০৯:৫৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

শিশুদের মস্তিষ্কে কী চলছে জানতে চেষ্টা করছে যে বিশেষ প্রকল্প

  • আপডেট সময়: ০৩:২০:৫৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ এপ্রিল ২০২৫
  • 39

মস্তিষ্কের কার্যকলাপ স্ক্যান করার জন্য শিশুদের জন্য সেন্সর বোঝাই বিশেষ টুপি রয়েছে


ভিক্টোরিয়া গিল

দুই বছর বয়সের হেনরি, তার সামনে রাখা ‘আইপ্যাড’ দেখে একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ। আইপ্যাডের স্ক্রিনে ফুটে ওঠা ‘স্মাইলি ফেস’ দেখতে পেলেই সে তার আঙুল ছুঁইয়ে দিচ্ছে, আর মুহূর্তে সেটা কোনো না কোনো প্রাণীর কার্টুনে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। সেই কার্টুন আবার নাচও করে।

সাদা মাটা চোখে এই ‘গেম’ সাধারণ এবং একঘেয়ে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে, এটা একটা পরীক্ষা যার মাধ্যমে শিশুদের মস্তিষ্কে কোন ধরনের মৌলিক দক্ষতার বিকাশ ঘটছে, তা বোঝা সম্ভব।

ছোট্ট হেনরির মাথায় রয়েছে একটা ক্যাপ, যেখানে ‘সেন্সর’বোঝাই করা রয়েছে। ওই ক্যাপ থেকে যে তারগুলো বেরিয়ে এসেছে, সেটা গিয়ে জুড়েছে একটা বড়সড় ‘অ্যানালিটিকাল মেশিনারি’ বা বিশ্লেষণাত্মক যন্ত্রপাতির সঙ্গে।

হেনরি যখন ওই গেমটা খেলছে, সেই সময় তার মাথায় থাকা সেন্সর বোঝাই ক্যাপ স্ক্যান করছে ওই খুদের মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপকে। পাশাপাশি, কতটা ভালভাবে সে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তারও একটা চিত্র তৈরি করছে।

‘ইনহিবিটরি কন্ট্রোল'(বাধা নিয়ন্ত্রণ)-এর সঙ্গে সম্পর্কিত এই পরীক্ষা। এর মাধ্যমে ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বুঝতে চাইছেন শিশুদের মধ্যে এই সমস্ত ক্ষমতা কখন এবং কীভাবে বিকাশ করে। এই দক্ষতাগুলো একেবারে খুদে বাচ্চাদের ফোকাস করতে এবং শিখতে সাহায্য করে।

দক্ষতাগুলো যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেটা ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা জানেন। কিন্তু তারা যেটা এখনও জানেন না সেটা হলো এই দক্ষতা শিশুর মস্তিষ্কে কোন সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়।

মাত্র ছয় মাস থেকে শুরু করে পাঁচ বছর বয়সের শিশুদের মধ্যে এমন দক্ষতার বিকাশ হতে থাকে যা ভবিষ্যতে তাদের অ্যাকাডেমিক (পঠন-পাঠন) এবং সামাজিক ক্ষমতা আকার দেবে। এটাই ওই বয়সের শতশত শিশুর ক্ষেত্রে ‘ট্র্যাক’ করছেন বিজ্ঞানীরা।

তবে এই অগ্রণী গবেষণামূলক প্রকল্পের একটা বিশেষত্ব রয়েছে। কয়েক দশক ধরে চলা গবেষণার মাঝে চলছে আরও একটা গবেষণা। বর্তমানে এই প্রজেক্টে অংশগ্রহণকারী ৩০০ শিশুর মায়েরাও একসময় এর অংশ ছিলেন। ১৯৯০-এর দশকে ওই মায়েরা যখন নিজেরা শিশু ছিলেন, সেই সময় থেকেই তাদের স্বাস্থ্য ‘মনিটর’ করা হয়েছে গবেষণার অংশ হিসাবে।

