরের প্রবন্ধ
পবিত্র ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য, শিক্ষা ও গুরুত্ব
গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
মুসলমানদের জীবনে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। এই দিনটির তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। প্রিয় পাঠক আমি অধম চেষ্টা করব ঈদুল ফিতরের বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করার এবং একজন রোজাদার ব্যক্তির রোজা, ইবাদত-বন্দেগিগুলো পরিশুদ্ধভাবে আল্লাহতায়ালার দরবারে কবুল হওয়ার জন্য সঠিকভাবে তুলে ধরতে- ইনশাআল্লাহ।
ঈদুল ফিতর: ঈদুল ফিতর শব্দটি ‘আওদ’ শব্দমূল থেকে উদ্ভূত। এর আভিধানিক অর্থ হলো ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা, বারবার আসা। আর ফিতর শব্দের অর্থ হলো ফাটল, ভেঙে ফেলা, বিদীর্ণ করা। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়ালের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে রোজা ভেঙে ফেলা হয় বলে এ দিনটিকে ঈদুল ফিতর বলা হয়।
ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য ও করণীয়:
মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন: ‘আর যেন তোমরা নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করতে পার এবং তোমাদেরকে যে সুপথ দেখিয়েছেন, তার জন্য তোমরা আল্লাহর মমত্ব-বড়ত্ব প্রকাশ কর এবং তার কৃতজ্ঞ হও।’ (বাকারা-১৮৫)।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ঈদুল ফিতরের দিন যখন আসে তখন আল্লাহতায়ালা রোজাদারদের পক্ষে গর্ব করে ফেরেশতাদেরকে বলেন, হে আমার ফেরেশতাগণ তোমরাই বলো রোজাদারদের রোজার বিনিময়ে আজকের এই দিন কি প্রতিদান দেওয়া যেতে পারে? সেই সমস্ত রোজাদার, যারা তাদের দায়িত্ব পুরোপুরি আদায় করেছে, তখন ফেরেশতারা আল্লাহকে বলেন, হে দয়াময় আল্লাহ উপযুক্ত উত্তম প্রতিদান তাদের দান করুন । কারণ তারা দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা করেছেন, প্রাপ্য পারিশ্রমিক তাদেরকে দান করুন।
তখন আল্লাহতায়ালা রোজাদারদের বলতে থাকেন, ‘হে আমার বান্দা তোমরা যারা যথাযথভাবে রোজা পালন করেছ, তারাবিহর নামাজ পড়েছ, তোমরা তাড়াতাড়ি ঈদগাহ মাঠে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য যাও এবং তোমরা তোমাদের প্রতিদান গ্রহণ করো । ঈদের নামাজের শেষে আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, হে আমার প্রিয় বান্দারা আমি আজকের এ দিনে তোমাদের সব পাপ পুণ্যের দ্বারা পরিবর্তন করে দিলাম । অতএব তোমরা নিষ্পাপ হয়ে বাড়িতে ফিরে যাও’। (বায়হাকি ও মিশকাত)
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন: “আল্লাহ এই দুটি দিনের পরিবর্তে অন্য দুটি দিন তোমাদের উৎসব করার জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার একটি হল ‘ঈদুল ফিতর’, অন্যটি ‘ঈদুল আজহা’। তোমরা পবিত্রতার সঙ্গে এ দুটি উৎসব পালন করবে।’’ (আবু দাউদ ও নাসায়ি)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: এদিনটিতে তোমরা রোজা রেখো না। এ দিন তোমাদের জন্য আনন্দ-উৎসবের দিন। খাওয়া, পান করা আর পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে আনন্দ-উৎসব করার দিন। আল্লাহকে স্মরণ করার দিন (মুসনাদ আহমাদ, ইবনু হিববান)।
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ঈদের আনন্দ শুধু তাদের জন্য যারা রমজানের রোজা তারাবিহর নামাজসহ আল্লাহতায়ালার যাবতীয় বিধিবিধান গুরুত্ব সহকারে আদায় করেছে । আর যারা রমজানের রোজা ও তারাবিহ আদায় করেনি তাদের জন্য ঈদের আনন্দ নেই, বরং তাদের জন্য ঈদ তথা আনন্দ অগ্নিশিখা সমতুল্য।’ (বুখারি)।
ঈদের রাতের ফজিলত: হজরত আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে আল্লাহর নিকট সাওয়াব প্রাপ্তির নিয়তে ইবাদত করবে তার হৃদয় সে দিনও জীবিত থাকবে, যেদিন সব হৃদয়ের মৃত্যু ঘটবে। (ইবন মাজাহ, হাদিস নম্বর ১৭৮২, আল মুজামুল আওসাত, হাদিস নম্বর-১৫৯)।
মহানবী সা. আরও ইরশাদ করেন ‘যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে পুণ্যের প্রত্যাশায় ইবাদত-বন্দেগি করে কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার, অর্থাৎ কিয়ামতের দিন অন্যান্য লোকদের অন্তর মরে যাবে, কিন্তু কেবল সেই ব্যক্তির অন্তর জীবিত থাকবে, সে দিনও মরবে না’। (আততারগিব)।
রাসুল সা. ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি পুণ্যময় ৫টি রাতে ইবাদত-বন্দেগি করে সেই ব্যক্তির জন্য সু-সংবাদ রয়েছে, আর সেই সুসংবাদটি হচ্ছে ‘জান্নাত’ এবং পুণ্যময় ৫টি রাত হলো ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, শবেবরাত, জিলহজের রাত, আরাফাতের রাত । (বায়হাকি) ।
ঈদের নামাজের সময়সীমা: সূর্য আনুমানিক তিন গজ পরিমাণ ওপরে ওঠার পর অর্থাৎ সূর্যোদয়ের ২৩/২৪ মিনিট পর থেকে দ্বি-প্রহরের পূর্ব পর্যন্ত ঈদের নামাজের ওয়াক্ত। সূর্য তিন গজ পরিমাণ ওপরে ওঠা পর্যন্ত সময়টুকুকে তার উদয়কাল বলে গণ্য করা হয়। এ সময়ে কোনো নামাজ পড়া জায়েজ নেই। ঈদুল ফিতরের নামাজ অপেক্ষাকৃত বিলম্বে এবং ঈদুল আজহার নামাজ আগে আদায় করা উত্তম।
বৃষ্টির কারণে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়া জায়েজ কি না। হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার ঈদের দিনে বৃষ্টি হলো, তখন রাসুল (স.) তাদেরকে নিয়ে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়লেন। (আবু দাউদ-১১৬২)। এতে বোঝা যায়, বৃষ্টি বা অন্য কোনো যুক্তিসংগত কারণ থাকলে ঈদের নামাজ মসজিদে পড়া জায়েজ।
নামাজের জন্য ঈদগাহের দিকে রওয়ানা হওয়ার আগে ৩টি, ৫টি এরকম বেজোড় সংখ্যক খেজুর খাওয়া সুন্নত। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, প্রিয়নবী (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন সকালে বেজোড়সংখ্যক খেজুর খেতেন। (আদ-দুরূসুর রামাদানিয়াহ, পৃ. ১৮৫।)
আসুন এক নজরে জেনে নেই ঈদের সুন্নতগুলো:
১। অন্য দিনের তুলনায় আগে আগে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া।
২। গোসল করা।
৩। শরিয়তসম্মত সাজসজ্জা গ্রহণ করা।
৪। সুগন্ধি ব্যবহার করা।
৫। ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে মিষ্টি জাতীয় আহার (যেমন খেজুর) গ্রহণ করা।
৬। সকাল সকাল ঈদগাহে যাওয়া।
৭। ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার আগে সাদকাতুল ফিতরা আদায় করা।
৮। সম্ভব হলে এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে যাওয়া এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ঈদগাহ থেকে ফিরে আসা।
৯। পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া।
১০। ঈদগাহে যাওয়ার সময় নিম্নোক্ত তাকবির পাঠ করা:
(আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।)
ঈদের দিনে শুভেচ্ছা বিনিময়: হাফেজ ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, ‘যুবাইর ইবনে নফির থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত, রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময় সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন, (তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম) অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। (ফাতহুল বারী শরহু সহীহিল বুখারি ৬/২৩৯, আসসুনানুল কুবরা লিলবাইহাকী, হাদীস-৬৫২১)।
সাদকায়ে ফিতর আদায়: রমজান মাসের রোজার ভুলত্রুটি দূর করার জন্য ঈদের দিন অভাবী বা দুস্থদের কাছে অর্থ প্রদান করা হয়, যেটিকে ফিতরা বলা হয়ে থাকে। এটি প্রদান করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী- ‘তুহরাতুল্লিস সায়িম’ অর্থাৎ এক মাস সিয়াম সাধনায় মুমিনের অনাকাঙ্ক্ষিত ত্রুটি-বিচ্যুতির কাফফারা হলো সাদকায়ে ফিতর।
ঈদের নামাজের পূর্বেই ফিতরা আদায় করার বিধান রয়েছে। তবে ভুলক্রমে নামাজ আদায় হয়ে গেলেও ফিতরা আদায় করার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে। সাদাকাতুল ফিতরবিষয়ক হাদিসগুলোতে পাঁচ ধরনের খাদ্যদ্রব্যের উল্লেখ রয়েছে : গম, যব, খেজুর, কিশমিশ, পনির। সাদকায়ে ফিতরের গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে পরিশুদ্ধ হয় ৷’ (সুরা আলা : আয়াত ১৪)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, গোলাম, স্বাধীন, পুরুষ, নারী, ছোট, বড় সব মুসলিমের ওপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ‘সা’ খেজুর, অথবা অর্ধ ‘সা’ গম জাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন এবং (ঈদের) নামাজের আগে তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন’ (বুখারি ও মুসলিম)। এবার রাষ্ট্রের পক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশন মাথাপিছু ফিতরা ধার্য করেছে সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২ হাজার ৯৭০ টাকা।
ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও শিক্ষা অপরিসীম। প্রত্যেক মুসলমানের জীবনে ধর্মীয় করণীয়গুলো পালনের মাধ্যমে নিজেকে একজন প্রকৃত মুমিন মুসলমান হিসেবে তৈরি করা জরুরি। পরিশেষে কামনা প্রত্যেক রোজাদার ব্যক্তির রোজা, সাহরি, ইফতার, তারাবি, ইবাদত- বন্দেগি, দান-সাদকা মহান আল্লাহতায়ালা কবুল করুন। আমিন। সবাইকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা ও ঈদ মোবারক।
প্রবন্ধ
লুমিয়ের পরিবার: সিনেমা উদ্ভাবনের কারিগর
মনিস রফিক
ফ্রান্সের লিয়ঁ শহরের চিত্রকর আঁতোয়া লুমিয়ের চিত্রকর্মে আর্থিক সুবিধা করতে পারছিলেন না। ফলে হুট করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন ছবি আঁকা ছেড়ে দেবেন। কারণ উপার্জন করাটা খুব বেশি জরুরি হয়ে পড়েছিল। ফলে হৃদয়ের গহীনে লালিত হওয়া আর্টের পথ ছেড়ে দিয়ে ফটোগ্রাফিক মালমশলা তৈরি এবং এর সরবরাহ দেয়ার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান খুলে বসলেন তিনি।
রং তুলির শিল্পী মনের অজান্তে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বিস্ময়কর শিল্প মাধ্যম-যাকে সপ্ত আর্টের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এবং যাকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’নামে সম্মানিত করা হয়েছে–সেই চলচ্চিত্র আবিষ্কারের পথটা সহজ ও সরল করে দিলেন এভাবেই। আজকের যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী এই শিল্প-মাধ্যমের আবিষ্কারের সঙ্গে ফ্রান্সের আঁতোয়া লুমিয়ের (১৮৪০-১৯১১) নাম কখনো উচ্চারিত হয় না বরং উচ্চারিত হয় তাঁর দুই সন্তান অগুস্ত লুমিয়ের (১৮৬২-১৯৫৪) এবং লুই লুমিয়েরের (১৮৬৪-১৯৪৮) নাম। কিন্তু আঁতোয়া’র মত পিতা না পেলে অগুস্ত এবং লুই-য়ের সিনেমাটোগ্রাফের আবিষ্কার হয়তো অনিশ্চিত হয়ে পড়ত আর স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর মানুষ চলচ্চিত্র শিল্পের স্বাদ আরো বিলম্বে পেতেন।
বিশ্বে সিনেমার প্রথম পোস্টার
আঁতোয়া লুমিয়ের রং তুলি ছেড়েছিলেন এটা সত্যি, কিন্তু মনের মধ্যে প্রকৃতির যে সৌন্দর্য তাকে আলোড়িত করত, সেই সৌন্দর্যের স্থায়িত্ব দেওয়ার জন্য তিনি ক্যামেরা হাতে নিয়েছিলেন এবং দীর্ঘ সাধনায় নিজেকে একজন খ্যাতনামা ফটোগ্রাফারের স্তরে উন্নীত করেছিলেন। আর অবিরাম পরিশ্রমে নিজের ফটোগ্রাফিক মালমশলা তৈরির প্রতিষ্ঠানটির আকার ব্যাপকতর করতে লাগলেন। ফলে সেই সময়ের প্রতিষ্ঠানটি হয়ে উঠে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফটোগ্রাফিক কারখানা। সবচেয়ে বড় কারখানা আমেরিকার নিউইয়র্কের জর্জ ইস্টম্যানের ইস্টম্যান কোডাক কোম্পানির পরেই ছিল এর স্থান। আঁতোয়া লুমিয়েরের দুই সন্তান অগুস্ত এবং লুই দু’জনেই পিতার সঙ্গে মগ্ন হয়ে কাজ করতে শুরু করলেন নতুন সৃষ্টির উদ্দীপনায়। বড় জন মূলত ম্যানেজারের ভূমিকা পালন করতে লাগলেন আর ছোট জন পদার্থ বিদ্যায় আবেশিত লুই নতুন আবিষ্কারের চিন্তায় নিমগ্ন হলেন। তবে দু’জনেই ছিলেন একে অপরের পরিপূরক।
চলচ্চিত্র আবিষ্কারের মাহেন্দ্রক্ষণটি ছিল ১৮৯৪ সালের গ্রীষ্মকালে। ইতোমধ্যে টমাস আলভা এডিসন (১৮৪৭-১৯৩১) ও ডব্লিউ কে এল ডিক্সন (১৮৬০-১৯৩৫) ১৮৮৮ সালে কিনোটোস্কোপ আবিস্কার করেছেন। পঞ্চাশ ফুট দৈর্ঘ্যরে চলমান ছবি এই যন্ত্রের মাধ্যমে দেখা যেত। বিশাল আকৃতির এই যন্ত্রটিতে কেবলমাত্র একজন এর ছবি দেখতে পেতেন। ১৮৯৪ সালের গ্রীষ্মে টমাস আলভা এডিসন প্যারিসে কিনোটোস্কোপ-এর প্রদশর্নীতে আঁতোয়া লুমিয়েরকে আমন্ত্রণ জানালেন। প্রথমবারের মতো তিনি কিনোটোস্কোপ প্রত্যক্ষ করে নিজ শহর লিয়ঁতে ফিরে এসে দুই সন্তানকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে শুধু বলেছিলেন, ‘তোমরা এর থেকে ভালো কিছু করার চেষ্টা করো। আমি তোমাদের সঙ্গে আছি।’
লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়
পিতার অনুপ্রেরণা গভীর উদ্দীপনার জন্ম দিল অগুস্ত ও লুই লুমিয়ের’র মনে। বিশেষ করে লুই লুমিয়ের যিনি পদার্থবিদ্যা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে ভালোবাসতেন। চলমান আলোকচিত্র গ্রহণের উপযোগী ক্যামেরা আবিষ্কারের নেশায় দীর্ঘ গবেষণা ও পরিশ্রমের পর তিনি এক ধরনের ক্যামেরা ও প্রোজেকটর যন্ত্রের আবিষ্কারে সফল হন। প্রখ্যাত সমালোচক ও চলচ্চিত্রের ঐতিহাসিক জর্জ সাঁদুল বলেছেন, লুই লুমিয়ের ডিটেলের প্রতি এত গভীর মনোযোগ দিয়েছিলেন বলেই প্রকৃত অর্থেই তাঁকে সত্যিকারের চলচ্চিত্রের প্রথম স্রষ্টা বলা যায়। অগুস্ত লুমিয়েরও ছোট ভাইয়ের কৃতিত্ব বিনয়ের সঙ্গে স্বীকার করে উল্লেখ করেছেন, তাঁর ভাই একরাতের মধ্যে চলচ্চিত্র আবিষ্কার করেন। আর সেই রাতে সৃষ্টির বেদনায় লুই মাথার যন্ত্রণা এবং নানারকম দুঃস্বপ্ন দেখে খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন।
