০৯:১৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

চিনুয়া আচেবে: আফ্রিকার আলোকিত হৃদয়

  • আপডেট সময়: ০৬:৩৪:১৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১১ মে ২০২৫
  • 18

চিনুয়া আচেবে


অংকুর সাহা

বৃহস্পতিবার ২১ মার্চ, ২০১৩ আমেরিকার বস্টন শহরে পরলোকে গমন করেছিলেন আফ্রিকার এক প্রধান এবং জনপ্রিয় লেখক চিনুয়া আচেবে। রবীন্দ্রনাথ যেরকম বাংলা ও ভারতীয় সাহিত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে, আফ্রিকার সাহিত্যের জগতে সেই দুরূহ কাজটি করেছেন চিনুয়া। মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তাঁর বন্ধু ও অনুরাগী দক্ষিণ আফ্রিকার অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান নেলসন ম্যান্ডেলা জানালেন, “There was a writer named Chinua Achebe, in whose company prison walls fall down.”

অ্যালবার্ট চিনুয়ালুমোগু আচেবের জন্ম নাইজিরিয়ায়, ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর। তাঁর বাবার নাম আইশায়া, মায়ের নাম জ্যানেট। তিনি ধর্মে খ্রিস্টান, জন্মস্থান দক্ষিণপূর্ব নাইজিরিয়ার আধাশহর ওসিডি; তাঁর মাতৃভাষা ইগবো। সেই ভাষায় নামটি অর্থবহ; ‘চি’ অর্থাৎ “ঈশ্বর আমার হয়ে যুদ্ধ করুন’; ‘আচেবে’ হল ‘আনিচেবে’ শব্দের সংক্ষিপ্তকরণ, যার অর্থ “ধরিত্রীমাতা অর্থাৎ ‘আনি’ আমাকে রক্ষা করুন”। নাইজিরিয়া তখন ব্রিটিশ উপনিবেশ — রাজভক্ত ধর্মপ্রচারক আইশায়া ছেলের নাম রেখেছিলেন — “অ্যালবার্ট” — মহারানি ভিক্টোরিয়ার স্বামীর নামে। সেই সন্তান যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শুরু করলেন, তখন সারা মহাদেশে জাতীয়তাবাদের হাওয়া, অতএব বিদেশি নামটি বাদ পড়ল এবং স্থানীয় নামটি থাকল, যদিও সংক্ষিপ্ত হয়ে দাঁড়াল ‘চিনুয়া’।

ইংরেজি ভাষায় তখন আফ্রিকা বিষয়ক প্রধান গ্রন্থ জোসেফ কনরাড (১৮৫৭-১৯২৪) রচিত ‘অন্ধকারের হৃদয়’ (“Heart of Darkness”; প্রকাশ: ১৮৯৯); পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে প্রকাশিত হল আইরিশ লেখক জয়েস কেরির (Joyce Cary, ১৮৮৮-১৯৫৭) নাইজিরিয়ার পটভূমিতে রচিত উপন্যাস “মিস্টার জনসন” (“Mister Johnson”)। ধন্য ধন্য রব উঠল পশ্চিমের দেশগুলিতে – টাইম ম্যাগাজিন কিছু না জেনেই লিখলো — “আফ্রিকার বিষয়ে রচিত সর্বকালের সেরা উপন্যাস”। চিনুয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি গ্রন্থই অবশ্যপাঠ্য – তাঁর হৃদয়ে ঘৃণা এবং ধিক্কার। দুটি গ্রন্থেই আফ্রিকা বর্ণিত হয়েছে অসভ্য এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ হিসেবে; দুই লেখকেরই কোনো ধারণা নেই আফ্রিকার ভূমিজ সংস্কৃতি বিষয়ে। তাঁদের ভঙ্গি ঘৃণা, অশ্রদ্ধা, অভক্তি ও অপমানের; কাহিনিতে স্থানীয় চরিত্রগুলিও হাবাগোবা, অলস, বোকা ও অশিক্ষিত। অথচ আফ্রিকার মুখর (oral) সংস্কৃতি হাজার হাজার বছরের পুরানো – উপকথায়, রূপকথায়, কাব্যে, পুরাণে উজ্জ্বল। ধূর্ত, লোভী ব্রিটিশেরা সারা পৃথিবীকে বোঝাতে চাইল আফ্রিকা আদিম ও বন্য – সেখানে সভ্যতার সূচনা ঘটেছে ব্রিটিশরা তার মাটিতে পা দেবার পর এবং পশুর সঙ্গে আফ্রিকার মানুষের তফাৎ অল্প।

এইরকম এক বিষাদময় পটভূমিতে চিনুয়ার সাহিত্যচর্চায় হাতেখড়ি; তাঁর রচনা হবে সৎ, সুন্দর, গভীর ও মননশীল – সেখানে আফ্রিকা তার দোষ-গুণ, আলো-অন্ধকার সমেত উপস্থিত থাকবে; থাকবে মানুষ তার ধর্ম, সংস্কার, সমাজ, পরিবেশ সমেত – কোনো পশ্চিমি পক্ষপাত বা পূর্বধারণা ছাড়াই। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম উপন্যাস “সবকিছু ভেঙে যায়” (“Things Fall Apart”); নামটি এসেছে উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস-এর (১৮৬৫-১৯৩৯) “দ্বিতীয় আবির্ভাব” (“The Second Coming”) কবিতার একটি পঙ্‌ক্তি থেকে—

সবকিছু ভেঙে যায়; কেন্দ্র ধরে রাখতে অপারগ;
নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়ে কেবলই সমগ্র দুনিয়ায়।

