০৩:০৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

জলবায়ু পরিবর্তন কী, কেন: সম্ভাব্য পরিণতি ও উত্তরণ

  • আপডেট সময়: ১০:৪৫:৫৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ জুন ২০২৫
  • 21

হাসান জাহিদ

জলবায়ু পরিবর্তন মানবজাতির সামনে সবচেয়ে বড় হুমকি যে কোনো মানদণ্ডেই। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও পরিবেশদূষণ ইতোমধ্যেই মানুষের স্বাস্থ্যের উপর সরাসরি আঘাত হানছে। বায়ুদূষণ, নানান রোগ, চরম আবহাওয়ার ঘটনা, জলবায়ু উদ্বাস্তু তৈরি, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর চাপ। সেইসাথে চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া ক্ষতি করছে ফসল, জমি, গাছ, পানি ও জীবজন্তু ও ইকোসিস্টেমের ওপর।

২১ শতকের প্রথম কয়েক দশকেই জলবায়ু পরিবর্তনের বহু প্রভাব লক্ষ্য  করা গেছে। এর মধ্যে ২০২৪ সাল ছিল এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা সবচেয়ে উষ্ণ বছর, যেখানে গড় উষ্ণতা ১৮৫০ সাল থেকে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ শুরুর পর থেকে ১.৬০ degrees Celsius change (২.৮৮ degrees Fahrenheit change) বেড়েছে। অতিরিক্ত উষ্ণতা এই প্রভাবগুলো আরও বাড়িয়ে তুলবে এবং টিপিংপয়েন্ট সক্রিয় করতে পারে, যেমন পুরো গ্রীনল্যান্ডের বরফ আস্তর গলে যাওয়া।

২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, দেশগুলো সম্মিলিতভাবে উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সীমাবদ্ধ রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে, এই চুক্তির আওতায় দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, শতাব্দীর শেষে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রায় ২.৮ degrees Celsius change (৫.০ degrees Fahrenheit change)-এ পৌঁছাতে পারে। উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন প্রায় অর্ধেকে নামাতে হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে নেট-শূন্য নির্গমন অর্জন করতে হবে।

করণীয়

জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে তা থেকে অধিক মাত্রায় কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্যাস নির্গত হয়। প্রতিনিয়ত আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি হিসেবে তেল, গ্যাস বিশেষ করে কয়লা ব্যবহার করি। বায়ুমণ্ডলে নিঃসরিত কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্যাস সূর্য থেকে আগত তাপ আটকে রেখে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে। বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে জীবাশ্ম জ্বালানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে অবশ্যই দেশগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করতে হবে। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনে প্রথম সারির দেশগুলো (অস্ট্রোলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত) এই জ্বালানি ব্যবহার হ্রাসের বিপক্ষে।

মিথেন গ্যাস নিগর্মন হ্রাস করা জাতিসংঘের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মিথেন গ্যাসের নির্গমন হ্রাস করা গেলে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন বহুলাংশে রোধ করা সম্ভব। মিথেন গ্যাস তাপমাত্র বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা পালন করে। তেল নিষ্কাশনের সময় প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানো হয় যা থেকে ব্যাপক মাত্রায় মিথেন গ্যাস নির্গত হয়। অবশ্যই প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানোর বিকল্প হিসেবে ভিন্ন পরিবেশবান্ধব উপায় বের করতে হবে। এর মাধ্যমে মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ হ্রাস পাবে। পাশাপাশি বর্জ্য পদার্থ বিনষ্টকরণের জন্য পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে। কারণ স্তুপীকৃত বর্জ্য পদার্থ থেকে প্রচুর পরিমাণ মিথেন গ্যাস নির্গত হয়।

নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে জ্বালানি খাত ব্যাপক ভূমিকা রাখে। বৈশ্বিক অর্থনীতির যে কোনো খাতের তুলনায় বিদ্যুৎ ও তাপশক্তি উৎপাদন খাত জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রভাবিত করে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে সমগ্র বিশ্বের নেতাদের একযোগে কাজ করতে হবে। সভ্যতার উন্নতির ধারায় প্রতিয়িনত বিদ্যুৎ ও তাপের ব্যবহার বাড়বে কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে একদিকে বিদ্যুৎ বা তাপের চাহিদা পূরণ হবে, অন্যদিকে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে না। এর ফলে বিদ্যুৎ ও তাপ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি নির্ভরতার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। পুরোপুরি জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা থেকে ক্লিন এনার্জি তথা ডিকার্বোনাইজেশন প্রযুক্তি নির্ভরতার দিকে ঝুঁকতে হতে পারে। তবে সাম্প্রতিক বৈশ্বিক লক্ষ্য ও চাহিদা বিবেচনায় এমন পদক্ষেপ কঠিন হবে।

অন্যদিকে বায়ু ও সৌরশক্তির ব্যবহারের ফলে জ্বালানি চাহিদা মিটতে পারে। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব নেতাদের প্রস্তাবিত নিট জিরো বাস্তবায়নে নবায়নযোগ্য তথা বায়ু ও সৌরশক্তির ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। তবে এই পথ এতটা সহজ নয়। কারণ বাতাসের গতিবেগ কম হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হবে। এক্ষেত্রে উন্নত ব্যাটারি উদ্ভাবনের পথে হাঁটতে হবে যেন প্রয়োজনীয় শক্তি তথা বিদ্যুৎ সঞ্চয় এবং প্রয়োজন মাফিক তার ব্যবহার করা যায়।

পেট্রোল ডিজেলের ব্যবহার সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সমৃদ্ধ হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রতিনিয়ত সড়ক, নৌ ও আকাশ পথে নতুন নতুন বাহনের ব্যবহার বাড়ছে। আর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে পেট্রোল, ডিজেল, অকটনেরে মতো জ্বালানি। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অবশ্যই যানবাহনে ডিজেল ও পেট্রোলের ব্যবহার হ্রাস করতে হবে। এসকল জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে ইলেক্ট্রিক যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি হতে পারে একটি সমাধান। তবে ইলেক্ট্রিক যানবাহনের ব্যবহার বৃদ্ধি যথেষ্ট জটিল কাজ। এক্ষেত্রে হাইড্রোজেন জ্বালানি হতে পারে যানবাহনের উৎকৃষ্ট জ্বালানি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত হাইড্রোজেন জ্বালানি আগামীতে পরিবেশবান্ধব পরিবহন খাতের স্বপ্ন দেখাতে পারে।