তবে এটা স্বীকার্য যে, চলচ্চিত্রের মত একটা জটিল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হঠাৎ করে কারো মাথায় একরাতে আসেনি। বরং মানুষের চলমান দৃশ্যের স্থায়ি প্রতিফলনে হাজার বছরের যে স্বপ্ন ও আগ্রহ ছিল, তার ধারাবাহিকতার একটা চূড়ান্ত মুহূর্ত হতে পারে লুই লুমিয়েরের সেই অস্থির রাত।
সিনেমা’ শব্দটির উৎপত্তিগত বিষয়টি লক্ষ্ করলে আমাদের ফিরে যেতে হয় অনেক পেছনে। গ্রীক ‘কিনেমা’শব্দটি থেকে ‘সিনেমা’শব্দটি এসেছে; যার অর্থ গতি। আমরা যদি স্পেনের প্রাচীন গুহা আলতামিরায় ফিরে যাই তাহলে দেখি, একটি বাইসন দৌড়াচ্ছে; যার পায়ের সংখ্যা ছয়টি। দৌড়ানোর সময় নিশ্চয় আমাদের মনে হয় কোনো প্রাণীর পায়ের সংখ্যা বেড়ে গেছে। দশ হাজার বছরের প্রাচীন সেই গুহাশিল্পী হয়ত বাইসনের সেই গতির রূপটাই ধরতে চেয়েছিলেন।
যুগে যুগে আমরা গুহাচিত্র, ধোঁয়া-সংকেত ((Smoke-signal)), চীনা ছায়া নাটক (Shadow-play) বা মধ্যযুগের ম্যাজিক-লন্ঠনের (Magic-lantern) মাঝে দেখি মানুষ কীভাবে ঘটমান গতিকে রূপ দিতে চেয়েছে। কাচ ঘষে ছোট জিনিস বড় করে দেখা, অর্থাৎ ‘লেন্স’ আবিষ্কার, মানবসভ্যতার পুরনো এক আবিষ্কার। তবে ১৬৪০ সালে এথেনসিয়াস কারচার তাঁর ম্যাজিক-লণ্ঠনে যীশু খ্রীষ্টের জীবনের ঘটনাসমূহকে যখন একটা চলমান রূপ দেয়ার চেষ্টা নিয়েছিলেন, সেটাকে ঘটমান গতিকে ধরার একটা উল্লেখযোগ্য প্রয়াস বলতে হবে। আর এই ঘটমান গতিকে ধরাই হচ্ছে চলচ্চিত্র শিল্পের মূলকথা।
আর চলচ্চিত্র বিজ্ঞানের মূলসূত্র, ‘অবিরত দৃষ্টিতত্ত্ব’ (Persistence of vision), প্রাচীনকাল থেকেই বিজ্ঞানীদের এই বিষয়টি ভাবিয়েছে। সহজভাবে বললে ‘অবিরত দৃষ্টিতত্ত্ব’ হচ্ছে–আমরা যখন একটা জিনিস দেখি এবং তা থেকে চোখ ফিরিয়ে অন্য আরেকটা জিনিস দেখি; এ দুয়ের মাঝে আমাদের চোখে খুব সামান্য সময়ের জন্য হলেও (সেকেন্ডের ভগ্নাংশ) আগের দেখা চিত্রটার রেশ লেগে থাকে। চলচ্চিত্রে পর পর সাজানো একটা শট থেকে আরেকটা শর্টে দর্শককে টেনে নিয়ে যাওয়ার দৃষ্টি বিজ্ঞানগত ভিত্তিটা হচ্ছে এই ‘অবিরত দৃষ্টিতত্ত্ব।’ যুগে যুগে বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে মানুষের জ্ঞান বাড়াতে সাহায্য করেছেন। অ্যারিস্টটল ও আর্কিমিডিসের আলোকবিদ্যা, ইউক্লিডের আলোর গতির তত্ত্ব পেরিয়ে লিওনার্দো ডা ভিঞ্চির ‘ক্যামেরা অবসকিউরা-কে গ্রহণ করে, পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীদের লেন্সের নানা গবেষণা এবং নিসেফোর নিপসের ফটোগ্রাফিক ইমেজকে ধারণ করে আজকের ফিল্ম ও চলচ্চিত্রের বিকাশের পথ সহজতর হয়। ফলে আজকের চলচ্চিত্রের আবিষ্কারের পথ হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের চিন্তা ও সাধনার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য ঘটনা জড়িত রয়েছে। তারপরও যেসব সৃষ্টিশীল প্রাণ প্রত্যক্ষভাবে একে বর্তমান রূপ দিয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বলতে হয়, লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের ক্যামেরা, ইস্টম্যানের সংবেদনশীল ফিল্ম ও ম্যারের আবিষ্কৃত প্রজেক্টরের সংমিশ্রণেই আজকের চলচ্চিত্রের জন্ম। এর আগে প্রতিভাবান ক্যামেরাম্যান এতিয়েন মারে ফটোগান নামে রিপিট শট রাইফেলের মতো এক ধরনের ক্যামেরা আবিষ্কার করেছিলেন যা দিয়ে পর পর গুলি ছোঁড়ার ভঙ্গিমায় এক সঙ্গে পর পর অনেকগুলো ফ্রেম শুট করা সম্ভব ছিল। সে ক্যামেরা এখন আর ব্যবহার হয় না। কিন্তু চলচ্চিত্রের ‘শ্যুটিং’শব্দটার উৎপত্তি ওখান থেকেই।
লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় তাদের প্রথম চলচ্চিত্রটি শুট করেছিলেন ১৮৯৫ সালের ১৯ মার্চ। ১৫ মার্চ –এর মধ্যে তারা তাদের প্রথম চলচ্চিত্রটির সব কাজ শেষ করেন। ছবিটির নাম ওয়ার্কাস লিভিং দ্য লুমিয়োর ফ্যাক্টরি।’ওই ছয়দিনের যেহেতু ১৯ তারিখ ছাড়া প্রতিদিন বৃষ্টি হয়েছিল সে জন্য ধারণা করা হয় সেই দিনই পৃথিবীর ইতিহাসে লুমিয়েরদের দ্বারা প্রথম ছবির শুটিং হয়েছিল। মাত্র ৪৬ সেকেন্ডের ছবিটিতে দেখা যায় লুমিয়েরদের কারখানা থেকে শ্রমিকরা বের হচ্ছেন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন নারী শ্রমিক। তারা যখন কারখানা থেকে বের হচ্ছিলেন তখন কেউ-ই ক্যামেরার দিকে তাকাননি।
ফলে ধারণা করা হয় তারা শুটিং এর বিষয়টা জানতেন। শ্রমিক ছাড়াও ছবিটিতে দেখা যায় একটি কুকুর, একটি বাইসাইকেল এবং দু’টো ঘোড়া। ফলে স্বভাবতই বলা যায়, চলচ্চিত্রের প্রথম চরিত্র হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণী, কুকুর এবং ঘোড়া। পরবর্তীতে লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় একক শটের মোট ১,৪২৫টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন; যার কোনোটিরই দৈর্ঘ্য এক মিনিটের উর্ধ্বে নয়। তাদের ছবিগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, এ ট্রেন রিচেস দ্য স্টেশন, এ কোট লিভস্ দ্য হারভার, বেবি এ্যাট ব্রেকফাস্ট টেবিল, ওয়াটারিং দ্য গার্ডেন, হর্স ট্রিকস্, রাইডার্স, ফিশিং ফর গোল্ড ফিশ, ব্ল্যাকসিম্থ, জাম্পিং অন দ্য ব্ল্যাংকেট।
১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্যারিসের গ্রান্ড ক্যাফেতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম বারের মত অগুস্ত লুমিয়ের এবং লুই লুমিয়ের কুড়ি মিনিটের অনুষ্ঠানে তাদের নির্মিত দশটি চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী করেন। এরপর তারা প্যারিসের একটি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। প্রথম কয়েকদিন দর্শকদের বিশেষ কোনো ভিড় হয়নি, তারপর ধীরে ধীরে এটা এমনই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকল যে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল দুনিয়াজুড়ে।
লুমিয়েররা যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও পাকা ব্যবসায়ীর মতো আগের বছরেই বেশ কয়েকটি ক্যামেরা ও প্রজেক্টর তৈরি করে রেখেছিলেন। তাদের বিশ্বাসী কিছু লোককে ক্যামেরাম্যান ও প্রজেক্টর অপারেটরের কাজও শিখিয়ে রেখেছিলেন। এসব ট্রেনিংপ্রাপ্ত লোকদের লুমিয়েররা তাদের আবিষ্কৃত চলচ্চিত্র পাঠাতে লাগলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।
ভারতবর্ষে লুমিয়েরদের প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হলো বোম্বাই শহরে ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই। যে কয়েকটি স্বল্প দৈর্ঘ্যরে ছবি তখন দেখানো হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে–এ্যারাইভাল অফ এ ট্রেন, সী বেদার্স, লন্ডন গার্ল ড্যান্সার্স, ওয়াটারিং দ্য গার্ডেন। কলকাতায় ছবিগুলো দেখানো হয় পরের বছর অর্থাৎ ১৮৯৭ সালে। ১৮৯৮ সালের ১৭ এপ্রিল বেডফোর্ড সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি ঢাকার ক্রাউন থিয়েটারে প্রথম চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী করে।
লুমিয়েররা আর্ক-লাইট প্রজেক্টরে তাঁদের ছবি দেখাতেন। প্রতি সেকেন্ডে ১৬ ফ্রেম করে ছবি পর্দায় পড়ত। বর্তমানে প্রতি সেকেন্ডে ২৪ ফ্রেম করে পড়ে থাকে। ফলে তাদের ছবিগুলো দেখলে মনে হয় চরিত্ররা ছুটোছুটি করছে অর্থাৎ ফাস্ট মোশন হচ্ছে।
অগুস্ত লুমিয়ের এবং লুই লুমিয়ের-এর অদ্ভুত আবিষ্কার যখন পৃথিবীর মানুষের মাছঝ বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে এবং তাদের প্রচুর বিত্ত-বৈভবের মালিক বানিয়েছে, তখন বাবা আঁতোয়া লুমিয়ের নীরবে সন্তানদের সাফল্য দেখেছেন আর সুখ অনুভব করেছেন। তিনি খুব গর্ব অনুভব করতেন যে, তাঁর দুই সন্তান তাঁর কথা রেখে তাঁকে পৃথিবীর মানুষের কাছে সম্মানিত করেছে।
তরুণ বয়সে যে আঁতোয়া লুমিয়েরের গভীর উদ্দীপনা ছিল রং তুলি নিয়ে ছবি আঁকায়, তিনি জীবনের মাঝখানে নিজেকে ছবি আঁকা থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন মূলত আর্থিক কারণে। তবে সন্তানদের সাফল্য এবং চলচ্চিত্র নিয়ে তাঁর স্বপ্ন পূরণ তাকে আবার পুরোদস্তুর চিত্রশিল্পী বানিয়েছিল। ১৯১১ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি প্রায় সব সময়ই ছবি আঁকায় নিমগ্ন থাকতেন।
আমেরিকা বারবার কানাডাকে দখল করার চেষ্টা করেছে
আতোয়ার রহমান
শুধু ২০২৪ বা ২০২৫ সালেই নয়, শুধু ট্রাম্পই নায়, এর আগেও অনেকবার আমেরিকার তরফ থেকে কানাডার সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি এসেছে। উত্তর আমেরিকার সর্বউত্তরে অবস্থিত দামী খনিজ সম্পদে পূর্ণ এই বিশাল জমি দখলের ধারণার ঐতিহাসিক নজির রয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘন ঘন তার উত্তর প্রতিবেশীর সাথে একীভূত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু বারবারই কানাডীয় দেশপ্রেমিক জনগনের প্রবল প্রতিরোধের মুখে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হওয়ার আগেই, সংবিধানের পূর্বসূরির অনুচ্ছেদ ১১, কনফেডারেশনের প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে: "কানাডা … এই ইউনিয়নের সমস্ত সুবিধার মধ্যে প্রবেশ করবে এবং অধিকার পাবে।"
আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা পিতারা যখন ১৭৮৭ সালে মার্কিন সংবিধানে স্বাক্ষর করেন, তখন কানাডা কেবল কুইবেক, নোভা স্কশিয়া এবং নিউফাউন্ডল্যান্ড নিয়ে গঠিত। জনসংখ্যার বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল ক্যাথলিক এবং ফরাসি ভাষাভাষী। সুতরাং, পিউরিটান নিউ ইংল্যান্ডবাসীদের দ্বারা চালিত একটি নতুন জাতিতে আত্মীভূত হওয়ার ধারণাটি আকর্ষণীয় ছিল না।
কানাডিয়ানদের জন্য লন্ডন থেকে তত্ত্বাবধান করা যথেষ্ট খারাপ ছিল, কিন্তু অন্তত ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৭৭৪ সালের কুইবেক আইনের মাধ্যমে তাদের অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছিল। এই সহনশীল পদক্ষেপটি ক্যাথলিক ধর্মের অবাধ অনুশীলনের অনুমতি দেয়, ফরাসি ভাষার ব্যবহারকে সুরক্ষিত করে এবং এমনকি ফরাসি নাগরিক আইন পুনরুদ্ধার করে।
উপরন্তু, সেই সময়ে কানাডার পশম, কাঠ এবং মাছের ব্যবসা প্রায় পুরোটাই ব্রিটেনের সাথে ছিল, যা ব্রিটিশ জাহাজের আধিপত্য নিশ্চিত করতে শুল্ক এবং আইনের মিশ্রণ ব্যবহার করেছিল।
কানাডিয়ান ব্যবসায়ীরাও ব্রিটেনের ক্যারিবিয়ান উপনিবেশগুলির সুবিধা নিতে পারে যেগুলি একটি বৃত্তাকার বাণিজ্যে তুলা, রাম এবং চিনি আমদানি করে। মার্কিন বিপ্লবের প্রাদুর্ভাবের মাধ্যমে, কানাডাকে ব্রিটেনের বাণিজ্য কক্ষপথে সত্যিকার অর্থে ভালোভাবে সেলাই করা হয়েছিল, তাই কানাডিয়ানরা আমেরিকান বিপ্লবীদের সাইরেন গানকে প্রতিরোধ করেছিল।
কিন্তু এটি আমেরিকান দেশপ্রেমিকদের কানাডায় তাদের স্বার্থের জন্য সমর্থন সমাবেশের প্রচেষ্টা থেকে বিরত করেনি। ১৭৭৫ সালের মে মাসে নিউ ইয়র্কের উপরের ফোর্ট টিকোন্ডেরোগা দখলের ফলে আমেরিকার কুইবেক আক্রমণ শুরু হয়। যাহোক, দুর্বল নেতৃত্ব, অপর্যাপ্ত সংখ্যা এবং খারাপ পরিকল্পনার কারণে ১৭৭৫ সালের ডিসেম্বরে সে আক্রমণের পরাজয় ঘটে।
১৭৭৬ সালের জুলাই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করার সময় পরের বছর আরেকটি আক্রমণ প্রতিরোধ করা হয়েছিল। ১৮১২ সালে ব্রিটেনের সাথে তাদের পরবর্তী যুদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমেরিকানরা তাদের উত্তর প্রতিবেশী দেশটি আক্রমণের চেষ্টা করেনি।
১৮১২ সালের কানাডা আক্রমণ ছিল আরও গুরুতর ব্যাপার। ব্রিটেনের সাথে তাদের সামুদ্রিক বিরোধে দর কষাকষির চিপ হিসাবে এটি ব্যবহার করার জন্য কানাডাকে দখল করার আশায়, মার্কিন বাহিনী কানাডার বিরুদ্ধে ত্রিমুখী আক্রমণ শুরু করে।
তবে এটি ব্রিটিশ এবং তাদের কানাডিয়ান এবং নেটিভ আমেরিকান মিত্রদের কাছ থেকে কঠোর প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছিল। আক্রমণকারী মার্কিন বাহিনী ব্যাপকভাবে পরাজিত হয়। তারা ইরি লেকের পশ্চিম প্রান্তে ডেট্রয়েটে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু তাই বলে এটি আমেরিকানদের দ্বারা শেষ আক্রমণ হয়নি।
মার্কিন গৃহযুদ্ধের সময় (১৮৬১-১৮৬৫) কনফেডারেসির জন্য ব্রিটিশ সমর্থনের কারণে কানাডাকে জোরপূর্বক আমেরিকার সাথে সংযুক্ত করার কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু এটি কেবল আলোচনাতেই থেকে যায়। সেই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরের বছর, ১৮৬৬ সালের জুন মাসে, ১৫০০ আইরিশ-আমেরিকানদের একটি দল নায়াগ্রা নদী অতিক্রম করে কানাডায় প্রবেশ করে।
১৮৩৭-১৮৩৮ সালের তথাকথিত দেশপ্রেমিক যুদ্ধে যখন আইরিশ-আমেরিকানদের ছোট ব্যান্ডগুলি আপার কানাডার প্রদেশে (আজকের অন্টারিওর দক্ষিণ অর্ধেক) একটি ডজন বা তার বেশি অভিযান শুরু করেছিল তখন এই আক্রমণের একটি অগ্রদূত ছিল। যাইহোক, ১৮৬৬ সালের অভিযানটি তর্কযোগ্যভাবে ১৮১২ সালের আক্রমণের মতো ছিল, যে অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল কানাডাকে দখলে নিয়ে যাওয়া এবং আইরিশ হোম শাসনের জন্য দর কষাকষির চিপ হিসাবে ব্যবহার করা।
শুরুতে অভিযান ভালোই চলে। আমেরিকানরা কানাডিয়ান মিলিশিয়াদের একটি ছোট বাহিনীকে পরাজিত করেছিল, কিন্তু ব্রিটিশরা অনেক বড় বাহিনীকে একত্রিত করলে তারা সীমান্তের উপর দিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। অবশ্য, কয়েকদিন পরে, আইরিশরা মন্ট্রিয়লের দক্ষিণে আরেকটি ব্যর্থ অভিযান চালায়।
