০৬:১৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

সিরিয়ায় যে পরিণতি হয়েছিল মোসাদের গুপ্তচর কোহেনের

  • আপডেট সময়: ০৮:৫৬:৪৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫
  • 17

সংগৃহীত ছবি


হানাহানি চলছে ইসরায়েল এবং ইরানের মধ্যে। শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েল-ইরান ক্ষেপণাস্ত্র পাল্টাপাল্টি হামলায় ইসরায়েলে মোট ১৭ জন নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে, ইরানের সরকারি মিডিয়ার বরাতে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, এখন পর্যন্ত ইরানে ২২৪ জন নিহত এবং ১,২৭৭ জন হাসপাতালে আহত অবস্থায় ভর্তি আছে।

পাল্টাপাল্টি হামলা হলেও ইসরায়েলের হামলাগুলো খুব নিখুঁত।

এর কারণ ইসরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই এতটা নিখুঁত হামলা চালাতে সক্ষম হচ্ছে ইসরায়েল। যে কারণে ইরানের প্রধান প্রধান নেতারা ইতিমধ্যেই নিহত হয়েছেন।

মোসাদ কোন ছদ্মবেশে যে লুকিয়ে আছে, তা বুঝে ওঠার আগেই কাজ শেষ করে অন্তর্হিত হন তারা।

বহু ক্ষেত্রেই আক্রান্ত দেশ মোসাদের উপস্থিতি টের পায় ক্ষতি হয়ে যাওয়ার পর। কীভাবে গোপনে ইরানে প্রবেশ করে ইসরায়েলের বাহিনী আঘাত হেনেছে, তার কিছু ভিডিও ফুটেজও প্রকাশ করেছে সে দেশের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ।

ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ যন্ত্র (মিসাইল লঞ্চার) লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলের বাহিনী। ইসরায়েলের সামরিক অফিসারদের উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা সিএনএনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় করতে সেখানে আগে থেকেই ড্রোন ঘাঁটি তৈরি করে রেখেছিল মোসাদ বাহিনী।

টাইমস অব ইসরায়েলের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, মোসাদের চরেরা অনেক দিন আগেই অনুপ্রবেশ করেছিল ইরানে। মধ্য ইরানে পৌঁছে ঘাঁটি গেড়েছিল তারা। নিয়ে আসা হয়েছিল ড্রোন, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসকারী প্রযুক্তি। সেই দিয়েই ওই চরেরা ধ্বংস করেছে ইরানের রাডার ব্যবস্থা, এস-৩০০ অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফ্ট ব্যাটারি। এর ফলে ইসরায়েল যখন শুক্রবার ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ শুরু করে, তখন ইরানে অবাধে ঢুকে যায় তাদের যুদ্ধবিমান।

মোসাদের গুপ্তচরদের সেই গোপন অভিযানের পরে অনেকেরই স্মৃতিতে ভেসে উঠেছে এলি কোহেনের কথা। মোসাদের এক সুপরিচিত এবং অন্যতম সফল গুপ্তচর ছিলেন কোহেন। তিনি এমনই এক গুপ্তচর ছিলেন, যার জন্য পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতিতে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল ইসরায়েল।

১৯২৪ সালে মিশরের এক ইহুদি পরিবারে জন্মেছিলেন কোহেন। পুরো নাম ছিল ইলিয়াহু বেন শল কোহেন। মিশরে ইহুদি-বিরোধী কট্টরতার কারণে দেশছাড়া হয় তার পরিবার। পড়াশোনা সম্পূর্ণ করার জন্য মিশরেই থেকে যান কোহেন। তিনি মিশরেই থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মিশরে ইহুদি-বিরোধিতা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৫৬ সালে ইসরায়েলে পরিবারের কাছে চলে যান তিনি।

পড়াশোনায় ভাল হওয়ার কারণে ইসরায়েলি সেনায় ভাল পদে চাকরিতে যোগ দেন কোহেন। সেনায় গোয়েন্দা বিভাগেই কাজ শুরু করেন তিনি। মোসাদে যোগদানের বাসনা ছিল তার। কিন্তু বেশ কয়েক বার আবেদন করেও বিফল হন। সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সময়েই নাদিয়া মাজেল নামে এক নারীর সঙ্গে বিয়ে হয় কোহেনের।