ছবির উৎস,Kevin Church/BBC News

গবেষকদের ডিজাইন করা বিভিন্ন গেমের মাধ্যমে শিশুদের নানান দক্ষতা সম্পর্কে পরীক্ষা করা হয়।

জীবনব্যাপী তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে যা শিশুদের (যারা এখন এই গবেষণার অংশ) মস্তিষ্কের বিকাশ, তাদের অভিভাবকদের (যারা নিজেরাও এই গবেষণার অংশ ছিলেন) স্বাস্থ্য, অভিজ্ঞতা এবং জেনেটিক্সের মধ্যে থাকা ‘লিঙ্ক’ প্রকাশ করতে পারে।

প্রধান গবেষক ড. কার্লা হোম্বের মতে, শিশুদের বিকাশ সম্পর্কিত গবেষণার দিক থেকে, ওই বাচ্চাদের অভিভাবক সম্পর্কে ইতিমধ্যে এত সমৃদ্ধ তথ্য সংগ্রহে থাকার বিষয়টা এই প্রকল্পকে ‘একেবারে অনন্য’ করে তুলেছে।

“কোন সময় শিশুদের বিভিন্ন স্কিল (দক্ষতা) তৈরি হয় সেটা আমাদের জানা দরকার এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন শিশুদের ক্ষেত্রে তার বিকাশ কীভাবে হয়, সেটাও আমাদের জানা দরকার,” বলেছেন তিনি।

ড. হোম্বে ব্যাখ্যা করেছেন, যে সমস্ত শিশু স্কুল যাওয়া শুরু করার পর ‘স্ট্রাগল’ করে, সেই ‘স্ট্রাগল’ পরেও চলতে দেখা গিয়েছে।

তার কথায়, “এটা (স্ট্রাগল) তাদের যৌবন বয়স পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। তাই বাচ্চাদের বিকাশের এই পুরো সময়কালকে আমাদের ভালভাবে বোঝা দরকার, যাতে একেবারে কম বয়সেই আমরা শিশুদের সাপোর্ট করতে পারি।”

ছবির উৎস,Kevin Church/BBC News

খুদের সঙ্গে ব্যস্ত একজন গবেষণা সহকারী

গবেষণার সময়, অংশগ্রহণকারী শিশু এবং তাদের অভিভাবকদের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান ল্যাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে তারা (শিশুরা) নানান ধরণের বৈজ্ঞানিক ‘গেম’ খেলে, ধাঁধার সম্মুখীন হয় এবং সেই সময় তাদের মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ করা হয়।

অনেক শিশুরই ছয় মাস বয়সে, তিন বছরে এবং পাঁচ বছর বয়সে এমআরআই স্ক্যান করা হয়, যা তাদের ক্রমবিকাশমান মস্তিষ্কের প্রকৃত চিত্র তৈরিতে সাহায্য করে।

এমনই একটা খেলা নিয়ে ব্যাস্ত হেনরি। ওই খেলায় আইপ্যাডের স্ক্রিনে ‘স্মাইলি ফেস’ ফুটে উঠছে। সাধারণত স্ক্রিনের ডান দিকে বারেবারে ফুটে উঠছে ওই ‘স্মাইলি ফেস’। যেই মুহূর্তে হেনরি এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে, সেই মুহূর্তে ওই ‘স্মাইলি ফেস’ ফুটে উঠছে স্ক্রিনের অন্য প্রান্তে।

এই গবেষণায় সহকারী হিসাবে কাজ করছেন কারমেল ব্রফ। তিনি বলেছেন, “আমরা দেখতে চাইছি শুধুমাত্র ডানদিকে ট্যাপ করার তাগিদকে হেনরি কাটিয়ে উঠতে পারে কি না এবং তার পরিবর্তে স্মাইলি ফেস স্ক্রিনের কোন দিকে ফুটে উঠছে, সেটাও সে খুঁজে দেখছে কি না।”

ড. হোম্বে ব্যাখ্যা করেছেন, শিশুরা যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করে, তখন এই সমস্ত দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার কথায়, “ক্লাসরুমে (শ্রেণীকক্ষে) একজন শিশুর ফোকাস করাটা দরকার। তাদের মনোযোগ যেন কোনোভাবেই নষ্ট না হয়।”