পরের উপন্যাস “আর কোনো স্বস্তি নেই” (“No Longer At Ease”) প্রকাশিত হল ১৯৬০ সালে। এই উপন্যাসের নামটি এসেছে টি. এস. এলিয়টের (১৮৮৮-১৯৬৫) “ঋষিদের যাত্রা” (“The Journey of the Magi”) কবিতার থেকে—

দলে দলে ফিরে আসি নিজের ভূমিতে আর রাজার শাসনে,
আর কোনো স্বস্তি নেই, এখানে প্রাচীন যত প্রথার বাঁধনে,
সেখানে অচেনা লোকে একান্তে আঁকড়ে ধরে তাদের ঈশ্বর।

তৃতীয় উপন্যাস “ঈশ্বরের তীর” (“The Arrow of God”) এর প্রকাশ ১৯৬৪ সালে। নামটির উৎস চিনুয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ক্রিস্টোফার ওকিগ্‌বোর (১৯৩২-১৯৬৭) একটি বিখ্যাত কবিতার পঙ্‌ক্তি—

জাদুপাখিরা ডানায় বয়ে আনে অলৌকিক বিদ্যুতের ঝলক….
আলোকের দেউড়িতে কাঁপে ঈশ্বরের তীর,
মৃত্যুর নৃত্যের তালে তালে সংহারের ঢাক বাজে….

[এই বন্ধুর অকালমৃত্যুতে তিনি একটি আনন্দবিধুর কবিতাও লিখেছিলেন। সেটিও এই নিবন্ধে সংকলিত হয়েছে।]

তিনটি মহতী উপন্যাস মিলে বিশাল ক্যানভাসে এক আফ্রিকার ট্রিলজি — নাইজিরিয়ার উমুয়োফিয়া গ্রামের একটি পরিবারের তিন প্রজন্মের কাহিনি। সাহিত্য সমালোচক ডেভিড ক্যারল লিখলেন, “with great skill, Achebe in these novels of traditional life combines the role of novelist and anthropologist, synthesising them in a new kind of fiction. This is where his genius lies.” লেখক তাঁর মাতৃভাষায় উপন্যাসগুলি না লিখে লিখলেন ইংরেজিতে, কিন্তু, “I feel that the English language will be able to carry the weight of African experience. But it will have to be a new English, still in communion with its ancestral home, but altered to suit its African surroundings.” এই একই পথে হেঁটেছেন এশিয়া ও আফ্রিকার অসংখ্য লেখক এবং সমৃদ্ধ হয়েছে ইংরেজি ভাষা। চিনুয়ার উপন্যাসগুলি শুরু করেছে আফ্রিকার ভূমিজ কথাসাহিত্যের একটি নতুন ধারার, বিক্রি হয়েছে লক্ষ লক্ষ কপি এবং অনূদিত হয়েছে পঞ্চাশটির বেশি ভাষায়।

গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের পাশাপাশি চলেছে চিনুয়ার অন্তরঙ্গতায় রচিত কবিতার ক্ষীণ ধারাটি; সেখানে উপজীব্য আফ্রিকার বৈচিত্র্যময় নানা বিষয় — ভয়াবহ বায়াফ্রার যুদ্ধ থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত সম্পর্কের স্মৃতিচারণা। একটিই মাত্র কাব্যগ্রন্থ ছিল তাঁর – সত্তরের দশকের প্রথম দিকে প্রকাশিত “বায়াফ্রায় বড়দিন ও অন্যান্য কবিতা” (প্রকাশক – অ্যাংকর-ডাব্‌ল্‌ডে, ন্যু ইয়র্ক)। প্রথম কমনওয়েলথ কবিতা পুরস্কারে ভূষিত হয় গ্রন্থটি, কিন্তু তার পরে তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখা যায় না প্রকাশকদের। অথচ প্রকাশিত হয়ে চলেছে উপন্যাসের পর উপন্যাস। অল্প সংখ্যাতে হলেও নিয়মিত কবিতা লেখা চালিয়ে যান তিনি।

এইভাবে কেটে যায় পঁচিশ বছরের বেশি। মার্কিন আলোকচিত্রশিল্পী রবার্ট লিয়ন্‌স (১৯৫৪-) ১৯৯৮ সালে “অন্য আফ্রিকা’ নামে একটি চিত্র প্রদর্শনীর পরিকল্পনা করেছিলেন – তাতে ছিল লিয়ন্‌সের তোলা আফ্রিকার ছবি – তার প্রকৃতির উদ্দাম বিস্তার, তার মানুষ ও পশুপাখি, তার স্বকীয়তা এবং অগ্রগতি। সেই উপলক্ষ্যে চিনুয়া লেখেন “জ্ঞান হরণ করে” নামে একটি কবিতা – সেটি প্রদর্শনীতে রাখা হয় এবং তার সঙ্গে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ, ওই একই নামের একটি কফি-টেবিল বইতে সংকলিত হয়। তার পরেই ঘটেছিল বিপর্যয় – দুবছর ধরে প্রদর্শনীটি ভ্রমণ করেছিল আমেরিকার শহর থেকে শহরে – কিন্তু দর্শকেরা প্রদর্শনীর স্মারকগ্রন্থ থেকে চিনুয়ার কবিতার পাতাটি চুরি করে ছিঁড়ে নিয়ে পালাতে শুরু করলেন। কবি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রসিকতায় জানিয়েছেন যে, প্রদর্শনীর ক্ষতি হলেও, তার ফলে প্রকাশকেরা উপলব্ধি করলেন তাঁর কবিতার পাঠক বর্তমান এবং তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করলে লাভের সম্ভাবনা। আবার শুরু হল তাঁর কবিতার প্রকাশ। ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে র‍্যান্ডম হাউস প্রকাশ করলেন তাঁর “কবিতা সমগ্র”। সেখান থেকে কিছু কবিতার নির্বাচন করে বাংলা অনুবাদ করেছি আমি।

আফ্রিকার সাহিত্যচর্চায় চিনুয়া আচেবের প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী? শিক্ষাবিদ ও সাহিত্য সমালোচক কোয়ামে অ্যান্‌থনি আপিয়া-র (১৯৫৪- ) মতে, “It will be impossible to say how ‘Things Fall Apart’ influenced African writing. It would be like asking how Shakespeare influenced English writers or Pushkin influenced Russians. Chinua Achebe did not only play the game, he invented it.”