ভাগ্যের চাকা ঘোরে ১৯৬০ সালে। আচমকাই কোহেন ডাক পান মোসাদ থেকে। সেই সময় একটি নতুন মিশনে তাকে পাঠানোর জন্য মনস্থির করে মোসাদ। মিশন ছিল যথেষ্ট বড়। দায়িত্বপালনের জন্য তাকে বিশেষ প্রশিক্ষণও নিতে হয়। সিরীয়দের মতো আরবিতে কথা বলা থেকে শুরু করে তাদের জীবনযাপনের পদ্ধতি শিখতে হয় তাকে। মোসাদের গুপ্তচর হিসেবে তার প্রথম গন্তব্য ছিল আর্জেন্টিনা।

১৯৬১ সালে আর্জেন্টিনায় সিরীয় পরিচয়ে কাজ শুরু করেন কোহেন। নিজের পরিচয় দেন কামিল আমেন থাবেত হিসাবে। জানান তিনি পেশায় ব্যবসায়ী। আর্জেন্টিনা থেকে সিরিয়ায় যোগাযোগ শুরু করেন তিনি। প্রথমে সিরীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও পরে তাদের মারফত সিরিয়া প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ওঠাবসা শুরু হয় তার। তাদের কাছ থেকে পাওয়া খবর মোসাদকে পাঠানো শুরু করেন তিনি। চমকপ্রদ সেই সব তথ্যে ভর করে পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতিতে প্রভাব বাড়ানো শুরু করে ইসরায়েল।

আর্জেন্টিনায় কামিল আমেন থাবেতের বিলাসবহুল পার্টিতে নিয়ম করে সিরীয় ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের যাতায়াত শুরু হয়। জানা যায়, সেই সব মহার্ঘ পার্টির আয়োজন করা হত মোসাদের অর্থেই। সেই সব পার্টিতে অজানা তথ্য সহজেই পেয়ে যেতেন কোহেন। এই পার্টিগুলোতে পর্যাপ্ত মদের সঙ্গে জুয়ার আসরও বসত। আনা হতো সুন্দরী নারীদেরও।

এক বছর আর্জেন্টিনায় থেকে নিজের অবস্থান তৈরির পর এ বার প্রয়োজন ছিল সরাসরি সিরিয়ায় ঘাঁটি গাড়ার। সিরিয়ার সামরিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে ইসরায়েলকে অবগত করতে কোহেনকে সিরিয়ায় পাঠানো হয়।

কোহেনের কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার জন্যই তাকে সিরিয়া পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মোসাদ। সিরিয়ার প্রতিরক্ষা বিভাগে এত সহজে ঢুকে যাবেন কোহেন, তা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি মোসাদও। তাই রসদ হিসাবে কোহেন যা যা চেয়েছিলেন, সবই দিয়েছিল মোসাদ।

ব্যবসায়ী ভেবে কোহেনকে সিরিয়ায় ঢুকতে সহায়তা করেছিলেন তৎকালীন সিরীয় সেনার কর্মকর্তা আমিন-আল-হাফিজ (পরে যিনি সিরিয়ার প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন)। তার হাত ধরেই দামেস্কে এসে আমদানি-রফতানির ব্যবসা শুরু করেন কোহেন। ব্যবসার কাজের জন্য দামেস্কে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তিনি।

দামেস্কে এসেও কোহেন সিরিয়ার মন্ত্রী, প্রতিরক্ষা বিভাগ ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে মহার্ঘ পার্টি দেওয়া শুরু করেন। সেই সব পার্টি থেকে এ বার সিরিয়া প্রশাসনের অন্দরমহলের খবর মোসাদের কাছে পৌঁছানোর কাজ শুরু করেন তিনি। এক কথায় কোহেনের দিনরাত কাটত সিরিয়া প্রশাসন ও সেনাবিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গেই। কাউকে টাকা দিয়ে, কাউকে বা উপহার দিয়ে, সিরিয়া সরকারের গোপন তথ্য আদায়ে সিদ্ধহস্ত ছিলেন কোহেন।