১৮৭০ সালের মে মাসে তারা আরও দুটি আক্রমণের চেষ্টা করে এবং ১৮৭১ সালের অক্টোবরে ম্যানিটোবায় একটি চূড়ান্ত অভিযান চালায়। সকলেই কানাডিয়ান বাহিনীর সাথে মিলিত হয়েছিল এবং তা কখনও গুরুতর হুমকির প্রতিনিধিত্ব করেনি।
যদিও কানাডা কখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আরেকটি আগ্রাসনের সামনে পড়বে না, এটিকে আন্তঃযুদ্ধের বছরগুলিতে মার্কিন কৌশলগত পরিকল্পনায় একটি সম্ভাবনা হিসাবে দেখা হয়েছিল। ১৯২৭ সালে মার্কিন যুদ্ধ বিভাগ ব্রিটেনের সাথে একটি কাল্পনিক সংঘর্ষের মডেল তৈরি করেছিল।
যুদ্ধ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে কানাডা আক্রমণ করা এবং বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করে নোভা স্কশিয়াকে ধ্বংস করা, সেইসাথে হ্যালিফ্যাক্সে বৃটেনের সাবমেরিন তারগুলি কাটা। সৌভাগ্যবশত, সেই যুদ্ধ কখনই ঘটেনি, এবং আক্রমণের পরিকল্পনা স্থগিত করা হয়েছিল।
ওয়াশিংটনে ১৮৭১ এর অ্যাংলো-আমেরিকান চুক্তিতে কানাডার আধিপত্যের মার্কিন স্বীকৃতির পর থেকে ২০২৪ সালে ট্রাম্পের আগ্রহ পুনর্নবীকরণ না হওয়া পর্যন্ত সংযুক্তির বিষয়ে সত্যিই কোনও গুরুতর আলোচনা হয়নি। তবে কিছু আঞ্চলিক কানাডিয়ান গোষ্ঠী রয়েছে যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যোগদানের পক্ষে কথা বলেছে।
১৮৪০-এর দশকে, আপার কানাডার রিপাবলিকান রক্ষণশীলরা গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব উন্নত করার উপায় হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যোগদান করতে চেয়েছিল। ১৮৫০-এর দশকে কুইবেকে আমেরিকান অভিবাসীরা ফরাসি-কানাডিয়ান আধিপত্য থেকে দূরে থাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সংযুক্তিকরণের পক্ষে ছিল। ১৮৭১ সালে কানাডিয়ান প্রদেশ হওয়ার আগে কিছু ব্রিটিশ কলম্বিয়ান আমেরিকান হওয়ার জন্য পিটিশনে স্বাক্ষর করেছিল।
বিশ শতকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আন্দোলন ছিল ১৯৫০-এর দশকে নিউফাউন্ডল্যান্ডের ‘অর্থনৈতিক ইউনিয়ন পার্টি’ এবং ১৯৮০-এর দশকে সাস্কাচুয়ানে স্বল্পকালীন ‘ইউনিয়নিস্ট পার্টি’। এই দুটি ছোট দলই অর্থনৈতিক কারণে কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অংশের সাথে একীভূত হওয়ার মধ্যে এক ধরণের ইউনিয়নের সুবিধা দেখেছিল।
অতি সম্প্রতি, ১৯৮০-এর দশকে শুরু করে, একটি ছোট রাজনৈতিক দল, ‘পার্টি ৫১’, কুইবেককে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হওয়ার পক্ষে সমর্থন করেছিল, কিন্তু বছরের পর বছর ধরে এর পক্ষে সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়েছিল। এর পাঁচজন প্রার্থী ২০২২ সালে কুইবেকে মাত্র ৬৮৯ ভোট পেয়েছিলেন। দলটি এখন ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
১৬ জানুয়ারি, ২০২৫ এর একটি ইপসোস পোল দেখা গেছে যে প্রায় ৮০% কানাডিয়ান জরিপ করেছে "কানাডাকে কখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হওয়ার জন্য ভোট দেবে না"।
বর্তমানে কানাডার প্রধান দলগুলির সব নেতারা পরিস্কার ও কঠোরভাবে ট্রাম্পকে বলেছেন, কানাডা কখনই বা কোন ভাবেই আমেরিকার অংশ হবে না।
(‘দি কনভারসেশন’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত নিবন্ধ অবলম্বনে লেখা)
বিভূতিভূষণের ছোটগল্পে জীবনবোধ
বীরেন মুখার্জী
‘লেখকমাত্রই মেধাবী’ কথাটি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে সাহিত্য বোদ্ধামহলে। তবে একজন লেখক যে প্রখর আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন হবেন তা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। একজন বড় সাহিত্যিকের ‘টোটাল’ পরিচয় নিহিত থাকে তার সাহিত্যকর্মের ব্যাপ্তি ও বহুমুখীনতায়। বহুবিধ সংযোগ ও লিখন প্রতিভার গুণে একজন সৎ সাহিত্যিক নিজের জন্য পাঠক-বোদ্ধামহলে স্থায়ী আসন করে নিতে সম। এ ক্ষেত্রে লেখক তার চারিত অভিজ্ঞানের বিস্তৃতি ঘটান তার সৃষ্টিকর্মে। সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবেশ, প্রতিবেশ, অর্থনীতি থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়াবলী তাকে পরিমার্জিত শৈলীতে উপস্থাপন করতে হয় তার সাহিত্যে। যাপনের এমন কোনো বিষয়-আশয় নেই যা একজন সাহিত্যিক স্পর্শ করতে অম। যে কারণে সৎ সাহিত্যিকের হাতে রচিত সাহিত্যকর্ম যুগ যুগ ধরে পাঠক তার অন্তঃস্থলে ধরে রাখে। অনেক সময় দেখা যায়, আপাতসরল দৃষ্টিতে সমাজ সম্পর্কে উদাসীন সাহিত্যিকের রচনাতেও গভীরভাবে উঠে আসে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার অনুপুঙ্খ বাস্তবতা। এক্ষেত্রে সাহিত্যিক অনেকটা অজ্ঞাতসারেই তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সম হন। এরূপ রচনা পাঠে আলোচকরা প্রথমদিকে রচনাটির শিল্পমূল্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেও সেটির নিবিড় পাঠ ও পর্যালোচনায় আবিস্কৃত হয় অপরিমেয় শিল্পমূল্য এবং সমাজ মূল্য। এ ধরণের সাহিত্য পাঠে সাহিত্যিকের এক ধরণের নিরীক্ষাপ্রবণ মানসিকতার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটে। উন্মেষ ঘটে লেখকের শ্রেণীসচেতনতার। লিখনীতে মানব-সংসারের বিচিত্রতা তেমনভাবে ফুটে ওঠেনি এমন অভিঘাতে জর্জরিত হতে হয় ‘পথের পাঁচালী’র অমর রূপকার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাহলে প্রশ্ন জাগে- বিভূতিভূষণ কি শ্রেণীচেতন ছিলেন না? মানুষের জীবন-যাপনের প্রতিমুহূর্তের বিবর্তিত অবস্থা, সংঘাত জানতেন না তিনি? প্রকৃতার্থে বিভূতিভূষণ রচিত উপন্যাস কিংবা ছোটগল্পের চরিত্র স্থান, কাল, পাত্র সমন্বয়িত হতে দেখা যায় সুষম বিন্যাসে। উপন্যাসিক হিসাবে বিভূতিভূষণের খ্যাতি বেশি হলেও তার গল্পগুলোতে আবেগঘন পরিস্থিতির প্রাধান্য থাকায় সমকালীন অনেক সমালোচক তার ব্যাপারে ঔদাসীন্য দেখিয়েছেন। সমাজতন্ত্রবাদী লেখক ও সমালোচকরাও তাকে এড়িয়ে গেছেন। অথচ তার ‘মেঘ মল্লার’ (১৯৩১), ‘মৌরীফুল’ (১৯৩২), ‘জন্ম ও মৃত্যু’ (১৯৩৮), ‘নবাগত’ (১৯৪৪) গ্রন্থের গল্পগুলো শ্রেণীচেতন বিভায় সমুজ্বল। বিভূতিভূষণের রচনাতে একদিকে যেমন ফুটে ওঠে শ্রেণী-বৈষম্য তেমনি রয়েছে নর-নারীর শ্বাশত রোমান্টিকতা। রয়েছে প্রকৃতি অবলোকনের অপূর্ব দর্শন। ইউরোপ-আমেরিকার নবজীবন-চেতনার প্রবাহ এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে সামাজিক ও নৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের প্রবল হাওয়ায় তৎকালীন ভারতের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নাগরিক জীবনের আলোড়ন, আক্ষেপ, হতাশা নানামুখী বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার রচনাশৈলীতে স্পষ্টভাবেই মুদ্রিত।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণের ছোটগল্পে ইদ্রিয়বেদী অনুভূতিগুলি প্রযত্ন পরিচর্যায় বেড়ে উঠতে দেখা যায়। দৃশ্য, ঘ্রাণ, শ্র“তি, স্বাদ অনুভবভেদ্য প্রায় প্রতিটি উপযোগই তার লিখনীতে সঘন। এরপরও তৎকালীন প্রগতিবাদী সমালোচকরা তার প্রতি প্রসন্ন ছিলেন না। মূলত ‘প্রগতি লেখক সঙ্ঘ’ প্রকাশিত ‘প্রগতি’ পত্রিকায় বিভূতিভূষণের ‘সই’ গল্পটি প্রকাশিত হলে তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ওঠে। কারণ হিসাবে বলা হয়, প্রগতি ছিল ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন-আন্দোলনের প্রতিরোধী মঞ্চ। সেখানে বিভূতিভূষণের লেখায় কোনো ধরনের ফ্যাসিবাদ বিরোধী ভূমিকা দেখা যায়নি। ‘সই’ গল্পটি লেখা হয়েছিল গ্রামীণ শৈশবে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের দু’টি মেয়ের বন্ধুত্বকে উপজীব্য করে। কালপরিক্রমণে বড় হবার পর দুই বান্ধবীর মধ্যে মধ্যবিত্ত মেয়েটি পায় সচ্ছল সংসার এবং দরিদ্র মেয়েটির ভাগ্যে জোটে কপর্দকহীন-সঞ্চয়হীন জীবন। একদিন সেই দরিদ্র মেয়েটি তার শীর্ণকায় শিশু পুত্রটিকে নিয়ে সইয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসে। তার মনে আশা ছিল শৈশবের সই তার শিশু পুত্রটিকে দেখে হয়তো তাকে একটা মিষ্টি এনে দিবে কিংবা দুপুরে না খেয়ে ফিরতে দিবে না। কিন্তু তেমন কোনো ঘটনা ওই মেয়েটির ভাগ্যে ঘটে না। শিশুটির ভাগ্যে জোটে জলের সঙ্গে একটু গুড়; অথচ তার ছেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এলে মধ্যবিত্ত সইটি তার নিজের ছেলেকে ভাত খাইয়ে নিজে গিয়ে শুয়ে পড়ে। সামাজিক শ্রেণী বিন্যাসের ফলে শৈশবের স্বাভাবিক সম্পর্কটি এ গল্পে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। বিবর্তনের ধারায় সম্পর্কটি হয়ে উঠেছে অনুগ্রহদাত্রী আর অনুগ্রহ প্রার্থিনীর মধ্যেকার সম্পর্ক। গল্পটিতে মধ্যবিত্তের এই আচরণ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও উদাসীনতা যে হৃদয়হীনতার নিদর্শন হয়ে দাঁড়ায় সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়; যা আমরা ভুলে যাই। মানুষের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যেও যে শ্রেণীগত পার্থক্যের বোধ গভীরভাবে নিহিত থাকে সেটিই লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন আশ্চর্য সমতায়।
‘কয়লাভাটা’ গল্পটিতে গল্প-কথক ‘আমি’ চরিত্রটি অংশীদারীর ভিত্তিতে কয়লাভাটার ঠিকাদারী নিয়েছিল। কিন্তু কুলি-মজুরদের কম মজুরি দেয়া হয় এজন্য তিনি ঝুড়ি প্রতি রেট প্রায় দ্বিগুণ করে দেয়। দেখা যায় হাতে পয়সা বেশি পেয়ে মজুররা নেশা করে পড়ে থাকে। ফলে রেট আবার কমিয়ে পূর্বের মত করা হয়। রেট বাড়লে তার মুনাফা কমে যাবে এটা জেনেও তিনি সেটা করেন। জানা যায় এটা তার অপর অংশীদারের কারসাজি। সে-ই কুলিদের নেশা করার টাকা দিয়েছিল। পূর্বের রেটে ফিরে গিয়ে কুলিরা সেই ‘আমি’ চরিত্রটি ঠকে গেছে বলে কৌতুক অনুভব করে। এ গল্পটিতেও সাম্যবাদের ছোঁয়া পাননি প্রগতিবাদীরা। গল্পটি মামুলি হলেও শিল্পী বিভূতিভূষণ সর্বহারা শ্রেণীর চেতনার জাগরণে সক্রিয় ছিলেন বলে ধরা পড়ে। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন বঞ্চিত শ্রেণী অনেক সময় নিজেদের অধিকার আদায়েও সচেতন নয়। যুগে যুগে পুঁজিবাদীরা তাদের স্বার্থ রক্ষায় সর্বহারাদের ঠকাতে নানা কৌশল অবলম্বন করে, গল্পটিতে তারই বাস্তবতা বিবৃত হয়েছে। প্রশ্ন জাগে গল্পটি কি শ্রেণী চেতনতা সমর্থন করে না?
বিভূতিভূষণের কাছে কোনো নীতি, তত্ত্ব বা মূল্যবোধের কোনো বিচ্ছিন্ন অর্থ ছিল না, যদি না সেসব নীতি, তত্ত্ব বা মূল্যবোধ মানুষকে আশ্রয় দিতে না পারে। সুতরাং এ কথা বলা মোটেও অসঙ্গত নয় যে, গ্রামীণ জীবনের নীতিবোধ ও মূল্যবোধের রক্ষণশীলতা বিভূতভূষণ সমর্থন করেননি। তিনি শ্রেণী বিদ্বেষীও নন কিংবা ব্যক্তিগতভাবেও কাউকে ঘৃণার চোখে দেখেননি। যে কারণে তার অধিকাংশ ছোটগল্পই গ্রামীণ জীবনের শান্তি ও পারস্পরিক নিশ্চিন্ততা নিয়ে বেড়ে ওঠে। তিনি নিজে বলেছেন, ‘সাহিত্য আমাদের কল্পনা ও অনুভব-বৃত্তিকে উজ্জীবিত করে।... কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পী যত কথা বলেন, তার মর্ম এই যে আমাদের ধরণী ভারী সুন্দর- একে বিচিত্র বললেই বা এর কতটুকু বোঝান হলো! আমাদের এ দৃষ্টিটি বারে বারে ঝাপসা হয়ে আসে, প্রকৃতির বাইরেকার কাঠামোটাকে দেখে আমরা বারে বারে তাকে ‘রিয়ালিটি’ বলে ভুল করি, জীবন-নদীতে অন্ধ গতানুগতিকতার শেওলাদাম জমে, তখন আর স্রোত চলে না; তাই তো কবিকে, রসস্রষ্টাকে আমাদের বারবার দরকারÑ শুকনো মিথ্যা-বাস্তবের পাঁক থেকে আমাদের উদ্ধার করতে।’
বিভূতিভূষণের সমকালীন অনেক লেখকই বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের বিচিত্র অভিজ্ঞান নিয়ে যন্ত্রণাময় কাহিনী রচনা করছেন। কিন্তু তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম ধারার সাহিত্যকর্মী। বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাঙালি যখন পৃথিবীর নানান মতবাদ আর পরিবর্তনের দোলায় দুলছিল, ঠিক সেই সময়ে ঝাঁঝালো জীবনবোধের বেড়াজাল থেকে মানুষকে অনাড়ম্বর ঘরোয়া পরিবেশে টেনে আনতেই তিনি নিরলস শ্রম বিনিয়োগ করেছেন। ফলে চিরায়ত গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় সংরাগ আর দ্বান্দ্বিক সৌন্দর্য ও রসবোধকে সহজেই তিনি পাঠকের সামনে হাজির করেন। দেহজীবিনীদের নিয়ে রচিত ‘হিঙের কচুরি’ গল্পটি বিভূতিভূষণের বহুল পঠিত গল্পের একটি। শৈশবে নন্দরাম সেনের গলিতে মাখন-কুসুম-প্রভাদের ঘরে নিয়মিত যাতায়াত ছিলো গল্প কথকের। প্রাপ্ত বয়সে তার প্রতি সবচেয়ে বেশি স্নেহ পরায়ণ কুসুম এখন একটি মেসের পরিচারিকা। অথচ কুসুম তার বিগত পতিতা জীবনের জন্য কোনো ধরণের সঙ্কোচ বোধ করে না সেই আট বছরের ছেলেটিকে বন্ধু বেষ্টিত দেখে। কখনও গোপন করার চেষ্টা করেনি নিজের পরিচয়। উপরন্তু পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করে কুসুম সেই কচুরি-লুব্ধ বালকটিকে হিঙের কচুরি এনে খাইয়ে তৃপ্ত বোধ করে। তার ‘বিপদ’ গল্পটিতেও বর্ণিত হয়েছে জীবন-জীবিকার কারণে পতিতার খাতায় নাম লেখানো একজন গ্রাম্য বালিকা হাজুর কথা। একদিন যে মেয়েটি ভিখারিণীর মতো অন্ন-বস্ত্রের চাহিদা মিটিয়েছে সে এখন নিজের ঘরে বসে গ্রামের চেনা লোকদের আত্মীয়জ্ঞানে আপ্যায়ন করে। অথচ ওই বালিকার পিতাও কোনোদিন শহরে বসবাস কিংবা কাপ-পিরিচে চা খাওয়ার কথা কল্পনা করতে পারেনি। গল্প-কথক তার গ্রামের বাসিন্দা হওয়ায় হাজু তাকে ঘরে ডেকে এনে সোপার্জিত অর্থে চা খাওয়ায়। এ সময় তার চোখে মুখে পরম সাফল্য ফুটে ওঠে।
