
আবুল হাসান এর কবিতা
এক
অবশেষে জেনেছি মানুষ একা
জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা
দৃশ্যের বিপরীতে সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনদিন
দূরে বসে প্রবাহের অন্তর্গত আমি, তাই নিজেরই অচেনা নিজে
কেবল দিব্যতা দুষ্ট শোনিতের ভারা ভারা স্বপ্ন বোঝাই মাঠে দেখি
সেখানেও বসে আছে বৃক্ষের মতোন একা একজন লোক
যাকে ঘিরে বিশজন দেবদূত গাইছে কেবলি
শত জীবনের শত কুহেলী ও কুয়াশার গান!
(‘পাখি হয়ে যায় প্রাণ’)
দুই
এতদিন ছিলাম তবুও প্রণয়-প্রণতি কাজশূন্যতা সঙ্গম
কিছু দিন এ-ওকে ধারণ করে!
অবশেষে এখন আবার সেই
প্রথমের আভাস, বিন্যাস :
সত্তা : আবার যা তাই!
একা হয়ে গেছি, একা! সর্বদাই শূন্য, একা-ভালোলাগে
তবু ভাবি আমার একায় যদি শুদ্ধ হয় সন্তানেরা
আর ঐ সহস্র অপর!!
(‘অন্তর্পুরুষ’)
*(আবুল হাসান (জন্ম: ৪ আগস্ট ১৯৪৭ – ২৬ নভেম্বর ১৯৭৫) বাংলাদেশের একজন আধুনিক কবি যিনি ষাটের দশকের সঙ্গে চিহ্নিত। পেশায় তিনি সাংবাদিক ছিলেন। তার প্রকৃত নাম আবুল হোসেন মিয়া আর সাহিত্যিক নাম আবুল হাসান। তিনি ষাটের দশকের জনপ্রিয় কবিদের একজন এবং সত্তুরের দশকেও গীতল কবিতার জন্য উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয়তা লাভ করেন।)
শার্ল বোদলেয়ার-এর তিনটি কবিতা
১
বিষাদ
ফেব্রুয়ারি, বিরক্তিকর প্যারিস, দাপুটে বৃষ্টি
অবিরত ঝরে বিষণ্ণ মুষলধারায় কাছের গোরস্তানে শুয়ে থাকা
ফ্যাকাসে ইজারাদারদের চাতালে আর এক বিনাশক গভীর শৈত্য
ছড়ায় কুয়াশাক্রান্ত শহরতলির ভাড়াটিয়াদের আবাসে।
আমার বিড়ালটা আয়েশ পায় না ওই টালির উপর শুয়ে
ওর কাদামাখা শরীরে ওম মেলেনা একটুও;
প্রেতাহত ক’জন বয়সী কবির আত্মা নর্দমায় ঘুরে ফেরে
গুমরায়, যেনো হিমেল হাওয়ার কাছে প্রেতের তীব্র ফরিয়াদ।
গির্জার ঘন্টার আর্তনাদ, পোড়া কাঠখড়ির ধোঁয়া ফায়ারপ্লেসে
ঘড়ির শ্লেষ্মাময় ভুতুড়ে গুনগুন
আর তারই সাথে বদগন্ধ তাসের আসর
এ এক শোথরোগী বৃদ্ধা চাকরানীর উত্তরাধিকার,
হরতনের ঠগী ফুলবাবু আর ইস্কাবনের বিবি
খুঁড়ে তোলে তাদের উদ্দাম কামাচার।
২
স্মরণিক?
আমার হাজার বছর বাঁচার চাইতেও বেশি!