চিনুয়া আচেবে, নাইজিরিয়া, (১৯৩০ – ২০১৩)

জ্ঞান হরণ করে

জ্ঞান হরণ করে আমাদের বিস্ময়।
যদি না সে আদিম নিশীথের
ভয়ংকর আলখাল্লা ছিঁড়ে চুরি করে আনতো
কুকুরের মাথায় শিং গজানোর
গোপন রহস্য এবং মুরগির গেরস্ত ঠোঁটে
রাতারাতি ভরে দিতো বিদ্রোহের
অদম্য ভাবনা; যদি না আমাদের মনে
ভরসা দিতে। প্রতিদিন সকাল হবে
এবং সূর্যের আলো এসে মুছে দেবে
রাতের দত্যিদানোর উদ্ভট মূর্তিগুলি—
প্রতিটি ভোরকে মালা দিয়ে
অভ্যর্থনা করা হবে শহরের দেউড়িতে
এবং ঢাকঢোল বাজিয়ে রাজকীয়ভাবে
নিয়ে আসা হবে অবাক পৃথিবীর
ঝলমলে উৎসবে।

একদিন

কালবোশেখির তুমুল ঝড়ের পর,
পাখিরা ঘরে ফেরে চষা মাঠ ধরে
প্রভাতসঙ্গীতের বীজ বপন করতে করতে
যদিও তখন পেরিয়ে গেছে দুপুর,
তাদের উজ্জ্বল স্বরে চারপাশে গজাচ্ছে সবুজ
পৃথিবীর আর কাউকে রুখোসুখো
ধুলো মাখা হাওয়ায় শুকিয়ে মরতে হবে না।

কিন্তু আমার কাছে
সব উৎসবই মনগড়া কাল্পনিক;
ঋতু পরিবর্তনের ফলে
সজীব হয়ে উঠবে এনসুক্কার পাহাড়ি অঞ্চল
কয়েক ঘন্টার জন্যে হলেও;
আমার আকাশে কোন ঝড় নেই—
নেই কোন মুক্তির গানও।

ওকিগ্‌বোর জন্যে শোকগাথা

আমরা কাকে খুঁজে বেড়াই?
আমরা কাকে খুঁজে বেড়াই?
ওকিগ্‌বোকে খুঁজে বেড়াই!
নোজেমোলিজো!

সে গেছে কাঠ কাটতে, ফিরে আসতে দাও।
সে গেছে জল আনতে, ফিরে আসতে দাও।
সে গেছে দূরের হাটে, ফিরে আসতে দাও।
ওকিগ্‌বোকে খুঁজে বেড়াই।
নোজোয়ালিজো!

আমরা কাকে খুঁজে বেড়াই?
আমরা কাকে খুঁজে বেড়াই?
ওকিগ্‌বোকে খুঁজে বেড়াই!
নোজোমালিজো!

সে গেছে কাঠ কাটতে, উগ্‌বোকো তাকে টেনে নিও না।
সে গেছে নদীর পারে, আইই তাকে গিলে ফেলো না।
সে গেছে দূরের হাটে, বাজারের কালবোশেখি তাকে
কাছে টেনো না!
সে গেছে লড়াই করতে ওগ্‌বোনুকে তার
পথ ছেড়ে দাও।
ওকিগ্‌বোকে খুঁজে বেড়াই!
নোজোমালিজো!

সে নাচের মুদ্রায় ঘরে ফেরে, কিন্তু নাচার ফুরসত কই?
সে যুদ্ধ বগলে ঘরে ফেরে, কিন্তু এখানে লড়ার লোক কই?
আমরা বার বার বলি, তুমিই পারো
সবচেয়ে যোগ্য লোক তুমি
ওকিগ্‌বোকেই ডাকি আমরা!
নোজোমালিজো!

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাচ দেখো, কিভাবে তা শমে এসে থামে
যুদ্ধকে দেখো, কিভাবে দাবানল ছড়িয়ে পড়ে
কিন্তু প্রধান নাচিয়েরই যে চারদিকে কোথাও পাত্তা নেই
যুদ্ধের সাহসী লড়াকুও কেটে পড়েছে।
দেখতে পাচ্ছো না বারবার ডেকে মরছি তাকে
এ কাজ অন্য কারুর দ্বারা সম্ভব মনে হয় কি?
ওকিগ্‌বোকেই ডাকি আমরা!
নোজোমালিজো!
হঠাৎ নাচ শেষ হয়
ভরদুপুরে নাচ শেষ করে নৃত্যময় আত্মারা মিলিয়ে যান
বৃষ্টি এসে ভেজায় বাদকদের, জলে ঢোল সপসপে!
ভেঙে গেছে বাঁশি, কিন্তু কমেনি বাজিয়েদের উৎসাহ
পায়ের সঙ্গে তাল মেলানো সঙ্গীতের ভান্ডটি(??)
ভেঙে চৌচির
আমার রক্তধারার সাহসী পুরুষ!
ইগবো দেশের সাহসী মানুষ!
রক্তের নদী পার হও সাহসী মানুষ!
ধনী মানুষদের প্রাসাদে মৃত আত্মাদের ঘোরাফেরা
তোমাকেই ডাকি আমরা ওকিগবো!
নোজোমালিজো!

