০৬:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫

কস্তুরী মৃগ: সোনার চেয়েও দামী হরিণের যে অংশ 

  • আপডেট সময়: ১২:০১:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫
  • 12

 

কস্তুরী মৃগ কী? 

কস্তুরী হরিণ বা মাস্ক ডিয়ার হলো এক প্রজাতির পুরুষ হরিণ। হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল, সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, নেপাল, কিরগিজস্তান এবং কোরিয়ায় এই প্রজাতির হরিণ বসবাস করে। কস্তুরী হরিণ দেখতে ছোট হরিণের মতো। এদের দেহের গঠন মোটা এবং পেছনের পা সামনের পায়ের তুলনায় লম্বা।


কস্তুরী হরিণ তৃণভোজী, পাহাড়ি, বনাঞ্চলে বাস করে। সাধারণত মানুষের বাসস্থান থেকে দূরে থাকতে ভালোবাসে এরা। অন্য হরিণের মতো এরাও পাতা, ফুল এবং ঘাস খায়। কিছু শ্যাওলা এবং লাইকেনও খায়। এই হরিণ স্বভাবে লাজুক ও নিশাচর হয়ে থাকে।

কস্তুরী কী? 
কস্তুরী হলো একটি বিশেষ ধরনের সুগন্ধি। একে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সুগন্ধিও বলা যায়। আর এর উৎস হলো কস্তুরী মৃগ বা হরিণ। এই প্রজাতির হরিণের নাভিতে একটি বিশেষ গ্রন্থি থাকে, যা থেকে কস্তুরী উৎপন্ন হয়।


কস্তুরী হরিণগুলোর বয়স যখন ১০ বছর পূর্ণ হয় তখন এদের নাভিতে একটি বিশেষ ধরনের গ্রন্থি বিকশিত হয়, যা থেকে কস্তুরী উৎপন্ন হয়। এর ঘ্রাণ অত্যন্ত শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী। কথিত আছে, কস্তুরীর সামান্য পরিমাণও যদি কোনো ঘরে রাখা হয়, সেই ঘরে বহু বছর ধরে এর সুবাস থেকে যায়। এই ঘ্রাণ এতটাই শক্তিশালী যে তিন হাজার ভাগ গন্ধহীন পদার্থের সঙ্গে এর এক ভাগ মেশালেও সব পদার্থই সুবাসিত হয়ে ওঠে।

কস্তুরীর নানা রকমফের: 
ভারতীয় প্রাচীন গ্রন্থে তিন প্রকার কস্তুরীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলো হলো- কামরূপী, নেপালি, এবং কাশ্মীরী। এর মধ্যে কামরূপী কস্তুরী সর্বোত্তম মানের এবং কাশ্মীরী কস্তুরী তুলনামূলকভাবে নিম্নমানের। কস্তুরীর সুবাসেও রয়েছে ভিন্নতা। এগুলো বিভিন্ন নামে পরিচিত।


কস্তুরী কীভাবে সংগ্রহ করা হয়? 
কস্তুরী হরিণ থেকে এর নাভিগ্রন্থি বা কস্তুরী সংগ্রহ করা প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল, দুঃখজনক ও মর্মান্তিক। পুরুষ হরিণের দশ বছর বয়স হলে যখন তার নাভি গ্রন্থি পরিপক্ব হয় তখন শিকারিরা এই হরিণ হত্যা করে গ্রন্থি সংগ্রহ করে। কস্তুরী মৃগের বিশেষ ঘ্রাণই তাদের জীবনের অন্যতম দুর্বলতা, যা তাদের শিকারির কাছে সহজ শিকার করে তোলে।
একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থির ওজন সাধারণত ৬০-৬৫ গ্রাম হয়। সব হরিণের নাভিতে একই পরিমাণে কস্তুরী উৎপন্ন হয় না। হরিণের বয়স এবং পরিবেশভেদে কস্তুরীর পরিমাণের তারতম্য হয়। ১ কেজি কস্তুরী পেতে প্রায় দুই হাজার হরিণ শিকার করতে হয়।


নিজের শরীর সুগন্ধের উৎস হলেও তা জানে না কস্তুরী হরিণ নিজেই। এই গন্ধ তার নাকে আসে। সুগন্ধের উৎসও হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ায় সে। কিন্তু বোকা হরিণ জানেই না, তার শরীরের একটি অংশই এই গন্ধের উৎস।
কস্তুরী সংগ্রহের সময় এর গন্ধ এতটাই তীব্র থাকে যে শিকারিরা নিজেদের নাক মোটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে। তবুও, এই গন্ধ সহ্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেকসময় শিকারিদের চোখ, নাক থেকে পানি পড়তে শুরু করে, মুখ থেকে লালা ঝরা শুরু হয়। গন্ধের তীব্রতায় কখনও কখনও জীবনহানিও ঘটে।