বৃক্ষরোপণের হার বৃদ্ধি জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বৃক্ষরোপণের কোনো বিকল্প নেই। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে বৃক্ষরোপণের চেয়ে ফলদায়কপদ্ধতি আর হতে পারে না। প্রয়োজনের তাগিদে গাছ কাটা হলেও দেশগুলোকে বৃক্ষ রোপণের হার বাড়াতে হবে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ জানায়, ‘বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হলে বাতাস থেকে কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্যাস দূর করতে হবে। বায়ু থেকে কার্বন-ডাইঅক্সাইড দূর করতে গাছের বিকল্প নেই।

তাছাড়া, জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বৃক্ষ ও জলাভূমির কোনো বিকল্প নেই। পরিতাপের বিষয়, গাছপালা-বৃক্ষ, বনভূমি সাফ করে আমাদের দেশে, এমনকি ফসলের জমিতেও ইটভাটা, তীব্র পানিদূষণকারী ডায়িং কারখানা ও কম্পোজিট মিল তৈরি হচ্ছে। এগুলো, অবশ্যই আমাদের দেশে অভ্যন্তরীণ পরিবেশ মারাত্মক দূষিত করছে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল প্রতিরোধের ক্ষমতা হ্রাস করছে।

বায়ু থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস দূরীকরণ গ্রিনহাউস গ্যাস সূর্য থেকে আগত তাপ পৃথিবীপৃষ্ঠে প্রতিফলিত হওয়ার পর মহাশূন্যে বিলীন হওয়ার পথে বাধা। এর ফলে পৃথিবী উষ্ম থাকে। গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রা অধিক হলে পৃথিবী অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়। ফলে পৃথিবীর স্বাভাবিক জীবন ধারণ ব্যহত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিনিয়ত বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস দূর করতে হবে।

সমস্যা হলো বিশ্বের শক্তিধর ও প্রভাবশালী দেশগুলো নিজেদের শিল্প ও উৎপাদনের হার বাড়াতে চায়। ফলে তারা নিজেদের দেশের কার্বন নিঃস্বরণ না কমিয়ে অন্য দেশগুলিকে সিংক বানাতে চাইছে, এবং ফান্ড ও গ্রিন টেকনোলজি দিয়ে দূষণ কমাতে চাইছে। এটা সুদূরপ্রসারী কোনো ফল বয়ে আনবে না। ফলে প্রায় প্রতিটি কপ (জাতিসংঘের কনফারেন্স অব পার্টিজ) সম্মেলনেই সিদ্ধান্ত আসে ফান্ড প্রদানের এবং টেকনোলজি ট্রান্সফারের। এইসব সিদ্ধান্ত জলবায়ুর সুদূরপ্রসারী সুফল বয়ে আনবে না।

বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন-ডাইঅক্সাইড বা অন্য কোনো গ্রিনহাউস গ্যাস কৃত্রিমভাবে দূর করা গেলে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অথবা গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপন্ন হওয়ার পর এর উৎস থেকে অন্য স্থানে সম্প্রসারণ রোধ করা গেলে পরিবেশে এসব গ্যাসের প্রভাব অনেকাংশে রোধ করা যায়।

ইতোমথ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস দূর করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে টেক্সাসের ‘কার্বন ইঞ্জিনিয়ারিং’ এবং সুইজারল্যান্ডের ‘ক্লাইমওয়ার্কস ‘ অন্যতম। তারা একটি রাসায়নিক পদার্থের ফিল্টারের ভিতর দিয়ে বিশাল ফ্যানের সাহায্যে বায়ুমণ্ডলে বাতাস নির্গত করে বায়ুমণ্ডলের কার্বন-ডাইঅক্সাইড শোষণ করে। অন্য একটি পদ্ধতি হলো, কার্বন বন্দি ও সংরক্ষণ (capture and storage). তবে এ সকল প্রযুক্তি বেশ জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ।

দরিদ্র দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান অনুন্নত দেশের জন্য ফান্ড সৃষ্টির বিষয়টি সবসময়ই প্রাধান্য পেলেও তা যথেষ্ঠ নয়। আর এই ফান্ড পেতে দরিদ্র দেশগুলোকে অনেক জটিল মেকানিজমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়

এই করণীয়গুলো কিন্তু সঠিকভাবে করা হচ্ছে না। বৈশ্বিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সর্বোচ্চ জোর দেয়া উচিত কার্বন নিঃস্বরণ কমানোয়। সেই কাজটিই বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত কপ বা জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের নেতৃবৃন্দ একমত হতে পারেননি। তারা ফান্ড বা অনুদান দেবার বিষয়টি অনুমোদনে চুক্তি করেন। কার্বন কমাতে নিজেদের দেশের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দিতে তারা দ্বিধাবোধ করেন। বৈশ্বিক এই সমস্যা শুধু দরিদ্র দেশের ভোগান্তিই বাড়াবে না। এর কমবেশি কুপ্রভাব পড়বে সব দেশেই। অথচ সেটা ঝুলন্তই থেকে যাচ্ছে কপ সম্মেলনগুলোতে।

২০২৪’র নভেম্বরে আজারবাইজানের রাজধানি বাকুতে অনুষ্ঠিত হয় জাতিসংঘের ২৯তম জলবায়ু সম্মেলন (কপ ২৯)। সম্মেলনে রাষ্ট্রপ্রধান, বিজ্ঞানী, নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তারা অংশ নেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও ফ্রান্সের মতো বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানরা অনুপস্থিত ছিলেন, তাদের উপস্থিতি এই আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব বহন করতো।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতার বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ৪৩ শতাংশ কমাতে হবে। এই জলবায়ু সম্মেলনে ধনী দেশগুলো দীর্ঘ তেত্রিশ ঘণ্টার আলোচনার পর উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তার অঙ্গীকার করেছে।

জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে (COP 29) উন্নত দেশগুলি ২০৩৫ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য বার্ষিক ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহে “নেতৃত্ব গ্রহণ” করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এটি ২০০৯ সালে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রতিশ্রুতি থেকে বেশি।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, তাতে সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীত হয়ে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ক্ষতির শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। উষ্ণতা বৃদ্ধি মানবসৃষ্ট, প্রাকৃতিক কারসাজি নয়Ñএটি বিশ্বে আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। আর এই অমোঘ সত্যটাকে বহুবছর যাবত ধামাচাপা দেয়ার প্রচেষ্টায় রত ছিল বিশে^র শিল্পোন্নত কতিপয় দেশ। শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। উন্নত ও শিল্পায়িত বিশ্বের  লাগামহীন কার্বন নিঃসরণের শিকার এখন গোটা বিশ^; কেননা উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়ে বরফ গলছে আর তা স্ফীত করে তুলছে সাগর-মহাসাগরকে যার কুফলে অধিক ভুগবে বিশে^র দ্বীপরাষ্ট্রসহ নিম্নাঞ্চলীয় নাজুক ভৌগোলিক অবস্থানের দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশ।

প্যারিস সম্মেলনের লক্ষ্য অর্জনে নানা অ্যাকশন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে কপ ২৬ (UN Climate Change Conference of the Parties, Glasgow, 31 October–13 November 2021) অনুষ্ঠিত হয় স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে সই করা দেশগুলো বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যেন না বাড়ে, তা নিশ্চিতকরণে ব্যবস্থা নিতে একমত হয়েছিল।

২০১৯ সালের শেষ দিকে করোনাভাইরাস মহামারির উত্থানের পর এটিই সশরীরে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। চারটি লক্ষ্যকে এবারের সম্মেলনে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল।

-২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীব্যাপী কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ শূন্যতে নামিয়ে আনতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনের মাত্রা ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা

-জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগকবলিত মানুষের জন্য বাস্তুতন্ত্র রক্ষা এবং পুনরুদ্ধার করা, প্রতিরক্ষা ও সতর্কতা ব্যবস্থা গ্রহণ, অবকাঠামো তৈরি ও কৃষি ব্যবস্থাকে স্থিতিস্থাপক করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা

-এসব কাজ সম্পাদনের জন্য প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল করার জন্য উন্নত দেশগুলোর ভূমিকা রাখা এবং

-জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করা

সম্মেলনে ‘গ্লোবাল গোল অন অ্যাডেপ্টেশন’ সংক্রান্ত বৈশ্বিক লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য গ্লাসগো-শার্ম এল-শেইখ ওয়ার্ক প্রোগ্রাম অন দি গ্লোবাল গোল অন অ্যাডেপ্টেশন”প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যা বাংলাদেশের ভবিষ্যত অ্যাডেপ্টেশন কার্যক্রমকে বেগবান করবে বলে বিভিন্ন মহল থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।

ঘুরেফিরে সেই অ্যাডেপ্টেশনের বিষয়টিই বারবার উঠে আসছে। অ্যাডেপ্টেশনই বাংলাদেশের একমাত্র অপশন। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে এতো মানুষ কোথায়-কীভাবে অ্যাডেপ্টেড হবে (তা নির্ভর করে অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে কতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ, তার ওপর)। অ্যাডেপশন বা খাপ খাইয়ে নিতে যে পরিকল্পনা, অর্থ ও প্রযুক্তির প্রয়োজন হবে, সেই বিষয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আমাদের মিশন ও ভিশন হতে হবে। বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বা কার্বন নিঃসরণ ঘটিয়ে আজকের বিশ^কে বিপর্যস্ত করায় বাংলাদেশের কোনো দায়ভাগ নেই। কিন্তু ভঙ্গুর ভৌগোলিক অবস্থান ও নিম্নাঞ্চল হওয়ায় বাংলাদেশ শিকার হচ্ছে উন্নত বিশে^র লাগামহীন কার্বন নিঃসরণের কুফলে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের জন্য প্যারিস সম্মেলনের চুক্তি সুফল বয়ে আনত বিগত বছরগুলোতে।

বিশে^র প্রভাবশালী ও সমৃদ্ধ দেশগুলোর কাছ থেকে কার্বন কমানোর জোরালো ও সুস্পষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি কিন্তু এই সম্মেলনেও পাওয়া যায়নি। প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য এই সম্মেলনে একটি রুল বুক প্রণীত হয়েছিলো। আর এই রুল বুকের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিশ্রুতিগুলো খতিয়ে দেখবেন বিশেষজ্ঞরাÑএরকম কর্ম পন্থা নির্ধারিত হয়েছিলো।

কপ-২৬এর মূল লক্ষ্য ছিল তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার আশা বাঁচিয়ে রাখা, সেই উদ্দেশ্য সাধিত হলেও এটা কীভাবে পরিপূর্ণ সফলতা পাবে, তা কিন্তু তর্কাতীত নয়। খোদ কপ-২৬ সভাপতি অলোক শর্মার ভাষায়, ‘আমরা ১.৫ ডিগ্রির লক্ষ্যমাত্রার আশা বাঁচিয়ে রেখেছি, কিন্তু এর নাড়ি বড়ই দুর্বল।’

প্যারিস চুক্তির আওতায় বিশ্বের উন্নত দেশসমূহ ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে একশ বিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি।

এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, একমাত্র আইপিসিসি এর জন্মলগ্ন থেকে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এই প্যানেলের বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল বিভিন্ন বছরের ও সময়ের রিপোর্ট-এর সুপারিশগুলো যদি উন্নত দেশ আমলে আনত, আজকে বিশে^ জলবায়ু পরিবর্তনের চূড়ান্ত নেতিবাচক প্রভাব পড়ত না। বরং একধরনের বিনাশী প্রচারণা ছিল তার উল্টোপিঠে যে, জলবায়ু পরিবর্তন মানবসৃষ্ট নয়!