টীকা—

— মূল কবিতা ইগ্‌বো ভাষায় লেখা। কবি ক্রিস্টোফার ওকিগ্‌বোর (১৯৩২-৬৭) স্মৃতির উদ্দেশে। ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ইফিআনি মেনকিটি। কবিতাটি শেষকৃত্যের আনা শব আগলে রেখে শোকের বহিঃপ্রকাশ। ইগ্‌বোদের দেশে, বিশেষ করে কমবয়েসি মানুষের মৃত্যু হলে তার আত্মীয়স্বজন খেলার ছলে তাকে সারা গ্রাম খুঁজে বেড়ায়; জোরগলায় বলে, কি ছেলেমানুষ, লুকোচুরি খেলছে আমাদের সঙ্গে।

— উগ্‌বোকো- জঙ্গলের দেবতা; আইই- জলের দেবতা; ওগনোবুকে – বিদ্বেষ ও ধ্বংসের প্রতীক।

— নোজোমালিজো – লুকোচুরি খেলা; “জো”- লুকানো; মালি-খেলার ছলে। মূল শব্দটি রেখে দিয়েছি আফ্রিকার ধ্বনিমাধুর্য এবং শব্দময় পুনরাবৃত্তিকে ধরে রাখার জন্যে।

বায়াফ্রা, ১৯৬৯

বায়াফ্রা যখন প্রথমবার এলো,
আমরা জানলাম, সে শক্ত কাঠে খোদাই
দৈত্যের মতন বিশাল মূর্তি।

ধুরন্ধর পেটুক উইপোকারা
দলবেঁধে জাঁকিয়ে বসে তার গায়ে
খেতে শুরু করে বিশাল মাচানে দাঁড়ানো পা থেকে
আর পৌঁছে যায় হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত,
ফাঁপা কাকতাড়ুয়া বানিয়ে দেয় তাকে।

রৌদ্রস্নাত সমুদ্রের ঢেউ এসে
সজোরে আঘাত করে তার টলোমলো পায়ে
মুখ থুবড়ে সে লক্ষ লক্ষ টুকরোয় ভেঙে পড়লে
আনন্দে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়
অন্য শীতল উপকূলে — তারপর ম্যাপ আঁকিয়েরা
দৈত্যের কথা ভুলে গিয়ে
বেলাভূমির মানচিত্র বানায়।

আমাদের প্রজন্মে সে ফিরে আসে
ব্যথা ও বারুদের কড়া দুর্গন্ধ
গায়ে মেখে। এবার পাঁচশো বছরের
যুদ্ধে জেতার সাহসে ভর করে
তাকে ভাঙতে লোকলস্কর সমেত
আসছে বিদেশিরা, তেল বিক্রির নবীন অর্থে
তারা পুষ্ট, এখন তোমার কৃষ্ণকায় কন্ঠ
চেপে ধরেছে তারা – রক্ত ও জীবনরস
প্রবাহিত হতে দিচ্ছে না
ফেঁপে ওঠা হাত পায়ে।

এবার আফ্রিকার জীবনে কি
তৃতীয় সুযোগ আসবে?

যুদ্ধের পর

যুদ্ধের শেষ হবার পর
মানুষের জীবন চেষ্টা করে যায়
সামান্যতম হলেও স্বাভাবিকতা ফিরে পাবার
যেমন আঙুরলতাটি জড়িয়ে যায়<ব্র> বৃক্ষশাখার ফাঁক দিয়ে; তার বুভুক্ষু শিকড়
ভাঙা কাচ আর ধ্বংসাবশেষ অগ্রাহ্য করে
খাদ্যরস খোঁজে।

অন্যসময় যাদেরকে দেখলে গাল দিতাম
এখন তাদের দেখা পেলে ঘরে ডাকি
বসতে জিরোতে বলি আমাদের টেবিলে….
যেমন ইলেকট্রিক মিটার দেখে
ইনসপেক্টার বাবুটি আমার হাতে
বিল ধরিয়ে দিয়েও
হাসিমুখ দেখলো আমার
দরজার সামনে
সমস্যাসংকুল গম্ভীর মুখ নয়।

যুদ্ধের পর আমরা
আমাদের হারিয়ে যাওয়া স্রোতকে ফেলে
বর্তমানের অস্থির তরঙ্গে ভাসা
জলজ জঞ্জালকেও আঁকড়ে ধরি….
অসুস্থ নর্তকীরা সেরে ওঠার আগেই
আবার যোগ দেয় নাচের বৃত্তে
আমাদের পায়ে শক্তি নেই
আগের মত
কিন্তু
ইচ্ছে রয়ে গেছে
অর্ধেক ভুলে যাওয়া
এলোমেলো পদক্ষেপে।
বছরের পর বছর
কাঁধে চেপে বসা মৃত্যুর আর
শেষ মুহূর্তের টলমলে সাময়িক রেহাইএর পর
আমরা আনন্দে ছুঁড়ে ফেলে দিই ভয়ডর
আমাদের বিপন্ন বিজয়গুলিকে জড়ো করি
এক অগভীর কবরে আর পালাই
একই অনুশোচনায় যেভাবে
ঘরে ফিরেছিলাম ভৌতিক আড়ম্বরে।

বড়দিন ১৯৭১

বিমান হানা

ঝড়ের বেগে তারা আসে
মৃত্যুর বিহঙ্গ
সোভিয়েত প্রযুক্তির শয়তানি অরণ্য থেকে

বন্ধুর বাড়ি যাবার জন্যে
রাস্তা পার হচ্ছিল লোকটা
কিন্তু দেরি হল সামান্য।
বন্ধু কেটে দুফালি
তার হৃদয় জুড়ে এখন অন্য দুশ্চিন্তা
দ্বিপ্রহরে বন্ধুকে সাদর সম্ভাষণ করা নয়।

তথ্যসূত্র: — “Chinua Achebe: Collected Poems”; Random House; 2004.

