
আন্দোলনের চাপে বিপর্যস্ত ঢাকা। ছবি: সংগৃহীত
বোরহান উদ্দিন
-৯ মাসে পাঁচ শতাধিক দাবি-দাওয়ার আন্দোলন
-যানজটের সঙ্গে বাড়ছে শব্দদূষণ
-আন্দোলন সামাল দিতে ক্লান্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
-প্রয়োজনে আন্দোলনের জন্য স্পট ঠিক করে দেওয়ার পরামর্শ
মেগাসিটি রাজধানী ঢাকায় যানজট নিত্যদিনের চিত্র। দৈনন্দিন প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হওয়া মানুষ যানজট, গাড়ির হর্নে ত্যক্ত-বিরক্ত। এরমধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের যৌক্তিক-অযৌক্তিক দাবিতে আন্দোলনের ভোগান্তি। একটা সময় জাতীয় প্রেসক্লাব, কখনো শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন কর্মসূচি হলেও এখন যেন তা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো নগরজুড়ে। যার যখন যেভাবে খুশি সড়কে বসে পড়ছেন দাবির লম্বা তালিকা নিয়ে। বিশেষ করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দাবি আদায়ের মিছিলে যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ঢাকার রাজপথ।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) হিসাবে, ঢাকায় গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে তিনটি আন্দোলন কর্মসূচি পালিত হয়। সে হিসেবে অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়ে পাঁচ শতাধিক আন্দোলন হয়েছে ঢাকার বুকে। আন্দোলনে যুক্ত সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, পেশাজীবীরা যেমন রাস্তায় দুর্ভোগ বাড়াচ্ছেন, সমান গতিতে সরকারি চাকরিজীবীরাও দফতরের ভেতরে-বাইরে আন্দোলন করে নগরবাসীর দুঃখ বাড়াচ্ছেন।
ডিএমপির পক্ষ থেকে দুর্ভোগ এড়ানো এবং নিরাপত্তার স্বার্থে আন্দোলন না করতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, এলাকা নির্দিষ্ট করে দফায় দফায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েও আন্দোলনকারীদের থামাতে যাচ্ছে না। নগরবাসীকে জিম্মি করে দিনের পর দিন চলছে আন্দোলন। অন্যদিকে দিনভর মাইক ব্যবহার করে স্লোগানে মুখরিত করে তোলায় বাড়ছে শব্দ দূষণও।
আবার জুলাই অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে নানা কারণে মনোবল ভেঙে যাওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও বেগ পেতে হচ্ছে এসব আন্দোলন সামাল দিতে। আন্দোলন থামাতে গিয়ে বিভিন্ন বাহিনীর জনশক্তি বাড়াতে হচ্ছে, অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নগরীর সার্বিক আইনশৃঙ্খলা দেখভালে প্রভাব পড়ছে বলে জানা গেছে।
নগরবাসীরা বলছেন, গত ১৬ বছর যারা চুপ ছিলেন তারা নতুন সরকার আসার পর নিজেদের স্বার্থ আদায়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। অন্যদিকে সরকারও আন্দোলনকারীদের ছাড় দিয়ে কিংবা দ্রুত দাবি পূরণ করায় অন্যরাও উৎসাহিত হচ্ছেন। রোববার (১৯ মে) আওয়ামী লীগের আমলে বিভিন্ন সময় নানা অভিযোগে চাকরিচ্যুত সাবেক সেনা সদস্যরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গাড়ি আটকে দিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। যাকে নজিরবিহীন ঘটনা বলা হচ্ছে।
আর নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, নগরীতে সভা-সমাবেশ করার ক্ষেত্রে আইন আছে। আবার নীরব এলাকায় বিকট শব্দে মাইক বাজানোর ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা আছে। এসব বিষয়ে আয়োজকদের অসচেতনতা এবং আইনের কঠিন প্রয়োগ না হওয়ার কারণে দিনের পর দিন এভাবে চলে আসছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অবশ্যই কঠোর হতে হবে।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের দেশে আইনের কঠিন প্রয়োগ নেই। আবার আইনের প্রতি নাগরিকদের সম্মানও নেই। তাই সংশ্লিষ্টদের আইন প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার কথা ভাবতে হবে।’