রেডিও ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে দামাস্কাস থেকে কোহেন ইসরায়েলে মোসাদের দপ্তরে খবর পাঠাতেন। সময়ে সময়ে বিভিন্ন কোড ব্যবহার করে নিজের বার্তা ইসরায়েলে পৌঁছে দিতেন তিনি। কোনো দস্তাবেজ পাঠানোর হলে, তখন কাজে আসত তার আমদানি-রফতানির ব্যবসা। ব্যবসার আড়ালে সেই সব নথি সহজেই মোসাদের কাছে পৌঁছে যেত।

১৯৬৪ সালে নিজের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে শেষ বার ইসরায়েল এসেছিলেন এলি কোহেন। সেই সময়ই তিনি মোসাদের শীর্ষ কর্মকর্তাদের জানিয়ে দেন খুব বেশি দিন এভাবে আর সিরিয়ায় কাজ করা সম্ভব হবে না। কিন্তু এমন কথা জানার পরেও কোহেনকে আবারও সিরিয়ায় ফিরে কাজ করার পরামর্শ দেয় মোসাদ। সেই নির্দেশ পাওয়ার পর আবারও দামেস্কে ফিরে যান তিনি।

ইসরায়েলের হয়ে সিরিয়ায় চার বছর গুপ্তচর হিসাবে কাজ করেছিলেন কোহেন। তত দিনে সিরিয়া সরকার ও সেনাবিভাগের বহু তথ্য ইসরায়েলের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। পারদর্শী এই গুপ্তচর চার বছর একের পর এক খবর মোসাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিল সিরিয়াকে। কোথা থেকে তাদের সব পদক্ষেপের আগাম খবর ইসরায়েলের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, সে সম্বন্ধে বহু দিন কোনো খোঁজই পায়নি সিরিয়া।

কিন্তু এক সময় টনক নড়ে সিরীয় গোয়েন্দাদের। তারা জানতে পারেন রেডিও ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে গোপন খবর সিরিয়া থেকে ইসরায়েলে পাঠানো হচ্ছে। সেই খবরের ওপর ভিত্তি করেই রেডিও ট্রান্সমিটারের খোঁজে নামে সিরীয় সেনা ও গুপ্তচর সংস্থা।

রেডিও ট্রান্সমিটারের খোঁজ করতে গিয়ে হতবাক হয়ে যায় সিরীয় সেনাবাহিনী। দেখা যায়, যত বার তারা এই সংক্রান্ত বিষয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার করছেন, তত বারই তাদের প্রযুক্তি দামেস্কে কোহেনের বাসভবনের দিকে ইঙ্গিত করছে। শেষমেশ ১৯৬৫ সালে কোহেনকে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী।

এর পর হাজারো চেষ্টা করে এলি কোহেনের থেকে কোনো তথ্যই পায়নি সিরিয়া। সেই সময় ইসরায়েল আন্তর্জাতিক মহল থেকে সিরিয়ার ওপর চাপ তৈরি করে কোহেনকে দেশে ফেরানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কোনো অনুরোধ বা চাপে কর্ণপাত না করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মোসাদের গুপ্তচর হিসাবে সিরিয়াকে ঘুণপোকার মতো ফাঁপা করে দেওয়ার শাস্তি হিসাবে চরম দণ্ড দেওয়া হয়েছিল তাকে।

আর কেউ যাতে সিরিয়ার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করার সাহস না দেখান, সেই কারণে কোহেনকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়েছিল সিরিয়া সরকার। ১৯৬৫ সালের ১৮ মে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে মার্জিস স্কোয়ারে প্রায় ১০ হাজার মানুষের জমায়েত। উপলক্ষ ‘বিশ্বাসঘাতক’ গুপ্তচর কোহেনের ফাঁসি। ঘটনাস্থলে হাজির ছিলেন সিরিয়া প্রশাসনের ছোট, বড় বহু কর্মকর্তা। কোহেনকে ফাঁসিতে ঝোলানোর সঙ্গে সঙ্গেই উল্লাস করে ওঠেন অনেকে।

ফাঁসিতে ঝোলানোর সময় তার গায়ে আরবি ভাষায় লিখে দেওয়া হয়, তিনি একজন মোসাদের গুপ্তচর, সিরিয়ার বহু ক্ষতি করেছেন। ১৯৬৫ সালের ১৮ মে মৃত্যুর পর তার মরদেহ ইসরায়েলকে ফেরত দেয়নি সিরিয়া। কেবলমাত্র ১৫ মে তার লেখা একটি চিঠি পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল তার পরিবারের কাছে।

 