 

উত্তরাধুনিক

Writer, Singer & Environmentalist

চিনুয়া আচেবে: আফ্রিকার আলোকিত হৃদয়

আপডেট সময়: ০৬:৩৪:১৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১১ মে ২০২৫

চিনুয়া আচেবে


অংকুর সাহা

বৃহস্পতিবার ২১ মার্চ, ২০১৩ আমেরিকার বস্টন শহরে পরলোকে গমন করেছিলেন আফ্রিকার এক প্রধান এবং জনপ্রিয় লেখক চিনুয়া আচেবে। রবীন্দ্রনাথ যেরকম বাংলা ও ভারতীয় সাহিত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে, আফ্রিকার সাহিত্যের জগতে সেই দুরূহ কাজটি করেছেন চিনুয়া। মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তাঁর বন্ধু ও অনুরাগী দক্ষিণ আফ্রিকার অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান নেলসন ম্যান্ডেলা জানালেন, “There was a writer named Chinua Achebe, in whose company prison walls fall down.”

অ্যালবার্ট চিনুয়ালুমোগু আচেবের জন্ম নাইজিরিয়ায়, ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর। তাঁর বাবার নাম আইশায়া, মায়ের নাম জ্যানেট। তিনি ধর্মে খ্রিস্টান, জন্মস্থান দক্ষিণপূর্ব নাইজিরিয়ার আধাশহর ওসিডি; তাঁর মাতৃভাষা ইগবো। সেই ভাষায় নামটি অর্থবহ; ‘চি’ অর্থাৎ “ঈশ্বর আমার হয়ে যুদ্ধ করুন’; ‘আচেবে’ হল ‘আনিচেবে’ শব্দের সংক্ষিপ্তকরণ, যার অর্থ “ধরিত্রীমাতা অর্থাৎ ‘আনি’ আমাকে রক্ষা করুন”। নাইজিরিয়া তখন ব্রিটিশ উপনিবেশ — রাজভক্ত ধর্মপ্রচারক আইশায়া ছেলের নাম রেখেছিলেন — “অ্যালবার্ট” — মহারানি ভিক্টোরিয়ার স্বামীর নামে। সেই সন্তান যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শুরু করলেন, তখন সারা মহাদেশে জাতীয়তাবাদের হাওয়া, অতএব বিদেশি নামটি বাদ পড়ল এবং স্থানীয় নামটি থাকল, যদিও সংক্ষিপ্ত হয়ে দাঁড়াল ‘চিনুয়া’।

ইংরেজি ভাষায় তখন আফ্রিকা বিষয়ক প্রধান গ্রন্থ জোসেফ কনরাড (১৮৫৭-১৯২৪) রচিত ‘অন্ধকারের হৃদয়’ (“Heart of Darkness”; প্রকাশ: ১৮৯৯); পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে প্রকাশিত হল আইরিশ লেখক জয়েস কেরির (Joyce Cary, ১৮৮৮-১৯৫৭) নাইজিরিয়ার পটভূমিতে রচিত উপন্যাস “মিস্টার জনসন” (“Mister Johnson”)। ধন্য ধন্য রব উঠল পশ্চিমের দেশগুলিতে – টাইম ম্যাগাজিন কিছু না জেনেই লিখলো — “আফ্রিকার বিষয়ে রচিত সর্বকালের সেরা উপন্যাস”। চিনুয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি গ্রন্থই অবশ্যপাঠ্য – তাঁর হৃদয়ে ঘৃণা এবং ধিক্কার। দুটি গ্রন্থেই আফ্রিকা বর্ণিত হয়েছে অসভ্য এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ হিসেবে; দুই লেখকেরই কোনো ধারণা নেই আফ্রিকার ভূমিজ সংস্কৃতি বিষয়ে। তাঁদের ভঙ্গি ঘৃণা, অশ্রদ্ধা, অভক্তি ও অপমানের; কাহিনিতে স্থানীয় চরিত্রগুলিও হাবাগোবা, অলস, বোকা ও অশিক্ষিত। অথচ আফ্রিকার মুখর (oral) সংস্কৃতি হাজার হাজার বছরের পুরানো – উপকথায়, রূপকথায়, কাব্যে, পুরাণে উজ্জ্বল। ধূর্ত, লোভী ব্রিটিশেরা সারা পৃথিবীকে বোঝাতে চাইল আফ্রিকা আদিম ও বন্য – সেখানে সভ্যতার সূচনা ঘটেছে ব্রিটিশরা তার মাটিতে পা দেবার পর এবং পশুর সঙ্গে আফ্রিকার মানুষের তফাৎ অল্প।

এইরকম এক বিষাদময় পটভূমিতে চিনুয়ার সাহিত্যচর্চায় হাতেখড়ি; তাঁর রচনা হবে সৎ, সুন্দর, গভীর ও মননশীল – সেখানে আফ্রিকা তার দোষ-গুণ, আলো-অন্ধকার সমেত উপস্থিত থাকবে; থাকবে মানুষ তার ধর্ম, সংস্কার, সমাজ, পরিবেশ সমেত – কোনো পশ্চিমি পক্ষপাত বা পূর্বধারণা ছাড়াই। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম উপন্যাস “সবকিছু ভেঙে যায়” (“Things Fall Apart”); নামটি এসেছে উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস-এর (১৮৬৫-১৯৩৯) “দ্বিতীয় আবির্ভাব” (“The Second Coming”) কবিতার একটি পঙ্‌ক্তি থেকে—

সবকিছু ভেঙে যায়; কেন্দ্র ধরে রাখতে অপারগ;
নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়ে কেবলই সমগ্র দুনিয়ায়।