৯ মাসে যত দুর্ভোগ বাড়ানো আন্দোলন দেখল ঢাকা
ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ঢাকায় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ আন্দোলন করেছে। কেউ সফল হয়েছে। কেউ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অ্যাকশনে নিবৃত হয়েছে। কেউ আবার সরকারি নিয়ম ভেঙে চাকরিচ্যুতও হয়েছেন।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত আগস্টে নতুন সরকার দায়িত্বে আসার পর থেকে অটোরিকশা থেকে শিক্ষার্থীদের অটোপাশ, আনসার থেকে চাকরিচ্যুত পুলিশ। নিয়োগ বঞ্চিত বিসিএস ক্যাডার থেকে বিদ্রোহে যোগ দেওয়া বিডিআর সদস্য কিংবা সাত কলেজ পৃথকীকরণ থেকে তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আন্দোলন দেখেছে ঢাকার রাজপথ।
কখনো আবার পলিটেকনিক্যালের শিক্ষার্থীদের অবরোধ, কখনো হয়েছে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলন। রেলের কর্মচারীরা আন্দোলন করতে গিয়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে এমন ঘটনাও ঘটেছে গত নয় মাসে।
মাঝে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনাসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় কিছুটা সহনীয় অবস্থা দেখা গেলেও বেশ কিছুদিন ধরে আবারও উত্তাল ঢাকা।
সাম্প্রতিক সময়ে বেশি আলোচনায় ছিল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন। এই কর্মসূচি ঘিরে বিএনপি একেবারে চুপচাপ থাকলেও এনসিপি, জামায়াত, শিবির ও ধর্মভিত্তিক একাধিক দলের ব্যাপক সমর্থক মাঠে ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা থেকে শুরু করে এক পর্যায়ে সড়কে সমাবেশ, পরবর্তী সময়ে শাহবাগ অবরোধের মধ্য দিয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠে সেই আন্দোলন। একপর্যায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত জানায় সরকার।
আওয়ামী লীগ নিয়ে আন্দোলন শেষ না হতেই দেশের সর্বস্তরের ডিপ্লোমা ইন নার্সিং এবং ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্সকে স্নাতক সমমানের স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে মাঠে নামে নার্সিংয়ের শিক্ষার্থীরা। শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বেশ সমালোচনার মুখে পড়ে তারা। এক পর্যায়ে সড়ক ছেড়ে যায় এসব আন্দোলনকারী।
অন্যদিকে ৭০ শতাংশ আবাসন ভাতাসহ তিন দফা দাবিতে গত সপ্তাহে রাজধানীর কাকরাইল মোড় অবরোধ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা। যমুনার দিকে মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় বুধবার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয় পুলিশের। এতে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। ওই কর্মসূচিকে ঘিরে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর বোতল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। আন্দোলন রূপ নিয়ে ভিন্ন দিক। অবশেষে শুক্রবার তাদের দাবি মেনে নেওয়ায় গণঅনশন ভেঙে ক্লাসে ফিরে যান শিক্ষার্থীরা।
মাঝে অবশ্য ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে মার্চ টু গাজার কর্মসূচিতে মানুষের ঢল নামে। ইসরায়েলের বর্বোরচিত হামলার এই প্রতিবাদে অবশ্য মানুষের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।
এদিকে সবশেষ রোববার (১৮ মে) একদিনে ঢাকায় আটটি বড় বড় আন্দোলন কর্মসূচির ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে নাগরিকদের। এদিন চাকরিচ্যুত সেনাসদস্যরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এক পর্যায়ে সেনাসদর থেকে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে এলেও তারা দাবি পূরণ না হওয়ার অজুহাতে তাদের গাড়ির নিচে শুয়ে পড়েন। পরে অবশ্য লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়।
