প্রায় ৮০০ শিশুকে এখানেই গোপনে কবর দেওয়া হয়েছে। ছবি: এএফপি
কবরের কোনো রেকর্ড নেই। নেই কোনো সমাধিফলক। স্মৃতিচিহ্ন তো দূরের কথা। দীর্ঘ সময় ধরে এভাবেই আয়ারল্যান্ডের পশ্চিমে কাউন্টি গলওয়ের ছোট্ট শহর টিউআমে শিশুদের গণকবর দেওয়ার এক গোপন সত্য চাপা পড়ে ছিল।
অবশেষে ২০১৪ সালে একজন অপেশাদার ইতিহাসবিদ প্রমাণ খুঁজে পান নির্মম এই গণকবরের— তখনই আলোচনায় উঠে আসে শত শত শিশুর নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, তদন্তকারীরা রহস্য উন্মোচন করতে টিউআমের একটি আবাসিক এলাকার শিশুপার্কের পাশে ঘাসের ওপর খননযন্ত্র বসিয়েছে। আগামী সোমবার (১৪ জুলাই) থেকে শুরু হচ্ছে দীর্ঘ দুই বছরের খনন কার্যক্রম।
এই জায়গাটিতেই একসময় ছিল সেন্ট মেরির শিশু হোম।
১৯২৫ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত চার্চ পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানটি হাজার হাজার নারী ও শিশুকে আশ্রয় দিয়েছিল। অধিকাংশ নারী ছিলেন অবিবাহিত মা, যাদের সমাজচ্যুত করেছিল পরিবার। সন্তান জন্মের পরই তাদের কাছ থেকে আলাদা করা হতো শিশুদের।
সেই হোমের প্রথম মৃত্যুর রেকর্ড ১৯১৫ সালের—পাঁচ মাস বয়সী প্যাট্রিক ডেরেইনের।
শেষ রেকর্ড ১৯৬০ সালে— মেরি কার্টি নামের সমবয়সী এক শিশুর। এই দুই মৃত্যুর মাঝখানে ৭৯৪ জন শিশু ও কিশোরের মৃত্যুর তথ্য মিলেছে, যাদের বেশিরভাগের কবরের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী এন্ডা কেনি একে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘ভয়াবহতার কক্ষ’।
সেই হোমে শৈশবের ছয়টি বছর কাটিয়েছিলেন পি. জে. হ্যাভার্টি। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে ওটা ছিল একটা কারাগার।
আমি সৌভাগ্যবান ছিলাম— কারণ আমি ওখান থেকে বের হতে পেরেছিলাম।’
বিদ্যালয়ে ‘হোম চিলড্রেন’ হিসেবে পরিচিত এসব শিশুদের সঙ্গে অন্যদের সম্পর্ক করতে দেওয়া হতো না।
হ্যাভার্টি বলেন, ‘স্কুলে আমাদের ১০ মিনিট দেরিতে যেতে হতো, আবার ১০ মিনিট আগে বের হয়ে যেতে হতো। ছুটির সময়েও অন্যদের সঙ্গে খেলতে দেওয়া হতো না। যেন আমরা রাস্তাঘাটের ময়লা।’
এমন বিদ্বেষ, এমন নিগ্রহ সারাজীবন ছায়ার মতো পিছু নিয়েছে তার। পরে এক দম্পতির কাছে আশ্রয় পান। শেষে খুঁজে পান তার জন্মদাত্রী মাকেও।
টিউআমেরই বাসিন্দা ক্যাথরিন করলিস, ২০০৫ সালে একটি স্থানীয় ইতিহাস কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখান থেকেই আগ্রহী হন সেন্ট মেরির ইতিহাস জানার।
তিনি বলেন, ‘যখন শুরু করি, জানতাম না আমি কী খুঁজে পাব।’
কিন্তু তার প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নীরবতা ও সন্দেহ তাকে আরো উৎসাহী করে তোলে।
একপর্যায়ে স্থানীয় এক কবরস্থানের তত্ত্বাবধায়কের সহায়তায় তিনি পৌঁছান একটি শিশুদের খেলার মাঠের পাশেই থাকা ঘাসে ঘেরা চত্বরে।
তত্ত্বাবধায়ক তাকে জানান, ১৯৭০-এর দশকে দুই কিশোর ওই এলাকায় খেলার সময় একটি ভাঙা কংক্রিট স্ল্যাব তুললে নিচে হাড়গোড় দেখতে পায়।
তখন ধারণা করা হয়েছিল, হয়তো এসব কঙ্কাল ১৮৪০-এর দশকের দুর্ভিক্ষের সময়ের। কারণ তখন সেখানে একটি ওয়ার্কহাউস ছিল। তবে ক্যাথরিন জানতেন, দুর্ভিক্ষের মৃতদের কবর ছিল আধা মাইল দূরে—স্মৃতিসৌধসহ।
পুরনো মানচিত্রে চোখ রাখতেই তার সন্দেহ আরো জোরালো হয়। ১৯২৯ সালের মানচিত্রে যে জায়গায় হাড়গোড় পাওয়া গিয়েছিল, তা চিহ্নিত ছিল ‘সিউয়েজ ট্যাংক’ হিসেবে। আর ১৯৭০-এর দশকের একটি মানচিত্রে হস্তলিখিতভাবে লেখা ছিল— ‘সমাধিক্ষেত্র’।
তিনি যখন গ্যালওয়ের জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন অফিসে ফোন করে সেন্ট মেরির হোমে মারা যাওয়া শিশুদের নাম জানতে চান, তখন কর্মকর্তারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, তিনি কি সত্যিই ‘সব নাম’ চান?
তারপর তিনি গ্যালওয়ে এবং আশপাশের কবরস্থান খুঁজে দেখেন, এই শিশুদের কেউ কি সেখানে সমাহিত? উত্তর ছিল— না।
সব কিছু মিলিয়ে তিনি নিশ্চিত হন, এই শিশুদের হয়তো ওই সিউয়েজ ট্যাংকে গোপনে কবর দেওয়া হয়েছিল।
২০১৪ সালে যখন তার গবেষণা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসে, তখন নিজের শহরেই সন্দেহ আর বিদ্বেষের মুখোমুখি হন ক্যাথরিন।
তিনি বলেন, ‘মানুষ আমার কথা বিশ্বাস করছিল না।’
তবে একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। যিনি নিশ্চিত করেছিলেন— স্ল্যাবের নিচে তিনি মানুষের হাড়গোড় দেখেছেন।
বহু বছরের অপেক্ষার পর, আইরিশ সরকার অবশেষে টিউআমে খননকাজ শুরুর ঘোষণা দেয়।
এই দীর্ঘদিনের চাপা পড়া সত্য, যা একটি পুরো শহর লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল, তা উঠে আসতে চলেছে মাটির নিচ থেকে।