পরের উপন্যাস “আর কোনো স্বস্তি নেই” (“No Longer At Ease”) প্রকাশিত হল ১৯৬০ সালে। এই উপন্যাসের নামটি এসেছে টি. এস. এলিয়টের (১৮৮৮-১৯৬৫) “ঋষিদের যাত্রা” (“The Journey of the Magi”) কবিতার থেকে—

দলে দলে ফিরে আসি নিজের ভূমিতে আর রাজার শাসনে,
আর কোনো স্বস্তি নেই, এখানে প্রাচীন যত প্রথার বাঁধনে,
সেখানে অচেনা লোকে একান্তে আঁকড়ে ধরে তাদের ঈশ্বর।

তৃতীয় উপন্যাস “ঈশ্বরের তীর” (“The Arrow of God”) এর প্রকাশ ১৯৬৪ সালে। নামটির উৎস চিনুয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ক্রিস্টোফার ওকিগ্‌বোর (১৯৩২-১৯৬৭) একটি বিখ্যাত কবিতার পঙ্‌ক্তি—

জাদুপাখিরা ডানায় বয়ে আনে অলৌকিক বিদ্যুতের ঝলক….
আলোকের দেউড়িতে কাঁপে ঈশ্বরের তীর,
মৃত্যুর নৃত্যের তালে তালে সংহারের ঢাক বাজে….

[এই বন্ধুর অকালমৃত্যুতে তিনি একটি আনন্দবিধুর কবিতাও লিখেছিলেন। সেটিও এই নিবন্ধে সংকলিত হয়েছে।]

তিনটি মহতী উপন্যাস মিলে বিশাল ক্যানভাসে এক আফ্রিকার ট্রিলজি — নাইজিরিয়ার উমুয়োফিয়া গ্রামের একটি পরিবারের তিন প্রজন্মের কাহিনি। সাহিত্য সমালোচক ডেভিড ক্যারল লিখলেন, “with great skill, Achebe in these novels of traditional life combines the role of novelist and anthropologist, synthesising them in a new kind of fiction. This is where his genius lies.” লেখক তাঁর মাতৃভাষায় উপন্যাসগুলি না লিখে লিখলেন ইংরেজিতে, কিন্তু, “I feel that the English language will be able to carry the weight of African experience. But it will have to be a new English, still in communion with its ancestral home, but altered to suit its African surroundings.” এই একই পথে হেঁটেছেন এশিয়া ও আফ্রিকার অসংখ্য লেখক এবং সমৃদ্ধ হয়েছে ইংরেজি ভাষা। চিনুয়ার উপন্যাসগুলি শুরু করেছে আফ্রিকার ভূমিজ কথাসাহিত্যের একটি নতুন ধারার, বিক্রি হয়েছে লক্ষ লক্ষ কপি এবং অনূদিত হয়েছে পঞ্চাশটির বেশি ভাষায়।

গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের পাশাপাশি চলেছে চিনুয়ার অন্তরঙ্গতায় রচিত কবিতার ক্ষীণ ধারাটি; সেখানে উপজীব্য আফ্রিকার বৈচিত্র্যময় নানা বিষয় — ভয়াবহ বায়াফ্রার যুদ্ধ থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত সম্পর্কের স্মৃতিচারণা। একটিই মাত্র কাব্যগ্রন্থ ছিল তাঁর – সত্তরের দশকের প্রথম দিকে প্রকাশিত “বায়াফ্রায় বড়দিন ও অন্যান্য কবিতা” (প্রকাশক – অ্যাংকর-ডাব্‌ল্‌ডে, ন্যু ইয়র্ক)। প্রথম কমনওয়েলথ কবিতা পুরস্কারে ভূষিত হয় গ্রন্থটি, কিন্তু তার পরে তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখা যায় না প্রকাশকদের। অথচ প্রকাশিত হয়ে চলেছে উপন্যাসের পর উপন্যাস। অল্প সংখ্যাতে হলেও নিয়মিত কবিতা লেখা চালিয়ে যান তিনি।

এইভাবে কেটে যায় পঁচিশ বছরের বেশি। মার্কিন আলোকচিত্রশিল্পী রবার্ট লিয়ন্‌স (১৯৫৪-) ১৯৯৮ সালে “অন্য আফ্রিকা’ নামে একটি চিত্র প্রদর্শনীর পরিকল্পনা করেছিলেন – তাতে ছিল লিয়ন্‌সের তোলা আফ্রিকার ছবি – তার প্রকৃতির উদ্দাম বিস্তার, তার মানুষ ও পশুপাখি, তার স্বকীয়তা এবং অগ্রগতি। সেই উপলক্ষ্যে চিনুয়া লেখেন “জ্ঞান হরণ করে” নামে একটি কবিতা – সেটি প্রদর্শনীতে রাখা হয় এবং তার সঙ্গে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ, ওই একই নামের একটি কফি-টেবিল বইতে সংকলিত হয়। তার পরেই ঘটেছিল বিপর্যয় – দুবছর ধরে প্রদর্শনীটি ভ্রমণ করেছিল আমেরিকার শহর থেকে শহরে – কিন্তু দর্শকেরা প্রদর্শনীর স্মারকগ্রন্থ থেকে চিনুয়ার কবিতার পাতাটি চুরি করে ছিঁড়ে নিয়ে পালাতে শুরু করলেন। কবি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রসিকতায় জানিয়েছেন যে, প্রদর্শনীর ক্ষতি হলেও, তার ফলে প্রকাশকেরা উপলব্ধি করলেন তাঁর কবিতার পাঠক বর্তমান এবং তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করলে লাভের সম্ভাবনা। আবার শুরু হল তাঁর কবিতার প্রকাশ। ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে র‍্যান্ডম হাউস প্রকাশ করলেন তাঁর “কবিতা সমগ্র”। সেখান থেকে কিছু কবিতার নির্বাচন করে বাংলা অনুবাদ করেছি আমি।

আফ্রিকার সাহিত্যচর্চায় চিনুয়া আচেবের প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী? শিক্ষাবিদ ও সাহিত্য সমালোচক কোয়ামে অ্যান্‌থনি আপিয়া-র (১৯৫৪- ) মতে, “It will be impossible to say how ‘Things Fall Apart’ influenced African writing. It would be like asking how Shakespeare influenced English writers or Pushkin influenced Russians. Chinua Achebe did not only play the game, he invented it.”