পাশাপাশি, তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, “নতুন জিনিস শিখতে হলে, আমাদের পুরানো অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।”

ছবির উৎস,Kevin Church/BBC News

গবেষণায় অংশ নেওয়া এক শিশু

হেনরি’র মতোই অন্য একটা ঘরে খেলা করতে ব্যস্ত জ্যাকসন। তারও বয়স দুই বছর। এই খুদে যে খেলাটা খেলছে সেটা তার ‘ওয়ার্কিং মেমরি’ পরীক্ষা করার জন্য ‘ডিজাইন’ করা।

একজন গবেষণা সহকারী বিভিন্ন পাত্রে স্টিকার লাগাচ্ছেন এবং জ্যাকসনকে তা দেখার জন্য উৎসাহিত করছেন। এরপর ওই খুদেকে মনে করতে বলা হয় যে কোন পাত্রগুলোতে স্টিকার রয়েছে এবং কোনটাতে নেই।

প্রশ্ন জাগতেই পারে যে কোন বিষয়টা তাকে এই খেলায় উৎসাহিত করছে? উত্তরটা হলো, খেলা শেষ হলে সমস্ত স্টিকারের মালিক হবে জ্যাকসন।

ওয়ার্কিং মেমরি কী সে বিষয়ে বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন ড. হোম্বে। তার কথায়, “ওয়ার্কিং মেমরি হলো এমন একটা বিষয় যেক্ষেত্রে খুব সামান্য কিছু তথ্য আমাদের মাথায় রাখতে হয়। কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য বা কোনো কাজের জন্য- যেমন একটা ধাঁধার উত্তর খুঁজতে, বা দুই মিনিট আগে আমরা কোনো জিনিস কোথায় রেখেছি তা মনে রাখতে এটা (ওয়ার্কিং মেমরি) প্রয়োজন।”

“শিশুরা যখন অঙ্ক কষতে শেখে বা পড়তে শেখে তখন এই সমস্ত দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে। এগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতার বিল্ডিং ব্লক (ভিত্তি) বলে আমি মনে করি।”

এই গবেষণা শিশুর ভাষার বিকাশ এবং তার প্রক্রিয়াকরণের গতিও মূল্যায়ন করবে যে বাচ্চারা কত দ্রুত নতুন তথ্য গ্রহণ করতে পারে, তারও একটা পরিমাপ।

 

Kevin Church/BBC News

আপাতদৃষ্টিতে গেমগুলো সাধারণ এবং একঘেয়ে বলে মনে হলেও প্রতিটাই সযত্নে ডিজাইন করা এবং এর উদ্দেশ্য শিশুদের নানান ক্ষমতাকে পরীক্ষা করা।

‘দ্য চিলড্রেন অফ দ্য ‘৯০জ’-নামক এই গবেষণামূলক প্রকল্পের বয়স এখন ৩৫ বছর। প্রাথমিকভাবে শিশু স্বাস্থ্যের উপর ফোকাস করা এই প্রকল্প ১৯৯১ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী ১৪,৫০০ শিশুকে ট্র্যাক করেছে। ওবেসিটি, অটিজম এবং সাম্প্রতিককালে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর মহামারীর প্রভাব সম্পর্কে বিশেষ আলোকপাত করতে সক্ষম হয়েছে এই গবেষণা।

সেখান থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞানীদের কাছে উপলব্ধ করা হয়েছে। হাজার হাজার বৈজ্ঞানিক গবেষণামূলক প্রতিবেদনে এই প্রকল্পের বিষয়ে উদ্ধৃতও করা হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ ১৯৯০-এর দশকের শিশুদের ডায়েটের বিষয়ে একটা উল্লেখযোগ্য তথ্য উঠে এসেছে। খাওয়া নিয়ে শিশুরা ঝামেলা করলে অভিভাবকদের উদ্বেগ হয় বটে, কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের স্বাস্থ্য ও বিকাশের উপর এর কোনও স্থায়ী প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই বলে প্রমাণ মিলেছে ওই গবেষণায়।