আবার এটিও বলা হয় যে, মিলন ঋতুতে পুরুষ হরিণের পেটের কাছের কস্তুরী গ্রন্থি থেকে সুগন্ধ বের হয়, যা নারী হরিণকে আকৃষ্ট করে। ঋতুর শেষে তা হরিণের দেহ থেকে খসে পড়ে যায়। সেটি সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে কস্তুরী তৈরি করা হয়।

কস্তুরীর মূল্য এবং ব্যবহারের ইতিহাস 
কস্তুরীকে পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান সুগন্ধি হিসেবে বিবেচিত হয় এর দাম সোনার দামের তিনগুণ। প্রাচীনকালে এই সুগন্ধি মোগল সম্রাটরা এবং বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহরা ব্যবহার করতেন। কস্তুরীর গন্ধের প্রভাব এতটাই প্রবল যে রাজারা এই সুগন্ধি ব্যবহার করলে তাদের প্রতি রাণীরা বিশেষভাবে আকর্ষিত হতেন বলে কথিত আছে।


কস্তুরী যে কেবল সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহৃত হয় তা নয়। এটি বিভিন্ন ঔষধি গুণের জন্যও পরিচিত। জ্বর, স্নায়ুবিক রোগ, পেটের ব্যথা এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যায় কস্তুরী ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও, শক্তি বাড়াতে এবং যৌন উদ্দীপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এটি।
ইসলাম ধর্মে কস্তুরীর উল্লেখ পাওয়া যায়। সুগন্ধির প্রতি প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রচণ্ড অনুরাগ ছিল। তাঁর প্রিয় সুগন্ধির তালিকায় রয়েছ মেশক আম্বর যা কস্তুরী থেকে উৎপন্ন।


তবে পরিবেশ ও প্রকৃতির কথা বিবেচনায় কস্তুরী মৃগ হত্যা করে কস্তুরী সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি নিরুৎসাহিত করেন অনেকেই। তার পরিবর্তে কৃত্রিম সুগন্ধি বা ফুলের নির্যাস থেকে তৈরি সুগন্ধি ব্যবহার করা যায়।

 

 

উত্তরাধুনিক

Writer, Singer & Environmentalist

কস্তুরী মৃগ: সোনার চেয়েও দামী হরিণের যে অংশ 

আপডেট সময়: ১২:০১:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫

 

কস্তুরী মৃগ কী? 

কস্তুরী হরিণ বা মাস্ক ডিয়ার হলো এক প্রজাতির পুরুষ হরিণ। হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল, সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, নেপাল, কিরগিজস্তান এবং কোরিয়ায় এই প্রজাতির হরিণ বসবাস করে। কস্তুরী হরিণ দেখতে ছোট হরিণের মতো। এদের দেহের গঠন মোটা এবং পেছনের পা সামনের পায়ের তুলনায় লম্বা।


কস্তুরী হরিণ তৃণভোজী, পাহাড়ি, বনাঞ্চলে বাস করে। সাধারণত মানুষের বাসস্থান থেকে দূরে থাকতে ভালোবাসে এরা। অন্য হরিণের মতো এরাও পাতা, ফুল এবং ঘাস খায়। কিছু শ্যাওলা এবং লাইকেনও খায়। এই হরিণ স্বভাবে লাজুক ও নিশাচর হয়ে থাকে।

কস্তুরী কী? 
কস্তুরী হলো একটি বিশেষ ধরনের সুগন্ধি। একে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সুগন্ধিও বলা যায়। আর এর উৎস হলো কস্তুরী মৃগ বা হরিণ। এই প্রজাতির হরিণের নাভিতে একটি বিশেষ গ্রন্থি থাকে, যা থেকে কস্তুরী উৎপন্ন হয়।


কস্তুরী হরিণগুলোর বয়স যখন ১০ বছর পূর্ণ হয় তখন এদের নাভিতে একটি বিশেষ ধরনের গ্রন্থি বিকশিত হয়, যা থেকে কস্তুরী উৎপন্ন হয়। এর ঘ্রাণ অত্যন্ত শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী। কথিত আছে, কস্তুরীর সামান্য পরিমাণও যদি কোনো ঘরে রাখা হয়, সেই ঘরে বহু বছর ধরে এর সুবাস থেকে যায়। এই ঘ্রাণ এতটাই শক্তিশালী যে তিন হাজার ভাগ গন্ধহীন পদার্থের সঙ্গে এর এক ভাগ মেশালেও সব পদার্থই সুবাসিত হয়ে ওঠে।

