
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির কল্যাণে বছরে বা অর্ধবছরে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার সংখ্যা সহজেই জানা যায়। ওটিটি মাধ্যমের ক্ষেত্রে এরকম সমন্বয়কারী সংগঠন না থাকায় সেটি সম্ভব না। তাই ব্যক্তিগত হিসাব-ই ভরসা। সে হিসাব বলছে, ২০২৫-এর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে ২৬টির মতো ওয়েব কনটেন্ট। ওয়েব সিরিজ, ওয়েব সিনেমার পাশাপাশি অনুদানের সিনেমাও রয়েছে এ তালিকায়। চলুন দেখি, সেসব সিরিজ-সিনেমা দর্শকের প্রত্যাশার কতটা পূরণ করল?
জানুয়ারি
জানুয়ারির প্রথম দিন মুক্তি পায় ওয়েব সিরিজ ‘ব্ল্যাক মানি’। বছরের প্রথম ওয়েব কনটেন্টটি নিয়ে দর্শকদের প্রত্যাশা ছিল পাহাড় সমান। রায়হান রাফীর নির্মাণ, পূজা চেরীর প্রথম ওয়েব সিরিজ, জনপ্রিয় চিত্রনায়ক রুবেলের প্রথম ওটিটি— উপাদানগুলোই উত্তেজনা জাগিয়েছিল। প্রমোশনেও চমক ছিল। কিন্তু আশার ফুল ফোটেনি। প্রত্যাশা মেটাতে পারেনি দর্শকের। অনেকের মতে, আওয়াজে যতটা ছিল কাজে ততটা দেখাতে পারেনি বঙ্গে মুক্তিপ্রাপ্ত সিরিজটি। এ মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত আরও তিন ওয়েব কনটেন্টের একটি নুহাশ হুমায়ূন নির্মিত ‘২ষ’ । জনপ্রিয় অভিনেত্রীর সুমাইয়া শিমুর প্রত্যাবর্তন, অভিনয়ে হাত ছাইড়া দাও সোনার দেওরা’ খ্যাত ইসলাম উদ্দিন পালাকার— আলোচনার পাত্র কানায় কানায় পূর্ণ করলেও মুক্তির পর প্রত্যাশার পাত্র ভরতে পারেনি চরকির চার গল্পের সিরিজটি। অন্যদিকে মোশাররফ করিম থাকা সত্ত্বেও আলো জ্বালতে পারেনি ‘অন্ধকারের গান’ ওয়েব ফিল্মটি। আবুল হায়াত, জাকিয়া বারী মম, শাহনাজ সুমি, রাশেদ মামুন অপুও ছিলেন ভিকি জাহেদ নির্মিত সিনেমাটিতে। কিন্তু সবার সম্মিলিত চেষ্টায়ও তেমন দর্শকের আগ্রহ জাগাতে পারেনি। সুকর্ন সাহেদ ধীমান নির্মিত ওয়েব সিরিজ ‘ফেউয়ে’র ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। পশ্চিমবঙ্গের মরিচঝাঁপির গণহত্যার ওপর নির্মিত শুনে দর্শকরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু আলোচনার টেবিলে তেমন দাপট দেখাতে পারেনি চরকির কনটেন্টটি। গল্পের ধীরগতি এবং পর্দায় যথাযথ উপস্থাপনের অভাবকে দায়ী করেছেন অনেকে।
ফেব্রুয়ারি
ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পায় বেশ কয়েকটি ওয়েব কনটেন্ট। তবে দর্শকের পাখির চোখ ছিল ‘নীল সুখ’-এ। নির্মাণে ভিকি জাহেদ, অভিনয়ে মেহজাবীন চৌধুরী— দুই কারণে দর্শকের প্রত্যাশার পাখি যতটা উড়ু উড়ু করছিল মুক্তির পর ততটা উড়তে পারেনি। বিঞ্জে মুক্তিপ্রাপ্ত ওয়েব ফিল্মটি প্রশংসা যতটুকু পেয়েছে তা মেহজাবীনের নামের ওপর। কিন্তু মানের দিক থেকে মাঝারি-ই ছিল। তবে ভিকি-মেহজাবীন জোট বেঁধে সন্তুষ্টির পাত্র পূর্ণ করতে না পারলেও ‘ঘুমপরী’ দিয়ে দর্শকের ঘুম কেড়ে নেন জাহিদ প্রীতম। চরকির এ ফিল্মটির গল্প, সংলাপ, গান, দৃশ্যায়ন— দারুণ প্রশংসা কুড়ায়। অনেকের মতে তানজিন তিশার অভিনয় ও সৌন্দর্যের যথাযথ ব্যবহার হয়েছে সিনেমাটিতে। গানের মানুষ প্রীতম হাসান ও পারশা মাহজাবীন পূর্ণিও মন ভরিয়েছেন দর্শকের। এর বাইরে বঙ্গে মুক্তিপ্রাপ্ত স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাগুলো আলোচনার পালে তেমন হাওয়া দিতে পারেনি।
মার্চ