শিশুদের ক্রমাগত স্বাস্থ্য পরীক্ষার কারণে অন্য বিষয়ও প্রকাশ্যে এসেছে ওই প্রকল্পের হাত ধরে। যেমন জানা গিয়েছে, পাঁচজন তরুণের মধ্যে একজনের ফ্যাটি লিভার রোগের লক্ষণ দেখা যায়। পাশাপাশি জানা গিয়েছে ৪০ জন তরুণের মধ্যে একজনের লিভারে ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে যা মূলত ওবেসিটি এবং অ্যালকোহল সেবনের কারণে হতে পারে। এই পরিস্থিতি যে সাধারণ এবং ডায়েটের মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করা যায়, সেই বিষয়েও আলোকপাত করেছে এই বিশেষ প্রজেক্ট।

এর হাত ধরে প্রায়শই নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক উদ্ঘাটন প্রকাশ্যে আসতে থাকে। যেমন গত মাসে জানা গিয়েছে যে সমস্ত শিশুদের ডায়েটে তৈলাক্ত মাছের অভাব ছিল, তারা কম মিশুক এবং দয়ালু।

নব্বইয়ের দশকের শিশুদের নিয়ে শুরু হওয়া এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এখন তাদের (যারা নব্বইয়ের দশকে অংশগ্রহণ করেছিল) সন্তানদের গঠনমূলক ক্ষমতা এবং মস্তিষ্কের বিকাশের দিকে বিশেষভাবে নজর দিচ্ছেন। স্কুলে যাওয়া শুরু না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক শিশুকে অনুসরণ করা হবে।

ছবির উৎস,Kevin Church/BBC News

নব্বইয়ের দশকে মায়ের সঙ্গে এমিলি

নব্বইয়ের দশকে এই প্রকল্পে অংশগ্রহণ করেছিলেন এমিলি। তিনিই বছর দুয়েকের হেনরির মা। এখন তার কোলে বসে ছোট্ট হেনরি গবেষণাকারীদের যত্নসহকারে তৈরি একটা ধাঁধা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে।

এমিলির কথায়, “আমরা দুজনেই জন্ম থেকেই এরই (এই গবেষণামূলক প্রকল্পের) একটা অংশ। শুরুর দিকে আমি এটা পছন্দ করতাম না। আমার মা আমাকে এর জন্য সাইন আপ করিয়ে ছিলেন। কিন্তু এখন আমার এটাকে দারুণ আকর্ষণীয় বলে মনে হয়।”

ড. হোম্বে জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে শিশুদের উন্নতিতে সহায়তা করাই এই গবেষণামূলক প্রকল্পের লক্ষ্য। কারণ তার মতে যখন বাচ্চারা স্কুলে যাওয়া শুরু করে ততদিনে শিশুদের মধ্যে অনেক কিছুই (দক্ষতা এবং অভ্যাস) “তৈরি হয়ে যায়”।

তিনি বলেছেন, “এটা এমন একটা মৌলিক ভিত্তি তৈরির কাজ যা আমাদের সঠিক সময়ে শিশুদের সাহায্য করবে।”

এদিকে, হেনরি এবং জ্যাকসন তাদের ধাঁধা এবং গেম শেষ করে মাথা থেকে মস্তিষ্ক-স্ক্যানিং টুপি খুলে ফেলেছে।

এমিলি বলেছেন, “আমার ছেলেরা এখানে আসতে ভালবাসে। তারা এখানে রাখা সমস্ত খেলনাগুলোও ভালবাসে। বিনামূল্যে স্ন্যাকসও পায় তারা। তাই ওরা যতদিন চাইবে, ততদিন আমি এখানে আসব।”

তিনি নিজেও অবশ্য ততটাই আগ্রহী। এমিলির কথায়, “কেন আপনি এর অংশ হতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সাহায্য করতে চাইবেন না?”