বোধকরি জীবনের মূলধারাকেই বিভূতিভূষণ তার রচনাকর্মের আধার হিসাবে বিবেচনা করেছেন। যে কারণে বিশ্বব্যাপী কার্ল মার্কসের বৈপ্লবিক সাম্যনীতি গ্রহণ-বর্জনের দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়েও নগরকে পাশ কাটিয়ে গ্রামকেই সাহিত্য চর্চার কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করেন। চরিত্র সৃষ্টিতে প্রাধান্য পায় গ্রামের খেটে খাওয়া, অবহেলিত সাধারণ মানুষ। কাহিনীতে ফুটে ওঠে আমাদের চেনা-জানা মানুষের স্বাভাবিক জীবন প্রবাহ। প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের জীবনাচরণের সজীব ও নিখুঁত চিত্র তার কথাশিল্পে পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিক ডামাডোলে বিভূতিভূষণের সৃষ্টিকর্মের মৌলিকত্ব সমকালীন আলোচকদের কাছে প্রশ্নশীল হলেও তার প্রখর জীবনবোধ ও শিল্পবোধ জারিত রচনাগুলো বাংলা সাহিত্যের এক অনবদ্য স্বর্ণফসল। উত্তরকালে তার রচনার পাঠকপ্রিয়তা এটাই প্রমাণ করে যে, দূরাশ্রয়ী অন্তর্দৃষ্টির মিশেলে রচিত উপন্যাসের পাশাপাশি বিভূতিভূষণের ছোটগল্পগুলোও পাঠককে মহাকালাশ্রয়ী চৈতন্যে টেনে নিতে সক্ষম। আর এখানেই সৃষ্টির প্রকৃত সার্থকতা নিহিত।
হাসান আজিজুল হক: বাংলা কথাসাহিত্যের মহান ভাষ্যকার
মোজাফ্ফর হোসেন
হাসান আজিজুল হক। প্রতিকৃতি : প্রসূন হালদার
বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান লেখক হাসান আজিজুল হককে বাংলা ছোটগল্পের পালাবদলের অন্যতম প্রধান লেখক বলা হয়। ষাটের দশকের শুরুতে ‘শকুন’ গল্পটি লিখে তিনি দুই বাংলার লেখক ও সাহিত্যবোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। এরপর ১৯৬৪ সালে ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ এবং ১৯৬৮ সালে ‘আত্মজা ও একটি করবীগাছ’ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন আমাদের ছোটগল্পের অন্যতম প্রধান ভাষ্যকার।
এই দুটি বই লিখেই তিনি ১৯৭০ সালে পেয়ে যান বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। তিনি গল্পগ্রন্থ লিখেছেন মোট ১০টি : ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’, ‘আত্মজা ও একটি করবীগাছ’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘পাতালে হাসপাতালে’, ‘আমরা অপেক্ষা করছি’, ‘রোদে যাবো’, ‘মা-মেয়ের সংসার’, ‘বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প’ ও ‘রাই কুড়িয়ে বেল’।
ছোটগল্পের পাশাপাশি তিনি তিনটি উপন্যাস লেখেন : ‘শামুক’, ‘আগুনপাখি’ ও ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’। ‘শামুক’ লিখেছিলেন পঞ্চাশের দশকে, যদিও সেটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে।
‘আগুনপাখি’ ২০০৬ ও ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়। বিষয়বস্তুর দিক থেকে তাঁর উপন্যাস তাঁর ছোটগল্পেরই সম্প্রসারণ। হাসান আজিজুল হক আখ্যানপ্রধান কথাসাহিত্যিক। তাঁর কথাসাহিত্যের ধারাটি বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যগত এবং আগে-পরে জনপ্রিয়।
কিন্তু তিনি সেই প্রচলিত গল্পের ধারাকে আরো সমৃদ্ধ ও সম্প্রসারিত করেছেন। নিজের একটি সিগনেচার তৈরি করেছেন ভাষা ও বিষয়বস্তুতে। বাংলাদেশের দেশভাগের সাহিত্যের স্বরূপ তিনি ঠিক করে দিয়েছেন। এই বঙ্গের গণমানুষ ও প্রান্তিক মানুষ, দাঙ্গা, খরা, দুর্ভিক্ষ, ক্ষুধা, মুক্তিযুদ্ধ, রাঢ়বঙ্গের প্রকৃতি—এ সবই তাঁর ছোটগল্পে ফটোগ্রাফিকভাবে চিত্রিত হয়েছে।
গল্প-উপন্যাসের বাইরে সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, রাজনীতি, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে তিনি বিপুল মননশীল প্রবন্ধ ও চার খণ্ড স্মৃতিকথা লিখেছেন।
স্মৃতি থেকে যত দূরে যাওয়া যায়, ততই নির্মোহ থেকে, ততই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় নিজেকে। গল্প লেখা প্রায় ছেড়ে দিয়ে লিখলেন চার খণ্ডে আত্মস্মৃতি ও স্মৃতিকহনমূলক গ্রন্থ ‘ফিরে যাই ফিরে আসি’ (২০০৯, ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ), ‘উঁকি দিয়ে দিগন্ত’ (২০১১, ঐ), ‘এই পুরাতন আখরগুলি’ (২০১৪, ঐ) ও ‘দুয়ার হতে দূরে’ (২০১৭, ঐ)। লিখলেন যে দুটি উপন্যাস—‘আগুনপাখি’ (২০০৬, ঐ) ও ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ (২০১৩, ঐ) তা-ও তাঁর স্মৃতিসিক্ত। স্মৃতিকথার প্রথম পর্ব ‘ফিরে যাই ফিরে আসি’ এ কালের হাসান গুরুত্বপূর্ণ এক কথা দিয়ে শুরু করেছেন—‘স্মৃতিকে কতোটা পিছনে নেওয়া যায়, নিশ্চয়ই চেতনার পিছনে নয়। আমার ধারণা শুধু চেতনাতেও স্মৃতি নেই, যদি থাকেও তা আধো অন্ধকারেই ডুবে থাকে। আত্মচেতনা থেকেই স্মৃতির শুরু। জন্মের পর থেকে চেতনা আছে, গূঢ় রহস্যময় চেতনা কিন্তু স্মৃতি নেই। চেতনা-আত্মচেতনার মাঝখানের সান্ধ্য জায়গায়টায় অনেকবার ফিরে ফিরে যেতে চেয়েছি। তাই ফিরে যাই, ফিরে আসি।’
হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক পরিচয়ের মাঝে চাপা পড়ে গেছে তাঁর আরো এক সুকীর্তি। তিনি বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ এক শিশুসাহিত্যিক। উপন্যাসের মতো এখানেও তাঁর সৃষ্টি বিপুল নয়। মাত্র দুটি বই লিখেছেন শিশুদের জন্য—‘লাল ঘোড়া আমি’ ও ‘ফুটবল থেকে সাবধান’। ‘লাল ঘোড়া আমি’ একটি উপন্যাসিকা বা বড় গল্প। অন্যটি একটি গল্পগ্রন্থ, সাতটি ক্ষীণকায় গল্প আছে এখানে। হাসানের অন্য কোনো লেখায় যে শিশু-কিশোরদের উপস্থিতি ঘটেনি, তা কিন্তু নয়। তাঁর বিখ্যাত ‘শকুন’ গল্পটির কথা এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে—‘কয়েকটি ছেলে বসে ছিল সন্ধ্যার পর। তেঁতুলগাছটার দিকে পিছন ফিরে। খালি গায়ে ময়লা হাফশার্টকে আসন করে। গোল হয়ে পা ছড়িয়ে গল্প করছিল।’ (‘শকুন’, ১৯৬০) কয়েকটি কৌতূহলী কিশোরের একটি শকুনকেন্দ্রিক সন্ধ্যা ও রাত্রি যাপনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় পুরো গল্প। ‘শকুন’ গল্পের কিছুকাল পরেই রচনা করেন ‘একটি আত্মরক্ষার কাহিনী’ (১৯৬৩) গল্পটি। কিশোর রেজার বয়ঃসন্ধিকালের মানসিক ও শারীরিক যে টানাপড়েন তার উপস্থিতি ঘটেছে এই গল্পে। গল্পটি যথার্থ কিশোর উপযোগী গল্প হয়ে উঠেছে।
হাসান আজিজুল হক ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর প্রয়াত হয়েছেন ঠিকই, তবে তিনি চিরজাগ্রত আছেন তাঁর সৃষ্টি দিয়ে। এই মহান লেখককে আমরা স্মরণ করি বিনম্রচিত্তে।
মোহাম্মদ আলি ও জর্জ ফোরম্যান উপাখ্যান
(সংকলিত)
♣♣
দুইবারের হেভিওয়েটে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জর্জ ফোরম্যান মারা গেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। কিংবদন্তি এই বক্সার শুক্রবার (২১ মার্চ) নিজ বাড়িতেই মারা যান।
ইনস্টাগ্রামে পরিবারের পক্ষ থেকে লেখা হয়, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমাদের প্রিয় জর্জ ফোরম্যান মারা গিয়েছেন। ২১ মার্চ তিনি মারা যান। সেই সময় পরিবার তাঁর পাশেই ছিল। উনি যেমন একজন ভাল স্বামী তেমনি একজন ভাল বাবাও।
প্রসঙ্গত, মহম্মদ আলির সঙ্গে ‘রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল’–এ লড়েছিলেন এই বক্সার। ফোরম্যানের পরিবারের তরফে জানানো হয়েছে, ‘হৃদয়বিদারক খবর। গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি আমাদের প্রিয় জর্জ এডওয়ার্ড ফোরম্যান আর নেই। ২১ মার্চ তিনি মারা গিয়েছেন।
১৯৭৩ সালে ফোরম্যান প্রথম হেভিওয়েট বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হন। হারিয়েছিলেন অপ্রতিরোধ্য জো ফ্রেজিয়ারকে। কিন্তু ১৯৭৪ সালে তিনি অষ্টম রাউন্ডে নকআউটে হেরে গিয়েছিলেন সর্ব কালের সেরা মুষ্টিযোদ্ধা কিংবদন্তি মোহাম্মদ আলির কাছে। এরপর আচমকাই তিনি বক্সিং থেকে সরে যান।
পরে রিংয়ে ফেরেন ১৯৯৪ সালে।
সেবার হেভিওয়েটে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন মাইকেল মুরারকে হারিয়ে। সবচেয়ে বেশি বয়সে হেভিওয়েটে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড ফোরম্যানের দখলে। খেতাব জিতেছিলেন ৪৬ বছর ১৬৯ দিন বয়সে। তার কেরিয়ার রেকর্ড ৭৬–৫। তার মধ্যে ছিল ৬৮টি নকআউট। উত্তরাধুনিক
♣♣
রাম্বল ইন দি জাংগল
সিএনএন থেকে অনুবাদ: অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন
ঠিক অষ্টম রাউন্ডে, আলী বুঝতে পারলেন, সময় এসেছে শেষ আঘাত হানার। তিনি বিদ্যুতের মতো গতি নিয়ে সামনে এগিয়ে এলেন, এক ভয়ঙ্কর বাঁ-ডান কম্বিনেশন ঘুষি মারলেন, এবং ফোরম্যান ছিটকে পড়লেন রিংয়ে। কিনশাসার স্টেডিয়াম যেন উন্মাদনায় ফেটে পড়ল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রিংয়ে ঢুকে পড়লেন কোচ, কর্মকর্তা, ভক্তরা—তারপর যোগ দিলেন জায়ারের পুলিশ ও প্যারাট্রুপাররা।
৩০ অক্টোবর, ১৯৭৪। ভোর সাড়ে ৪টায় শুরু হলো মোহাম্মদ আলী ও জর্জ ফোরম্যানের মধ্যে বক্সিং ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় লড়াই—'রাম্বল ইন দ্য জঙ্গল'। কিন্তু এই লড়াইয়ের আসল শুরুটা হয়েছিল বহু বছর আগে, রিংয়ের বাইরে।
[caption id="attachment_3206" align="aligncenter" width="490"] FILE - This is an Oct. 9, 1974, file photo showing Muhammad Ali. Ali, the magnificent heavyweight champion whose fast fists and irrepressible personality transcended sports and captivated the world, has died according to a statement released by his family Friday, June 3, 2016. He was 74. (AP Photo/Ross D. Franklin, File)(AP Photo/FIle)[/caption]
ম্যাচের সাত সপ্তাহ আগে, যখন এই দুই কিংবদন্তি জায়ারের (বর্তমানে কঙ্গো গণপ্রজাতন্ত্র) মাটিতে পা রাখেন, তখনও এই লড়াই শুরু হয়নি। এমনকি তখনও নয়, যখন কিংবদন্তি প্রোমোটার ডন কিং কয়েক মিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে আফ্রিকার প্রথম হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ লড়াইয়ের আয়োজন নিশ্চিত করেন। এ লড়াইয়ের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে হলে আপনাকে ফিরে যেতে হবে এক দশক আগে।
'রাম্বল ইন দ্য জঙ্গল'-কে শুধু একটি বক্সিং ম্যাচ হিসেবে দেখা যাবে না,' বলেন আলীর জীবনী লেখা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু থমাস হাউজার। '১৯৭৪ সালের জায়ারে এই লড়াই ছিল ১৯৬০-এর দশকের আদর্শের প্রতীকী স্বীকৃতি।'
১৯৬৪ সালে, এক বিস্ময়কর লড়াইয়ে সোনি লিস্টনকে পরাজিত করে হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হন ক্যাসিয়াস ক্লে—যিনি পরবর্তীতে পরিচিত হন মোহাম্মদ আলী নামে। ওই সময়টি ছিল এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ। মাত্র তিন মাস আগে জন এফ. কেনেডির হত্যাকাণ্ড ঘটে, এবং একই সময়ে দ্য বিটলস প্রথমবারের মতো আমেরিকার মাটিতে পা রাখে।
হাউজার বলেন, 'এই কয়েক মাসের ঘটনাগুলোই মূলত ৬০-এর দশকের রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্থানের ভিত্তি স্থাপন করেছিল'।
লিস্টনকে হারানোর এক মাস পর, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ক্যাসিয়াস ক্লে তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন মোহাম্মদ আলী। এর ঠিক তিন বছর পর, ১৯৬৭ সালে, আলী যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান।
'কেন আমাকে ইউনিফর্ম পরে ১০ হাজার মাইল দূরে গিয়ে নিরীহ ভিয়েতনামীদের উপর বোমা ফেলতে বলা হবে, যখন আমার নিজের শহরের কৃষ্ণাঙ্গদের কুকুরের মতো ব্যবহার করা হয় এবং মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়?'—তখন বলেছিলেন আলী।
এরপরই গ্রেপ্তার হন তিনি, তার বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপের খেতাব কেড়ে নেওয়া হয়, পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং তার পেশাদার বক্সিং ক্যারিয়ার স্থগিত করা হয়। তিন বছর পর আবার লড়াইয়ে ফেরার অনুমতি পেলেও, তার হারানো খেতাব পুনরুদ্ধারের সুযোগ আসে আরও সাত বছর পর, ১৯৭৪ সালে, জায়ারের মাটিতে।
১৯৭৪ সালে বিশ্বজুড়ে চলমান পরিবর্তন ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও এই লড়াইকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছিল।
'সেই সময়ের মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে দুটি বিশাল ঘটনা ঘটেছিল,' বলেন হাউজার। 'প্রথমত, ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কারণে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পদত্যাগ করেন। এরপর, মোহাম্মদ আলী জায়ারে ফিরে এসে তার হেভিওয়েট খেতাব পুনরুদ্ধার করেন।'
ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসানকালে যুদ্ধের অন্যতম প্রধান সমর্থক নিক্সনের পতন হয়, আর যুদ্ধে আপোষহীন সমালোচক আলী আবার বক্সিং রিংয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন।
'এ দুটি ঘটনা যেন প্রমাণ করে, ১৯৬০-এর দশকের জন্য যে লড়াই করা হয়েছিল, তা ব্যর্থ হয়নি,' যোগ করেন হাউজার।
লড়াইয়ের ভিন্ন রাজনৈতিক রূপ
তবে 'রাম্বল ইন দ্য জঙ্গল'-এর পেছনে আরেকটি রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কাজ করেছিল। জায়ারের স্বৈরশাসক মোবুতু সেসে সেকো, যিনি ১৯৬৫ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন, এই ম্যাচকে তার শাসনের প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন।
আয়োজকরা এই লড়াইকে আফ্রিকান শিকড়ে ফিরে যাওয়ার প্রতীক হিসেবে প্রচার করতে চেয়েছিলেন। এমনকি প্রথমদিকে লড়াইয়ের নাম ঠিক করা হয়েছিল— 'ফ্রম দ্য স্লেভ শিপ টু দ্য চ্যাম্পিয়নশিপ!' (দাস জাহাজ থেকে চ্যাম্পিয়নশিপের মঞ্চে)। তবে হিস্টরি ডট কমের তথ্য অনুযায়ী, মোবুতু বিষয়টি বোধগম্য হতেই সব পোস্টার পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন, কারণ তিনি চাইছিলেন আফ্রিকার শক্তি ও গৌরবের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে।