মার্চ হতে পারত ওটিটির জন্য সবচেয়ে আশীর্বাদপুষ্ট। রায়হান রাফী, আশফাক নিপুন, শিহাব শাহীন, কাজল আরিফিন অমির মতো জনপ্রিয় নির্মাতাদের ওয়েব কনটেন্ট মুক্তি পেয়েছিল মাসটিতে। প্রত্যাশার বেলুন তাই ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। ‘ব্ল্যাক মানি’ দিয়ে হতাশ করলেও চরকির ‘আমলনামা’য় রায়হান রাফী ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এটি বেশ প্রসংসা কুড়ায়। অভিনয়শিল্পীরাও হন প্রশংসিত। ক্যামেরায় তমা মির্জা ছিলেন খাপ খোলা তলোয়ার। মুক্তির আগে আশফাক নিপুনের ‘জিম্মি’ ওয়েব সিরিজটি আলোচনায় জ্বালানীর জোগান দিয়েছিল। গল্পের সারসংক্ষেপ শুনে রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন দর্শক। দেশের ওয়েব সিরিজে প্রথমবারের মতো জয়া আহসানের সংযুক্তি দেখে জনতা ভেবেছিল নিপুণ-জয়া দর্শককে পর্দার সামনে জিম্মি করবেন। কিন্তু হইচইয়ে মুক্তি পাওয়া সিরিজটি হইচই ফেলতে পারেনি। পেয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। হতাশ করেছে ‘সিন্ডিকেট’ ওয়েব ফিল্মের স্পিন অব সিরিজ ‘অ্যালেন স্বপনে’র দ্বিতীয় কিস্তি ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। প্রথম কিস্তিতে মুগ্ধ দর্শক বুক ভরা আশা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় কিস্তি ছিল অনেকটা চুম্বকশক্তি হারানো ধাতুর মতো। এদিকে অমির প্রথম ওয়েব সিনেমা ‘হাউ সুইটে’র আগাগোড়া ছিল সিনেম্যাটিক। আয়োজনে খামতি না থাকলেও গল্পে দর্শক টানার প্রয়োজনীয় উপাদানে ঘাটতি ছিল। একইমাসে আইস্ক্রিনে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘কিস্তিমাত’ ও ‘ছায়া’ নিয়ে বলার মতো কিছু নেই।
এপ্রিল
এপ্রিলে মুক্তি পায় ‘ননসেন্স’ নামের একটি ওয়েব সিরিজ। রাকেশ বসু নির্মিত বঙ্গের শহরকেন্দ্রিক পারিবারের গল্পের এ সিরিজটি আলোচনার আগুন তেমন উসকে দিতে পারেনি।
মে
মে তে মনে হয়েছিল কিছু একটা হবে। এর অন্যতম কারণ পশ্চিমবঙ্গের ডাকসাইটে অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। ‘গুলমোহরে’র মাধ্যমে প্রথমবার বাংলাদেশের সিরিজে অভিনয় করেন তিনি। প্রমোশনেও খামতি ছিল না। কিন্তু মুক্তির পর আলোচনার টেবিলে তেজ দেখাতে পারেনি। সারা জাকের, সুষমা সরকার, মোস্তাফিজুর নূর ইমরান, ইন্তেখাব দিনারের মতো অভিনয়শিল্পীদের দারুণ অভিনয় এবং আহমেদ শাওকীর সু-নির্মাণ সত্ত্বেও চরকির সিরিজটি আলোচনার ঝড় বইয়ে দিতে পারেনি। শাশ্বতর চরিত্রও আলাদা কোনো আবেদন তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। এদিকে মোশাররফ করিমকে ডিটেক্টিভ হিসেবে দেখার লোভ ছিল দর্শকের। নির্মাতা সুমন আনোয়ারেও আস্থাটা বেশ ছিল। কিন্তু দিনশেষে বঙ্গর ‘মির্জা’ ওয়েব ফিল্মটি নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেনি। আলোচনায় আসেনি একই ওটিটি মাধ্যমের সিরিজ ‘ফ্যাকড়া’ও। এর বাইরে নিস্তেজ ছিল সিনেমা ‘প্রিয় সত্যজিৎ’।
জুন
কোরবানি ঈদ উপলক্ষে জুনে বেশ সরগরম ছিল ওটিটি মাধ্যম। মুক্তি পায় ছয় কন্টেন্ট। একটিও ছক্কা মারতে পারেনি। দর্শকের নজর যতটুকু কাড়ার কেড়েছিল অমিতাভ রেজা চৌধুরী নির্মিত ‘বোহিমিয়ান ঘোড়া’ ওয়েব সিরিজ। একঝাঁক তারকা এবং প্রমোশনাল ভিডিওর জনপ্রিয়তা ছিল এর কারণ। মুক্তির পরও আলোচনায় ছিল। তবে রিভিউ ছিল মিশ্র। এর বাইরে ওয়েবফিল্ম ‘পার্টি’ জমেনি। রুনা খান অভিনীত সিনেমা ‘নীল পদ্ম’ সুভাষ ছড়ায়নি। শাহরিয়ার নাজিম জয় নির্মিত ‘পাপ কাহিনি’ও আলোচনা তোলেনি। সায়মন সাদিক অভিনীত ‘জলরং’ নিয়েও আলোচনা শোনা যায়নি। মাহমুদুর রহমান হিমি নির্মিত তানজিন তিশা, প্রার্থনা ফারদিন দীঘির ‘হাইড এন সিকে’র ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা গেছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, গেল ছয় মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত ওয়েব কনটেন্টগুলো যত গর্জেছে তত বর্ষেনি। একমাত্র ‘ঘুমপরী’ ছাড়া দর্শকের ঘুম কাড়তে পারেনি কোনোটাই। তবে প্রশংসিত ও আলোচিত ছিল সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণায় নির্মিত ‘আমলনামা’, ‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’, ‘নীল সুখ’, ও ‘গুলমোহর’। যদিও ‘ওয়ান টাইম ওয়াচে’র গণ্ডি ছাড়াতে সেগুলো।