
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন কখন হবে লন্ডনের বৈঠকের পর সেই আলোচনা কিছুটা কমে এসেছে। সম্প্রতি অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রধান ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠক শেষে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে এমনটা ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনের মাঠ তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছে। তবে নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে তা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে বিভেদ দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মতো বিপরীত মেরুতে চলা রাজনৈতিক দলগুলো এখন পিআর পদ্ধতির কারণে এক ছাদের নীচে আসছেন। বাম দলগুলোও অনেকে এই ইস্যুতে এক সুরে কথা বলছেন।
`এই পদ্ধতিতে ভোট হলে কারও পক্ষে অতীতের মতো স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে সরকার পরিচালনার সুযোগ হবে না।’
জেসমীন টুলী; নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব
কারণ বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো যখন বিদ্যমান ব্যবস্থার ভোটে জোর দিচ্ছে, অন্যদিকে জামায়াত ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ অনেক দল সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি তুলছে।
এমন পরিস্থিতি আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকারকেও এক ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে। কারণ কোনো কোনো দলের শীর্ষ নেতারা পিআর পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচন হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন।
`নির্বাচনকে বিলম্বিত করার জন্যই এই ইস্যুকে ইচ্ছেকৃত সামনে আনা হচ্ছে।’
বিএনপি ও সমমনা দল
আর বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বলছে, নির্বাচনকে বিলম্বিত করার জন্যই এই ইস্যুকে ইচ্ছেকৃত সামনে আনা হচ্ছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এমন পদ্ধতিতে নির্বাচন কতটা সম্ভব তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
এ পদ্ধতিতে একটি দল সারা দেশে যত ভোট পায়, তার অনুপাতে সংসদে আসন পায়। তবে বাংলাদেশে এই পদ্ধতিতে এখনো নির্বাচন হয়নি। আসছে নির্বাচন এই পদ্ধতিতে করার জন্য দাবি তুলছেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা।
নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিপরীত মেরুতে রাজনীতিবিদরা
এদিকে ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব ও দলের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘গণহত্যার বিচার ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর তারা পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন চান। আওয়ামী লীগের মতো ভবিষ্যতে অন্য কেউ যাতে এক নায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারে সেজন্য এই পদ্ধতির বিকল্প নেই।’
যদিও নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থায় নির্বাচনে ভোটারদের জনমতের প্রতিফলন ঘটে। তবে রাজনৈতিক দলের ঐক্যমত ছাড়া এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন বলেও মনে করেন তারা। বিশেষ করে বড় রাজনৈতিক দলের আপত্তির মুখে এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব হবে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
`সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা দেশে ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তি সৃষ্টি করতে পারে।’
তারেক রহমান; বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান
মঙ্গলবার (০১ জুলাই) জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পিআর পদ্ধতিতে ভোটে ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। রাজনৈতিক
দলগুলোর নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা দেশে ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তি সৃষ্টি করতে পারে।’
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের উপযোগিতা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনি ব্যবস্থার দাবি প্রসঙ্গে তারেক রহমান দেশের বাস্তবতায় এই পদ্ধতিতে ভোট করা কতটা উপযোগী তা নিয়েও চিন্তা করার কথা বলেছেন।
এরআগে গত শনিবার সংস্কার, বিচার এবং পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশে যোগ দিয়ে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, এবি পার্টি, গণ অধিকার পরিষদের নেতারাও পিআর ভোটের পক্ষে কথা বলেন। পিআর পদ্ধতিতে ভোটের বিরোধিতা করা বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোতে এই কর্মসূচিতে আমন্ত্রণও জানানো হয়নি।
সমাবেশ থেকে পিআর ছাড়া নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনকে জনগণের দাবি উল্লেখ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, ‘আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। সংসদের প্রস্তাবিত উভয় কক্ষেই এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হতে হবে। এটি হলে কোনো দল জালেম হওয়ার সুযোগ পাবে না।’ একই অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি ছাড়া বাংলার মানুষ কোনো নির্বাচন গ্রহণ করবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন।
শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সংস্কার, বিচার এবং পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশে যোগ জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, এবি পার্টি, গণ অধিকার পরিষদ।
যদিও বিএনপি পিআর পদ্ধতিতে ভোট দাবির পেছনে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র দেখছে। দলটির নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, নির্বাচন নিয়ে নতুন নতুন ইস্যু সামনে নিয়ে আসলে পতিত সরকার আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
`নির্বাচন নিয়ে যখন ইতিবাচক কথাবার্তা হচ্ছে তখন নতুন একটি ভোটের পদ্ধতি সামনে এনে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
ড. আসাদুজ্জামান রিপন, ভাইস চেয়ারম্যান; বিএনপি
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন ঢাকা মেইলকে বলেন, নির্বাচন নিয়ে যখন ইতিবাচক কথাবার্তা হচ্ছে তখন নতুন একটি ভোটের পদ্ধতি সামনে এনে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা আসলে নির্বাচনকে পিছিয়ে দেয়ার চেষ্টা। কারণ যারা এই দাবি তুলছেন তাদের অনেকে সারাদেশে প্রার্থীও দিতে পারেননি অতীতে। এমন হলে তো দেশ আবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে।’
`বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতির কোনো বাস্তবতা নেই।’
শাহাদাত হোসেন, ১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব
পিআর পদ্ধতির বিরোধিতা করা ১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বর্তমান ঐক্যমত্য কমিশন প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠকের প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী সংসদ নির্বাচন বর্তমান পদ্ধতিতে হবে। বর্তমানে যে সভা চলছে সেখানে বিষয়টি যেহেতু সেটেল্ট, তাই পিআর পদ্ধতি এজেন্ডায় আসে নাই। বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতির কোনো বাস্তবতা নেই।
তিনি বলেন, ‘পিআর দাবি নিয়ে নির্বাচন পেছিয়ে যাবার কোনো সম্ভাবনা নাই। এটা একটা সাময়িক ইস্যু। অচিরেই এটা চাপা পড়ে যাবে।’
আনুপাতিক পদ্ধতি আর বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থায় পার্থক্য কী?