দেরাজের ড্রয়ারে ঠেসে রাখা কোনো নথি নয়,
প্রেম-পত্র, বিয়ের-নিমন্ত্রণ, দলিল,
কিম্বা কাগজে মোড়ানো কোনো কেশগুচ্ছ নয়,
কিছুই নেই দেরাজে যা আছে লুকানো আমার এই মাথার ভেতর।
এই অন্ধকার সমাধিবিন্যাসে, এই পিরামিডে
শব আছে যত, ঐ আসল সমাধিস্থানে নেই তত:
আমি কবরস্থান এক, জ্যোৎস্নার ঘৃণা,
এখানে ক্লেদাক্ত দানব পোকারা সব বেঁচে থাকে
আমারই প্রিয় মরদেহগুলো নির্লজ্জ্য খুটে-খুটে খেয়ে।
তাকে তাকে সাজানো মেয়েলী পোশাকের আমি এক শীর্ণ মহিলা-গোঁসাঘর
মরা গোলাপের সুবাস মাখা, ধুলার আস্তরে ঢাকা;
এখানে শুধু বিবর্ণ প্যাস্টেল আর পাণ্ডুর নিষ্ঠুরতা
বেঁচে থাকা ফাঁপা সুদীর্ঘ শ্বাসাধারে নিঃশ্বাস নিয়ে।
দিনগুলো খুড়িয়ে চলে ধীরতর লয়ে
বছরের সেই ভারী আবহাওয়ার মৌসুমে
বিষাদ, নিঃসঙ্গ বৈরাগ্যের পরিণাম,
অনন্তকালের মাত্রায় নেয় রূপ . . .
অনন্তর, নশ্বর কাদামাটি, তুমি তো শুধু
নামহীন আতঙ্কে ঘেরা পাথরের টুকরো ছাড়া কিছু নও,
মানচিত্রে অবলুপ্ত এক পুরাকালের স্ফিংস
বিশ্বে বিস্মৃত, উগ্র মেজাজ তার
৩
আমি যেন ঘোর বর্ষা-রাজ্যের বাদশা, ঐশ্বর্যবান
কিন্তু অসহায়, জরাজীর্ণ অথচ এখনও যুবক
যে তার সেবায়েত শিক্ষকদের করে অবজ্ঞা, সময় নষ্ট করে
সারমেয় আর জানোয়ার নিয়ে, কিন্তু আনন্দ পায়না কিছুতে;
কিছুতেই মন কাড়ে না তার, বাজপাখি কিম্বা শিকার
অথবা রাজ-তোরণে অপেক্ষমান অনাহারী।
তার প্রিয় ভাঁড়ের রগরগে অশ্লীলতা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে
–রাজ-পঙ্গুত্বকে মুছে ফেলে পারে না আমোদে মাতাতে—
আর ওই সৌখিন রমণীরা রাজকীয় অনুমোদনে
পরে না তো খোলামেলা পোশাক আর
অস্থিসার যুবকের মিষ্টি হাসির আশায়।
রাজশয্যা হয়ে যায় রাজসমাধি।
সেই যে জাদুকর যে স্পর্শে গড়ে সোনা, সেও অক্ষম
তার অন্তর্গত গভীরের অশুদ্ধতাকে শুদ্ধ করতে,
রোমের রক্তস্নাত পুরুষানুক্রমিক বংশসূত্র
আর তাদের পাতশাহী পতন সময়কালের ইতিবৃত্তও
সক্ষম নয় আজ এই রক্তশূন্য জীবদেহ পুনরুজ্জীবনে
যে দেহ থেকে চুইয়ে পড়ে না রক্ত কোনো বৈতরণীর লোনা জল ছাড়া।
*ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ: আবদুস সেলিম
(শার্ল বোদলেয়ার। ফরাসী কবি (৯ এপ্রিল ১৮২১-৩১ অগাস্ট ১৮৬৭) বোদলেয়ার নিজেকে মডার্নিটি-র কবি বলে চিহ্নিত করেছেন এবং তার এই কাব্যপ্রতিভার জন্য বিশ্বজুড়ে তিনি আধুনিক কবিতার জনক বলে স্বীকৃত—যে আধুনিকতা জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু এবং অপরাপর একাধিক আধুনিক বাংলা কবিকেও স্পর্শ করেছে। বোদলেয়ার-এর আধুনিকতা তাঁকে অ-মহান এবং পতিত জীবন ও বিষয়বস্তুকে তাঁর কবিতার উপজীব্য রূপে গ্রহণ করতে শিখিয়েছে, এবং বোদলেয়ার নিজে সেকথা স্বীকারও করেছেন একাধিকবার।)
গাসসান জাকতানের কবিতা
১
‘ক্যাভাফির নির্মাতারা’
আমার কণ্ঠে এক সুর আছে
কখনো তার স্পর্শ পাইনি আমি—
তবে তা-ই আমার একমাত্র সোনার টুকরো
এবং তা-ই আমার অবলম্বন
তাতে আছে উপস্থিত রচনার সম্ভাবনা
আছে ক্রিয়াপদের কোমলতা
এবং আছে বর্ণনার দৃঢ়তা
যেন ক্যাভাফির জাগিয়ে তোলা গুপ্ত নির্মাতারা
পাহাড়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল
এবং তা খোঁড়া শুরু করে দেয় আমারই বালিশ দিয়ে!