একই দিনে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র পদে ইশরাক হোসেনের শপথের ব্যবস্থা করাতে চতুর্থ দিনের মতো বিক্ষোভ করেন তার অনুসারীরা। সচিবালয়ের সামনে থেকে নগর ভবন এবং আশপাশের এলাকায় বিক্ষোভকারীরা ছড়িয়ে পড়ায় মানুষের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। সোমবার (১৯ মে) একই দাবিতে পালন করা হয় ব্লকেড কর্মসূচি। মঙ্গলবারও যা চলবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ছাত্রদল নেতা সাম্য হত্যার বিচারের দাবিতে শাহবাগ থানা ঘেরাও, শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে খুনিদের খুঁজে বের করতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী শিক্ষকরা। এদিন জাতীয়করণের দাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা। সেখান থেকে নিয়মিত বেতনের দাবিতে মাউশি ঘেরাও করতে যান তারা। আন্দোলনের মুখে অবশ্য দ্রুত বেতন ছাড়ের কথা জানায় মাউশি। শিক্ষকদের এই কর্মসূচি এখনও চলছে। জাতীয়করণের ঘোষণা ছাড়া তারা মাঠ ছাড়বেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
এছাড়াও রোববার বিজয়নগরে বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাসের ঘোষণা না দিলে দেশ অচলের ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন করেন শ্রমিকরা। অপরদিকে শেয়ারবাজারের অব্যাহত পতনের প্রতিবাদে কাফনের কাপড় নিয়ে মিছিল করেন বিনিয়োগকারীরা। হাইকোর্টের মাজার গেটের সামনে একই দিনে বিক্ষোভ করেন পলিটেকনিক কলেজের শিক্ষার্থীরা।
এদিকে সোমবার নগরভবনে ব্লকেড, প্রেসক্লাব এলাকায় শিক্ষকদের আন্দোলনের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট দূর করার দাবিতে আন্দোলন। পুরান ঢাকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করায় পুরো স্থবির হয়ে পড়ে ওই এলাকার সড়ক।
কী পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা?
নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান এমন কথায় কথায় আন্দোলন নিয়ে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘রাষ্ট্র কাঠামোতে দাবি দাওয়া উপস্থাপনের একটা পদ্ধতি আছে। রাস্তা বন্ধ করার কথাও না। কেউ আন্দোলন করলেই বর্তমান সরকার শুরুর দিকে দাবি মেনে নেওয়ায় মানুষ ধরেই নিয়েছে এটাই পদ্ধতি। কিন্তু পার্থকুঞ্জ পার্ক নিয়ে নীরব আন্দোলন হচ্ছে অনেক দিন ধরে, দায়িত্বশীলরা গায়ে মাখছেন না।’
এই নগর পরিকল্পাবিদ বলেন, ‘এভাবে রাস্তায় বসে দাবি আদায়ের পদ্ধতি কোনোভাবে গ্রহণযোগ নয়। নগরীতে বড় বড় স্কয়ার করে দিতে হবে। যেখানে গিয়ে মানুষ তার দাবির কথা বলবেন। তাদের নিরাপত্তা দিতে হবে। তারা সরকারকে লিখিত দেবেন। সেখানে একজনের ন্যায্য দাবি হলেও সরকার তা মেনে নেবেন। কিন্তু লক্ষ মানুষও অন্যায় দাবি করলে তা মানবে না এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের দেশে আইনের কঠিন প্রয়োগ নেই। আবার আইনের প্রতি নাগরিকদের সম্মানও নেই। যত্রতত্র পার্কিং, বায়ূদূষণ, শব্দদূষণের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হলো প্রথম ধাপ। আইনের প্রয়োগ সবশেষ ধাপ। কিন্তু সচতেনতায় ঘাটতির কারণে আইন প্রয়োগের তো বিকল্প নেই। অথচ ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে ঢুকলেই আমরা সচেতন হয়ে যাই। অন্যথায় বিপদ হবে সেটা প্রথমেই সবাই চিন্তা করি।’
আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘আইন অনুযায়ী হাইকোর্ট-সচিবালয় এলাকা পুরোটাই নীরব এলাকা। এই এলাকায় আইনগতভাবে শব্দদূষণ করার সুযোগ নেই। কিন্তু প্রেসক্লাবের সামনে চেয়ার-মাইক নিয়ে স্থায়ীভাবে লোকজন ব্যবসা করছে, সেখানে মানুষ দিনের পর দিন বিকট শব্দে অনুষ্ঠান করছে। এ থেকে বোঝা যায় আমাদের পরিবেশগত অবস্থার কতটা অবক্ষয় হয়েছে। তাই সংশ্লিষ্টদের আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরির কথা ভাবতে হবে।’