দেশের বর্তমান সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো ৩০০টি আসনে আলাদা আলাদা প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। পিআর হচ্ছে নির্বাচনি ব্যবস্থার এমন একটি পদ্ধতি যেখানে আসন বণ্টন হবে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। অর্থাৎ যদি কোনো দল মোট ভোটের শতকরা ১০ শতাংশ পায়, তাহলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি আসন পাবেন।
বিদ্যমান পদ্ধতিতে এক আসনে চার প্রার্থীর মধ্যে বেশি ভোট যিনি পাবেন তিনিই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অন্য তিন প্রার্থী যত ভোট পান না কেন তা কোনো কাজে আসে না। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে ভোটের আগে প্রতিটি দল ক্রম ভিত্তিতে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল তার প্রাপ্ত ভোটের হার অনুসারে আসন সংখ্যা পাবে।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, এ পদ্ধতিতে একটি নির্বাচনে দেওয়া প্রত্যেকটি ভোট কাজে লাগে এবং প্রতিটি ভোট সংসদে সমানভাবে প্রতিনিধিত্ব করে। এতে সুশাসন নিশ্চিত করা সহজ হবে।
এখনই বাস্তবায়নের সুযোগ দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ জেসমীন টুলী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পিআর পদ্ধতিতে ভোট করার ভালো-মন্দ দুই দিকই আছে। অনেক দেশ এই পদ্ধতিতে গিয়ে আবার ফিরেও এসেছে। তবে বাংলাদেশে এই আলোচনাটা শুরু হয়েছে এটা ভালো দিক। কিন্তু আগামী নির্বাচনেই এটা বাস্তবায়ন করতে হবে কিংবা করা যাবে এমনটা চিন্তা করা কঠিন হবে। কারণ আইন করাসহ সার্বিক প্রস্তুতির জন্য ৬ থেকে ৭ মাস সময় অবশ্যই লাগবে।’
নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমীন টুলী আরও বলেন, এই পদ্ধতিতে ভোট হলে কারও পক্ষে অতীতের মতো স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে সরকার পরিচালনার সুযোগ পাবে না। কারণ সরকার গঠন করতে গিয়ে বেশি আসন পাওয়া দল ছোটদের কাছে টানবে। কোনো কারণে এই দলগুলো সরে গেলে সরকারের বিপদে পরার সম্ভাবনা আছে।
তিনি বলেন, যখন এই পদ্ধতিতে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হবে তখন আলাদা আইন থাকবে। সেখানে বলা থাকবে নূন্যতম কত শতাংশ ভোট পেলে সেই দল সংসদে আসন পাবে। যেহেতু এখন আইন নেই ফলে এটা আগেই বলা যাবে না।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে কমিশনের কাছে প্রত্যেক দলের পক্ষ থেকে প্রার্থী তালিকা দেয়া হবে। যা সিলগালা করে রাখবে কমিশন। ভোট শেষে কে কত আসন পাবে সেই হিসেবে তালিকা থেকে সংসদ সদস্য পদ পাবেন। এখানে পরিবর্তনের সুযোগ পাবে না।
তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৭০টি দেশের মধ্যে ৯১টি দেশে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ, ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশেও নির্বাচন নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময় আনুপাতিক হারে নির্বাচন পদ্ধতি চালুর সুপারিশ করেছিলেন। তবে তা কখনো আলোর মুখ দেখেনি। এবার জোরালো আলোচনা হচ্ছে।
বিভিন্ন দেশে পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুক্ত, গোপন ও মিশ্র তিনটি আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে। তবে মিশ্র পদ্ধতি বেশ জটিল প্রক্রিয়া।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ জেসমীন টুলী বলেন, ‘এখনই এটা বাস্তবায়ন না হলেও আলোচনা চলতে পারে। ঐকমত্য হলে উচ্চকক্ষের জন্য যে দল যত ভোট পায় সেই অনুযায়ী আসন দেয়ার বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তখন এর সুবিধা-অসুবিধাও বোঝা যাবে।’