কস্তুরীর নানা রকমফের: 
ভারতীয় প্রাচীন গ্রন্থে তিন প্রকার কস্তুরীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলো হলো- কামরূপী, নেপালি, এবং কাশ্মীরী। এর মধ্যে কামরূপী কস্তুরী সর্বোত্তম মানের এবং কাশ্মীরী কস্তুরী তুলনামূলকভাবে নিম্নমানের। কস্তুরীর সুবাসেও রয়েছে ভিন্নতা। এগুলো বিভিন্ন নামে পরিচিত।


কস্তুরী কীভাবে সংগ্রহ করা হয়? 
কস্তুরী হরিণ থেকে এর নাভিগ্রন্থি বা কস্তুরী সংগ্রহ করা প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল, দুঃখজনক ও মর্মান্তিক। পুরুষ হরিণের দশ বছর বয়স হলে যখন তার নাভি গ্রন্থি পরিপক্ব হয় তখন শিকারিরা এই হরিণ হত্যা করে গ্রন্থি সংগ্রহ করে। কস্তুরী মৃগের বিশেষ ঘ্রাণই তাদের জীবনের অন্যতম দুর্বলতা, যা তাদের শিকারির কাছে সহজ শিকার করে তোলে।
একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থির ওজন সাধারণত ৬০-৬৫ গ্রাম হয়। সব হরিণের নাভিতে একই পরিমাণে কস্তুরী উৎপন্ন হয় না। হরিণের বয়স এবং পরিবেশভেদে কস্তুরীর পরিমাণের তারতম্য হয়। ১ কেজি কস্তুরী পেতে প্রায় দুই হাজার হরিণ শিকার করতে হয়।


নিজের শরীর সুগন্ধের উৎস হলেও তা জানে না কস্তুরী হরিণ নিজেই। এই গন্ধ তার নাকে আসে। সুগন্ধের উৎসও হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ায় সে। কিন্তু বোকা হরিণ জানেই না, তার শরীরের একটি অংশই এই গন্ধের উৎস।
কস্তুরী সংগ্রহের সময় এর গন্ধ এতটাই তীব্র থাকে যে শিকারিরা নিজেদের নাক মোটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে। তবুও, এই গন্ধ সহ্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেকসময় শিকারিদের চোখ, নাক থেকে পানি পড়তে শুরু করে, মুখ থেকে লালা ঝরা শুরু হয়। গন্ধের তীব্রতায় কখনও কখনও জীবনহানিও ঘটে।


আবার এটিও বলা হয় যে, মিলন ঋতুতে পুরুষ হরিণের পেটের কাছের কস্তুরী গ্রন্থি থেকে সুগন্ধ বের হয়, যা নারী হরিণকে আকৃষ্ট করে। ঋতুর শেষে তা হরিণের দেহ থেকে খসে পড়ে যায়। সেটি সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে কস্তুরী তৈরি করা হয়।

কস্তুরীর মূল্য এবং ব্যবহারের ইতিহাস 
কস্তুরীকে পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান সুগন্ধি হিসেবে বিবেচিত হয় এর দাম সোনার দামের তিনগুণ। প্রাচীনকালে এই সুগন্ধি মোগল সম্রাটরা এবং বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহরা ব্যবহার করতেন। কস্তুরীর গন্ধের প্রভাব এতটাই প্রবল যে রাজারা এই সুগন্ধি ব্যবহার করলে তাদের প্রতি রাণীরা বিশেষভাবে আকর্ষিত হতেন বলে কথিত আছে।


কস্তুরী যে কেবল সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহৃত হয় তা নয়। এটি বিভিন্ন ঔষধি গুণের জন্যও পরিচিত। জ্বর, স্নায়ুবিক রোগ, পেটের ব্যথা এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যায় কস্তুরী ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও, শক্তি বাড়াতে এবং যৌন উদ্দীপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এটি।
ইসলাম ধর্মে কস্তুরীর উল্লেখ পাওয়া যায়। সুগন্ধির প্রতি প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রচণ্ড অনুরাগ ছিল। তাঁর প্রিয় সুগন্ধির তালিকায় রয়েছ মেশক আম্বর যা কস্তুরী থেকে উৎপন্ন।


তবে পরিবেশ ও প্রকৃতির কথা বিবেচনায় কস্তুরী মৃগ হত্যা করে কস্তুরী সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি নিরুৎসাহিত করেন অনেকেই। তার পরিবর্তে কৃত্রিম সুগন্ধি বা ফুলের নির্যাস থেকে তৈরি সুগন্ধি ব্যবহার করা যায়।