অনস্বীকার্য যে, শিল্পবিপ্লবের পর থেকে সাম্রাজ্যবাদী ও পরাশক্তির দেশগুলো বিলাসিতায় ও আরাম-আয়েশে থেকে, পৃথিবীর সিংহভাগ ভূখণ্ডকে চরম বিপদের মুখে ফেলেছে জলবায়ু পরিবর্তন নামের দানবের জন্ম দিয়ে।

তারা জেগে থেকেও ঘুমের ভান করে পড়ে ছিল। তারা জানতো, এই পৃথিবীটা আমাদের নয়; আমরা শুধুমাত্র একে ধার নিয়েছি আগামী প্রজন্মের কাছ থেকে।

সম্মেলন ব্যর্থ ধরে নিলে বলতে হয় যে, ব্যর্থতা দিয়ে যার শুরু তার ব্যর্থতার দায়ভাগ বাংলাদেশের নয়। মাদ্রিদ সম্মেলন শেষ হয়েছিলো ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ দিয়ে, যার অর্থ ছিল বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণ আদায়ে ওয়ারশো ইন্টারন্যাশনালের যে দীর্ঘ সময় ও জটিল ম্যাকানিজমের মধ্য দিয়ে যাবে, সেই সময় ও পরিশ্রমে বাংলাদেশ নিজস্ব উদ্যোগে অনেক এগিয়ে যেতে পারে অবকাঠামো উন্নয়ন ও অ্যাডেপ্টেশনের দিকে। সেইক্ষেত্রে প্রয়োজন ফান্ড ও ক্ষতিপূরণ।

বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তন বলতে বোঝায় গ্লোবাল ওয়ার্মিংÑযা বিশ্বের গড় তাপমাত্রার ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধিকে নির্দেশ করে, এবং পৃথিবীর জলবায়ু ব্যবস্থার ওপর এর বিস্তৃত প্রভাবকে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিস্তৃত অর্থে এতে অতীতের দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনগুলিও অন্তর্ভুক্ত। বর্তমান তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণ মানব ক্রিয়াকলাপ, বিশেষ করে শিল্পবিপ্লবের পর থেকে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার।

জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, বন উজাড়, এবং কিছু কৃষি ও শিল্প খাতের কার্যক্রম গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করে। এসব গ্যাস সূর্য থেকে আগত তাপ শোষণের পর পৃথিবী যেই তাপ বিকিরণ করে, তার কিছু অংশ ধরে রাখে, ফলে নিম্ন বায়ুমণ্ডল উষ্ণ হয়। কার্বন ডাইঅক্সাইড হল বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রধান গ্যাস, যার মাত্রা পূর্ব-শিল্প যুগ থেকে প্রায় ৫০% বেড়েছে এবং তা কয়েক মিলিয়ন বছরে দেখা যায়নি।

জলবায়ু পরিবর্তন পরিবেশের ওপর ক্রমাগত বড় প্রভাব ফেলছে। মরুভূমি প্রসারিত হচ্ছে, এবং তাপপ্রবাহ ও বুশফায়ারের ঘটনা আরও ঘনঘন ঘটছে।

আর্কটিকে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে চিরহিমভূমি গলছে, হিমবাহ হ্রাস পাচ্ছে এবং সামুদ্রিক বরফও হ্রাস পাচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘূর্ণিঝড়কে আরো তীব্র করছে, পাশাপাশি খরা ও অন্যান্য চরম আবহাওয়ার ঘটনাও বাড়িয়ে তুলছে। পার্বত্য অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র, প্রবাল প্রাচীর, এবং আর্কটিক অঞ্চলে দ্রুত পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে অনেক প্রজাতিকে স্থান পরিবর্তন করতে বা বিলুপ্ত হতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে উষ্ণতা বৃদ্ধির হার সীমিত করলেও কিছু প্রভাব শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে থাকতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে মহাসাগরের উষ্ণতা বৃদ্ধি, অম্লতা বৃদ্ধি, এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি।

জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের ওপরও বড় ধরনের হুমকি তৈরি করছে। এটি বন্যা, চরম তাপপ্রবাহ, খাদ্য ও জল সংকট বৃদ্ধি, রোগব্যাধির বিস্তার এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনা বাড়ায়। এর ফলে মানব অভিবাসন এবং সংঘাতের ঘটনাও ঘটতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জলবায়ু পরিবর্তনকে ২১ শতকে বিশ্বের স্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম বড় হুমকি হিসেবে বর্ণনা করেছে।  যদি উষ্ণতা সীমিত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া হয়, তাহলে সমাজ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাগুলি আরো গুরুতর ঝুঁকির মুখে পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ যেমন বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা খরার সহনশীল ফসল চাষের মাধ্যমে কিছুটা ঝুঁকি কমানো যায়। তবে, অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোজনের সীমা পৌঁছে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল সম্প্রদায়গুলোর বৈশ্বিক নির্গমনের হার কম হলেও, তাদের অভিযোজনের সামর্থ্য কম এবং তারা জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।

জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ধাপে ধাপে বন্ধ করা সম্ভব, যদি জ্বালানি সাশ্রয় করা হয় এবং এমন শক্তির উৎসে রূপান্তর করা হয় যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কার্বন দূষণ সৃষ্টি করে না। এই পরিচ্ছন্ন শক্তির উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে বায়ু,  সূর্য,  জলবিদ্যুৎ, এবং পারমাণবিক শক্তি। এসব উৎস থেকে উৎপন্ন পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ পরিবহন, ভবন গরম রাখা, এবং শিল্প প্রক্রিয়া চালানোর জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়।  বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বনও অপসারণ করা যায়, যেমন-বনভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি এবং এমন কৃষিপদ্ধতি ব্যবহার করে, যা মাটিতে কার্বন সংরক্ষণ করে।

মানুষ কী করতে পারে?

-গাড়ির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সাইকেল বা জনপরিবহনের ব্যবহার বাড়াতে পারে

-বাড়িতে যাতে গরম বা ঠাণ্ডা কম ঢোকে তার ব্যবস্থা নিতে পারে

-মাংস এবং দুগ্ধজাত খাবার কমাতে পারে

-বিমান ভ্রমণ কমাতে পারে

সামনের কপ সম্মেলনে কার্বন নিঃস্বরণ কমাতে উন্নত দেশগুলো থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে, যা হবে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সবচাইতে জরুরি পদক্ষেপ। এর কোনো বিকল্প নেই। টেকনোলজি ট্রান্সফার, নবায়নযোগ্য এনার্জির ব্যবহার এবং সৌরশক্তি ব্যবহার সাময়িক সমাধান। আর এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশের জন্য এগুলোর ব্যবহার এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে।

অতএব কেবল ফান্ড সৃষ্টির ওপর জোর না দিয়ে  স্বল্পোন্নত দেশের প্রতিনিধিদের প্রধান কাজ হবে, কার্বন কমাতে শিল্পোন্নত দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, আর সেইসাথে নিজ নিজ দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে নিরলস কাজ করে যাওয়া।

 

 

 

 

 