(খড়ের পাখির মতো তা আমার পিছু নেয়, ২০০৮)
২
একা নও তুমি বিজন বনে
জাবালে নাজমায়, বনের ধারে, জাদুকর পথ আগলে দাঁড়াবে আমার
কালো মাস্তুলের নৌকা চলে যে পথে
খড়ের মুখোশ আর শোকের বসনে মৃতেরা যেখানে বসে থাকে ভোরের আগ থেকে,
যে পথ পাড়ি দেয় পাখি
যেখানে সাঁতরে বেড়ায় সাদা কুয়াশা আর ঝোপেরা খুলে রাখে দরজা সকল
যেখানে ঢাল থেকে ভেসে আসে কারও কণ্ঠ
এবং শোনা যায় ঘণ্টাধ্বনি, ডানা ঝাপটানোর শব্দ
রাতের খাঁজ কেটে এ বন যেন উড়ে চলেছে সব পর্বত বেয়ে!
…কৃষক, জেলে, শিকারি ও বিস্মিত সৈন্য,
মোয়াবি, আসিরি, কুর্দি, মামলুক,
মিসর থেকে আসা কথিত হিব্রু,
সোনার রথে চড়া মিসরি,
সাদা দ্বীপের জাতিগোষ্ঠী, কালো পাগড়িপরা পারসিয়ান,
বেত-ভাঁজ-করা মূর্তিপূজক দার্শনিক
এবং অসুখের শেকড় খুঁজে-ফেরা সুফির দল…
ডানার ঝাপটানি বনকে টেনে নেয় অন্ধকারের ধারে!
জাবালে নাজমায়, বনের ধারে
যেখানে অনুপস্থিতের নামাজ বিছিয়ে দেয় শুদ্ধতার জায়নামাজ
এবং দেখা যায় গিরিখাতটির শেষ প্রান্ত,
অতি সন্তর্পণে পাশ দিয়ে বয়ে যায় সমুদ্রের ঘ্রাণ
ফাটলগুলি যেন জিনের ফসল
এবং আলো ছড়ায় সন্ন্যাসীদের প্রার্থনা—
তখন আমি জীর্ণ সাইপ্রাসের ওপর ঘুমিয়ে থাকা কুষ্ঠরোগীদের ভূত দেখি
জাবালে নাজমায়, বনের ধারে
পুরোনো এক চেনা কণ্ঠস্বর শুনতে পাব,
আমার দিকে পাশা ছুড়ে দেওয়া আমার বাবার কণ্ঠস্বর
কিংবা মালিকের—
এপিটাফে তিনি হাঁকাচ্ছেন স্বর্ণকেশী ঘোড়া
অথবা হুসাইন আল-বারগৌসির কণ্ঠস্বর—
বাদামগাছের নিচে ঘুমিয়ে আছেন যিনি
তাঁর লিখে যাওয়া অসিয়ত মোতাবেক
এবং আমার কণ্ঠস্বর—
একা নও তুমি বিজন বনে।
(খড়ের পাখির মতো তা আমার পিছু নেয়, ২০০৮)
*(কবিতাশৈলীতে গাসসান জাকতান পঞ্চাশের দশক থেকে আরবি কবিতার নেতৃত্ব দিয়ে আসা কবি প্রজন্মকে ছাড়িয়ে গেছেন এরই মধ্যে। যেসব আরবি কবির কবিতা আধুনিক চিন্তা ও প্রযুক্তির মৌলিক চিহ্নবাহী, তাঁদের মধ্যে সেরা কবি গাসসান জাকতান। তাঁর কবিতা উজ্জ্বল চকচকে মনোরম দৃশ্যে সজ্জিত, যা কবিতার শরীরকে জীবন্ত করে তোলে। তাতে ফুটে ওঠে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব ঘটনাপ্রবাহ; মানুষের যাপিত জীবনের সবকিছুই। ফলে তাঁর কবিতা সাধারণভাবে সমকালীন আরবদের জীবনের ওপর আলো ফেললেও বিশেষভাবে ফিলিস্তিনি মানুষের জীবনপ্রবাহের প্রতিনিধিত্ব করে। )
আল মুজাহিদীর কবিতা
মাটি গরীয়সী
খাঁটি, খাঁটি, খাঁটি
বাংলা মায়ের হরিৎ আঁচল
আমার দেশের মাটি।
ভালোবাসি, বাসি