মোহাম্মদ আলী যখন জায়ারে পা রাখলেন, তখনই বোঝা যাচ্ছিল যে, এই লড়াই শুধু বক্সিং রিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। জায়ারের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে এক স্থানীয় তাকে বিমানবন্দর থেকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বের করে আনলেন, যেন এক নায়ককে স্বাগত জানানো হচ্ছে তার হারানো শিকড়ে। অন্যদিকে, জর্জ ফোরম্যানও পিছিয়ে ছিলেন না—তিনি পশ্চিম আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে, আফ্রিকার প্রতি তার সংযোগকে তুলে ধরতে চাইলেন।
তিন দিনব্যাপী এক বিশাল সঙ্গীত উৎসবেরও আয়োজন করা হয়, যেখানে জেমস ব্রাউন, বি বি কিং ও বিল উইদার্সের মতো শিল্পীরা পারফর্ম করেন।
মোহাম্মদ আলী ও জর্জ ফোরম্যানের এই মহারণকে মোবুতু শুধু ক্রীড়া আয়োজন হিসেবে দেখেননি; এটি ছিল তার ক্ষমতা প্রদর্শনের অন্যতম মাধ্যম।
'একটি লড়াই, যেখানে দুই কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধা, এক কৃষ্ণাঙ্গ দেশে, কৃষ্ণাঙ্গদের আয়োজনে লড়ছে এবং তা বিশ্বজুড়ে সম্প্রচারিত হচ্ছে—এটাই মোবুতুর বিজয়,'—জায়ারের বিভিন্ন স্থানে এমন প্রচারণা চালানো হয়েছিল।
ম্যাচের রাতে স্টেডিয়ামে মোবুতুর বিশাল প্রতিকৃতি টাঙানো হয়, যেখানে আগে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বন্দি করে রাখা হতো।
আফ্রিকার হৃদয়ে আলী
আলী রাজনৈতিক কারণে মোবুতুর প্রতি অনুগত না হলেও, আফ্রিকায় লড়াই করার সুযোগ পেয়ে আনন্দিত ছিলেন।
থমাস হাউজার বলেছিলেন, 'এটি শুধু এক ম্যাচ ছিল না, বরং আলীর জন্য এটি ছিল তার পূর্বপুরুষদের ভূমিতে ফিরে আসার মুহূর্ত।'
আলী নিজেও পরে লিখেছিলেন, 'আমি চেয়েছিলাম আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে আফ্রিকার মানুষের একটি সংযোগ গড়ে তুলতে। এই লড়াই ছিল শুধু বক্সিংয়ের নয়, বরং বর্ণবাদ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ—সবকিছুর প্রতিচ্ছবি।'
ছবি: কেন রেগান/ডিজনি জেনারেল এন্টারটেইনমেন্ট কনটেন্ট, গেটি ইমেজেস
যদিও ব্যক্তিগতভাবে আলী পরে স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি আফ্রিকার প্রতি কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তবে জায়ারের মানুষ তাকে নিজেদের নায়ক হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
লড়াই যত এগিয়ে আসছিল, ততই রাস্তায় রাস্তায় ধ্বনিত হচ্ছিল এক স্লোগান— 'আলী, বোমায়ে!' (আলী, ওকে মেরে ফেলো!)।
কিনশাসার জনগণ তাদের হৃদয় দিয়ে আলীকে আপন করে নিয়েছিল। তাদের কাছে এটি ছিল শুধু একটি বক্সিং ম্যাচ নয়, এটি ছিল এক প্রতিরোধ, এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
বিশ্বব্যাপী প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ সরাসরি দেখেছিল এই লড়াই। আর যখন আলী তার ঐতিহাসিক বিজয় ছিনিয়ে আনলেন, তখন সেটি শুধু তার ব্যক্তিগত জয় ছিল না—এটি ছিল পুরো আফ্রিকার জন্য এক সম্মান, এক গৌরবগাঁথা।
'রোপ-এ-ডোপ'—যে কৌশলে বদলে গেল লড়াইয়ের ইতিহাস
এই লড়াই শুধু একটি চ্যাম্পিয়নশিপ বাউট ছিল না, এটি ছিল বক্সিংয়ের ইতিহাসের অন্যতম মহাকাব্যিক অধ্যায়। এ লড়াই ছিল দুই কিংবদন্তির মধ্যে— ফাইট রিং-এর একদিকে ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে থাকা একজন অপ্রতিরোধ্য চ্যাম্পিয়ন, অন্যজন প্রত্যাবর্তনের লড়াইয়ে থাকা এক প্রতীকী যোদ্ধা।
২৫ বছর বয়সী জর্জ ফোরম্যান তখন ছিলেন তার ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে। ৪০টি লড়াইয়ের প্রতিটিতে জয়ী হয়েছেন, যার মধ্যে ৩৭টিই ছিল নকআউট। বলা হতো, হেভিওয়েট বিভাগের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘুষির জোর ছিল তার হাতে।
তার আত্মবিশ্বাস ছিল আকাশছোঁয়া। পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'আমি ভেবেছিলাম, এটা একরকম দাতব্য লড়াই। শুনেছিলাম, আলী অর্থকষ্টে ভুগছেন, তাই ভেবেছিলাম, ওকে একটা সুযোগ দেই। আমি ৫ মিলিয়ন ডলার পেয়েছি, আর ওকেও সেটাই দিতে রাজি ছিলাম।'
গল্প
দিদেলাস মিথ কিংবা অজগর বুড়ো
হাসান জাহিদ
১
তিরিশটি বছর পার হয়ে গেল। তিনটি দশক! জীবনের ভেতরে আরেকটি জীবনের মতো সময়কাল। তিরিশ বছর আগে এক দগ্ধ দিনে শিকার করতে বের হয়ে খড়ম-পেয়ে বুড়োর দেখা পেয়েছিলাম। তারপর তিরিশটি বছর সেই বুড়ো আমার বুকের মধ্যে হেঁটে বেড়িয়েছে। আমার করোটির ভেতরে এঁকে দিয়েছে বিচিত্র জঙ্গম চিত্র...।
...শেয়াল শিকারে বের হয়েছিলাম। গ্রামের গরিব লোকেরা পাগলা শেয়ালের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আমাকে শেয়াল মেরে দিতে বলল। জীর্ণ বেড়ার ফোকর দিয়ে ঘরে ঢুকে ওরা মানুষকে কামড়ে দিচ্ছিল।
গাঁয়ের মানুষ হামলে পড়ল আমার ওপর। যে করেই হোক শেয়ালগুলো মেরে দিতে হবে। ওদের আর্তিতে সাড়া দিয়ে জিম করবেটের মতো প্রথমে গ্রামটা ঘুরে দেখলাম। বিশাল বেগুন খেতের ভেতরে একটা বাছুরের ভুক্তাবশেষ খুঁেজ পেলাম। কিন্তু শেয়ালের টিকিটির নাগাল পেলাম না। ওলোটকম্বল আর লজ্জাবতীর ঝোপ মাড়িয়ে অনেকটা সময় জঙ্গল চষলাম। শেষে একটা ঢিবিমতো স্থানে এসে থামলাম।
আমার কাঁধে ছিল দোনলা বন্দুক। গাঁয়ের সবচেয়ে বড় কলাবাগানটা চষে বেরিয়েও শেয়ালের দেখা পেলাম না। আশেপাশে কয়েকটি গুঁইসাপ দেখলাম। ওদেরকে মারা আমার উদ্দেশ্য নয়। কখনও মারিনি। বন্দুক দিয়ে হাওর অঞ্চলে শীতকালে পাখি শিকার করেছি একসময়। এখন তা-ও ছেড়ে দিয়েছি। জীবজন্তু, জঙ্গল আর গাছপালা কমে যাচ্ছে।
দুপুরের তেজী রোদ পড়তির দিকে। তখনও সূর্য ডোবার সময় হয়নি; কিন্তু হঠাৎ করেই সে ডুব দিল। প্রকৃতি গুমোট রূপ ধারণ করল। হাঁটতে হাঁটতে বেগুন খেতের শেষপ্রান্তে চলে এলাম। ততক্ষণে আমার পেছনে ধাবিত ছেলেবুড়োর দল হারিয়ে গেল। তাদের সার্বক্ষণিক গুঞ্জন থেমে গেল চারপাশ নীরব নিথর করে দিয়ে। আকাশটা কালো হয়ে গেছে। কোনো পাখি উড়ছিল না। সহসা বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা। একটা ঝড় আসছে, স্থল ঘূর্ণিঝড়। বাঁচতে হলে এখুনি দৌড়াতে হবে। ঠান্ডা ও গরম মিশেল হাওয়া শরীরে বিচিত্র দোলা দিয়ে গেল। পালাতে হবে। পুরোনো আমলের রেলইঞ্জিনের ধুঁয়ার মতো আজদাহা কুÐুলি আসমান আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এক চাষা খেতের কাজ ফেলে চোঁচা দৌড় লাগাল।
ঢিবিমতো স্থানটায় লাফ দিয়ে উঠলাম। কাঁধ থেকে পড়ে গেল বন্দুক। দৌড়ে এসে একটা বেড়ায় ঘেরা স্থানে ঢুকলাম। মাঝখানে এক চিলতে উঠোন। মাথার ওপর নাম না জানা গাছের সারি। একপাশে চালাঘর, অন্যদিকে একটা টিনের ঘর। দরজায় কড়া নাড়লাম। ভেতর থেকে একটা খটখটে শব্দ পেলাম। শব্দটা আমার অনুভূতির মধ্যে থাকলেও ব্যক্ত করতে পারব না। চেনা-অচেনার মাঝামাঝি কোনো শব্দ। কেউ দরজা খুলল না। ফের কড়া নাড়লাম। সাড়া পেলাম না এবারও। শেষে ধাক্কা দিলাম দরজায়। নড়বড়ে দরজা খুলে গেল। প্রায়ান্ধকার ঘরটায় কাউকে দেখতে পেলাম না।
ঘরে একটা হাতল ভাঙা চেয়ার আর একটা তক্তপোষ। চালার নিচের কাঠের তাকে কিছু তৈজসপত্র আর পাটখড়ির গাদাগাদি অবস্থান। চালা থেকে বাদুড়ের মতো ঝুলছে কয়েকটি শিকে। শব্দটা আবার ভেসে এলো। এক বুড়ো পায়ে খটাখট শব্দ তুলে একটা হারিক্যান রাখল চেয়ারে। বললাম, ‘ঝড় শুরু হয়ে গেছে।’ আমাকে দেখে বুড়ো চমকাল না, কেমন ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
মনে হলো, ঝড়ের মূল ঝাপ্টা বোধহয় এদিক দিয়ে যায়নি। গেলে এই নড়বড়ে টিনের ঘর, বুড়োর নির্বিকার ভঙ্গি আর প্রাণ রক্ষায় আমার ভেতরের তাগাদা চিরতরে মুছে যেত।
২
বুড়ো এগিয়ে এসে তার কানটা আমার মুখের সামনে ধরল। কথাটা পুনরাবৃত্তি করলাম। বুড়ো মাথা নাড়ল। তারপর বিড়বিড় করে কিছু বলল।
ততক্ষণে ঝড় থেমে গেলেও ঝড়োহাওয়া থামল না। ঠান্ডা হাওয়া আর বৃষ্টি চলল। বুড়ো খটরমটর করে ঘরময় পায়চারি করছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। চলে যাবার তাগাদা অনুভব করলাম। কিন্তু আমার আস্তানা অনেক দূরে। নিকষ কালো আঁধার আর প্রবল বৃষ্টিতে যাব কেমন করে?
বুড়ো চেয়ে আছে আমার দিকে। গ্রীকপুরাণের ক্যারন মাঝির মতো বুড়োর কুতকুতে চোখে জুগুপ্সিত চাহনি। বৃষ্টির প্রকোপ বুঝার জন্য জানালার দিকে তাকালাম। কিন্তু জানালা বন্ধ। ঘরটা গুমোট। একটা আঁশটে, ভেজা কুকুরের গায়ের মতো অরুচিকর গন্ধ নাকে লাগছিল থেকে থেকে। আমার সামনে যে দÐায়মান সে ক্যারন মাঝি, যার কাজ হলো সদ্য মৃতদের স্টাইক্স ও অ্যাচেরন নদী পার করে জীবিত দুনিয়া থেকে মৃতদের দুনিয়ায় পৌঁছে দেয়া। মনে হলো তক্তপোষটা একটা নৌকা, বুড়োটা ক্যারন মাঝি আর আমি সদ্য দেহচ্যুত কোনো আত্মা।
বুড়োর পরনে লুঙি ও শতচ্ছিন্ন তেলতেলে কোট। বুড়োকে জিজ্ঞেস করলাম সে এখানে একা থাকে কিনা। বুড়ো ঘাড় নাড়ল।
পায়ে আঠালো কী একটা শীতল সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছিল। হারিক্যানের স্বল্প আলোয় দেখলাম মোটা ঘিনঘিনে কেঁচোটাকে। আমি কেঁচো খুব ভয় পাই। স্যান্ডেল ছুড়ে ফেলে একলাফে চৌকিতে পা উঠিয়ে বসলাম। দেখলাম, সারা ঘরে কেঁচোর ম্যালা বসেছে। ঘরের অন্ধকার কোণে কতগুলো কেঁচো দ্যুতি ছড়াচ্ছে। ঘরের মেঝে জুড়ে ফাটল আর ঢিবি। কেঁচোর জমা করা গুটি মাটি। এই ঘরটা কতকাল সারাই হয় না কে জানে। বুড়ো ইশারা করল বসতে। কিন্তু বসব কোথায়? যদি কেঁচোগুলো চৌকির পায়া বেয়ে ওপরে উঠে আসে!
বাইরের বর্ষণ থামছে না; বরং যেন আরও বেড়ে গেল। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে এবার শুনতে পেলাম ঘ্র্যাংকো-ঘ্যাঙর ঘ্যাং রাগসংগীত। ততক্ষণে বুড়ো ঘরের ভেতরকার একটা বেড়ার আড়ালে চলে গেল। বেড়ার ভাঙা অংশ দিয়ে উনুন দেখা যাচ্ছিল। পোলাও চালের গন্ধ পেলাম। বুড়ো কি পোলাও কোরমা রাঁধতে শুরু করল? আমার খিদে পেয়েছিল। সেই সকালে সামান্য চা বিস্কিট খেয়ে বেরিয়েছিলাম। তারপর পেটে আর দানাপানি পড়েনি। এই সময় বস্তুটা দেখতে পেলাম। ঘরের তাকের ওপর থেকে ঝুলছে। একটা ধূসর-কালো মোটা দড়ি। কাছিয়ে গিয়ে দড়ির মালিকের চেহারাটা দেখতে পেলাম। ধূসর-কালচে একটা গন্ধগোকুল। পোলাও চালের গন্ধের উৎস খুঁজে পেলাম। দুইচোখের ওপর সাদা দাগ। বাদুড়ের মতো চেহারাটা মেলে সে আমার দিকে বিজাতীয় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।
৩
বুড়ো কোথায়? তার খড়মের আওয়াজ আর পাচ্ছি না। ঘরের কিনারাগুলো বৃষ্টিতে ভিজে নরম হয়ে আছে। ঘরের মেঝের কিনারাগুলো স্যাঁতসেঁতে হয়ে দৃঢ়তা হারিয়েছে; ভ্যাপসা ও সোঁদা গন্ধে ভরপুর। খড়মের আওয়াজটা হারিয়ে গেছে।
বুড়ো এক সানকি মুড়ি এনে বিছানায় রাখল। জিজ্ঞেস করলাম তার ঘরে চা আছে কিনা। বুড়ো নিবিষ্ট চিত্তে মুড়ি চিবোতে লাগল। বুড়োর বয়স কত? আশি, নব্বই নাকি একশ’? আরও দুয়েকটি প্রশ্ন করলাম। বুড়ো শুনতে পেল না। শেষে হেঁশেলে গিয়ে বাঁশের তৈরি ভারী ফুঁকনিটা কুড়িয়ে আনলাম। তার একপ্রান্তে মুখ রেখে অন্যপ্রান্ত বুড়োর কানের ভেতরে প্রায় সেঁধিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘ঘরে চা আছে?’
‘না।’
আমার এই প্রশ্নে বুড়ো অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে যেতে লাগল। ভাবলাম এমন একটা প্রশ্ন করা যাক, যাতে বুড়ো আদ্যন্ত বলে যেতে পারে। কিন্তু কীভাবে প্রশ্নটা করা যায়? বাঁশের চোঙাটা তেমনি ভাবে বুড়োর কর্ণে স্থাপন করে বললাম, ‘আপনার কাহিনি আমাকে বলে যান, কবে জন্ম, আদি নিবাস কোথায়।’
বুড়ো আবার বলল, ‘সেই কোন্ কালে চা ছেড়ে দিয়েছি। যৌবনে খুব চা খেতাম। চা খেয়ে রাত জাগতাম আর তাস খেলতাম...।’
চোঙাটা আবার বুড়োর কানের ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম। বললাম, ‘চা প্রসঙ্গ থাক। আপনার কথা বলুন।’
‘ইংরিজি আমলে একটা দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। তখন ম্যালা লোক মারা যায়।’
‘পঞ্চাশ লাখ,’ বললাম। বুড়ো ইশারা করল তার কানের পাশ থেকে চোঙাটা সরিয়ে নিতে। চোঙা সরিয়ে নিলাম। মনের ভুলে সেটা ধরে রেখেছিলাম তার কর্ণদেশে।
‘দুই দুইটা জোয়ান পুলা আর একটা মাইয়া মরে গেল খাদ্যের অভাবে। আমি, আমার স্ত্রী, আরও দুই মেয়ে নোংরা আবর্জনা খেয়ে বেঁচে রইলাম। কিছুদিন পর আমার স্ত্রী মরে গেল। আমি দুই মেয়ে নিয়ে কলিকাতা ছেড়ে চলে এলাম ঢাকায়। কলিকাতায় বৌবাজারে বাপদাদার আমলের চাউলের দোকান ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান বর্মামুল্লুক দখল করে নেয়। বর্মা থেকে চাউল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। চাউলের বাজার পড়ে যায়। তারপর যে কয়টা কানাকড়ি ছিল, তা খরচ হয়ে যায় দুর্ভিক্ষের সময়। ভাদ্দর-আশ্বিন মাসে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ মরতে লাগল। একসময় ঢাকায় আসি, সঙ্গে দুইটা মাত্র কাঁথা, কয়েকটা হাঁড়িপাতিল আর এই একজোড়া খড়ম। এই খড়ম পায়ে আমার বাবা চাউলের দোকান বসত। খড়ম জোড়া আমার দাদার বাপের ছিল।’
বৃদ্ধের খড়মজোড়ার দিকে তাকালাম। কালো। এটা রং নয়, বহু ব্যবহারে খড়মজোড়া লোহার মতো কালো ও মসৃণ হয়ে গেছে। বললাম, ‘সব ইংরেজদের দোষ। এরাই সব নষ্টের মূল। এখন ভাবি, জাপানিরা যদি ভারতের সব ইংরেজদের মেরে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দিত তখন!’
বৃদ্ধ কী বুঝল জানি না, তবে সে মাথা নাড়ল। তারপর বলে চলল, ‘ঢাকায় এসে কয়েকদিন ভিক্ষা করলাম। সব জায়গায় একই অবস্থা। লাশ পড়ে আছে স্থানে স্থানে। তারপর দুর্ভিক্ষ আস্তে আস্তে কমে গেলে আমি একটা কাপড়ের দোকানে কাজ জুটিয়ে নিলাম। কিছু পুঁজি জমিয়ে পরে নিজেই একটা কাপড়ের দোকান দিলাম। মেয়েদের বিবাহ হলো একসময়। টানা একুশ বছর দোকান চালিয়ে তারপর নাতিকে কাপড়ের দোকানের দায়িত্ব দিয়ে অবসর নিলাম।’
‘আপনার আদিনিবাস কোথায়? এই গ্রামে এলেন কী করে?’
