
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের পর্বে এরমধ্যে দৃশ্যপট বদলে গেছে। ট্রাম্পের অসংলগ্ন কথাবার্তায় আন্দাজ করা যায়নি যে, ট্রাম্প সহসাই ইরান আক্রমণ করবেন। কিন্তু স্টিলথ বোমারু বিমান দিয়ে ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাতে আক্রমণ চালিয়েছেন। তার ভাষায় ইরানের ফোর্দো পারমাণবিক কেন্দ্র্র ধ্বংস হয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান দেশটির পশ্চিম উপকূল থেকে শনিবার প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে এসে ইরানের ৩ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে।
হামলার পর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, ইরানের তিনটি পরমাণুকেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এর মধ্যে ইরানের অত্যন্ত সুরক্ষিত ফোরদো পারমাণবিক কেন্দ্রে ছয়টি ‘বাংকার-বাস্টার’ বোমা ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। হামলার পরই ইরানের পাল্টা হামলার ভয়ে মার্কিন বোমারু বিমানগুলো পালিয়ে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে এগুলো দ্রুত গুয়ামের মার্কিন ঘাঁটির দিকে পালিয়ে গেছে।
মার্কিন বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমানগুলো ৩ হাজার পাউন্ডের বিশাল বোমা বহনে সক্ষম, যা দিয়ে ইরানের ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত করা হয়েছে।
তবে কি যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের নিয়ে ‘ইরাক পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে’ এই অজুহাতে ইরাক ধ্বংস করেছিল, সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই কি ইরানকে ইরাকের পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে? এবারের আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্র তার পুরোনো মিত্রদের সবাইকে না-ও পেতে পারে। ব্রিটেন ট্রাম্পকে ইরানের ওপর আক্রমণ চালাতে না করেছিলো, যদিও এই দেশ এখন সুর বদলেছে। এটা ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের মিত্র হিসেবে অনেককিছু করছে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এরকম আক্রমণের প্রয়োজন ছিলো না। ইসরায়েল মানবতার চরম অবমাননা করেছে গাজায় ও ইরানের ওপর আক্রমণ চালিয়ে। সেখানে ইরানের নিজকে রক্ষা ও ইসরায়েলের প্রতি পাল্টা আক্রমণের অধিকার আছে। জাতিসংঘ ও বিশ্বের দেশগুলো এই আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছে।
বাস্তবতা হলো ইরান একা। এবং এই মুহূর্তে কোণঠাসা। যা ইরাকের কথাই বারবার আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়। মার্কিনীদের আধিপত্য সবখানেই। গুয়াম, দিয়াগো গার্সিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে তাদের ঘাঁটি আছে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল স্থল আক্রমণ করলে ইরানের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। দৃশ্যপট পাল্টে যেতে পারে যদি চীন, তুরস্ক ও রাশিয়া ইরানকে সাহায্য করে। ইতোমধ্যে জর্ডানসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো ফূঁসছে। উত্তর কোরিয়া পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দিয়েছে।
একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক।
ইরানে ইসরাইলের বর্বর হামলা স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের একটি আগ্রাসী পরিকল্পনা। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ইরানের পারমাণবিক উন্নয়নকে যুক্তরাষ্ট্র বক্র চোখে দেখে আসছে। ইরান পারমাণবিকসমৃদ্ধ দেশ পরিণত হলে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন দখলদারিত্ব খর্ব হবার ভয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে নানাভাবে ব্যতিব্যস্ত রেখেছে। ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে তারা ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। এখন তারা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে ধ্বংস করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। মার্কিন প্রত্যক্ষ সমর্থন তো আছেই, তার ওপর মোসাদের মাকড়সার জাল ছড়িয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলই শুধু আক্রমণ করেনি, করেছে যুক্তরাষ্ট্রও। মোসাদ ঢুকে গেছিল ইরানের ভেতরে। কয়েকজন ধরাও পড়েছে। দুজনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ইরান। ইরান আগে আক্রমণ করেনি; করেছে ইসরায়েল। ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগের নজির তো এখনও নেই। ইরানের পেছনে কয়েকযুগ ধরে লেগে আছে য়ুক্তরারাষ্ট্র। যেমন তারা ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন, সিরিয়া, আফগানিস্তান ধ্বংস করেছে।
সরাসরি কেউ নেই ইরানের সাথে। ইসরায়েলের মোসাদ চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে ইরানের নেতাদের মারতে পারে। এটা তাদের মজ্জাগত। গাজায় ত্রাণসামগ্রী আটকে দিয়েছিলো তারা। গ্রেটা থুনবার্গকে ছেড়ে দিয়েছিলো হজম করতে পারবে না বলে। ইসরায়েল গাজায় হাজার হাজার শিশুকে মেরে ফেলেছে, পঙ্গু করে দিয়েছে চিরতরে। একজন বাবা মৃত ছেলে বা মেয়ের লাশ বহন করেছে। সেই তুলনায় ইরানের কিছু সংখ্যক ব্যালিস্টিক মিসাইল তো ইসরায়েলের প্রাপ্য।
এদিকে ইরান নেমেছে ঘরের শত্রুদের ধরতে। কথায় আছে, ঘরের ইঁদুর বেড়া কাটে। তেমনি মার্কিন ও মোসাদের তৎপরতায় ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী, সেনাবাহিনি প্রধানসহ অন্তত নয়জনকে তারা হত্যা করেছে। এটা যুদ্ধ নয়; কাপুরুষোচিৎ হামলা। বিকৃত মনোবাসনা পূরণের খতরনাক নমুনা।
ট্রাম্প একেক সময় একেক কথা বলেন। তিনি কীভাবে পারমাণবিক ভারসাম্য রক্ষা করবেন? তিনি নিজেই তো ভারসাম্যহীন। আর নেতানিয়াহু এ যুগের রক্তচোষা ড্রাকুলা। ইরানের ভাগ্যে যা-ই থাকুক না কেন, দুই সাইকোর নাটক দেখতে দেখতে ক্লান্ত আমরা।