উত্তরাধুনিক

Writer, Singer & Environmentalist

সিরিয়ায় যে পরিণতি হয়েছিল মোসাদের গুপ্তচর কোহেনের

আপডেট সময়: ০৮:৫৬:৪৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫

সংগৃহীত ছবি


হানাহানি চলছে ইসরায়েল এবং ইরানের মধ্যে। শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েল-ইরান ক্ষেপণাস্ত্র পাল্টাপাল্টি হামলায় ইসরায়েলে মোট ১৭ জন নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে, ইরানের সরকারি মিডিয়ার বরাতে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, এখন পর্যন্ত ইরানে ২২৪ জন নিহত এবং ১,২৭৭ জন হাসপাতালে আহত অবস্থায় ভর্তি আছে।

পাল্টাপাল্টি হামলা হলেও ইসরায়েলের হামলাগুলো খুব নিখুঁত।

এর কারণ ইসরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই এতটা নিখুঁত হামলা চালাতে সক্ষম হচ্ছে ইসরায়েল। যে কারণে ইরানের প্রধান প্রধান নেতারা ইতিমধ্যেই নিহত হয়েছেন।

মোসাদ কোন ছদ্মবেশে যে লুকিয়ে আছে, তা বুঝে ওঠার আগেই কাজ শেষ করে অন্তর্হিত হন তারা।

বহু ক্ষেত্রেই আক্রান্ত দেশ মোসাদের উপস্থিতি টের পায় ক্ষতি হয়ে যাওয়ার পর। কীভাবে গোপনে ইরানে প্রবেশ করে ইসরায়েলের বাহিনী আঘাত হেনেছে, তার কিছু ভিডিও ফুটেজও প্রকাশ করেছে সে দেশের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ।

ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ যন্ত্র (মিসাইল লঞ্চার) লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলের বাহিনী। ইসরায়েলের সামরিক অফিসারদের উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা সিএনএনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় করতে সেখানে আগে থেকেই ড্রোন ঘাঁটি তৈরি করে রেখেছিল মোসাদ বাহিনী।

টাইমস অব ইসরায়েলের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, মোসাদের চরেরা অনেক দিন আগেই অনুপ্রবেশ করেছিল ইরানে। মধ্য ইরানে পৌঁছে ঘাঁটি গেড়েছিল তারা। নিয়ে আসা হয়েছিল ড্রোন, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসকারী প্রযুক্তি। সেই দিয়েই ওই চরেরা ধ্বংস করেছে ইরানের রাডার ব্যবস্থা, এস-৩০০ অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফ্ট ব্যাটারি। এর ফলে ইসরায়েল যখন শুক্রবার ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ শুরু করে, তখন ইরানে অবাধে ঢুকে যায় তাদের যুদ্ধবিমান।

মোসাদের গুপ্তচরদের সেই গোপন অভিযানের পরে অনেকেরই স্মৃতিতে ভেসে উঠেছে এলি কোহেনের কথা। মোসাদের এক সুপরিচিত এবং অন্যতম সফল গুপ্তচর ছিলেন কোহেন। তিনি এমনই এক গুপ্তচর ছিলেন, যার জন্য পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতিতে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল ইসরায়েল।

১৯২৪ সালে মিশরের এক ইহুদি পরিবারে জন্মেছিলেন কোহেন। পুরো নাম ছিল ইলিয়াহু বেন শল কোহেন। মিশরে ইহুদি-বিরোধী কট্টরতার কারণে দেশছাড়া হয় তার পরিবার। পড়াশোনা সম্পূর্ণ করার জন্য মিশরেই থেকে যান কোহেন। তিনি মিশরেই থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মিশরে ইহুদি-বিরোধিতা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৫৬ সালে ইসরায়েলে পরিবারের কাছে চলে যান তিনি।

পড়াশোনায় ভাল হওয়ার কারণে ইসরায়েলি সেনায় ভাল পদে চাকরিতে যোগ দেন কোহেন। সেনায় গোয়েন্দা বিভাগেই কাজ শুরু করেন তিনি। মোসাদে যোগদানের বাসনা ছিল তার। কিন্তু বেশ কয়েক বার আবেদন করেও বিফল হন। সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সময়েই নাদিয়া মাজেল নামে এক নারীর সঙ্গে বিয়ে হয় কোহেনের।