‘কলিকাতায় ছিলাম। যদ্দূর মনে পড়ে, আমার বাপদাদার ভিটা ছিল চিৎপুরে। সেই ভিটা দাঙ্গার সময় দখল হয়ে যায়। ঢাকায় থাকতে বড় মেয়ের বিবাহ দিলাম এই গ্রামে। কিছুদিন মেয়ে আর মেয়ের শ্বশুড়ের হেফাজতে ছিলাম। তারপর জামাইয়ের বাপের কাছ থেকে তাদের দক্ষিণের এই ভিটা আর ঘর জমানো টাকায় কিনে এখানেই বসবাস করতে লাগলাম।’
চোঙাটা বুড়োর কানে ভালোভাবে বসিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আপনার বয়স কত?’
‘অতশত কি আর মনে আছে?’ বুড়ো বলল। দেখলাম বুড়ো বিড়বিড় করে কিছু বলছে। চটজলদি চোঙাটা এবার বুড়োর মুখের কাছে ধরে তার অপরপ্রান্ত আমার কানের কাছে ঠেকালাম। বুড়ো অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছে! কাকে গালাচ্ছে, কী কারণে এমন বেমক্কা গালমন্দ বুঝতে পারলাম না। কান থেকে চোঙাটা সরিয়ে ফেললাম।
৪
ঘড়ি দেখলাম, ভোর সাড়ে ছ’টা। থেকে থেকে মাথা পাক দিচ্ছিল। একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল। তন্দ্রায় আমি হোর্হে লুই বোর্হেসের গল্পরাজ্যে বিচরণ করছিলাম। বুড়োর অবয়ব ভয়জাগানিয়া অনুভূতির সঞ্চার করছিল আমার মাঝে। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল কারুর স্পর্শে।
চোখ মেলে খুবসুরত মেয়েটিকে দেখলাম। কালো মেয়ে কিন্তু খুবসুরত। কোমরে আঁচল জড়ানো। এক হাতে তার ঝাঁটা। আমাকে চোখ মেলে চাইতে দেখে মেয়েটি চোখ আর ভুরু নাচালÑ‘ঘুম হইছে?’
ঘাড় নাড়লাম। তারপর আদ্যোপান্ত খুলে বললাম। মেয়েটি কাচভাঙা হাসিতে গড়িয়ে পড়ল। বলল, ‘ভালোই করছেন। নাইলে গাছের ডাইল মাথায় পড়ত।’
মেয়েটি বলল, ‘দিনে বুড়ার খেদমত করি। বুড়ারে রাইন্ধাবাইড়া দেই। সন্ধ্যায় চইলা যাই। আমার বাজানের অসুখ। রাইতে তাইনের সেবা করি।’
‘বুড়ো তোমাকে বেতন দেয় নাকি এমনি করে দাও?’
‘বেতন! সোয়ামীর কাছ থেইকা বেতন নিতাম!’
আমার মুখটা বোধহয় পুরোনো মজা পুকুরের রূপ ধারণ করেছিল। সেদিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলল, ‘এই ঘাটের মড়ার সাথে আমার বিবাহ হইছে দুইবছর আগে। বাজান কামলা মানুষ। রোজগারপাতি তেমন আছিন না। বিনা চিকিৎসায় মা মইরা গেল। একটা ছোটোভাই আছিন। হ্যা-ও মইরা গেল। আমি বাড়ি-বাড়ি ঝিয়ের কাজ কইরা সংসার চালাইতাম। এইখানে একদিন কাম করতে আইসা বুইড়ারে মনে ধরল। আহা, কত বছর ধইরা বুড়া কষ্ট করতাছে...।’
‘ঠিক মেলানো যাচ্ছে না। তোমার বয়স কম। রূপ যৌবনে ভরপুর...।’
‘আপনের লগে একটু ইংরেজি কইতে ইচ্ছা করতেছে। যদি অনুমতি দেন তো কৃতার্থ হই।’
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। তুমি ইংরেজি জানো!’
‘কিছু জানি। আমি ম্যাট্রিক পাস। তারপর বাজান আর পড়াইতে পারে নাই। বুইড়ার সাথে সাঙ্গা বসবার পর থেকে হ্যার মুখে ইংরেজি শুইনা শরীর রি-রি করত। বাসর রাইতে তাইনে আমার কাছে তার যৌবনকালের গল্প করল। সে বলে বিট্টিশ। আমি শুদ্ধ কইরা দিয়া বললাম, ব্রিটিশ। তারপর একদিন সারাবেলা খালি দুর্ভিক্ষের গল্প বলল। জিজ্ঞাসা করলাম, কোন্ সালে দুর্ভিক্ষ হইছিল? কইতে পারল না। কইলাম, বাংলা তেরোশ’ পঞ্চাশ সনে। যাকগা। আফটার অল সে আমার সোয়ামী। রাতের বেলায় থাকতে পারি না বাজানের জন্য। তাই দিনের বেলা যদি সারাদিন না থাকি তাইলে মাইনষে মন্দ কইব। বুইড়া বেলা দুইটা পর্যন্ত ঘুমাইব। ওই যে দেহেন।’ মেয়েটির ইশারায় ঘরের আরেক প্রান্তে তাকিয়ে অবাক হলাম। এমন বিজাতীয় ভঙ্গিতে কোনো মানুষকে আমি ঘুমোতে দেখিনি। বুড়ো মুদ্রা আসনের ভঙ্গিতে মেঝেতে উবু হয়ে আছে। মেয়েটি বলল, ‘ঘুম থেকে উইঠা আমার সোহাগ চাইব।’
‘নামটা কী?’
‘পুরা নাম কইতারে না। খালি কয় মুন্সি।’
‘না, না। তোমার নাম।’
‘আমার নাম মোছাম্মাৎ হেনোরা বেগম ওরফে কাকলি। আমি সারাদিন খালি বকবক করি। আড়িয়াল খাঁ নদীর ধারে বাড়ি। গেরামের মানুষজন আমার নাম দিছে কাকলি। গায়ের রং কাউয়ার মতো হইলেও দেখতে আমি পরীর মতো। আর কন্ঠ কোকিলের মতো।’
‘স্বীকার করছি।’ বললাম, ‘কিন্তু তুমি জীবনটা এভাবে নষ্ট করে দিলে কেন?’
‘কী বলতে চাইতেছেন?’
‘তুমি তো লেখাপড়া ভালোই শিখেছ। শহরে গিয়ে কারখানায় চাকরি নিতে পারতে। তারপর তোমার বাজানকে নিয়ে চিকিৎসা করাতে পারতে। ইচ্ছে করলে আরো লেখাপড়া শিখতে পারতে।’
কাকলি ঝাড়–টা ছুড়ে মারল ঘরের অন্যপ্রান্তে। তারপর বিছানায় আসন করে বসে আমার মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘কী যে কন। চেষ্টা কি কম করছি। আমার সোয়ামী চায় নাই। সে কামলা, আমারেও কামলা কইরা রাখতে চাইল।’
‘এই বুড়োর এত তেজ!’
‘আপনে না ধুন্দা। এই বুইড়া না। আমার একটা জোয়ান স্বামী আছিন। সেই স্বামী আমারে মারত। খাইতে দিত না। শেষে তালাক দিল। আমি ফিরা আসলাম গ্রামে। কিছুদিন গ্রামে বাড়ি-বাড়ি কাম কইরা বাজানরে খাওয়াইলাম। মানুষজন নজর দিতে লাগল। আমি এহন কী করি। শেষে তাইনের এহানে কাম নিলাম। পাক করার কাম। তারপর একদিন বুইড়া আমারে প্রস্তাব দিল। পয়লা তো আমি হাসতে হাসতে সাতবার বেহুঁশ হইছিলাম। তালাবে গিয়া সাত আট বার ডুব দেওনের পর আমার বুদ্ধি খুলল। গ্রামের মাতবর চাচা মানুষটা খারাপ অইলেও আমারে ভালা পায়। তার পরামর্শ নিলাম। তাইনে আমারে ‘খুব গোপন কথা’ বইলা ধানখেত আর নামা পার কইরা এক কলাবাগানে আইনা এরপর বুদ্ধিটা দিল। কী কইতাম, লোকটা খাডাস হইলেও শলাটা ভালোই দিল।’
‘কী শলা!’
‘কইল, বুইড়া যেন আমারে তার ভিটাভূমিডা লেইখা দেয়। আমি দৌড়াইয়া গিয়া ধাব্বুস-ধুব্বুস বুকে কথাটা পাড়লাম। বুড়া সাথে সাথে রাজি হইয়া গেল। রাজি তো হইলই। রীতিমতো দলিলপত্তর কইরা দিল।’
‘তুমি বুদ্ধিমতি মেয়ে।’
‘যাক গিয়া। আপনে নাস্তা খাইবেন? দিতাম? আটার রুটি আর রামশিঙ্গা ভাজি। রামশিঙ্গা বুঝেন তো? আপনে তো আবার শহরে মানুষ অইছেন। মানে হইল চিচিঙ্গা।’
শুনে আমার জিভে পানি এসে গেল। খিদেয় নাড়িভুঁড়ি পাকিয়ে উঠছিল। বললাম, ‘বেশ তো দাও না নাস্তা। জম্পেশ করে খাই। আর একটু চা হবে?’
‘চা এই বাড়িতে নাই। তবে কুসুমদের বাড়িতে আছে। সে আমার ফ্রেন্ড। তার কাছ থেকে চাইয়া আনতে পারি। বেশি দূরে না।’
প্রীত হয়ে বললাম, ‘বেশ তো তাই করো। চায়ের জন্য প্রাণটা আঁইঢাই করছে। চা-নাস্তা খেয়ে শরীরটা তাজা করে তারপর না হয় রওনা দিব।’
‘ঠিক আছে চা, রুটি, রামশিঙ্গা ভাজি আর বন্দুক একসাথে হাজির করতেছি।’
‘চা-রুটি-শিঙ্গা ভাজি বুঝলাম, কিন্তু বন্দুকটা!’
‘আপনে মানুষটা আসলেই বুন্দা...। তুফানের সময় বন্দুক ফালাইয়া দৌড়াইয়া এই বাড়িতে আসেন নাই? আমি জানি এই গ্রামে হিয়াল মারতে একজন শিকারি আইছে। এখানে আসার পথে বন্দুক দেইখা ভাবলাম হয় আপনেরে তুফান উড়াইয়া নিয়া আইছে, না হয় আপনে উইড়া আইসা এই বাড়িতে উঠছেন।’
‘ঠিক’, মুগ্ধ চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম। তারপর পেটের মধ্যে জমানো জিজ্ঞাস্যটা উগড়ে দিলাম, ‘বুড়ার বয়স কত কাকলি?’
‘আপনে না একটা উন্দা...। একটু মাথা খাটাইলেই তো বয়সটা হিসাব করতে পারেন।’
‘কী জানি, আমার মাথায় খেলছে না। উন্দা কী?’
‘আগের সোয়ামীর বাড়ি আছিন ব্রহ্মপুত্রের ওইপাড়ে, তারা বন বিলাইরে কয় উন্দা। আমরার গ্রামেও অনেক জীব আছে। যেমন ধরেন বনখাডাস, গুঁইসাপ, আরো কত কিসিমের জীব।’
‘আমি বুঝি বনবিড়াল? যাহোক ওই নামটা খাডাস না। খাটাস, মানে গন্ধগোকুল। সেটা এই ঘরেই আছে।’
‘ও আপনে বুঝি টের পাইছেন? ঠিক আছে, আপনার নাস্তা নিয়া আসি।’
‘বয়সটা বললে না?’
‘আগে নাস্তা আনি। তারপরে হিসাবটা করতাছি।’
৫
‘বাংলা তেরোশ’ পঞ্চাশ সনেই তো দুর্ভিক্ষ হইছিল, তাই না?’ কাকলি শিক্ষকের ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকাল। আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, ‘বোধহয়।’ কাকলির প্রশ্নে আমার অনেকদিনের জানা সনটা কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। ওর দিকে তাকালাম নিরক্ষর দৃষ্টিতে। এই সুযোগে কাকলি কর্তৃত্বের আসন নিয়ে নিল। রুটি আর শিঙ্গা ভাজি মুখে পুরে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘দুর্ভিক্ষের সাথে বয়সের কী সম্পর্ক?’
‘সেইসময় বুড়ার জোয়ান দুই ছেলে আর এক মেয়ে মারা যায়। জোয়ান বলতে বুড়া কী বুঝাইতেছে জানি না। আঠারোও হইতে পারে আবার আটাইশও হইতে পারে। যদি আঠারোও হয়, তাইলে বাপ হিসাবে তার বয়স কত ছিল? ধরেন, চল্লিশ কি বিয়াল্লিশ। তেরোশ পঞ্চাশ সন কত বৎসর আগের সন? সত্তর বৎসর আগের। তাহলে সত্তর আর বিয়াল্লিশ যোগ করেন। একশ’ বারো বৎসর।’
‘বুড়োর বয়স একশ’ বারো বছর!’ আমার চোখ কপালে উঠল।
‘চান্দি গরম হইয়া গেল? আরও আছে। আমার মতে, বুড়ার বয়স একশ’ একুশ বৎসর। আমি তো কমটা ধরলাম। শুনছি, তার মেয়ে মারা গেছে সাতাশি বৎসর বয়সে। সে মরছে তিন বৎসর আগে। তাইলে সে জন্মাইছিল নব্বই বৎসর আগে। তার মানে বুড়ার স্মরণশক্তিতে গÐগোল হইছে। জোয়ান দুই ছেলে মইরা গেছে অনাহারে, এইটা তার মনে দাগ কাইটা আছে। মেয়েও মারা গেছিন তখন। তার দুই ছেলের বহু আগে জন্মাইছিল বড়মেয়ে। এরপর আরও দুই মেয়ে।’
‘হুম।’ আমি বললাম, ‘বৃদ্ধ তবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে স্থান পাবার মতো।’
কথাটা বুঝল না কাকলি। বুঝিয়ে দিলাম।
এইসময় উঠোনে জবর হট্টগোল শুনতে পেলাম। বৃষ্টি ধরে এসেছিল। বাইরে এসে দেখলাম আমার দোস্ত বারিক আলি জনাদশেক লোক নিয়ে হাজির। তারা আমার আকস্মিক অন্তর্ধানে প্রবল উদ্বিগ্ন। বারিক আলি একগাল হাসল আমাকে দেখে। সব শুনে সে আরও এক চোট হাসল। সে আমার বন্ধু। ছোটোকালে এক পাঠশালায় পড়তাম। একসাথে ম্যাট্রিক পাস করেছিলাম। আঠারো বছর বয়সে আমি চলে যাই ঢাকায়। ডিগ্রি পাস করলাম। তারপর পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে চাকরিতে ঢুকলাম। চব্বিশ বছর টানা চাকরি করলাম। একটা সময় ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। মনে পড়ল দোস্তের কথা। ছেলেমেয়ে আর স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে চলে এলাম গ্রামে। উঠলাম বারিকের বাড়িতে। আমাদের বাড়িতে তো কেউ নেই। বারিক ভালো মনের মানুষ। সুখি ও সমৃদ্ধ।
৬
বারিকের বাড়ির সন্ধ্যাটি অনেকদিন মনে থাকবে আমার। বারিক, তার স্ত্রী, তাদের দুই কিশোরী মেয়ে, বারিকের বিধবা শালী ও এই গাঁয়ে আমাদের আরেক বন্ধু আজগর আড্ডা বসিয়েছিলাম...।
...আজ এই জীবনসায়াহ্নে এসে বড় বেশি মনে পড়ছে সেই দিনটির কথা। ছেলেমেয়ে আর নাতিরা হাসপাতালে এনেছে আমাকে। বারিকের মৃত্যুসংবাদ পেলাম দুইদিন আগে। মৃত্যুসংবাদ শুনে বুকের পুরোনো ব্যথাটা চেগিয়ে উঠেছিল। যখন কোনো মৃত্যুসংবাদ শুনি, তখন আমার চোখে ভেসে ওঠে অন্ধকার এক কুঠুরি। হলদেটে সাদা করোটি আর অস্থি। আমি ঘুমে কিংবা জাগরণে আমার অস্থিগুলোকে দেখি। আমি নাড়াতে চাই আমার অস্থিকে, কিন্তু পারি না।
এই দুইদিনে মরিনি। হয়তো আরো দুইচারদিন বেঁচে থাকব। কিংবা আজ রাতটিই শেষ রাত হবে। সকাল থেকে ভালো বোধ করছিলাম। প্রদীপ নেভার আগে দপ করে জ্বলে ওঠার মতো। ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে বসলাম। শহরের ধুঁয়াশা আর বিবর্ণ গাছপালা ঠেলে কোনোক্রমে উঁকি দিল চাঁদ। অভিভূত হয়ে তাকিয়ে থাকলাম সেদিকে। বড় ভালো লাগছে পৃথিবীটাকে, এই বেঁচে থাকাটাকে। পত্রিকায় দেখলাম শতশত ইউএফও নাকি দেখা গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। যাক দেখা, এসব দেখার আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি শুধু অতীত দেখি। আমি অতীত ভালবাসি। অতীতের মতো মধুর কোনো কাল হতে পারে না। তিরিশ বছর আগের দুইহাজার বারো সাল আমার কাছে মধুময়। তার আগের কালটা মধুরতর। এরও আগেরটা মধুরতম।
...বারিকের বউ মজাদার পিঠে তৈরি করে আড্ডায় সরবরাহ করেছিল। বারিকের পাকা বাড়ির বারান্দায় পাটি পেতে বসেছিলাম। খেতে খেতে আড্ডা জমে উঠল। আগের রাতের ঝড় আর সেদিনের সারাদিনের বর্ষণ থামিয়ে যেন কিছুই হয়নি এমনিভাবে গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছিল নিসর্গ।
আড্ডায় খড়ম পেয়ে বুড়োর প্রসঙ্গ চলছিল। বললাম, ‘অবাক কান্ড, বুড়োর ঘরে বসে তোকে অনেক ট্রাই করলাম সেলফোনে, কিছুতেই পেলাম না। মনে হয় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল যন্ত্রটা।’ আমার কথায় বারিকের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। বারিকের বউ কিছু একটা ইশারা করল। আজগর একটা পিঠে মুখে দিতে গিয়েও দিল না। বারিকের দুই মেয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসল। জঙ্গলে মানুষখেকো বাঘের চলবার সময় চারপাশটা যেমন স্তব্ধ হয়ে যায়, এমনকি ঝিঁঝিঁরা পর্যন্ত কলরব থামিয়ে দেয়, তেমনি একটা রূপ ধারণ করল পরিবেশটা। বিস্ময়পোহত চোখে সবার দিকে তাকালাম। বারিক নড়েচড়ে বসে শেষে বলল, ‘আমরার গ্রামে মোবাইলের নেটওয়ার্ক সবচাইতে তেজী। কিন্তু...।’
‘কিন্তু কী!’
