একসঙ্গে বাড়ছে করোনা ও ডেঙ্গুর প্রকোপ। ছবি: সংগৃহীত
দেশে আবারও বাড়ছে মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ। পাশের দেশ ভারতে শনাক্ত হয়েছে ভাইরাসটির একটি নতুন ধরন। সেই ধরনটি শনাক্ত হয়েছে বাংলাদেশেও। দ্রুত ছড়িয়ে পড়া নতুন এই ধরনে আক্রান্ত হচ্ছে ছোট-বড় নানা বয়সী মানুষ। সেই সঙ্গে হঠাৎ করেই বাড়তে শুরু করেছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। সংক্রামক ও অসংক্রামক- দুই ভাইরাস একসঙ্গে চোখ রাঙাচ্ছে। এতে জনমনে বাড়ছে উদ্বেগ ও আতঙ্ক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ভারত থেকে ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের দেশগুলোতে। পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ায় রেহাই পাচ্ছে না বাংলাদেশের মানুষও। সেইসঙ্গে করোনার নতুন ধরনটি আগের তুলনায় সংক্রামক এবং দ্রুত ছড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে উপসর্গ খুবই হালকা থাকায় অনেকেই বুঝতে পারছেন না যে, তারা সংক্রমিত হয়েছেন। ফলে অজান্তেই অন্যদের মাঝে করোনা ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের ঝুঁকিতে রয়েছেন।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লেও আগের মতো ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হবে না। বর্তমান ভাইরাসটি দ্রুত ছড়ায়, তবে ব্যাপকহারে প্রাণঘাতী নয়। সচেতনতাই অনেক কিছু বদলে দেবে। লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা করা যাবে না, করোনাভাইরাস পরীক্ষা করাতে হবে।
ডা. লেনিন চৌধুরী, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লেলিন চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতেও বাড়ছে করোনার নতুন এই ধরনের আক্রান্ত রোগী সংখ্যা। করোনার নতুন এই ধরনটি একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়াচ্ছে। অনেক মানুষ আক্রান্ত হবে, তবে এই ধরন মারাত্মক নয়। আগের মতো ভীতিকর অবস্থা তৈরি হবে না। লকডাউন বা বিশেষ নিয়ম মেনে চলার কোনো দরকার নেই, সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।’
এদিকে কয়েক দিন ধরে নিয়মিতভাবে করোনার নতুন ধরনে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এরমধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে শুক্রবার (১৩ জুন) দুজনের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার কেউ মারা না গেলেও সাতজনের শরীরে শনাক্ত হয়েছে ভাইরাসটি।
অন্যদিকে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে ডেঙ্গুও। শুক্রবার (১৩ জুন) এডিস মশাবাহী এই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। পরদিন শনিবার মারা গেছেন একজন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়বে।
একসঙ্গে নানা ভাইরাস
করোনার পাশাপাশি দেশে ডেঙ্গুসহ বিভিন্ন ভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। যার কারণে জনমনে আতঙ্ক ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে। একইসঙ্গে করোনা, ডেঙ্গু ও ডায়রিয়া- নানা জাতীয় ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। সেইসঙ্গে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গুজব। যার কারণে বাস্তবতার চেয়ে আতঙ্ক বেশি ছড়াচ্ছে।
হাসপাতালে শুরু হচ্ছে ফের করোনা পরীক্ষা। ছবি: সংগৃহীত
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘দেশে একসঙ্গে বিভিন্ন ভাইরাস বেড়ে যাচ্ছে। করোনা, ডেঙ্গু, ডায়রিয়াসহ কয়েকটি ভাইরাসে এই সময়ে মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। কোনটা করোনা, কোনটা ডেঙ্গু তা জনসাধারণ বুঝে না। এজন্য প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ ভয় পেয়ে যায়। তবে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না, সচেতন হতে হবে। লক্ষণ দেখা দিলেই পরীক্ষা করতে হবে। সেইসঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।’
এ বিষয়ে মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. রাজিব কুমার সাহা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কিছুদিন পর বোঝা যাবে নতুন ভ্যারিয়েন্টটি কতটুকু মারাত্মক। দেশে এখনো সেভাবে ছড়িয়ে পড়েনি, তবে আতঙ্কিত হওয়ার নেই। ঈদের পর যখন অফিস-আদালত খুলবে, তখন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। কেননা সেই সময়ে লোকসমাগম বেশি হবে। কারণ কোনো বাংলাদেশের মানুষ সচেতন নয়। এই ভ্যারিয়েন্টটির সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি। এই ভাইরাসটির আরেকটি বৈশিষ্ট হলো অনেক মানুষকে আক্রান্ত করে এবং বহু মানুষ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
জনসচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাগিদ
বর্তমান পরিস্থিতিতে জনসচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, করোনার নতুন ধরন প্রতিরোধে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মাস্ক পরা, বাহির থেকে ঘরে এলে হাত ধোয়া, জনসমাগম এড়িয়ে চলা এবং উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধে বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখা, জমে থাকা পানি অপসারণ, ফুলের টব বা খোলা পাত্র ঢেকে রাখা, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা ইত্যাদি বিষয়েও সচেতন হতে হবে। সরকার এককভাবে এসব রোগ প্রতিরোধ করতে পারবে না যদি না জনগণ নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্বশীল আচরণ করে। বিশেষ করে স্কুল, অফিস ও গণপরিবহনে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লেলিন চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘জনসচেতনতার বিকল্প নেই। সবাইকে আগের মতোই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং মাস্ক ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সেইসঙ্গে সরকারের উচিত জনসাধারণকে নিয়মিতভাবে করোনার আপডেট জানানো। তাহলে মানুষও বুঝতে পারে, কতটা মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে করোনা। মানুষেরও চলাফেরায় পরিবর্তন আসবে।’
অবহেলায় অনেকেই আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা
করোনার লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা নয়, সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ভাইরাসটি শুরু দিকে শনাক্ত করা গেলে চিকিৎসা করতে সহজ হবে এবং রোগী তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। যার ফলে ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হবে। আর অবহেলা করলে অনেকেই আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বর্ষায় ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়তে পারে। ছবি: ঢাকা মেইল
এবিষয়ে অধ্যাপক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লেও আগের মতো ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হবে না। বর্তমান ভাইরাসটি দ্রুত ছড়ায়, তবে ব্যাপকহারে প্রাণঘাতী নয়। সচেতনতাই অনেক কিছু বদলে দেবে। লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা করা যাবে না, করোনাভাইরাস পরীক্ষা করাতে হবে।’
আরো পড়ুন
একদিনে ডেঙ্গুতে ৫ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ১৫৯
ডা. রাজিব কুমার সাহা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এই ভাইরাসটির বেশির ভাগ লক্ষণ জ্বর জ্বর ভাব। তবে জ্বর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারো কারো ক্ষেত্রে জ্বর না থাকলেও রুচি কমে যাবে এবং নাকের স্বাদ বা গন্ধ পাওয়ার ক্ষমতা কমে যাবে। সেইসঙ্গে ডায়রিয়া থাকলেও বেশি আতঙ্কিত হওয়ার কোনো দরকার নেই। তবে বাসায় বিশ্রাম নিতে হবে। করোনার সময় যেসব স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলেছি, সেগুলো মেনে চলতে হবে। করোনা টেস্টের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এখনো লকডাউন বা বিধিনিষেধের প্রয়োজন দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, প্রয়োজন সচেতনতা।’
পরীক্ষা ও চিকিৎসায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রস্তুতি
এদিকে করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার প্রস্তুতি নিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এ বিষয়ে সংস্থাটির মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, করোনা শনাক্তে আবারও আরটি-পিসিআর ও র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি করোনার টিকা, প্রয়োজনীয় ওষুধ, অক্সিজেন, হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ভেন্টিলেটর, আইসিইউ ও এইচডিইউ সুবিধাসহ কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রাখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, সেবা প্রদানকারী স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নিরাপত্তা সরঞ্জাম যেমন—কেএন-৯৫ মাস্ক, পিপিই ও ফেস শিল্ড নিশ্চিত করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে এসব প্রস্তুতি চলছে বলেও জানান তিনি। সাখাওয়াত হোসাইন