ভাগ্যের চাকা ঘোরে ১৯৬০ সালে। আচমকাই কোহেন ডাক পান মোসাদ থেকে। সেই সময় একটি নতুন মিশনে তাকে পাঠানোর জন্য মনস্থির করে মোসাদ। মিশন ছিল যথেষ্ট বড়। দায়িত্বপালনের জন্য তাকে বিশেষ প্রশিক্ষণও নিতে হয়। সিরীয়দের মতো আরবিতে কথা বলা থেকে শুরু করে তাদের জীবনযাপনের পদ্ধতি শিখতে হয় তাকে। মোসাদের গুপ্তচর হিসেবে তার প্রথম গন্তব্য ছিল আর্জেন্টিনা।

১৯৬১ সালে আর্জেন্টিনায় সিরীয় পরিচয়ে কাজ শুরু করেন কোহেন। নিজের পরিচয় দেন কামিল আমেন থাবেত হিসাবে। জানান তিনি পেশায় ব্যবসায়ী। আর্জেন্টিনা থেকে সিরিয়ায় যোগাযোগ শুরু করেন তিনি। প্রথমে সিরীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও পরে তাদের মারফত সিরিয়া প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ওঠাবসা শুরু হয় তার। তাদের কাছ থেকে পাওয়া খবর মোসাদকে পাঠানো শুরু করেন তিনি। চমকপ্রদ সেই সব তথ্যে ভর করে পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতিতে প্রভাব বাড়ানো শুরু করে ইসরায়েল।

আর্জেন্টিনায় কামিল আমেন থাবেতের বিলাসবহুল পার্টিতে নিয়ম করে সিরীয় ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের যাতায়াত শুরু হয়। জানা যায়, সেই সব মহার্ঘ পার্টির আয়োজন করা হত মোসাদের অর্থেই। সেই সব পার্টিতে অজানা তথ্য সহজেই পেয়ে যেতেন কোহেন। এই পার্টিগুলোতে পর্যাপ্ত মদের সঙ্গে জুয়ার আসরও বসত। আনা হতো সুন্দরী নারীদেরও।

এক বছর আর্জেন্টিনায় থেকে নিজের অবস্থান তৈরির পর এ বার প্রয়োজন ছিল সরাসরি সিরিয়ায় ঘাঁটি গাড়ার। সিরিয়ার সামরিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে ইসরায়েলকে অবগত করতে কোহেনকে সিরিয়ায় পাঠানো হয়।

কোহেনের কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার জন্যই তাকে সিরিয়া পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মোসাদ। সিরিয়ার প্রতিরক্ষা বিভাগে এত সহজে ঢুকে যাবেন কোহেন, তা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি মোসাদও। তাই রসদ হিসাবে কোহেন যা যা চেয়েছিলেন, সবই দিয়েছিল মোসাদ।

ব্যবসায়ী ভেবে কোহেনকে সিরিয়ায় ঢুকতে সহায়তা করেছিলেন তৎকালীন সিরীয় সেনার কর্মকর্তা আমিন-আল-হাফিজ (পরে যিনি সিরিয়ার প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন)। তার হাত ধরেই দামেস্কে এসে আমদানি-রফতানির ব্যবসা শুরু করেন কোহেন। ব্যবসার কাজের জন্য দামেস্কে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তিনি।

দামেস্কে এসেও কোহেন সিরিয়ার মন্ত্রী, প্রতিরক্ষা বিভাগ ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে মহার্ঘ পার্টি দেওয়া শুরু করেন। সেই সব পার্টি থেকে এ বার সিরিয়া প্রশাসনের অন্দরমহলের খবর মোসাদের কাছে পৌঁছানোর কাজ শুরু করেন তিনি। এক কথায় কোহেনের দিনরাত কাটত সিরিয়া প্রশাসন ও সেনাবিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গেই। কাউকে টাকা দিয়ে, কাউকে বা উপহার দিয়ে, সিরিয়া সরকারের গোপন তথ্য আদায়ে সিদ্ধহস্ত ছিলেন কোহেন।