‘ওই ঘরের ভিতরে মোবাইল কাজ করে না।’
‘আমার মোবাইলটা কোনো কারণে হয়তো কাজ করেনি,’ বললাম।
‘না,’ বারিক বলল, ‘তোর মোবাইল ঠিকই ছিল। বিষয়টা হইল, ওই ঘরে মোবাইল কাজ করে না।’
‘বাজে কথা।’ বললাম।
‘মোটেও বাজে কথা না।’ বারিক উষ্ণ কন্ঠে বলল, ‘কাকলি কেন রাতে ওই ঘরে থাকে না? শত হইলেও বুড়া তো তার স্বামী। সে কেন একটা রাত্রিও ওই ঘরে থাকে নাই?’
‘ওর বাবা অসুস্থ, রাতে সে বাপের সেবা করে। দিনে তো সে যায়।’ বললাম, ‘তোদের কুসংস্কার আর গেল না।’
‘কুসংস্কার না,’ বারিক বলল, ‘কাকলি একদিন মোবাইল নিয়া সেই ঘরে ঢুকেছিল। একটা জরুরি ফোন করার জন্য মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল, নেটওয়ার্ক নাই। কিছুক্ষণ পর ফোন বন্ধ হইয়া গেল।’
‘বোধহয় ব্যাটারির চার্জ ছিল না।’
‘ছিল।’ বারিক বলল, ‘কাকলি তার বাড়িতে ফিরা আইসা দেখল মোবাইল চালু হইয়া গেছে। প্রথমে সে আমলে আনে নাই। হয়তো কোনো কারণে মোবাইল কাজ করে নাই। কিন্তু পরদিনও একই ঘটনা ঘটল। বুড়ার ঘরে ঢুকতেই অফ হইয়া গেল মোবাইল। অনেক চেষ্টা কইরাও সে চালু করতে পারল না।’
‘আশ্চর্য!’ আমার মুখ দিয়ে শুধু এই শব্দটাই বেরুল।
‘তাছাড়া...।’
‘তাছাড়া কী?’
‘কাকলি নিজে দেখছে।’
‘কী দেখেছে!’
বারিকের বলার ভঙ্গিতে ভয় পেল তার দুই মেয়ে। তারা তাদের মায়ের শরীর ঘেঁষে বসল। আজগর একটা বিড়ি ধরিয়েছিল। সেটায় টান দিতে ভুলে গেছে সে। আমি চায়ে চুমুক দিতে ভুলে গেলাম। আমার অস্বস্তি লাগছিল। বুড়োর ঘরের ভেতরের সেই গন্ধগোকুলটার নির্বিকার চাহনি ভেসে উঠল মানসপটে। আমার নাকে ভেসে আসছিল পোলাও চালের গন্ধ।
‘সেইদিনটা রান্নাবান্না আর ঘরের কাজ সাইরা সাঁঝের বেলা কাকলি সবে ঘরের বাইরে পা দিছে,’ বারিক বলে চলল, ‘এইসময় খটাখট খড়মের শব্দে কৌতূহলী হইয়া ফিরাবার সে ঘরে উঁকি দিল। ঘরের মধ্যে বুড়া নাই! ভাবল, বুড়া বোধহয় হেঁশেলে ঢুকছে। কাকলি সাহস কইরা ঘরে ঢুকতেই খড়মের শব্দ মিলাইয়া গেল। হারিক্যানের আলো বাড়াইয়া সে ঘরময় খুঁজল বুড়াকে। কিন্তু বুড়া নাই! হঠাৎ সে দেখতে পাইল ঘরের তাক থেইকা অর্ধেক জালক অজগর অর্ধেক মানব শরীরের বুড়া নামতেছে পিছলাইয়া! কাকলি এক দৌড়ে বাইরে এসে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে উঠোনে।’
...সেই সন্ধ্যের আড্ডাটা শেষ হলো রাতে ভুড়িভোজনের মধ্য দিয়ে। রাতে খাবারের সময় বুড়ো প্রসঙ্গ ছিল না। ছিল ফসল, মাটি, দেশ ও দশের গল্প। স্ত্রীর অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে পরদিন সকালে আমি ফিরে এসেছিলাম শহরে।
স্ত্রীর প্রলম্বিত অসুস্থতা, শেষে তার মৃত্যু আমাকে দিদেলাসের সুড়ঙ্গে প্রবীষ্ট করিয়ে দিয়েছিল। সেই গোলকধাঁধা থেকে কখনও বের হতে পারিনি আর। তাই অতীত দেখি আমি। দিদেলাসের সুড়ঙ্গে দেখি মাইনোটরকে, সে তেড়ে আসছে আমার দিকে। আমি যুঝে চলি। বারবার মৃত্যু হয় আমার। বারবার বেঁচে উঠি।
তিরিশটি বছর অজগর বুড়ো হেঁটে বেড়িয়েছে আমার চেতনায়।
এটা হয়তো ঠিক ভূতের গল্প নয়। ভূত সম্বন্ধীয় বা ভূতুড়ে গল্প বলা যেতে পারে। আমার এক নিকট আত্মীয়র নিজস্ব অভিজ্ঞতা। তার মুখ থেকেই শোনা। তাই সত্যি হলেও হতে পারে।
আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার কথা। রুডি তখন চোদ্দো বছরের কিশোর, সবে হাইস্কুলে পা দিয়েছে। তার বাবার বদলি হল মিডওয়েস্টের একটি ছোট্ট শহর সিউ ফলস-এ। আবার নতুন স্কুলে অ্যাডমিশন, নতুন ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানো, নতুন পাড়াপড়শীদের সঙ্গে পরিচয়। তবে রুডি ও তার ভাইবোনদের এটা অভ্যেস হয়ে গেছিল। তাদের বাবা প্রতি চার-পাঁচ বছর চাকরি ও শহর বদলাতেন। তারা চটপট নতুন জায়গার আদবকায়দা রপ্ত করতে শিখে গেছিল।
রুডিরা পাঁচ ভাই-বোন। সবাই হাইস্কুল বা স্থানীয় কলেজের ছাত্রছাত্রী। রুডিই সবথেকে ছোট। জন্ম থেকেই বড়ো দাদা-দিদিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মারপিট করে ও বেশ ডানপিটে ও স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছিল। বয়সের তুলনায় দায়িত্ববোধও অন্যদের চেয়ে বেশি ছিল।
সিউ ফলস-এ ওরা একটা পুরনো ভাড়া বাড়িতে ছিল চার-পাঁচ বছর। বাড়িটা খুব পুরনো। হয়তো ষাট বা সত্তর বছরের কিংবা বেশিই। কাঠের মেঝে, পা ফেললে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে। দরজা জানলার পাল্লাগুলো বেঁকাটেরা, ভালো করে চাপ না দিলে ঠিকমতো বন্ধ হয় না। আলগা খোলা থাকে আর হাওয়ায় খটাখট শব্দ করে।
তবে এসবই ওদের অভ্যেস হয়ে গেছিল। বাড়িটা বেশ বড়সড়, তিন-তলা, ওপরে ছাদে চিলেকুঠুরি, যাকে এখানে অ্যাটিক বলে। নীচে বেসমেণ্ট—কোনো অসুবিধে নেই।
অসুবিধে শুধু একটাই। মাঝেমধ্যেই একটা অদ্ভুত খট খট শব্দ আসে ওপর তলা থেকে। ক্যাঁচ কোঁচ, দুম দাম, সব সময় নয়, শুধু কদাক্বচিৎ। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও দু-একটা আরশোলা আর ইঁদুর ছাড়া চিলেকুঠুরিতে আর কিছুই পাওয়া যায়নি। কয়েকদিনের মধ্যেই সবাই ওই আওয়াজে অভ্যস্ত হয়ে গেল। কেউ আর চমকে ওঠে না। শুধু বাড়িতে যখন ওদের বন্ধুরা আসে আড্ডা দিতে বা রাত কাটাতে, তাদের ভয় দেখানোর মজাটা ওরা বেশ উপভোগ করে। রাতারাতি ওদের বন্ধুমহলে রুডিদের ভূতুড়ে বাড়িটা বেশ একটা টুরিস্ট আকর্ষণ হয়ে গেল। পাড়ায় নতুন কেউ এলে তাদের এই বাড়িটা অবশ্যই দেখানো হতো।
তারা কয়েকবার বাড়িওয়ালাকে এই ব্যাপার নিয়ে প্রশ্ন করেছিল কিন্তু কোনও সদুত্তর পায়নি। বেশি পীড়াপিড়ি করলে ভদ্রলোক গোমড়া মুখে বলতেন 'আপনাদের অসুবিধা হলে অন্য জায়গা দেখতে পারেন। আমার ক্লায়েন্টের অভাব নেই।' পড়শীরাও শুধু বলে যে এ বাড়িতে বেশিদিন কেউ টেঁকে না, দু-এক বছর অন্তর ভাড়াটে পালটায়। কিন্তু কারণটা কেউই জানে না।
দেখতে দেখতে চার বছর কেটে গেল। রুডির বাবার সেই 'হেথা নয়, অন্য কোনখানে' ভাবটা আবার মাথা চাড়া দিচ্ছিল। এবার আইওয়ার ছোট্ট শহর এমস-এ যাওয়ার পালা। রুডির হাই স্কুলে শেষ বছর। ওর স্কুলপর্ব শেষ হলেই সবাই এ বাড়ি ছেড়ে নতুন শহরে পাড়ি দেবে। এ-ই প্ল্যান। গরমের ছুটি প্রায় এসে গেল। রুডি ও তার বন্ধুরা স্কুলের শেষ ফেয়ারওয়েল পার্টি, প্রম ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত। অনেক ছেলে অন্য শহরে কলেজে ভরতি হয়েছে। তাই সবারই গোছগাছ নিয়ে ব্যস্ততা। রুডির বাবা ও মা আগেই বেশিরভাগ মালপত্র নিয়ে চলে গেছেন। খালি বাড়িতে রুডি একা ওর বইপত্র, কাপড়জামা গোছাচ্ছিল। সেদিন ওর বন্ধুর বাড়িতে একটা লাস্ট পার্টি। পরদিন বাড়ি তালাবন্ধ করে, বাড়িওয়ালার হাতে চাবি দিয়ে, ওর ব্যাগ বাক্স নিয়ে সোজা গাড়িতে উঠবে। প্ল্যান সোজা এমস, আইওয়ায় নতুন বাড়িতে ওঠার। ওখানেই ইউনিভারসিটিতে অ্যাডমিশন পেয়েছে। দু' মাস পরে ক্লাস শুরু।
সেদিন রুডি একটু বেশি রাত করে বাড়ি ফিরল। হাসিগল্প, খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে একটু বেশি বিয়ার হয়ে গেছিল। বাড়ি ফিরে বিছানায় গড়াতেই ওপরে দুমদাম শব্দে ঘুম চটে গেল। এবার বেশিই মনে হল শব্দটা। কোনো জন্তুজানোয়ার ঢুকে পড়ল নাকি? বাইরে রাত নিঃশব্দ। ঝড়-বৃষ্টির চিহ্ন নেই, হাওয়াও নেই একদম। একটু ইতস্তত করে রুডি টর্চ হাতে ওপরে চললো। চিলেকুঠুরিটা আগের মতোই ফাঁকা। ওদের কয়েকটা বাক্স আগেই আইওয়া রওনা হয়ে গেছে। দরজা, জানলার পাল্লা বন্ধ। তবে আওয়াজটা আসছে কোথা থেকে?
দেখতে দেখতে জানলার পাল্লা আপনাআপনি খুলে দড়াম শব্দে বন্ধ হল। শব্দগুলো এত জোরে ও এত ঘন ঘন রুডি আগে কখনো শোনেনি। হঠাৎ ওর মনে হল কেউ যেন খুব রেগে গিয়ে দুমদাম শব্দ করছে। কেন এরকম মনে হল তা সে বলতে পারবে না। আগে কখনো একটু-আধটু শব্দে এরকম মনে হয়নি। হঠাৎ ওর মনে হল দরজাটা দমাস করে বন্ধ হয়ে যাবে আর ও আটকে যাবে চিলেকুঠুরির ভিতর। হয়তো কেউ ওকে এ বাড়ি ছেড়ে যেতে দিতে চায় না। তারই অসন্তুষ্টির প্রকাশ এই জোর শব্দের মধ্যে। যদি বন্দী হয়ে যায় তাহলে তো আর এই বাড়ি ছেড়ে যেতে পারবে না। চিরকাল এখানেই মরে ভূত হয়ে থাকবে। খালি বাড়িতে কাউকে ডাকতেও পারবে না। (তখনকার দিনে তো আর সেল ফোন ছিল না।) মনে হতেই রুডি এক লাফে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। এসেই দুদ্দাড় করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে। পিছনে তখনো দুমদাম শব্দ চলছে।
ঘুমটুম মাথায় রইল। রুডির ব্যাগ দুটো আগে থেকেই প্যাক করা ছিল। সেদুটো গাড়ির মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে এক লাফে উঠে বসে গাড়িতে স্টার্ট দিল। পড়ে রইল বাকি জিনিশ, ঘরের চাবি। ভাগ্যিস গাড়িতে পেট্রল ভরা ছিল! সঙ্গে সঙ্গে স্পিড তুলে সে ছুটল হাইওয়ের দিকে। পিছনে খালি বাড়িতে খটখট দমাদম শব্দ হতে থাকল।
সারা রাত গাড়ি চালিয়ে, কোথাও না থেমে, ভোর বেলা রুডি এমস-এ ওদের নতুন বাড়িতে পৌঁছল। কাউকে কিছু বলল না। দিনের আলোয় সব ব্যাপারটাই কেমন হাস্যকর মনে হচ্ছিল। হয়তো রাত্তিরে মদটা একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছিল, আর সবই হয়তো একটা দুঃস্বপ্ন। এসব কথা বললে বড়োরা নিশ্চয়ই বকুনি দেবে আর ছোটরা নির্ঘাত হাসাহাসি করবে। ওর আসার কথা ছিল দুপুর বেলায়। একটু আগে পৌঁছতে কেউ কিছু প্রশ্নও করল না।
এর পর কলেজ, চাকরি, সবাই নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। আর কখনোই সিউ ফলস-এর সেই বাড়িতে যাওয়া হল না। সেই বাড়ির কথা ক্রমশ সবার স্মৃতি থেকে মুছে গেল। শুনেছিল বাড়িটা ভেঙে ওখানে নাকি একটা শপিং মল হয়েছে। রুডি আর কখনো ওমুখো হয়নি।
হেলাল হাফিজ। জন্ম: ৭ অক্টোবর, ১৯৪৮, নেত্রকোণা। মৃত্যু: ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, পেশা: কবি/সাংবাদিক
[হেলাল হাফিজ (Helal Hafiz) ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোণা জেলার বড়তলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নেত্রকোণা দত্ত হাইস্কুল থেকে ১৯৬৫ সালে মেট্রিক এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোণা কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন। ওই বছরেই কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র "দৈনিক পূর্বদেশে" সাংবাদিকতায় যোগদান করেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন "দৈনিক পূর্বদেশের" সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি "দৈনিক দেশ" পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদে যোগদান করেন । সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে বহুল আলোচিত তার বিখ্যাত কবিতার বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ প্রকাশিত হয়। কবি এ পর্যন্ত বেশ কিছু পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন,বিশেষ করে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের জন্যে তিনি পেয়েছেন নারায়ণগঞ্জ বৈশাখী মেলা উদযাপন কমিটির কবি সংবর্ধনা (১৯৮৫), যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), নেত্রকোণা সাহিত্য পরিষদের কবি খালেদদাদ চৌধুরী পুরস্কার ও সম্মাননা প্রভৃতি। "যে জলে আগুন জ্বলে"--এ কাব্যগ্রন্থে হেলেন নামে এক নারীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যিনি ছিলেন কবির প্রেমিকা। তার সাথে বিচ্ছেদের পরে কবি প্রায় ২৫ বছর এক ধরনের স্বেচ্ছা-নির্বাসনে জীবনযাপন করেন। এরপর নির্বাসিত জীবন থেকে বেরিয়ে তিনি ঢাকা জাতীয় প্রেস ক্লাবের কাছে বসবাস শুরু করেন।
২৬ বছর পর ২০১২ সালে আসে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’। তার অন্যতম জনপ্রিয় কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’; এ কবিতার দুটি পঙক্তি ‘‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’’ বাংলাদেশের কবিতামোদী ও সাধারণ পাঠকের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়ে থাকে। তিনি ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন।]
হেলাল হাফিজের দুটি কবিতা
একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম
শুধু আমাকেই দেখা যায়,
আলোর প্রতিফলন প্রতিসরণের নিয়ম না জানা আমি
সেই থেকে আর কোনদিন আয়না দেখি না।
জননীর জৈবসারে বর্ধিত বৃক্ষের নিচে
কাঁদতাম যখন দাঁড়িয়ে
সজল শৈশবে, বড়ো সাধ হতো
আমিও কবর হয়ে যাই,
বহুদিন হলো আমি সেরকম কবর দেখি না
কবরে স্পর্ধিত সেই একই বৃক্ষ আমাকে দেখে না।
কারুকার্যময় চারু ঘরের নমুনা দিয়ে
একদিন ভরা ছিল আমার দু’রেটিনার সীমিত সীমানা,
অথচ তেমন কোনো সীমাবদ্ধতাকে আর কখন মানি না।
কী দারুণ বেদনা আমাকে তড়িতাহতের মতো কাঁপালো তুমুল
ক্ষরণের লাল স্রোত আজন্ম পুরোটা ভেতর উল্টে পাল্টে খেলো,
নাকি অলক্ষ্যে এভাবেই
এলোমেলো আমাকে পাল্টালো, নিপুণ নিষ্ঠায়
বেদনার নাম করে বোন তার শুশ্রূষায়
যেন আমাকেই সংগোপনে যোগ্য করে গেলো।
কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট !
লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
ঘরের কষ্ট পরেরর কষ্ট পাখি এবং পাতার কষ্ট
দাড়ির কষ্ট
চোখের বুকের নখের কষ্ট,
একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,
ভুল রমণী ভালোবাসার
ভুল নেতাদের জনসভার
হাইড্রোজনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
দিনের কষ্ট রাতের কষ্ট
পথের এবং পায়ের কষ্ট
অসাধারণ করুণ চারু কষ্ট ফেরীঅলার কষ্ট
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
আর কে দেবে আমি ছাড়া
আসল শোভন কষ্ট,
কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন
আমার মত ক’জনের আর
সব হয়েছে নষ্ট,
আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট ।
একশো বছরে লোরকার কবিতা
স্বপন ভট্টাচার্য
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা
[ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা (১৮৯৮-১৯৩৬) সম্ভবত এখনও স্পেনের সবচেয়ে প্রিয় কবির আসনটি ধরে রেখেছেন। সবচেয়ে প্রিয় আধুনিক কবির আসনটিও, যদিও তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে। ‘বুক অফ পোয়েমস’ ছাপা হয়েছিল তাঁর বাবার অর্থানুকূল্যে ১৯২১’এ। সে বছরেরই নভেম্বর মাসে লোরকা লিখে ফেলেন তাঁর পরবর্তী সংকলন ‘পোয়েম অফ দ্য ডিপ সঙস’–এর কবিতাগুলি। এই লেখায় একশো বছর আগে লিখিত বা প্রকাশিত সাতটি কবিতার অনুবাদ সংকলিত হয়েছে । লক্ষণীয় এই যে অনূদিত কবিতাগুলির কেন্দ্রীয় সংযোগসূত্র হল আয়না। স্প্যানিশ না জানার আক্ষেপ নিয়েই ইংরাজি অনুবাদের আশ্রয় নিয়েছি। অর্ধশতাব্দীকাল লোরকায় মজে আছি ওই ইংরেজি অনুবাদ সম্বল করেই। এই বিশেষ কবিতাগুলি পেঙ্গুইন মডার্ন ক্ল্যাসিক্স সিরিজের ‘সিলেক্টেড পোয়েমস অফ ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা’ (২০০১ সংস্করণ) থেকে নেওয়া হয়েছে। আমার অনুবাদে স্তবকবিন্যাস, যতি বা মাত্রা একটি দুটি প্রয়োজনীয় ব্যতিক্রম ছাড়া মূলানুগ রাখার চেষ্টা করেছি।]
♠
তারার প্রহর (১৯২০)
রাত্রির নীরবতা বর্তুলসদৃশ
নিটোল অক্টেভ এক
অসীমের স্বরলিপি লিখে রাখা খাতার পাতায়।হারানো কবিতাগুলি পূর্ণতা এনে দিল আজ
পা রেখেছি রাস্তায় নগ্ন, তিলমাত্র আবরণহীন।
দেখছি গাঢ় অন্ধকারকে ধাঁধায় ফেলে দিচ্ছে
ঝিঁঝিঁপোকাদের গান:
শব্দ
যা মৃত আলেয়ার
শব্দ যা আলোর মতন
অশরীরী আত্মারা যে আলোকে চিনে নিতে পারে।আমার এ ঘরটার প্রতিটি দেয়ালে
হাজারো প্রজাপতির কঙ্কাল
তারা ঘুমিয়েছে আমারই সঙ্গী হয়ে।মত্ত ভিড়ের মত একঝাঁক নবীন বাতাস
নদীর উপরে বহে এল।(কবিতাঃ Hour of Stars, মূল স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: Catherine Brown)
♠
নতুন হৃদয় (১৯২০)
সাপের মতই আজ হৃদয়ের ত্বক
বাসি খোলস যেন, খসে পড়ে গেছে।
আমি সেটা হাতে নিয়ে দেখি
কিছুটা আঘাত আর কিছু তাতে মধু ভরা আছে।খোলসের ভাঁজে ভাঁজে বোনা যে মন
এখন কোথায় তারা, কোথায় এখন?
যে গন্ধে যীশু মাতোয়ারা হন এবং শয়তানও
বল সেই সুগন্ধী গোলাপ কোথায়?খুবই কোমল আর ভঙ্গুর সেই আবরণী
যা দিয়ে ভিজিয়ে রাখি আমার অলীক যত তারা
প্রিয় ছিল একদিন, হয়ত বাসি না আর ভালো
ধূসর সে শোকগাথাগুলি, আজ তারা কোথায় হারালো!গর্ভের ভিতর এক ভ্রুণের স্ফুরণ দেখি তাতে
দেখি মমি করে রাখা আছে আমার কবিতা
আমার গোপনকথা প্রণয়কঙ্কাল, আর
বহুদূরে ফেলে আসা আমার সঙ্গী সরলতা।আবেগের জাদুঘরে ফ্রেমবন্দি করে
দেওয়ালে টাঙাবো নাকি তাকে?
আঁধারশীতল এই অশুভ চোখের
ঘুমন্ত কনীনিকা দু'খানার পাশে?নাকি তোমাকে বিছিয়ে দেব পাইনের বনে চাঁদোয়ায়
- অবিরত বিদ্ধ হতে থাকা প্রেমের এ বই কবিতার -
যাতে তুমি সেই সুর তুলে নাও নিজের গলায়
যে সুরে নাইটঅ্যাঙ্গেল পাখি আসন্ন ভোরকে ভোলায়?(কবিতাঃ New Heart, মূল স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: Catherine Brown)
♠
সূর্য ওঠার আগে (১৯২১)
অথচ তীরন্দাজের দল
ভালোবাসার মতই
দৃষ্টিহীন।সবুজ রাত্রির উপর
জ্যা মুক্ত তীর
যেতে যেতে রেখে গেছে
প্রস্ফুট লিলির উত্তাপ।চাঁদের সাম্পান
ময়ূরপঙ্খি মেঘে গাঢ় বিঁধে গেলে
মেঘের শরীর কেঁপে ওঠে
সে কাঁপনে উড়ে যায় শিশির-কিংখাব।তবু হায়
তীরন্দাজের দল
ভালবাসার মতই তারা দৃষ্টিহীন(কবিতাঃ Before Dawn, মূল স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: Cola Franzen)
♠
ল্যান্ডস্কেপ (১৯২১)
জলপাই গাছের সারি
কখনো চোখে পড়ে, কখনো মিলিয়ে যায়
যেমন খোলে বা গুটিয়ে বন্ধ রাখে কেউ
হাতপাখাও।
জলপাই বাগিচার মাথায়
একটা গোটা আকাশ ডুবে আছে
শীতল তারার দল সেই বাগিচায়
আঁধার-বর্ষা হয়ে নেমে এল আজ।
নদীটির পাড়ে
চাঁদের উপচ্ছায়া বুনো ঘাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে।
ধূসর বাতাস আনে লহরীর মত শিহরণ।
জলপাই গাছের শরীর ঢাকা পড়ে
কান্না জড়ানো আলোয়ানে।
একদল পাখি
ফাঁদে পড়া পাখি তারা
অতিদীর্ঘ পুচ্ছপালক
মরে আসা আলোতে দোলায়।(কবিতাঃ Landscape, মূল স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: Cola Franzen)
♠
পথ (১৯২১)
জানোই তো,
তোমার ধূসর তরবারি
বিঁধবে না দিকচক্রবাল,
পাহাড় তখন ঢাল হবে।স্বপ্নেও ভেবো না চাঁদের কথা,
ভেবো না চাঁদের রক্তে ভিজে যাবে ফলা
বরং জিরোও চুপচাপ।
তবে, শোনো পথ,
আমার পায়ের দুটি পাতা
তোমার শিশিরে যার গোপন শৃঙ্গার
তাদের ভুলো না যেন তুমি।তুমি নাকি ভবিষ্যত দেখতে পাও!
তোমার নগ্ন পিঠে উল্কি তুলে
তোমাকেই ভুলে গেল যারা
তাদের আত্মা তুমি
অনায়াসে পড়ে নিতে পারো?
অনন্তে পায়ের শব্দ শুনতে পায় যারা
যদি তেমন গণক হও তুমি,
তাহলে নিশ্চিত
তুমি গাধাদের প্রেমে মজে আছো
তোমার আহত দেহে, যারা শুশ্রূষার মত
নরম ভ্রমণ রেখে
ধীরে ধীরে হেঁটে চলে গেছে!
কেবল তারাই জানে তোমার দীর্ঘ তরবারি
কাকে বিদ্ধ করে, কোথায় পৌছায়।
পশুদের মধ্যে তারা অবলোকিতেশ্বর
শুধু গাধারাই
আঘাতে দীর্ণ হয়ে অবসর নিলে
লিপিহীন তোমার সাদা পুঁথি
অবিরত পাঠ করে যায়।চারপাশে গ্রামের কুটির
তবু কত একা হয়ে আছো!
পুণ্য বিচ্ছুরিত যেন তোমার প্রভায়!
দায় নিয়ে নিয়েছো সবার
চারটে ঝিম মেরে পড়ে থাকা ওয়াগন,
খান'দুই বাবলার ঝোপ,
পুরাণপ্রাচীন এক কুয়ো
যার মধ্যে একফোঁটা জলও পড়ে নেই আর।সারা পৃথিবী বেড় দিয়ে ঘুরে এলে
তবু যা নিজের বলে, থাকে লোকে
যথার্থ তেমন কোন বাসা নেই আজও তোমার,
কাফন নেই, গোরস্থান নেই;
প্রেমের বার্তাবাহী এই যে বাতাস
তারও ক্ষমতা নেই
তোমাকে নতুন করে জাগাবে আবার।তবে, ফসলের ক্ষেত ছেড়ে উঠে আসো যদি,
যদি অসীমের দিকে চলে যাও,
যদি তমসার বুক চিরে তোমার এ শ্বেত তরবারি
নিজের প্রতিচ্ছায়া এঁকে দিতে পারে
তাহলে হে পথ!
সান্তা ক্লারা ব্রিজ
তুমিও তো পার হতে পারো।(কবিতাঃ The Road, মূল স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: Catherine Brown)
♠
গাছ (১৯১৯)
গাছ !
তোমরা কি কোনদিন আকাশের নীল থেকে
মাটিতে বিদ্ধ হয়েছিলে?
কার সেই প্রবল গাণ্ডীব
তোমাদের গেঁথে দিয়ে গেল? আকাশের তারা নাকি সে?তোমাদের গান
যেন পাখির আত্মা থেকে সুর ভেসে এলো,
এলো ঈশ্বরের দৃষ্টি থেকে,
এলো অকৃত্রিম বাসনা থেকেও।
গাছ!
কঠিন শিকড় তোমার জানবে কি কোনদিন
মাটিতে কতটা নীচে প্রোথিত রেখেছি এই হৃদয় আমার?(কবিতাঃ Trees, মূল স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: Catherine Brown)
ফিলিস্তিনি কবিতা
মূল: ইয়াহিয়া আশুর, অনুবাদ: কাফি কামাল
(ইয়াহিয়া আশুর একজন তরুণ ফিলিস্তিনি কবি। ১৯৯৮ সালে গাজায় জন্মগ্রহণ করেন। ২০১৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তুমি একটি জানালা, তারা মেঘ' প্রকাশিত হয়। ফিলিস্তিন, আরব বিশ্বসহ আন্তর্জাতিক সাময়িকী-সংকলনে ব্যাপকভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তার রচনা। তার লেখা অনুবাদ হয়েছে ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান ও ফিনিশসহ একাধিক ভাষায়। গাজার আল মাজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রিধারী ইয়াহিয়া আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রাইটিং ফেলো।)
সত্তার মহাবিশ্বআমার জনক যিনি পূর্ণ দিবাকর
তিনি চান হয়ে উঠি গগণের মেঘ।
আমার জননী যিনি পূর্ণ শশধর
তিনি চান জ্বলে উঠি আকাশের তারা।
কিন্তু আমি হতে চাই উড়ন্ত চড়ুই
অথবা নিদেনপক্ষে, সলীলের মীন।এক ব্যক্তি
বিশ্বাস করুন-আমাকে ঠেলে দিতে খাদের কিনারে,
একজন ব্যক্তিই যথেষ্ট।
কেন তবে-শরিক হতে চেয়েছিল সকলে?
অংশ নিতে চেয়েছিল সকলে?হঠাৎ আমার মনে পড়ে নিরাশার কথা
প্রিয় আসমান, আমাদের বাড়িতে বোমা হামলার সময়
তুমি কোথায় ছিলে?
সুপ্রিয় জলধি, যখন আমাদের মৃতদেহ পুড়ে যাচ্ছিল
তুমি কোথায় ছিলে?এই কারাগার
প্রতিবার মনে হয়
এই কারাগার থেকে
আমি বেরোতে অক্ষম।
একজন মস্ত ওয়ার্ডেন দৃশ্যপটে আসেন
আমাকে নতুন কারাগারে পুরে দেন
যে প্রক্রিয়ার সমাপ্তি নেই।খোলা নৌকা
আমি সমুদ্র সৈকতের একটি তাঁবুর চেয়ে বেশি কিছু নই
এবং যারা সমুদ্র যাত্রা করছে
খোলা নৌকায়।
আমি দাঁড় বেয়ে যাই নিজস্ব অন্ধকারে
সময় থেকে দূরে,
আমি নোঙ্গর ফেলার জায়গা খুঁজি না
এমন কি জীবনরক্ষার পরোয়াও করি না।
আমি একটি মৃত মাছ মাত্র।অভিশাপ
নিজেকে সন্তুষ্ট করার আগেই কেটে গেল দীর্ঘ সময়
আমি যা সন্ধান করছি, তুমি তা নও
কিন্তু কি? বুঝলাম না।
এ সমস্ত সময় কেন পার করতে হলো
তোমাকে সন্তুষ্ট করবো বলে-
তুমি যার সন্ধানে আছো, আমি তাই।ব্যথা নথিভুক্তিকরণ
হে বেদনা, কীভাবে তোমাকে লিখি-
যখন তোমার কান্না, কোনো ভাষারই অন্তর্ভুক্ত নয়?
কি করে পাবো তোমার একটি পরিচ্ছন্ন ছবি?
যখন তুমি সুস্থির নও।
আল মাহমুদ
[প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক ছিলেন। তবে কবিতাতেই আল মাহমুদ জ্বলে উঠেছিলেন বারুদের মতো।]
♠
নোলক
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে?
-হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে
শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছড়িয়ে থাকে।
জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক
সবুজ বনের হরিণ টিয়ে করে রে ঝিকমিক।
বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে ভাই,
আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরকে যেতে চাই।
কোথায় পাবো তোমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া ধন
আমরা তো সব পাখপাখালি বনের সাধারণ।
সবুজ চুলে ফুল পিন্দেছি নোলক পরি নাতো!
ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও, হাত পাতো হাত পাতো
বলে পাহাড় দেখায় তাহার আহার ভরা বুক
হাজার হরিণ পাতার ফাঁকে বাঁকিয়ে রাখে মুখ।
এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন, ফের বাড়ালাম পা
আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।
মুরশেদ নূর শাহরিয়ার
দাবি ও অধিকার
যতটাই দাবি নদীর শরীরের
তততাই অধিকার শরীরের নদীর
তাই খালাস হয়ে যাবার পর
শরীর,
দাবি ও অধিকারের অন্তরীপে
শরীর খেকে নদীর দেহাবশেষ নিয়ে
মান্দাসে ভাসছে মুর্দাফরাস।
বরফের টেবিলে শুয়ে আছে নদী
গলার নিচ থেকে নাভি অব্দি
চিড়ে চিড়ে দরজিপাড়া খেকে
ঘুরে এলো ডোম একবার।
কর্নিয়া রেটিনার ভেতর আর কিছু
উচ্চাভিলাসের শিরা-উপশিরা আছে কিনা
মাছেদের...
জলের নাড়ি ভূঁড়ি ভাঁজে সম্পদের বিবরণ
স্কালপেল ফোরসেপে হাত, তদন্ত আঁখিি
উপরির উপরি ফেনার বুজকুরিতে
লুকানো কচুরিপানার বিছানায়
শুয়ে আছে এ কোন ফেরারি চাঁদ?
দোলন চাঁপা’র তিনটি কবিতা
বাহারি ফ্রেম
গোলাপ কলি তুমি,
টকটকে লাল
রাতের হাসনাহেনা গন্ধে মাতাল।
তুমি আমার ভালোবাসার পঙক্তিমালা
লাল টকটকে ঠোঁট
রোদ্রজ্বালা সন্ধ্যা তারার প্রেম চেয়ে থাকে প্রতিদিন
তোমার আকাশ দেখি মেঘলা
রঙিন পাহাড়ি ঝরনা নামে জল সরোবর
টগবগে প্রেম যৌবন কম্পন
অধর পেতে চাই কাছে
অধর চুম্বনে এখনো কাছে
ডাকো ভরা যৌবনে।
*
রাতেরআমন্ত্রণ
যখন সন্ধ্যা নেমে আসে রাতের আমন্ত্রণে
লাল মেঘের স্পর্শ ভাসে বাতাস বহে আনমনে ।
তবুও সন্ধ্যা আসে
কখন আকাশে মিলায়
মেঘ অরণ্য ঘন অন্ধকার
মন আসে বাতাসের বেগে।
*
ভৈরবীরাগ
ভোরের কুসুম আলোর দেমাগ
একটু পরে আযান হবে
ভৈরবী রাগ অজানা কোন পাখির ডাকে
ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ে
আলোর ঝলক লুটিয়ে পড়ে আপন ঘরে।
ভোরের আলো রৌদ্র কুসুম প্রেম বিলাসে
আনন্দময়ী নদী ও মাঠ সবাই হাসে ।
চোখের ঝিলিক রঙিন ঠোঁটে
ভোরের বাতাস গোলাপ ফোটে।