উত্তরাধুনিক

Writer, Singer & Environmentalist

শিশুদের মস্তিষ্কে কী চলছে জানতে চেষ্টা করছে যে বিশেষ প্রকল্প

আপডেট সময়: ০৩:২০:৫৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ এপ্রিল ২০২৫

মস্তিষ্কের কার্যকলাপ স্ক্যান করার জন্য শিশুদের জন্য সেন্সর বোঝাই বিশেষ টুপি রয়েছে


ভিক্টোরিয়া গিল

দুই বছর বয়সের হেনরি, তার সামনে রাখা ‘আইপ্যাড’ দেখে একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ। আইপ্যাডের স্ক্রিনে ফুটে ওঠা ‘স্মাইলি ফেস’ দেখতে পেলেই সে তার আঙুল ছুঁইয়ে দিচ্ছে, আর মুহূর্তে সেটা কোনো না কোনো প্রাণীর কার্টুনে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। সেই কার্টুন আবার নাচও করে।

সাদা মাটা চোখে এই ‘গেম’ সাধারণ এবং একঘেয়ে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে, এটা একটা পরীক্ষা যার মাধ্যমে শিশুদের মস্তিষ্কে কোন ধরনের মৌলিক দক্ষতার বিকাশ ঘটছে, তা বোঝা সম্ভব।

ছোট্ট হেনরির মাথায় রয়েছে একটা ক্যাপ, যেখানে ‘সেন্সর’বোঝাই করা রয়েছে। ওই ক্যাপ থেকে যে তারগুলো বেরিয়ে এসেছে, সেটা গিয়ে জুড়েছে একটা বড়সড় ‘অ্যানালিটিকাল মেশিনারি’ বা বিশ্লেষণাত্মক যন্ত্রপাতির সঙ্গে।

হেনরি যখন ওই গেমটা খেলছে, সেই সময় তার মাথায় থাকা সেন্সর বোঝাই ক্যাপ স্ক্যান করছে ওই খুদের মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপকে। পাশাপাশি, কতটা ভালভাবে সে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তারও একটা চিত্র তৈরি করছে।

‘ইনহিবিটরি কন্ট্রোল'(বাধা নিয়ন্ত্রণ)-এর সঙ্গে সম্পর্কিত এই পরীক্ষা। এর মাধ্যমে ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বুঝতে চাইছেন শিশুদের মধ্যে এই সমস্ত ক্ষমতা কখন এবং কীভাবে বিকাশ করে। এই দক্ষতাগুলো একেবারে খুদে বাচ্চাদের ফোকাস করতে এবং শিখতে সাহায্য করে।

দক্ষতাগুলো যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেটা ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা জানেন। কিন্তু তারা যেটা এখনও জানেন না সেটা হলো এই দক্ষতা শিশুর মস্তিষ্কে কোন সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়।

মাত্র ছয় মাস থেকে শুরু করে পাঁচ বছর বয়সের শিশুদের মধ্যে এমন দক্ষতার বিকাশ হতে থাকে যা ভবিষ্যতে তাদের অ্যাকাডেমিক (পঠন-পাঠন) এবং সামাজিক ক্ষমতা আকার দেবে। এটাই ওই বয়সের শতশত শিশুর ক্ষেত্রে ‘ট্র্যাক’ করছেন বিজ্ঞানীরা।

তবে এই অগ্রণী গবেষণামূলক প্রকল্পের একটা বিশেষত্ব রয়েছে। কয়েক দশক ধরে চলা গবেষণার মাঝে চলছে আরও একটা গবেষণা। বর্তমানে এই প্রজেক্টে অংশগ্রহণকারী ৩০০ শিশুর মায়েরাও একসময় এর অংশ ছিলেন। ১৯৯০-এর দশকে ওই মায়েরা যখন নিজেরা শিশু ছিলেন, সেই সময় থেকেই তাদের স্বাস্থ্য ‘মনিটর’ করা হয়েছে গবেষণার অংশ হিসাবে।