এই মাটি ফুল পাখি আর
নীল জোনাকির হাসি।
মাটি, মাটি, মাটি
সোনার উঠোন, রূপার আকাশ
কী যে পরিপাটি।
এই দেশ কী রূপসী
কী যে গরীয়সী।
*(আল মুজাহিদী (জন্ম: ১ জানুয়ারি ১৯৪৩) বাংলাদেশের একজন কবি ও সাহিত্যিক। তিনি ষাট দশকের কবি হিসাবে চিহ্নিত।)
ত্রিদিব দস্তিদারের কবিতা
তুমি ঘুমিয়ে পড়ছো ঘুমিয়ে পড়ছো
তুমি ঘুমিয়ে পড়ছো ঘুমিয়ে পড়ছো
তোমার চারপাশে এখন কালো মেঘ
সূর্য-ডোবার দিন
দূরে কালো হিমালয়, ঘুমন্ত মহানন্দা নদী
মহানন্দা জাগবে আবারো জলকাল্লোলে, কেলিতে
ভালোবাসা নামের অজস্র দেহলগ্ন ঢেউ-এ,
পলিমাটিতে, — কবিতার বীজ রোপণের মন্ত্রে
দেহ-ভূমির ওঠানামার উপত্যকায়
তৃষ্ণার সৌধ-শরীর নির্মাণে
অলীক গহবরে দেহ-কসরতের টানে, সাপ-ভঙ্গিমার সড়কে
কালো বিষ ছড়ানো ঘড়িহীন দিগন্তে
সময় যেখানে গলে যায় বার্গম্যানের হাতে
সময়কে অতিক্রম করতে পারোনি তুমি
সময় অতিক্রম করেছে তোমাকে বহুবার।
ঘুমের মধ্যে, না নেশা-ঘুম ঘুম কামার্ত তৃষ্ণার মধ্যে
কিংবা তোমার অস্তিত্বের একান্ত তৃষ্ণাগ্নির ছোঁয়ায়
তুমি ঘুমিয়ে পড়ছো ঘুমিয়ে পড়ছো
তুমি ঘুমিয়ে পড়ছো ঘুমিয়ে পড়ছো
আমার যাদুবিদ্যার হিমাগ্নি সম্মহনীতে,
না রতিক্লান্ত বেপুথ প্রেমিক-কুণ্ডে?
*ত্রিদিব দস্তিদার (১৯৫২-২০০৪) বাংলাদেশি কবি
বিশ্বজিৎ মণ্ডলের দুটি কবিতা
১
নগ্নিকার স্নান ঘর
কথা শেষ হলেই জেগে ওঠে, নিঃসঙ্গ স্নান ঘর
কথকতায় সেজে ওঠে, দেহ বল্লরের ওম…
নেমে আসে, অপরূপ রূপকথার দল
থমথমে দুপুর জুড়ে জেগে ওঠে, প্রসন্ন সাওয়ার…
একা নগ্নিকা তুমি, বুদবুদের শাসনে আঁকতে থাকো
গোপন কথার সুর
অকথ্য অত্যাচার বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল
অবয়ব জুড়ে অস্ফুটে লেগে থাকে, স্নান ঘরের দৃশ্য
২
নক্ষত্র ভেজা মেঘেদের গল্প
অদৃশ্য হয়ে যাব বলে, ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম
বাহান্নর মেহগনিতলায়
পাশ কাটিয়ে চলে গেল, গোপন ইচ্ছার অতৃপ্ত
মানুষের দল
ডানা থাকলেও উঠতে পারিনি,পক্ষাঘাতের কারণে
অসুস্থ হরিণ আমি, ব্যভিচারের উদ্যানে…
ইদানীং বড় বেশি জ্বর আসে, পরিযায়ী স্বপ্নের মত
শূন্যের আলপথে দাঁড়িয়ে একা খুঁজছি__
নক্ষত্র ভেজা মেঘেদের সস্তা গল্প
*(বিশ্বজিৎ মণ্ডল, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ)
দোলন চাঁপার তিনটি কবিতা
১
তন্দ্রাহারা কৌতূহল
ভোরের কুসুম রোদ অকালপক্ক ফল
বোশেখের স্রোতস্বিনী নদী বৃষ্টির প্রলাপ
কাকের কর্কশ ডাক
দাও মেঘ দাও জল
