ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, প্রতীকী ছবিতে কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা
চন্দন কুমার জজওয়াড়ে, বিবিসি
ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত বেড়েই চলেছে। বৃহস্পতিবার দুই দেশই অপরের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর দাবি করেছে। বৃহস্পতিবারই ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং সর্বদলীয় বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকের পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু বলেছেন, 'অপারেশন সিন্দুর একটি চলমান অপারেশন'।
এই পরিস্থিতিতে দুটি দেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো কী অবস্থান নেবে, তা জানতে বিবিসি কয়েকজন বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলেছে।
'মিডল ইস্ট ইনসাইটস' নামের প্ল্যাটফর্মটির প্রতিষ্ঠাতা ড. শুভদা চৌধুরী বলেছেন, "ভারত ও পাকিস্তানের আশপাশের দেশগুলোয় আর্থ-সামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা মানুষের সংখ্যাই বেশি। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এরকম মানুষের সংখ্যাটা খুব বড়।"
তার কথায়, "কোভিড মহামারির পর থেকে এই সব দেশের অর্থনীতি ধুঁকছে, তাই এ ধরনের দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্বার্থ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।"
তিনি মনে করেন, ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলো চেষ্টা করবে যাতে এই উত্তেজনা তাড়াতাড়ি শেষ হয়।
ছবির উৎস,X/Shehbaz Sharif
পাকিস্তান আর বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে - ফাইল ছবি
বাংলাদেশ, নেপাল, ভূটান, শ্রীলঙ্কার অবস্থান কী?
আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মিয়ানমার ও ভুটানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা বিভিন্ন দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গত বছর বাংলাদেশে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনের পতন হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে নানা বিষয়ে ভারতের মতপার্থক্য রয়েছে।
কামার আগা মনে করেন, চীনও অনেক দেশে বিনিয়োগ করেছে, কিন্তু দেখা গেছে চীন ওইসব বিনিয়োগ থেকে বেশি লাভবান হয়েছে, ফলে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশ আবারও ভারতের কাছাকাছি চলে এসেছে।
শুভদা চৌধুরী বলছেন, "ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত যদি দীর্ঘদিন ধরে চলে, তাহলে বিভিন্ন প্রতিবেশীর ওপর এর একেক রকম প্রভাব পড়বে। যদি নেপালের দিকে তাকানো যায়, তাদের ৬০ শতাংশ বাণিজ্যই ভারতের সঙ্গে, যেটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
"বন্দর এবং বাণিজ্যের ব্যাপারে নেপাল সমস্যায় পড়বে। নেপাল ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে এবং তারা চাইবে এই সংঘাত যাতে দ্রুত শেষ হয়। তবে চীন এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নেপালের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে," বলছিলেন শুভদা চৌধুরী।
তার মতে, ভুটানের ক্ষেত্রেও একই ধরনের অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিতে পারে। কারণ ভারতের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেখানকার পর্যটন শিল্পও প্রভাবিত হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ও সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ধনঞ্জয় ত্রিপাঠি মনে করেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার উত্তেজনার বিষয়ে আফগানিস্তান ছাড়া বাকি দেশগুলো নিরপেক্ষ এবং নীরব থাকবে।
অধ্যাপক ত্রিপাঠির কথায়, "ভারত এই অঞ্চলের একটা বৃহৎ অর্থনীতির দেশ এবং ছোট ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের একাধিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। নেপাল ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোর কাছে পর্যটন থেকে আয় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং তারা চাইবে যে এই সংঘাত তাড়াতাড়ি শেষ হোক।"
নরেন্দ্র মোদী শ্রীলঙ্কায় সফর করে এসেছেন, উন্নত হয়েছে দুই দেশের সম্পর্ক - ফাইল ছবি
ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে এবং সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকটের সময় ভারত শ্রীলঙ্কাকে অনেক সহায়তা করেছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়েছিলেন।
ধনঞ্জয় ত্রিপাঠি মনে করেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার সময়ে এই দেশগুলো চাইবে যাতে আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমস্যার সমাধান করা হয়।
পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কামার আগাও এর সঙ্গে একমত বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে।
কামার আগা বলেন, "সংঘাত বাড়লে অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। কারণ যুদ্ধের সময় প্রতিরক্ষা ব্যয় বেড়ে যায় এবং তাতে কর্মসংস্থান হয় না। এদিকে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার পাকিস্তানের কিছুটা কাছাকাছি চলে এসেছে এবং তাদের বড় ক্ষতি হতে পারে। তবে বাংলাদেশে ভারতের বড়সড় বিনিয়োগ আছে।
ছবির উৎস,Getty Images
চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক সুবিদিত, আবার ভারতও তাদের বড় বাণিজ্যিক অংশীদার
চীনের অবস্থান
ভারত ও পাকিস্তানের চলমান উত্তেজনার মধ্যে অনেকেই চীনের অবস্থানের দিকে নজর রাখছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং ভারতের সঙ্গেও তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে।
চীন নিজেই এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে, আর তার ফলে চীনের নিজস্ব অর্থনীতিতেও সংকট দেখা দিচ্ছে।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে ভারতের বিমান হামলাকে 'দুঃখজনক' বলে অভিহিত করেছে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, তারা বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে 'উদ্বিগ্ন'।
ওই মুখপাত্র বলেন, "ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের প্রতিবেশী এবং সবসময় তাই থাকবে। তারা আবার চীনেরও প্রতিবেশী। চীন সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা করে।"
"উভয় দেশকে শান্ত থাকার, সংযম বজায় রাখার এবং পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে, এমন পদক্ষেপ এড়িয়ে" চলতে বলেন ওই মুখপাত্র।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীন কখনোই চাইবে না পাকিস্তান অস্থিতিশীল থাকুক, যাতে তাদের কোটি কোটি বিনিয়োগ নষ্ট হয়।
পাকিস্তানে ২০০৫ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন।
এ ছাড়া চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) এবং বেল্ট অ্যান্ড রোডের আওতায় পাকিস্তানে বড় ধরনের বিনিয়োগ করছে চীন।
তবে পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কামার আগা বলছেন, "চীন চায় যে এই সংঘাত চলতে থাকুক, তাদের পক্ষে এটা ভালো। চীনের সাম্প্রতিক কিছু বিবৃতিও তাই বলছে। সংঘাত বাধলে পাকিস্তানের কাছে অস্ত্র বিক্রির সুযোগ পাবে চীন।"