
ফাহিমা আক্তার সুমি
বাবা-মা কোথায়? আমার মায়ের কাছে যাবো। বাবার সঙ্গে দেখা করবো। বাবাকে ডাকো। আমাকে বাবা-মায়ের কাছে নিয়ে চলো। হাসপাতালের বেডে চোখ খুললেই পাশে থাকা স্বজনদের কাছে এভাবে আবদার করছে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত আট বছরের শিশু আরাধ্য। শিশুটি এখনো জানে না তার বাবা-মা মারা গেছেন। নিহত দিলীপ বিশ্বাস ও সাধনা বিশ্বাসের একমাত্র সন্তান আরাধ্য। বুধবার সকালে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়া উপজেলার
চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকায় বাস-মাইক্রোবাসের সংঘর্ষ হয়। ঘটনার দিনই বাবা-মাকে হারায় শিশুটি। আরাধ্যের বাবা একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। তার বাবা-মায়ের সঙ্গে গাজীপুরের টঙ্গীতে থাকতো। আরাধ্য সবেমাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছে।
শিশুটি গুরুতর আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিল। উন্নত চিকিৎসার জন্য শুক্রবার তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। বর্তমানে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে আরাধ্য। হাসপাতালে সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসক এবং স্বজনরা তার সুস্থতার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আরাধ্যের চাচা অসিত কুমার বাড়ই মানবজমিনকে বলেন, আরাধ্যের চিকিৎসা চলছে, এখনো পুরোপুরি কিছু বুঝতে পারছি না। তার দুই পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে ভেঙে গেছে। মাথায় আঘাত লেগেছে। আরাধ্য অল্প অল্প কথা বলে। কিছু খেতে পারছে না। চোখ খুললেই ওর বাবা-মাকে খুঁজে। আরাধ্য বলে, বাবা-মা কোথায়? মায়ের কাছে যাবো। বাবার সঙ্গে দেখা করবো। বাবাকে ডাকো। আমাকে বাবা-মায়ের কাছে নিয়ে চলো। সে এখনো জানে না তার বাবা-মা আর এই পৃথিবীতে নেই। আরাধ্য ওর বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল। আরাধ্যর জন্ম ঢাকাতেই। ঢাকার টঙ্গীতে বাবা-মায়ের সঙ্গে বসবাস করতো। ওদের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানার বোয়ালিয়া গ্রামে। ওর বাবা-মায়ের বিয়ে হয় ১৬-১৭ বছর আগে। আরাধ্যর বাবাও তার বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে সন্তান। বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মা রয়েছে। সব বাবারই স্বপ্ন থাকে সন্তানকে নিয়ে। আরাধ্যকে নিয়েও ওর বাবা-মায়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। এ বছর মেয়েকে নার্সারিতে ভর্তি করিয়েছিল।
তিনি বলেন, চিকিৎসক বলেছেন, আগের থেকে আরাধ্যের শারীরিক অবস্থা কিছুটা ভালো হয়েছে। পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আরাধ্যকে ছাড়বেন না। ঘটনার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) চিকিৎসাধীন ছিল। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য শুক্রবার দুপুরে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে সন্ধ্যায় পৌঁছানো হয়। থেকেই আরাধ্যর চিকিৎসা শুরু হয়। পরিবারটির তো সব শেষ। বাড়িতে বৃদ্ধ দাদা-দাদী আছে। তাদের নিয়েই আরাধ্যের চলতে হবে। তাদের বাড়ির অবস্থা শোচনীয়। ওর বাবা পোশাক কারখানায় চাকরি করতো সেটি দিয়েই পুরো পরিবার চলতো। আরাধ্যর সুস্থতা খুব জরুরি। ও তো এই শিশু বয়সে বাবা-মা দু’জনকে হারালো আমরা চেষ্টা করবো ওর লেখাপড়া, ভবিষ্যৎ যেন সুন্দর হয়। ওর বাবা-মা তো আর ফিরে আসবে না কোনোদিন।
তিনি আরও বলেন, দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে খবর পেয়ে আমরা সেখানে যাই। একজন অপরিচিত লোক আমাদের ফোন দিয়ে বলেছিল। সেখানে গিয়ে দেখি ঘটনার পরপরই দাদা-বৌদি মারা যায় এবং আরাধ্যকে নিয়ে যায় চট্টগ্রাম হাসপাতালে। বর্তমানে আরাধ্য কখনো তাকাচ্ছে, কখনো কথা বলছে আবার ঘুমাচ্ছে। ওর পায়ে ব্যান্ডেজ দেয়া। এমন একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যাবে কখনো আমরা কল্পনা করতে পারিনি। ওর বাবা-মায়ের মরদেহ গ্রামে সৎকার করা হয়েছে। এ ঘটনায় আরাধ্যর মামাতো ভাই দুর্জয় কুমার মণ্ডল (১৮) আহত হয়। তারও পরিবারে মা ছাড়া কেউ নেই। দুর্জয়ের পরিবারে আর্থিক অবস্থা ভালো না।
ঈদের ছুটিতে সহকর্মী রফিকুল ইসলাম শামীমের ও দিলীপের পরিবার বেড়াতে যাচ্ছিলেন কক্সবাজার। তারা সবাই একই মাইক্রোবাসে ছিলেন। পরিকল্পনা ছিল কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে সবাইকে নিয়ে ঘুরবেন। কিন্তু পথে সড়ক দুর্ঘটনায় রফিকুল ও দিলীপের পরিবারসহ প্রথম দিনে ১০ জন মারা যান। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান রফিকুলের মেয়ে প্রেমা ও আরাধ্য বিশ্বাসসহ তিনজন। তবে শুক্রবার ভাগ্যের কাছে হেরে গিয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রেমাও মারা যান চট্টগ্রাম হাসপাতালে। এই নিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় এগারো জন। নিহতরা হলেন- ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার উত্তর বোয়ালিয়া এলাকার দুলাল বিশ্বাসের পুত্র দিলীপ বিশ্বাস (৪৩), দিলীপ বিশ্বাসের স্ত্রী সাধনা মণ্ডল (৩৭), দিলীপ বিশ্বাসের শ্বশুর আশীষ মণ্ডল (৫০), ঢাকা জেলার দক্ষিণখান থানার আজমপুর মধ্যপাড়া এলাকার কালা মিয়ার পুত্র মো. ইউসুফ আলী (৫৫), ঢাকা মিরপুরের আবদুল জব্বারের পুত্র রফিকুল ইসলাম শামীম (৪৫), রফিকুল ইসলাম শামীমের স্ত্রী লুৎফুন নাহার সুমি (৩৫), রফিকুল ইসলাম শামীমের ছোট মেয়ে লিয়ানা (৮), রফিকুল ইসলাম শামীমের মেজো মেয়ে আনিশা (১৪), রফিকুল ইসলাম শামীমের বড় মেয়ে প্রেমা, একই এলাকার রফিকুল ইসলাম শামীমের ভাগিনা তানিফা ইয়াসমিন (১৬), একই এলাকার মৃত বকুল বেপারীর পুত্র ও রফিকুল ইসলাম শামীমের বন্ধু মুক্তার হোসেন (৬০)। মানবজমিন