পাখিদের কোলাহল,
টকটকে লাল গোলাপ।
এসব কীর্তিকলাপ
তরতাজা ভোরের আহ্বান
মিলিত উল্লাস সাদা কালো মেঘ
রক্তিম অঞ্জলি
বৃষ্টি ভেজা জরাজীর্ণ নগরীর
তির্যক লেলিহান
বাগানের ইতস্তত
চারজোড়া গোলাপের কলি।
মেহগনির তামাটে নগ্নতায় খোলে
ভোরের কপাট
বাতাসে ভাসে ঘুঘুর ডাক
তন্দ্রাহারা কৌতূহল
এক চিলতে বাগান স্বপ্নঘোর যমুনার ঘাট
পাহাড়ের ঘন্টা ধ্বনি বাজে
দাও মেঘ দাও জল।
২
নারীর নোলক
বাতাসের যে স্পর্শ আসে
ভালোবাসার অধিক
ডেকে ওঠে ভোরের পাখি
আকাশ মেলেছে আঁখি
শুভ্র রোদের ঝিকমিক
ভালোবাসার মসৃণ ঘাসে
আকাশে রক্তিম আভাসে।
মেঘের বাহুতে বেষ্টিত পাহাড়
ঠোঁটের চুম্বনে খসে পড়ে পালক
আহা মায়ারী পাখির প্রেম
ভোরে শোভিত মেঘ পারাবার
ঘাসফুল অদ্ভুত নারীর নোলক
সকাল সেজে ওঠে প্রকৃতির ফ্রেম ।
৩
হৃদয় এক্সপ্রেস
প্রতিক্ষা আর ক্লান্তির অবসান হবেনা হয়তো এক জনমে,
তোমার হৃদয়ের কাছে এসে ফিরে গেছি বারবার,
স্বপ্নের সিঁড়ি ভাঙি ধাপে ধাপে…
জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে আছে হৃদয় এক্সপ্রেস…
তপ্ত দহনে পুড়ছে যুগল পথ…
স্বর্গীয় প্রেম জানিনা, শুধু জানি ভাঙনের খেলাটা…
যে খেলায় জয়ী তুমি…
আজকাল খুব বেশি মনে পড়ে কৈশোরে হেরে যাওয়ার কথা…
কিন্তু শিহরণ জাগেনা…
শুধু বুকের কার্নিশে জমা হয় কষ্ট।
*(কবি ও গীতিকার, বাংলাদেশ)
আতোয়ার রহমানের দুটি কবিতা
১
এই মুহূর্তে
এই মুহূর্তে রেললাইনের আলোহীন শেডের নীচে
আবর্জনার মতো পড়ে থাকা আধপাগলি
মেয়েটা পোড়া রুটি থেকে
একটু একটু করে জীবনরস শুষে নিচ্ছে,
ছায়া সেই রুটির টুকরো হয়ে ঢুকে যাচ্ছে
তার হা-এর অন্তরালে।
এই মুহূর্তে রক্ত বিক্রেতা গরিব বাবা
হাসপাতালের মূল ফটকপেরিয়ে গেল,
বেদনার আনন্দে তার চোখ সিক্ত হলো,
রক্তিম পঙক্তিরা তার হেঁটে যাওয়াকে
কাব্যিক যাত্রাপথ বানিয়ে তুললো।
এই মুহূর্তে একজন মা তার অসুস্থ সন্তানকে
ধরে আছেন জড়িয়ে স্নেহকোমলতায় আবৃত করে
ওষুধের টাকা নেই এটা জেনে।
এই মুহূর্তে একটি শিশুকে বাইরে বিশ্বে ঠেলে দিচ্ছে
তার সামনে থাকা কষ্ট সহ্য করার জন্য,
তার ছোট্ট শরীর খুব দুর্বল দেখাচ্ছে
জীবন দীর্ঘ বা ছোট হতে পারে সহজ বা কঠিন
সামনে কি আছে কে বলতে পারে?
এই মুহূর্তে একজন অফিসে ঘুষ দিয়ে বেরিয়ে এল
এখন গুম হওয়া পুকুরে খালে খেলার মাঠে
কয়েকটা বাহারি বাড়ি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে,
উচু বহুতলের মাথায় অহংকারি সমীরণ
টপফ্লোরের গ্লাসে- ‘ভিউ দারুণ’!