চিনুয়া আচেবে, নাইজিরিয়া, (১৯৩০ – ২০১৩)

জ্ঞান হরণ করে

জ্ঞান হরণ করে আমাদের বিস্ময়।
যদি না সে আদিম নিশীথের
ভয়ংকর আলখাল্লা ছিঁড়ে চুরি করে আনতো
কুকুরের মাথায় শিং গজানোর
গোপন রহস্য এবং মুরগির গেরস্ত ঠোঁটে
রাতারাতি ভরে দিতো বিদ্রোহের
অদম্য ভাবনা; যদি না আমাদের মনে
ভরসা দিতে। প্রতিদিন সকাল হবে
এবং সূর্যের আলো এসে মুছে দেবে
রাতের দত্যিদানোর উদ্ভট মূর্তিগুলি—
প্রতিটি ভোরকে মালা দিয়ে
অভ্যর্থনা করা হবে শহরের দেউড়িতে
এবং ঢাকঢোল বাজিয়ে রাজকীয়ভাবে
নিয়ে আসা হবে অবাক পৃথিবীর
ঝলমলে উৎসবে।

একদিন

কালবোশেখির তুমুল ঝড়ের পর,
পাখিরা ঘরে ফেরে চষা মাঠ ধরে
প্রভাতসঙ্গীতের বীজ বপন করতে করতে
যদিও তখন পেরিয়ে গেছে দুপুর,
তাদের উজ্জ্বল স্বরে চারপাশে গজাচ্ছে সবুজ
পৃথিবীর আর কাউকে রুখোসুখো
ধুলো মাখা হাওয়ায় শুকিয়ে মরতে হবে না।

কিন্তু আমার কাছে
সব উৎসবই মনগড়া কাল্পনিক;
ঋতু পরিবর্তনের ফলে
সজীব হয়ে উঠবে এনসুক্কার পাহাড়ি অঞ্চল
কয়েক ঘন্টার জন্যে হলেও;
আমার আকাশে কোন ঝড় নেই—
নেই কোন মুক্তির গানও।

ওকিগ্‌বোর জন্যে শোকগাথা

আমরা কাকে খুঁজে বেড়াই?
আমরা কাকে খুঁজে বেড়াই?
ওকিগ্‌বোকে খুঁজে বেড়াই!
নোজেমোলিজো!

সে গেছে কাঠ কাটতে, ফিরে আসতে দাও।
সে গেছে জল আনতে, ফিরে আসতে দাও।
সে গেছে দূরের হাটে, ফিরে আসতে দাও।
ওকিগ্‌বোকে খুঁজে বেড়াই।
নোজোয়ালিজো!

আমরা কাকে খুঁজে বেড়াই?
আমরা কাকে খুঁজে বেড়াই?
ওকিগ্‌বোকে খুঁজে বেড়াই!
নোজোমালিজো!

সে গেছে কাঠ কাটতে, উগ্‌বোকো তাকে টেনে নিও না।
সে গেছে নদীর পারে, আইই তাকে গিলে ফেলো না।
সে গেছে দূরের হাটে, বাজারের কালবোশেখি তাকে
কাছে টেনো না!
সে গেছে লড়াই করতে ওগ্‌বোনুকে তার
পথ ছেড়ে দাও।
ওকিগ্‌বোকে খুঁজে বেড়াই!
নোজোমালিজো!

সে নাচের মুদ্রায় ঘরে ফেরে, কিন্তু নাচার ফুরসত কই?
সে যুদ্ধ বগলে ঘরে ফেরে, কিন্তু এখানে লড়ার লোক কই?
আমরা বার বার বলি, তুমিই পারো
সবচেয়ে যোগ্য লোক তুমি
ওকিগ্‌বোকেই ডাকি আমরা!
নোজোমালিজো!

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাচ দেখো, কিভাবে তা শমে এসে থামে
যুদ্ধকে দেখো, কিভাবে দাবানল ছড়িয়ে পড়ে
কিন্তু প্রধান নাচিয়েরই যে চারদিকে কোথাও পাত্তা নেই
যুদ্ধের সাহসী লড়াকুও কেটে পড়েছে।
দেখতে পাচ্ছো না বারবার ডেকে মরছি তাকে
এ কাজ অন্য কারুর দ্বারা সম্ভব মনে হয় কি?
ওকিগ্‌বোকেই ডাকি আমরা!
নোজোমালিজো!
হঠাৎ নাচ শেষ হয়
ভরদুপুরে নাচ শেষ করে নৃত্যময় আত্মারা মিলিয়ে যান
বৃষ্টি এসে ভেজায় বাদকদের, জলে ঢোল সপসপে!
ভেঙে গেছে বাঁশি, কিন্তু কমেনি বাজিয়েদের উৎসাহ
পায়ের সঙ্গে তাল মেলানো সঙ্গীতের ভান্ডটি(??)
ভেঙে চৌচির
আমার রক্তধারার সাহসী পুরুষ!
ইগবো দেশের সাহসী মানুষ!
রক্তের নদী পার হও সাহসী মানুষ!
ধনী মানুষদের প্রাসাদে মৃত আত্মাদের ঘোরাফেরা
তোমাকেই ডাকি আমরা ওকিগবো!
নোজোমালিজো!