উত্তরাধুনিক

Writer, Singer & Environmentalist

জলবায়ু পরিবর্তন কী, কেন: সম্ভাব্য পরিণতি ও উত্তরণ

আপডেট সময়: ১০:৪৫:৫৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ জুন ২০২৫

হাসান জাহিদ

জলবায়ু পরিবর্তন মানবজাতির সামনে সবচেয়ে বড় হুমকি যে কোনো মানদণ্ডেই। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও পরিবেশদূষণ ইতোমধ্যেই মানুষের স্বাস্থ্যের উপর সরাসরি আঘাত হানছে। বায়ুদূষণ, নানান রোগ, চরম আবহাওয়ার ঘটনা, জলবায়ু উদ্বাস্তু তৈরি, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর চাপ। সেইসাথে চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া ক্ষতি করছে ফসল, জমি, গাছ, পানি ও জীবজন্তু ও ইকোসিস্টেমের ওপর।

২১ শতকের প্রথম কয়েক দশকেই জলবায়ু পরিবর্তনের বহু প্রভাব লক্ষ্য  করা গেছে। এর মধ্যে ২০২৪ সাল ছিল এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা সবচেয়ে উষ্ণ বছর, যেখানে গড় উষ্ণতা ১৮৫০ সাল থেকে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ শুরুর পর থেকে ১.৬০ degrees Celsius change (২.৮৮ degrees Fahrenheit change) বেড়েছে। অতিরিক্ত উষ্ণতা এই প্রভাবগুলো আরও বাড়িয়ে তুলবে এবং টিপিংপয়েন্ট সক্রিয় করতে পারে, যেমন পুরো গ্রীনল্যান্ডের বরফ আস্তর গলে যাওয়া।

২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, দেশগুলো সম্মিলিতভাবে উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সীমাবদ্ধ রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে, এই চুক্তির আওতায় দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, শতাব্দীর শেষে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রায় ২.৮ degrees Celsius change (৫.০ degrees Fahrenheit change)-এ পৌঁছাতে পারে। উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন প্রায় অর্ধেকে নামাতে হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে নেট-শূন্য নির্গমন অর্জন করতে হবে।

করণীয়

জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে তা থেকে অধিক মাত্রায় কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্যাস নির্গত হয়। প্রতিনিয়ত আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি হিসেবে তেল, গ্যাস বিশেষ করে কয়লা ব্যবহার করি। বায়ুমণ্ডলে নিঃসরিত কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্যাস সূর্য থেকে আগত তাপ আটকে রেখে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে। বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে জীবাশ্ম জ্বালানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে অবশ্যই দেশগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করতে হবে। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনে প্রথম সারির দেশগুলো (অস্ট্রোলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত) এই জ্বালানি ব্যবহার হ্রাসের বিপক্ষে।

মিথেন গ্যাস নিগর্মন হ্রাস করা জাতিসংঘের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মিথেন গ্যাসের নির্গমন হ্রাস করা গেলে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন বহুলাংশে রোধ করা সম্ভব। মিথেন গ্যাস তাপমাত্র বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা পালন করে। তেল নিষ্কাশনের সময় প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানো হয় যা থেকে ব্যাপক মাত্রায় মিথেন গ্যাস নির্গত হয়। অবশ্যই প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানোর বিকল্প হিসেবে ভিন্ন পরিবেশবান্ধব উপায় বের করতে হবে। এর মাধ্যমে মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ হ্রাস পাবে। পাশাপাশি বর্জ্য পদার্থ বিনষ্টকরণের জন্য পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে। কারণ স্তুপীকৃত বর্জ্য পদার্থ থেকে প্রচুর পরিমাণ মিথেন গ্যাস নির্গত হয়।

নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে জ্বালানি খাত ব্যাপক ভূমিকা রাখে। বৈশ্বিক অর্থনীতির যে কোনো খাতের তুলনায় বিদ্যুৎ ও তাপশক্তি উৎপাদন খাত জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রভাবিত করে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে সমগ্র বিশ্বের নেতাদের একযোগে কাজ করতে হবে। সভ্যতার উন্নতির ধারায় প্রতিয়িনত বিদ্যুৎ ও তাপের ব্যবহার বাড়বে কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে একদিকে বিদ্যুৎ বা তাপের চাহিদা পূরণ হবে, অন্যদিকে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে না। এর ফলে বিদ্যুৎ ও তাপ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি নির্ভরতার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। পুরোপুরি জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা থেকে ক্লিন এনার্জি তথা ডিকার্বোনাইজেশন প্রযুক্তি নির্ভরতার দিকে ঝুঁকতে হতে পারে। তবে সাম্প্রতিক বৈশ্বিক লক্ষ্য ও চাহিদা বিবেচনায় এমন পদক্ষেপ কঠিন হবে।

অন্যদিকে বায়ু ও সৌরশক্তির ব্যবহারের ফলে জ্বালানি চাহিদা মিটতে পারে। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব নেতাদের প্রস্তাবিত নিট জিরো বাস্তবায়নে নবায়নযোগ্য তথা বায়ু ও সৌরশক্তির ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। তবে এই পথ এতটা সহজ নয়। কারণ বাতাসের গতিবেগ কম হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হবে। এক্ষেত্রে উন্নত ব্যাটারি উদ্ভাবনের পথে হাঁটতে হবে যেন প্রয়োজনীয় শক্তি তথা বিদ্যুৎ সঞ্চয় এবং প্রয়োজন মাফিক তার ব্যবহার করা যায়।

পেট্রোল ডিজেলের ব্যবহার সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সমৃদ্ধ হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রতিনিয়ত সড়ক, নৌ ও আকাশ পথে নতুন নতুন বাহনের ব্যবহার বাড়ছে। আর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে পেট্রোল, ডিজেল, অকটনেরে মতো জ্বালানি। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অবশ্যই যানবাহনে ডিজেল ও পেট্রোলের ব্যবহার হ্রাস করতে হবে। এসকল জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে ইলেক্ট্রিক যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি হতে পারে একটি সমাধান। তবে ইলেক্ট্রিক যানবাহনের ব্যবহার বৃদ্ধি যথেষ্ট জটিল কাজ। এক্ষেত্রে হাইড্রোজেন জ্বালানি হতে পারে যানবাহনের উৎকৃষ্ট জ্বালানি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত হাইড্রোজেন জ্বালানি আগামীতে পরিবেশবান্ধব পরিবহন খাতের স্বপ্ন দেখাতে পারে।