২
একটি নদী ছিল
আমার একটি নদী ছিল, সেই নদীর নাম গিরাই
আমার একটি গ্রাম ছিল, সেই গ্রামের নাম গিরাই
বাড়ির সামনে চচকার বিল, পিছনে ক্ষীনতোয়া নদী,
কখনো সোনালি কখনো সবুজ আবার কখনো রূপালী,
এক চিতল মাছের সাদা পেট সদৃশ হাজির হয়ে
বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত ও উর্বর করে চলেছে সাত পুরুষ পরম্পরায়।
আমি বড় হয়েছিলাম এর ভাঙা পথের রাঙা ধুলায়।
আমি বিষন্ন হলে দুঃখ পেলে ডেকে নিত সে,
স্নেহজলমাখা হাত বুলিয়ে দিতো মাথায়।
নদীর ভালোবাসায় আমার দুহাতে পাখনা গজায়
হই রূপালী রঙের পাখি, আমি উড়তে থাকি,
পিছনে ফেলে মন খারাপের স্টেশন।
আমার কন্ঠ বদলে যায় সবুজে,
সকাল সিক্ত হতো দোয়েলের শিসে।
নদীর ধারে ফুটে থাকে সাদা কাশফুল,
ঢেউ খেলানো ধানের হাসিতে উপচে পড়ে দু’কুল।
শিমুলের গাড় লাল আর সরষে ফুলের হলুদে হৃদয় ব্যাকুল।
অস্তগামি সূর্যের নরম আলোয় গোধুলির শেষ রঙে,
নদীর জলে কেউ যেন আবির ঢেলে দেয়,
গাঙচিলেরা গাছে ফিরে যায়।
রাতের তারার আলো, স্নিগ্ধ জোতস্না, মোহময়
এর থেকে ছড়িয়ে পড়া এক নীল মায়াবি রেখা
ছুঁয়ে দেয় আমার শরীর, হাত পা মাথা
ফলভারে নুয়ে-পড়া পাইয়াল গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা।
কাছেই শ্মশান, কচি প্রাণ, ভূতের ভয়
মা, ছিলো আমার একমাত্র নির্ভার ও অলৌকিক আশ্রয়
মায়ের স্নেহমাখা হাত মাথায় শ্বাসরুদ্ধ দুঃসময়ে,
সুরা পড়ে বুকে মুখে ফুঁ কে আর আমায় দেবে?
টক আমগাছের ছায়া মাড়িয়ে. বিল পার হয়ে,
সুপারি বাগানের মাঝখান দিয়ে
মাথার সিঁথির মতো সরু আঁকাবাঁকা পথ মাড়িয়ে
ঘুরি হাফ প্যান্টের পকেটে রঙিন মার্বেল নিয়ে,
সুপারি গাছের ফাঁক গলে আসা নরম রোদের আলিঙ্গনে।
ধান-কেটে-নেওয়া কোন জমির ওপর দিয়ে হাঁটা
থেকে থেকে কাঁটা বেঁধে পায়ে, পিঠে এসে লাগে রোদ্দুরের ফলা।
রাখাল বালক বাঁশি বাজাতে বাজাতে হেঁটে
যায় গ্রামের রাস্তা দিয়ে।
সেই বাঁশির সুরেই যদি কেটে যেত জীবনটা।
সারা দুনিয়ায় ঘুরি, কিন্তু পিছে টানে সে মফস্বলি তৃষ্ণাটা।
*(কবি ও গল্পকার, বাংলাদেশ)
অরণি বসু’র কবিতা
বানভাসি
হাত বাড়ালেই কি আর সবসময় ছুঁয়ে ফেলা যায়—
মাথার ওপর ছেয়ে আছে ঘন কালো মেঘ,
চক্কর কাটছে প্রশাসনের হেলিকপ্টার আর
এক বুক জলে ত্রাণের প্রত্যাশায় ঊর্ধ্বমুখী বিপন্ন মানুষ।
ভেসে যায় খড়কুটো, ধ্বসে পড়ে গৃহস্থের সামান্য আয়োজন।
চোখের জল শুকিয়ে গেছে কবে, গায়ের জল আর,
শুকোতেই চায় না।
টেলিভিশনের দল আসে, কাগজের লোক আসে,
শহর থেকে স্বেচ্ছাসেবী আসে, আসে রং-বেরঙের নেতা।