ছবির উৎস,Kevin Church/BBC News

গবেষকদের ডিজাইন করা বিভিন্ন গেমের মাধ্যমে শিশুদের নানান দক্ষতা সম্পর্কে পরীক্ষা করা হয়।

জীবনব্যাপী তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে যা শিশুদের (যারা এখন এই গবেষণার অংশ) মস্তিষ্কের বিকাশ, তাদের অভিভাবকদের (যারা নিজেরাও এই গবেষণার অংশ ছিলেন) স্বাস্থ্য, অভিজ্ঞতা এবং জেনেটিক্সের মধ্যে থাকা ‘লিঙ্ক’ প্রকাশ করতে পারে।

প্রধান গবেষক ড. কার্লা হোম্বের মতে, শিশুদের বিকাশ সম্পর্কিত গবেষণার দিক থেকে, ওই বাচ্চাদের অভিভাবক সম্পর্কে ইতিমধ্যে এত সমৃদ্ধ তথ্য সংগ্রহে থাকার বিষয়টা এই প্রকল্পকে ‘একেবারে অনন্য’ করে তুলেছে।

“কোন সময় শিশুদের বিভিন্ন স্কিল (দক্ষতা) তৈরি হয় সেটা আমাদের জানা দরকার এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন শিশুদের ক্ষেত্রে তার বিকাশ কীভাবে হয়, সেটাও আমাদের জানা দরকার,” বলেছেন তিনি।

ড. হোম্বে ব্যাখ্যা করেছেন, যে সমস্ত শিশু স্কুল যাওয়া শুরু করার পর ‘স্ট্রাগল’ করে, সেই ‘স্ট্রাগল’ পরেও চলতে দেখা গিয়েছে।

তার কথায়, “এটা (স্ট্রাগল) তাদের যৌবন বয়স পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। তাই বাচ্চাদের বিকাশের এই পুরো সময়কালকে আমাদের ভালভাবে বোঝা দরকার, যাতে একেবারে কম বয়সেই আমরা শিশুদের সাপোর্ট করতে পারি।”

ছবির উৎস,Kevin Church/BBC News

খুদের সঙ্গে ব্যস্ত একজন গবেষণা সহকারী

গবেষণার সময়, অংশগ্রহণকারী শিশু এবং তাদের অভিভাবকদের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান ল্যাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে তারা (শিশুরা) নানান ধরণের বৈজ্ঞানিক ‘গেম’ খেলে, ধাঁধার সম্মুখীন হয় এবং সেই সময় তাদের মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ করা হয়।

অনেক শিশুরই ছয় মাস বয়সে, তিন বছরে এবং পাঁচ বছর বয়সে এমআরআই স্ক্যান করা হয়, যা তাদের ক্রমবিকাশমান মস্তিষ্কের প্রকৃত চিত্র তৈরিতে সাহায্য করে।

এমনই একটা খেলা নিয়ে ব্যাস্ত হেনরি। ওই খেলায় আইপ্যাডের স্ক্রিনে ‘স্মাইলি ফেস’ ফুটে উঠছে। সাধারণত স্ক্রিনের ডান দিকে বারেবারে ফুটে উঠছে ওই ‘স্মাইলি ফেস’। যেই মুহূর্তে হেনরি এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে, সেই মুহূর্তে ওই ‘স্মাইলি ফেস’ ফুটে উঠছে স্ক্রিনের অন্য প্রান্তে।

এই গবেষণায় সহকারী হিসাবে কাজ করছেন কারমেল ব্রফ। তিনি বলেছেন, “আমরা দেখতে চাইছি শুধুমাত্র ডানদিকে ট্যাপ করার তাগিদকে হেনরি কাটিয়ে উঠতে পারে কি না এবং তার পরিবর্তে স্মাইলি ফেস স্ক্রিনের কোন দিকে ফুটে উঠছে, সেটাও সে খুঁজে দেখছে কি না।”

ড. হোম্বে ব্যাখ্যা করেছেন, শিশুরা যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করে, তখন এই সমস্ত দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার কথায়, “ক্লাসরুমে (শ্রেণীকক্ষে) একজন শিশুর ফোকাস করাটা দরকার। তাদের মনোযোগ যেন কোনোভাবেই নষ্ট না হয়।”