বৃক্ষরোপণের হার বৃদ্ধি জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বৃক্ষরোপণের কোনো বিকল্প নেই। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে বৃক্ষরোপণের চেয়ে ফলদায়কপদ্ধতি আর হতে পারে না। প্রয়োজনের তাগিদে গাছ কাটা হলেও দেশগুলোকে বৃক্ষ রোপণের হার বাড়াতে হবে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ জানায়, ‘বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হলে বাতাস থেকে কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্যাস দূর করতে হবে। বায়ু থেকে কার্বন-ডাইঅক্সাইড দূর করতে গাছের বিকল্প নেই।

তাছাড়া, জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বৃক্ষ ও জলাভূমির কোনো বিকল্প নেই। পরিতাপের বিষয়, গাছপালা-বৃক্ষ, বনভূমি সাফ করে আমাদের দেশে, এমনকি ফসলের জমিতেও ইটভাটা, তীব্র পানিদূষণকারী ডায়িং কারখানা ও কম্পোজিট মিল তৈরি হচ্ছে। এগুলো, অবশ্যই আমাদের দেশে অভ্যন্তরীণ পরিবেশ মারাত্মক দূষিত করছে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল প্রতিরোধের ক্ষমতা হ্রাস করছে।

বায়ু থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস দূরীকরণ গ্রিনহাউস গ্যাস সূর্য থেকে আগত তাপ পৃথিবীপৃষ্ঠে প্রতিফলিত হওয়ার পর মহাশূন্যে বিলীন হওয়ার পথে বাধা। এর ফলে পৃথিবী উষ্ম থাকে। গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রা অধিক হলে পৃথিবী অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়। ফলে পৃথিবীর স্বাভাবিক জীবন ধারণ ব্যহত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিনিয়ত বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস দূর করতে হবে।

সমস্যা হলো বিশ্বের শক্তিধর ও প্রভাবশালী দেশগুলো নিজেদের শিল্প ও উৎপাদনের হার বাড়াতে চায়। ফলে তারা নিজেদের দেশের কার্বন নিঃস্বরণ না কমিয়ে অন্য দেশগুলিকে সিংক বানাতে চাইছে, এবং ফান্ড ও গ্রিন টেকনোলজি দিয়ে দূষণ কমাতে চাইছে। এটা সুদূরপ্রসারী কোনো ফল বয়ে আনবে না। ফলে প্রায় প্রতিটি কপ (জাতিসংঘের কনফারেন্স অব পার্টিজ) সম্মেলনেই সিদ্ধান্ত আসে ফান্ড প্রদানের এবং টেকনোলজি ট্রান্সফারের। এইসব সিদ্ধান্ত জলবায়ুর সুদূরপ্রসারী সুফল বয়ে আনবে না।

বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন-ডাইঅক্সাইড বা অন্য কোনো গ্রিনহাউস গ্যাস কৃত্রিমভাবে দূর করা গেলে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অথবা গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপন্ন হওয়ার পর এর উৎস থেকে অন্য স্থানে সম্প্রসারণ রোধ করা গেলে পরিবেশে এসব গ্যাসের প্রভাব অনেকাংশে রোধ করা যায়।

ইতোমথ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস দূর করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে টেক্সাসের ‘কার্বন ইঞ্জিনিয়ারিং’ এবং সুইজারল্যান্ডের ‘ক্লাইমওয়ার্কস ‘ অন্যতম। তারা একটি রাসায়নিক পদার্থের ফিল্টারের ভিতর দিয়ে বিশাল ফ্যানের সাহায্যে বায়ুমণ্ডলে বাতাস নির্গত করে বায়ুমণ্ডলের কার্বন-ডাইঅক্সাইড শোষণ করে। অন্য একটি পদ্ধতি হলো, কার্বন বন্দি ও সংরক্ষণ (capture and storage). তবে এ সকল প্রযুক্তি বেশ জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ।

দরিদ্র দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান অনুন্নত দেশের জন্য ফান্ড সৃষ্টির বিষয়টি সবসময়ই প্রাধান্য পেলেও তা যথেষ্ঠ নয়। আর এই ফান্ড পেতে দরিদ্র দেশগুলোকে অনেক জটিল মেকানিজমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়

এই করণীয়গুলো কিন্তু সঠিকভাবে করা হচ্ছে না। বৈশ্বিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সর্বোচ্চ জোর দেয়া উচিত কার্বন নিঃস্বরণ কমানোয়। সেই কাজটিই বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত কপ বা জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের নেতৃবৃন্দ একমত হতে পারেননি। তারা ফান্ড বা অনুদান দেবার বিষয়টি অনুমোদনে চুক্তি করেন। কার্বন কমাতে নিজেদের দেশের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দিতে তারা দ্বিধাবোধ করেন। বৈশ্বিক এই সমস্যা শুধু দরিদ্র দেশের ভোগান্তিই বাড়াবে না। এর কমবেশি কুপ্রভাব পড়বে সব দেশেই। অথচ সেটা ঝুলন্তই থেকে যাচ্ছে কপ সম্মেলনগুলোতে।

২০২৪’র নভেম্বরে আজারবাইজানের রাজধানি বাকুতে অনুষ্ঠিত হয় জাতিসংঘের ২৯তম জলবায়ু সম্মেলন (কপ ২৯)। সম্মেলনে রাষ্ট্রপ্রধান, বিজ্ঞানী, নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তারা অংশ নেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও ফ্রান্সের মতো বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানরা অনুপস্থিত ছিলেন, তাদের উপস্থিতি এই আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব বহন করতো।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতার বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ৪৩ শতাংশ কমাতে হবে। এই জলবায়ু সম্মেলনে ধনী দেশগুলো দীর্ঘ তেত্রিশ ঘণ্টার আলোচনার পর উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তার অঙ্গীকার করেছে।

জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে (COP 29) উন্নত দেশগুলি ২০৩৫ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য বার্ষিক ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহে “নেতৃত্ব গ্রহণ” করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এটি ২০০৯ সালে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রতিশ্রুতি থেকে বেশি।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, তাতে সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীত হয়ে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ক্ষতির শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। উষ্ণতা বৃদ্ধি মানবসৃষ্ট, প্রাকৃতিক কারসাজি নয়Ñএটি বিশ্বে আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। আর এই অমোঘ সত্যটাকে বহুবছর যাবত ধামাচাপা দেয়ার প্রচেষ্টায় রত ছিল বিশে^র শিল্পোন্নত কতিপয় দেশ। শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। উন্নত ও শিল্পায়িত বিশ্বের  লাগামহীন কার্বন নিঃসরণের শিকার এখন গোটা বিশ^; কেননা উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়ে বরফ গলছে আর তা স্ফীত করে তুলছে সাগর-মহাসাগরকে যার কুফলে অধিক ভুগবে বিশে^র দ্বীপরাষ্ট্রসহ নিম্নাঞ্চলীয় নাজুক ভৌগোলিক অবস্থানের দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশ।

প্যারিস সম্মেলনের লক্ষ্য অর্জনে নানা অ্যাকশন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে কপ ২৬ (UN Climate Change Conference of the Parties, Glasgow, 31 October–13 November 2021) অনুষ্ঠিত হয় স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে সই করা দেশগুলো বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যেন না বাড়ে, তা নিশ্চিতকরণে ব্যবস্থা নিতে একমত হয়েছিল।

২০১৯ সালের শেষ দিকে করোনাভাইরাস মহামারির উত্থানের পর এটিই সশরীরে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। চারটি লক্ষ্যকে এবারের সম্মেলনে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল।

-২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীব্যাপী কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ শূন্যতে নামিয়ে আনতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনের মাত্রা ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা

-জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগকবলিত মানুষের জন্য বাস্তুতন্ত্র রক্ষা এবং পুনরুদ্ধার করা, প্রতিরক্ষা ও সতর্কতা ব্যবস্থা গ্রহণ, অবকাঠামো তৈরি ও কৃষি ব্যবস্থাকে স্থিতিস্থাপক করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা

-এসব কাজ সম্পাদনের জন্য প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল করার জন্য উন্নত দেশগুলোর ভূমিকা রাখা এবং

-জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করা

সম্মেলনে ‘গ্লোবাল গোল অন অ্যাডেপ্টেশন’ সংক্রান্ত বৈশ্বিক লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য গ্লাসগো-শার্ম এল-শেইখ ওয়ার্ক প্রোগ্রাম অন দি গ্লোবাল গোল অন অ্যাডেপ্টেশন”প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যা বাংলাদেশের ভবিষ্যত অ্যাডেপ্টেশন কার্যক্রমকে বেগবান করবে বলে বিভিন্ন মহল থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।

ঘুরেফিরে সেই অ্যাডেপ্টেশনের বিষয়টিই বারবার উঠে আসছে। অ্যাডেপ্টেশনই বাংলাদেশের একমাত্র অপশন। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে এতো মানুষ কোথায়-কীভাবে অ্যাডেপ্টেড হবে (তা নির্ভর করে অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে কতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ, তার ওপর)। অ্যাডেপশন বা খাপ খাইয়ে নিতে যে পরিকল্পনা, অর্থ ও প্রযুক্তির প্রয়োজন হবে, সেই বিষয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আমাদের মিশন ও ভিশন হতে হবে। বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বা কার্বন নিঃসরণ ঘটিয়ে আজকের বিশ^কে বিপর্যস্ত করায় বাংলাদেশের কোনো দায়ভাগ নেই। কিন্তু ভঙ্গুর ভৌগোলিক অবস্থান ও নিম্নাঞ্চল হওয়ায় বাংলাদেশ শিকার হচ্ছে উন্নত বিশে^র লাগামহীন কার্বন নিঃসরণের কুফলে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের জন্য প্যারিস সম্মেলনের চুক্তি সুফল বয়ে আনত বিগত বছরগুলোতে।

বিশে^র প্রভাবশালী ও সমৃদ্ধ দেশগুলোর কাছ থেকে কার্বন কমানোর জোরালো ও সুস্পষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি কিন্তু এই সম্মেলনেও পাওয়া যায়নি। প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য এই সম্মেলনে একটি রুল বুক প্রণীত হয়েছিলো। আর এই রুল বুকের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিশ্রুতিগুলো খতিয়ে দেখবেন বিশেষজ্ঞরাÑএরকম কর্ম পন্থা নির্ধারিত হয়েছিলো।

কপ-২৬এর মূল লক্ষ্য ছিল তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার আশা বাঁচিয়ে রাখা, সেই উদ্দেশ্য সাধিত হলেও এটা কীভাবে পরিপূর্ণ সফলতা পাবে, তা কিন্তু তর্কাতীত নয়। খোদ কপ-২৬ সভাপতি অলোক শর্মার ভাষায়, ‘আমরা ১.৫ ডিগ্রির লক্ষ্যমাত্রার আশা বাঁচিয়ে রেখেছি, কিন্তু এর নাড়ি বড়ই দুর্বল।’

প্যারিস চুক্তির আওতায় বিশ্বের উন্নত দেশসমূহ ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে একশ বিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি।

এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, একমাত্র আইপিসিসি এর জন্মলগ্ন থেকে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এই প্যানেলের বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল বিভিন্ন বছরের ও সময়ের রিপোর্ট-এর সুপারিশগুলো যদি উন্নত দেশ আমলে আনত, আজকে বিশে^ জলবায়ু পরিবর্তনের চূড়ান্ত নেতিবাচক প্রভাব পড়ত না। বরং একধরনের বিনাশী প্রচারণা ছিল তার উল্টোপিঠে যে, জলবায়ু পরিবর্তন মানবসৃষ্ট নয়!