জলের নিয়মে জল নেমে যায় একদিন,
যারা এসেছিল তারা ফিরে গেছে আগেই—
পড়ে আছে দু’কূল ছাপানো খিদে আর
রাশি রাশি ভারা ভারা বঞ্চনা।
*(অরণি বসুর জন্ম ১৯৫১ সালে। সত্তর দশকের বিশিষ্ট কবি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ — খেলা চলে, শুভেচ্ছা সফর, লঘু মুহূর্ত এবং ভাঙা অক্ষরের রামধনু। ২০২২ সালে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বেরিয়েছে।)
কৌস্তুভ দে সরকার-এর তিনটি কবিতা
শুভ বিজয়া
ফুল পাতা পড়ে আছে
রঙ পচা জল
কাঠামোয় কাদা আর
শাড়ির আঁচল
ভেসে আছে মুখ যেন
অভিমানী চাঁদ
অপেক্ষার বারো মাস
ব্যপ্ত অবসাদ ।
আবর্তন
গড়িয়ে গেলেই সেটা ঘর্ষণ নয়,
তেমনি অনেক কিছুই…।
আসলে আমরা সব সময় সমার্থক শব্দ খুঁজে চলি ;
আমাদের প্রয়োগগুলোও একই অক্ষে আবর্তিত হয় ।
কিছুটা নিছক সমালোচনার জন্যই
আমাদের কাঁচিতে শুধু ভুল ধার দিয়ে চলি ।
করোটি কংকাল খুলে গেলে দেখা যায় –
আরে ! এতো ছিল বিফল প্রশ্রয় !
উপসংহার টানা যাক—
আমরা স্বেচ্ছায় আবর্তিত হই
আমাদের অজ্ঞাতসারেই ।
মন খারাপের কবিতা
ভাঙা মন্দিরে ওই বাঁশ দড়ি পেড়েক থারমোকল
একমাত্র হ্যালোজেন ঘিরে কাঁচপোকাদের নাচ
দেখছি বাজেট ফেল করা চোখে, যেন ছন্দ নেই আর ;
যুদ্ধ শেষ , বুঝে ওঠা মুশকিল , জিত না হার এবার ।
হারানো আশ্বিন সন্ধ্যা , থেমে আছে গান , ভিড় নেই কোথাও ;
পাখিরা পালক গুটিয়ে নতুন কোন অপেক্ষায় – সঙ্গলিপ্সার ;
যে আলোতে মিষ্টতা ছিল , রেশ ছিল কিশোরী হাওয়ায়
উদ্দমতা চাপা ছিল সোৎসাহে , উৎসবের মেজাজে
কোত্থেকে আজ এক চোরা- পাহারাদারের মত রাত এসে
এক বাক্যে পণ্ড করে দিল সব ।
ভাষাহীন আজ এই ভাসানের পর
কাঠামোগুলো ওভাবে আলগোছে টেনে নিয়ে যাওয়া
দেখতে আর ভালো লাগছে না
টিভি বন্ধ কর , প্লীজ ।
*(কবি, পশ্চিমবঙ্গ)
হাসান জাহিদ-এর দুটি কবিতা
প্রশ্ন
আমাকে প্রশ্ন করলো ‘প্রেয়সী’…
?
উত্তর কী দিবো, কোনো ভাষা ছিলো না আমার
? বোধক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম
সাবেক প্রেমিকার দিকে…
জবাব সে-ই দিলো, যা দিলো,
তাতে আমি
থ!
আমি তখন হাঁটুভাঙা
দ
পদ্ম
থির দীঘির টলটলে জলে,
ভাসে পদ্ম অপরূপ
ভোমরা কাজল এঁকে দেয়
পাঁপড়িতে তার। কানে কানে বলে চুপচুপ।
রাজহাঁসেরা করে জলকেলী,
আমার কিছু নেই যে খেলি।
সে তো হারিয়ে গেছে মায়াবী ছলে।
আমি তাই চেয়ে থাকি জলে,
স্বপ্ন দেখি রাঁধা-কৃষ্ণের কুঞ্জবনে প্রজাপতি মেলে পাখা
অথচ চোখে আঁধার খলবলে, সব মিছে, সব ফাঁকা।
*(কথাশিল্পী, সংগীতশিল্পী ও পরিবেশবিদ)