পাশাপাশি, তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, “নতুন জিনিস শিখতে হলে, আমাদের পুরানো অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।”

ছবির উৎস,Kevin Church/BBC News

গবেষণায় অংশ নেওয়া এক শিশু

হেনরি’র মতোই অন্য একটা ঘরে খেলা করতে ব্যস্ত জ্যাকসন। তারও বয়স দুই বছর। এই খুদে যে খেলাটা খেলছে সেটা তার ‘ওয়ার্কিং মেমরি’ পরীক্ষা করার জন্য ‘ডিজাইন’ করা।

একজন গবেষণা সহকারী বিভিন্ন পাত্রে স্টিকার লাগাচ্ছেন এবং জ্যাকসনকে তা দেখার জন্য উৎসাহিত করছেন। এরপর ওই খুদেকে মনে করতে বলা হয় যে কোন পাত্রগুলোতে স্টিকার রয়েছে এবং কোনটাতে নেই।

প্রশ্ন জাগতেই পারে যে কোন বিষয়টা তাকে এই খেলায় উৎসাহিত করছে? উত্তরটা হলো, খেলা শেষ হলে সমস্ত স্টিকারের মালিক হবে জ্যাকসন।

ওয়ার্কিং মেমরি কী সে বিষয়ে বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন ড. হোম্বে। তার কথায়, “ওয়ার্কিং মেমরি হলো এমন একটা বিষয় যেক্ষেত্রে খুব সামান্য কিছু তথ্য আমাদের মাথায় রাখতে হয়। কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য বা কোনো কাজের জন্য- যেমন একটা ধাঁধার উত্তর খুঁজতে, বা দুই মিনিট আগে আমরা কোনো জিনিস কোথায় রেখেছি তা মনে রাখতে এটা (ওয়ার্কিং মেমরি) প্রয়োজন।”

“শিশুরা যখন অঙ্ক কষতে শেখে বা পড়তে শেখে তখন এই সমস্ত দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে। এগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতার বিল্ডিং ব্লক (ভিত্তি) বলে আমি মনে করি।”

এই গবেষণা শিশুর ভাষার বিকাশ এবং তার প্রক্রিয়াকরণের গতিও মূল্যায়ন করবে যে বাচ্চারা কত দ্রুত নতুন তথ্য গ্রহণ করতে পারে, তারও একটা পরিমাপ।

 

Kevin Church/BBC News

আপাতদৃষ্টিতে গেমগুলো সাধারণ এবং একঘেয়ে বলে মনে হলেও প্রতিটাই সযত্নে ডিজাইন করা এবং এর উদ্দেশ্য শিশুদের নানান ক্ষমতাকে পরীক্ষা করা।

‘দ্য চিলড্রেন অফ দ্য ‘৯০জ’-নামক এই গবেষণামূলক প্রকল্পের বয়স এখন ৩৫ বছর। প্রাথমিকভাবে শিশু স্বাস্থ্যের উপর ফোকাস করা এই প্রকল্প ১৯৯১ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী ১৪,৫০০ শিশুকে ট্র্যাক করেছে। ওবেসিটি, অটিজম এবং সাম্প্রতিককালে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর মহামারীর প্রভাব সম্পর্কে বিশেষ আলোকপাত করতে সক্ষম হয়েছে এই গবেষণা।

সেখান থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞানীদের কাছে উপলব্ধ করা হয়েছে। হাজার হাজার বৈজ্ঞানিক গবেষণামূলক প্রতিবেদনে এই প্রকল্পের বিষয়ে উদ্ধৃতও করা হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ ১৯৯০-এর দশকের শিশুদের ডায়েটের বিষয়ে একটা উল্লেখযোগ্য তথ্য উঠে এসেছে। খাওয়া নিয়ে শিশুরা ঝামেলা করলে অভিভাবকদের উদ্বেগ হয় বটে, কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের স্বাস্থ্য ও বিকাশের উপর এর কোনও স্থায়ী প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই বলে প্রমাণ মিলেছে ওই গবেষণায়।