টীকা—

— মূল কবিতা ইগ্‌বো ভাষায় লেখা। কবি ক্রিস্টোফার ওকিগ্‌বোর (১৯৩২-৬৭) স্মৃতির উদ্দেশে। ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ইফিআনি মেনকিটি। কবিতাটি শেষকৃত্যের আনা শব আগলে রেখে শোকের বহিঃপ্রকাশ। ইগ্‌বোদের দেশে, বিশেষ করে কমবয়েসি মানুষের মৃত্যু হলে তার আত্মীয়স্বজন খেলার ছলে তাকে সারা গ্রাম খুঁজে বেড়ায়; জোরগলায় বলে, কি ছেলেমানুষ, লুকোচুরি খেলছে আমাদের সঙ্গে।

— উগ্‌বোকো- জঙ্গলের দেবতা; আইই- জলের দেবতা; ওগনোবুকে – বিদ্বেষ ও ধ্বংসের প্রতীক।

— নোজোমালিজো – লুকোচুরি খেলা; “জো”- লুকানো; মালি-খেলার ছলে। মূল শব্দটি রেখে দিয়েছি আফ্রিকার ধ্বনিমাধুর্য এবং শব্দময় পুনরাবৃত্তিকে ধরে রাখার জন্যে।

বায়াফ্রা, ১৯৬৯

বায়াফ্রা যখন প্রথমবার এলো,
আমরা জানলাম, সে শক্ত কাঠে খোদাই
দৈত্যের মতন বিশাল মূর্তি।

ধুরন্ধর পেটুক উইপোকারা
দলবেঁধে জাঁকিয়ে বসে তার গায়ে
খেতে শুরু করে বিশাল মাচানে দাঁড়ানো পা থেকে
আর পৌঁছে যায় হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত,
ফাঁপা কাকতাড়ুয়া বানিয়ে দেয় তাকে।

রৌদ্রস্নাত সমুদ্রের ঢেউ এসে
সজোরে আঘাত করে তার টলোমলো পায়ে
মুখ থুবড়ে সে লক্ষ লক্ষ টুকরোয় ভেঙে পড়লে
আনন্দে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়
অন্য শীতল উপকূলে — তারপর ম্যাপ আঁকিয়েরা
দৈত্যের কথা ভুলে গিয়ে
বেলাভূমির মানচিত্র বানায়।

আমাদের প্রজন্মে সে ফিরে আসে
ব্যথা ও বারুদের কড়া দুর্গন্ধ
গায়ে মেখে। এবার পাঁচশো বছরের
যুদ্ধে জেতার সাহসে ভর করে
তাকে ভাঙতে লোকলস্কর সমেত
আসছে বিদেশিরা, তেল বিক্রির নবীন অর্থে
তারা পুষ্ট, এখন তোমার কৃষ্ণকায় কন্ঠ
চেপে ধরেছে তারা – রক্ত ও জীবনরস
প্রবাহিত হতে দিচ্ছে না
ফেঁপে ওঠা হাত পায়ে।

এবার আফ্রিকার জীবনে কি
তৃতীয় সুযোগ আসবে?

যুদ্ধের পর

যুদ্ধের শেষ হবার পর
মানুষের জীবন চেষ্টা করে যায়
সামান্যতম হলেও স্বাভাবিকতা ফিরে পাবার
যেমন আঙুরলতাটি জড়িয়ে যায়<ব্র> বৃক্ষশাখার ফাঁক দিয়ে; তার বুভুক্ষু শিকড়
ভাঙা কাচ আর ধ্বংসাবশেষ অগ্রাহ্য করে
খাদ্যরস খোঁজে।

অন্যসময় যাদেরকে দেখলে গাল দিতাম
এখন তাদের দেখা পেলে ঘরে ডাকি
বসতে জিরোতে বলি আমাদের টেবিলে….
যেমন ইলেকট্রিক মিটার দেখে
ইনসপেক্টার বাবুটি আমার হাতে
বিল ধরিয়ে দিয়েও
হাসিমুখ দেখলো আমার
দরজার সামনে
সমস্যাসংকুল গম্ভীর মুখ নয়।

যুদ্ধের পর আমরা
আমাদের হারিয়ে যাওয়া স্রোতকে ফেলে
বর্তমানের অস্থির তরঙ্গে ভাসা
জলজ জঞ্জালকেও আঁকড়ে ধরি….
অসুস্থ নর্তকীরা সেরে ওঠার আগেই
আবার যোগ দেয় নাচের বৃত্তে
আমাদের পায়ে শক্তি নেই
আগের মত
কিন্তু
ইচ্ছে রয়ে গেছে
অর্ধেক ভুলে যাওয়া
এলোমেলো পদক্ষেপে।
বছরের পর বছর
কাঁধে চেপে বসা মৃত্যুর আর
শেষ মুহূর্তের টলমলে সাময়িক রেহাইএর পর
আমরা আনন্দে ছুঁড়ে ফেলে দিই ভয়ডর
আমাদের বিপন্ন বিজয়গুলিকে জড়ো করি
এক অগভীর কবরে আর পালাই
একই অনুশোচনায় যেভাবে
ঘরে ফিরেছিলাম ভৌতিক আড়ম্বরে।

বড়দিন ১৯৭১

বিমান হানা

ঝড়ের বেগে তারা আসে
মৃত্যুর বিহঙ্গ
সোভিয়েত প্রযুক্তির শয়তানি অরণ্য থেকে

বন্ধুর বাড়ি যাবার জন্যে
রাস্তা পার হচ্ছিল লোকটা
কিন্তু দেরি হল সামান্য।
বন্ধু কেটে দুফালি
তার হৃদয় জুড়ে এখন অন্য দুশ্চিন্তা
দ্বিপ্রহরে বন্ধুকে সাদর সম্ভাষণ করা নয়।

তথ্যসূত্র: — “Chinua Achebe: Collected Poems”; Random House; 2004.