অনস্বীকার্য যে, শিল্পবিপ্লবের পর থেকে সাম্রাজ্যবাদী ও পরাশক্তির দেশগুলো বিলাসিতায় ও আরাম-আয়েশে থেকে, পৃথিবীর সিংহভাগ ভূখণ্ডকে চরম বিপদের মুখে ফেলেছে জলবায়ু পরিবর্তন নামের দানবের জন্ম দিয়ে।

তারা জেগে থেকেও ঘুমের ভান করে পড়ে ছিল। তারা জানতো, এই পৃথিবীটা আমাদের নয়; আমরা শুধুমাত্র একে ধার নিয়েছি আগামী প্রজন্মের কাছ থেকে।

সম্মেলন ব্যর্থ ধরে নিলে বলতে হয় যে, ব্যর্থতা দিয়ে যার শুরু তার ব্যর্থতার দায়ভাগ বাংলাদেশের নয়। মাদ্রিদ সম্মেলন শেষ হয়েছিলো ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ দিয়ে, যার অর্থ ছিল বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণ আদায়ে ওয়ারশো ইন্টারন্যাশনালের যে দীর্ঘ সময় ও জটিল ম্যাকানিজমের মধ্য দিয়ে যাবে, সেই সময় ও পরিশ্রমে বাংলাদেশ নিজস্ব উদ্যোগে অনেক এগিয়ে যেতে পারে অবকাঠামো উন্নয়ন ও অ্যাডেপ্টেশনের দিকে। সেইক্ষেত্রে প্রয়োজন ফান্ড ও ক্ষতিপূরণ।

বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তন বলতে বোঝায় গ্লোবাল ওয়ার্মিংÑযা বিশ্বের গড় তাপমাত্রার ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধিকে নির্দেশ করে, এবং পৃথিবীর জলবায়ু ব্যবস্থার ওপর এর বিস্তৃত প্রভাবকে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিস্তৃত অর্থে এতে অতীতের দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনগুলিও অন্তর্ভুক্ত। বর্তমান তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণ মানব ক্রিয়াকলাপ, বিশেষ করে শিল্পবিপ্লবের পর থেকে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার।

জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, বন উজাড়, এবং কিছু কৃষি ও শিল্প খাতের কার্যক্রম গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করে। এসব গ্যাস সূর্য থেকে আগত তাপ শোষণের পর পৃথিবী যেই তাপ বিকিরণ করে, তার কিছু অংশ ধরে রাখে, ফলে নিম্ন বায়ুমণ্ডল উষ্ণ হয়। কার্বন ডাইঅক্সাইড হল বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রধান গ্যাস, যার মাত্রা পূর্ব-শিল্প যুগ থেকে প্রায় ৫০% বেড়েছে এবং তা কয়েক মিলিয়ন বছরে দেখা যায়নি।

জলবায়ু পরিবর্তন পরিবেশের ওপর ক্রমাগত বড় প্রভাব ফেলছে। মরুভূমি প্রসারিত হচ্ছে, এবং তাপপ্রবাহ ও বুশফায়ারের ঘটনা আরও ঘনঘন ঘটছে।

আর্কটিকে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে চিরহিমভূমি গলছে, হিমবাহ হ্রাস পাচ্ছে এবং সামুদ্রিক বরফও হ্রাস পাচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘূর্ণিঝড়কে আরো তীব্র করছে, পাশাপাশি খরা ও অন্যান্য চরম আবহাওয়ার ঘটনাও বাড়িয়ে তুলছে। পার্বত্য অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র, প্রবাল প্রাচীর, এবং আর্কটিক অঞ্চলে দ্রুত পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে অনেক প্রজাতিকে স্থান পরিবর্তন করতে বা বিলুপ্ত হতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে উষ্ণতা বৃদ্ধির হার সীমিত করলেও কিছু প্রভাব শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে থাকতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে মহাসাগরের উষ্ণতা বৃদ্ধি, অম্লতা বৃদ্ধি, এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি।

জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের ওপরও বড় ধরনের হুমকি তৈরি করছে। এটি বন্যা, চরম তাপপ্রবাহ, খাদ্য ও জল সংকট বৃদ্ধি, রোগব্যাধির বিস্তার এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনা বাড়ায়। এর ফলে মানব অভিবাসন এবং সংঘাতের ঘটনাও ঘটতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জলবায়ু পরিবর্তনকে ২১ শতকে বিশ্বের স্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম বড় হুমকি হিসেবে বর্ণনা করেছে।  যদি উষ্ণতা সীমিত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া হয়, তাহলে সমাজ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাগুলি আরো গুরুতর ঝুঁকির মুখে পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ যেমন বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা খরার সহনশীল ফসল চাষের মাধ্যমে কিছুটা ঝুঁকি কমানো যায়। তবে, অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোজনের সীমা পৌঁছে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল সম্প্রদায়গুলোর বৈশ্বিক নির্গমনের হার কম হলেও, তাদের অভিযোজনের সামর্থ্য কম এবং তারা জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।

জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ধাপে ধাপে বন্ধ করা সম্ভব, যদি জ্বালানি সাশ্রয় করা হয় এবং এমন শক্তির উৎসে রূপান্তর করা হয় যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কার্বন দূষণ সৃষ্টি করে না। এই পরিচ্ছন্ন শক্তির উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে বায়ু,  সূর্য,  জলবিদ্যুৎ, এবং পারমাণবিক শক্তি। এসব উৎস থেকে উৎপন্ন পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ পরিবহন, ভবন গরম রাখা, এবং শিল্প প্রক্রিয়া চালানোর জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়।  বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বনও অপসারণ করা যায়, যেমন-বনভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি এবং এমন কৃষিপদ্ধতি ব্যবহার করে, যা মাটিতে কার্বন সংরক্ষণ করে।

মানুষ কী করতে পারে?

-গাড়ির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সাইকেল বা জনপরিবহনের ব্যবহার বাড়াতে পারে

-বাড়িতে যাতে গরম বা ঠাণ্ডা কম ঢোকে তার ব্যবস্থা নিতে পারে

-মাংস এবং দুগ্ধজাত খাবার কমাতে পারে

-বিমান ভ্রমণ কমাতে পারে

সামনের কপ সম্মেলনে কার্বন নিঃস্বরণ কমাতে উন্নত দেশগুলো থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে, যা হবে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সবচাইতে জরুরি পদক্ষেপ। এর কোনো বিকল্প নেই। টেকনোলজি ট্রান্সফার, নবায়নযোগ্য এনার্জির ব্যবহার এবং সৌরশক্তি ব্যবহার সাময়িক সমাধান। আর এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশের জন্য এগুলোর ব্যবহার এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে।

অতএব কেবল ফান্ড সৃষ্টির ওপর জোর না দিয়ে  স্বল্পোন্নত দেশের প্রতিনিধিদের প্রধান কাজ হবে, কার্বন কমাতে শিল্পোন্নত দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, আর সেইসাথে নিজ নিজ দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে নিরলস কাজ করে যাওয়া।