শিশুদের ক্রমাগত স্বাস্থ্য পরীক্ষার কারণে অন্য বিষয়ও প্রকাশ্যে এসেছে ওই প্রকল্পের হাত ধরে। যেমন জানা গিয়েছে, পাঁচজন তরুণের মধ্যে একজনের ফ্যাটি লিভার রোগের লক্ষণ দেখা যায়। পাশাপাশি জানা গিয়েছে ৪০ জন তরুণের মধ্যে একজনের লিভারে ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে যা মূলত ওবেসিটি এবং অ্যালকোহল সেবনের কারণে হতে পারে। এই পরিস্থিতি যে সাধারণ এবং ডায়েটের মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করা যায়, সেই বিষয়েও আলোকপাত করেছে এই বিশেষ প্রজেক্ট।

এর হাত ধরে প্রায়শই নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক উদ্ঘাটন প্রকাশ্যে আসতে থাকে। যেমন গত মাসে জানা গিয়েছে যে সমস্ত শিশুদের ডায়েটে তৈলাক্ত মাছের অভাব ছিল, তারা কম মিশুক এবং দয়ালু।

নব্বইয়ের দশকের শিশুদের নিয়ে শুরু হওয়া এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এখন তাদের (যারা নব্বইয়ের দশকে অংশগ্রহণ করেছিল) সন্তানদের গঠনমূলক ক্ষমতা এবং মস্তিষ্কের বিকাশের দিকে বিশেষভাবে নজর দিচ্ছেন। স্কুলে যাওয়া শুরু না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক শিশুকে অনুসরণ করা হবে।

ছবির উৎস,Kevin Church/BBC News

নব্বইয়ের দশকে মায়ের সঙ্গে এমিলি

নব্বইয়ের দশকে এই প্রকল্পে অংশগ্রহণ করেছিলেন এমিলি। তিনিই বছর দুয়েকের হেনরির মা। এখন তার কোলে বসে ছোট্ট হেনরি গবেষণাকারীদের যত্নসহকারে তৈরি একটা ধাঁধা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে।

এমিলির কথায়, “আমরা দুজনেই জন্ম থেকেই এরই (এই গবেষণামূলক প্রকল্পের) একটা অংশ। শুরুর দিকে আমি এটা পছন্দ করতাম না। আমার মা আমাকে এর জন্য সাইন আপ করিয়ে ছিলেন। কিন্তু এখন আমার এটাকে দারুণ আকর্ষণীয় বলে মনে হয়।”

ড. হোম্বে জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে শিশুদের উন্নতিতে সহায়তা করাই এই গবেষণামূলক প্রকল্পের লক্ষ্য। কারণ তার মতে যখন বাচ্চারা স্কুলে যাওয়া শুরু করে ততদিনে শিশুদের মধ্যে অনেক কিছুই (দক্ষতা এবং অভ্যাস) “তৈরি হয়ে যায়”।

তিনি বলেছেন, “এটা এমন একটা মৌলিক ভিত্তি তৈরির কাজ যা আমাদের সঠিক সময়ে শিশুদের সাহায্য করবে।”

এদিকে, হেনরি এবং জ্যাকসন তাদের ধাঁধা এবং গেম শেষ করে মাথা থেকে মস্তিষ্ক-স্ক্যানিং টুপি খুলে ফেলেছে।

এমিলি বলেছেন, “আমার ছেলেরা এখানে আসতে ভালবাসে। তারা এখানে রাখা সমস্ত খেলনাগুলোও ভালবাসে। বিনামূল্যে স্ন্যাকসও পায় তারা। তাই ওরা যতদিন চাইবে, ততদিন আমি এখানে আসব।”

তিনি নিজেও অবশ্য ততটাই আগ্রহী। এমিলির কথায়, “কেন আপনি এর অংশ হতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সাহায্য করতে চাইবেন না?”