রেডিও ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে দামাস্কাস থেকে কোহেন ইসরায়েলে মোসাদের দপ্তরে খবর পাঠাতেন। সময়ে সময়ে বিভিন্ন কোড ব্যবহার করে নিজের বার্তা ইসরায়েলে পৌঁছে দিতেন তিনি। কোনো দস্তাবেজ পাঠানোর হলে, তখন কাজে আসত তার আমদানি-রফতানির ব্যবসা। ব্যবসার আড়ালে সেই সব নথি সহজেই মোসাদের কাছে পৌঁছে যেত।

১৯৬৪ সালে নিজের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে শেষ বার ইসরায়েল এসেছিলেন এলি কোহেন। সেই সময়ই তিনি মোসাদের শীর্ষ কর্মকর্তাদের জানিয়ে দেন খুব বেশি দিন এভাবে আর সিরিয়ায় কাজ করা সম্ভব হবে না। কিন্তু এমন কথা জানার পরেও কোহেনকে আবারও সিরিয়ায় ফিরে কাজ করার পরামর্শ দেয় মোসাদ। সেই নির্দেশ পাওয়ার পর আবারও দামেস্কে ফিরে যান তিনি।

ইসরায়েলের হয়ে সিরিয়ায় চার বছর গুপ্তচর হিসাবে কাজ করেছিলেন কোহেন। তত দিনে সিরিয়া সরকার ও সেনাবিভাগের বহু তথ্য ইসরায়েলের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। পারদর্শী এই গুপ্তচর চার বছর একের পর এক খবর মোসাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিল সিরিয়াকে। কোথা থেকে তাদের সব পদক্ষেপের আগাম খবর ইসরায়েলের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, সে সম্বন্ধে বহু দিন কোনো খোঁজই পায়নি সিরিয়া।

কিন্তু এক সময় টনক নড়ে সিরীয় গোয়েন্দাদের। তারা জানতে পারেন রেডিও ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে গোপন খবর সিরিয়া থেকে ইসরায়েলে পাঠানো হচ্ছে। সেই খবরের ওপর ভিত্তি করেই রেডিও ট্রান্সমিটারের খোঁজে নামে সিরীয় সেনা ও গুপ্তচর সংস্থা।

রেডিও ট্রান্সমিটারের খোঁজ করতে গিয়ে হতবাক হয়ে যায় সিরীয় সেনাবাহিনী। দেখা যায়, যত বার তারা এই সংক্রান্ত বিষয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার করছেন, তত বারই তাদের প্রযুক্তি দামেস্কে কোহেনের বাসভবনের দিকে ইঙ্গিত করছে। শেষমেশ ১৯৬৫ সালে কোহেনকে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী।

এর পর হাজারো চেষ্টা করে এলি কোহেনের থেকে কোনো তথ্যই পায়নি সিরিয়া। সেই সময় ইসরায়েল আন্তর্জাতিক মহল থেকে সিরিয়ার ওপর চাপ তৈরি করে কোহেনকে দেশে ফেরানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কোনো অনুরোধ বা চাপে কর্ণপাত না করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মোসাদের গুপ্তচর হিসাবে সিরিয়াকে ঘুণপোকার মতো ফাঁপা করে দেওয়ার শাস্তি হিসাবে চরম দণ্ড দেওয়া হয়েছিল তাকে।

আর কেউ যাতে সিরিয়ার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করার সাহস না দেখান, সেই কারণে কোহেনকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়েছিল সিরিয়া সরকার। ১৯৬৫ সালের ১৮ মে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে মার্জিস স্কোয়ারে প্রায় ১০ হাজার মানুষের জমায়েত। উপলক্ষ ‘বিশ্বাসঘাতক’ গুপ্তচর কোহেনের ফাঁসি। ঘটনাস্থলে হাজির ছিলেন সিরিয়া প্রশাসনের ছোট, বড় বহু কর্মকর্তা। কোহেনকে ফাঁসিতে ঝোলানোর সঙ্গে সঙ্গেই উল্লাস করে ওঠেন অনেকে।

ফাঁসিতে ঝোলানোর সময় তার গায়ে আরবি ভাষায় লিখে দেওয়া হয়, তিনি একজন মোসাদের গুপ্তচর, সিরিয়ার বহু ক্ষতি করেছেন। ১৯৬৫ সালের ১৮ মে মৃত্যুর পর তার মরদেহ ইসরায়েলকে ফেরত দেয়নি সিরিয়া। কেবলমাত্র ১৫ মে তার লেখা একটি চিঠি পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল তার পরিবারের কাছে।