বছরখানেক ধরে পোশাক খাতে বিরাজ করছে অস্থিরতা। ছবি: সংগৃহীত
-কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির প্রভাব উৎপাদন খরচে
-বন্ধ হচ্ছে কারখানা, নতুন উদ্যোক্তাও কম
-হুমকিতে সামাজিক নিরাপত্তা ও নারী কর্মসংস্থান
-সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ার শঙ্কা
দেশের প্রধান রফতানি খাত হিসেবে পরিচিত পোশাক শিল্প বর্তমানে নানা সংকটে জর্জরিত। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি এবং ক্রয়াদেশে মন্দাভাবের কারণে এই খাতে বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা। উদ্যোক্তা থেকে শ্রমিক- সবাই এক অনিশ্চয়তায় ভুগছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর উৎপাদনশীল কারখানা বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে একধরনের স্থবিরতা নেমে আসে। রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা জটিলতায় বন্ধ হয়ে গেছে অনেক কারখানা। ফলে কর্মসংস্থানে নেমে এসেছে খরা। অন্য দিকে নতুন উদ্যোক্তাও কম। আর্থিক সংকটের কারণে অনেক ব্যাংকই ঋণ দেওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে।
পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। এই খাতে চলমান সংকট অব্যাহত থাকলে শুধু রফতানি আয় নয়, সামাজিক নিরাপত্তা, নারী কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হুমকির মুখে পড়বে।
বিশেষজ্ঞদের মত
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তিই হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। দেশের মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশই আসে এই খাত থেকে, যা প্রতি বছর গড়ে ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক- যার বেশির ভাগই নারী- এই খাতে কর্মরত। ফলে এই সংকট শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবও ফেলছে।
ইউরোপ ও আমেরিকার মতো প্রধান ক্রেতা দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি, যুদ্ধ পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানির পরিমাণ কমেছে। অনেক কারখানায় অর্ডার আগের তুলনায় ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং শ্রমিক ছাঁটাইয়ের আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
এদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। অথচ পণ্যের মূল্য সেই অনুপাতে বাড়েনি। পাশাপাশি ডলার সংকট ও এলসি খুলতে জটিলতা তৈরি হওয়ায় অনেক উদ্যোক্তা কাঁচামাল আমদানিতে হিমশিম খাচ্ছেন।
বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক কারখানা। ছবি: সংগৃহীত
বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অনিয়মিত সরবরাহও উৎপাদনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক কারখানাই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না পেয়ে বাধ্য হচ্ছে উৎপাদন আংশিক বন্ধ রাখতে বা বিকল্পভাবে ব্যয়বহুল ডিজেলচালিত জেনারেটরের ওপর নির্ভর করতে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) জানিয়েছে, এই অস্থিরতা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে বিদেশি ক্রেতারা অন্য দেশমুখী হতে পারে, যা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে।
বর্তমানে পোশাক খাতের সংকট একাধিক দিক থেকে ঘিরে ধরেছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, ডলার নিয়ে জটিলতা, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, এলসি (ঋণপত্র) জটিলতা, অর্ডার সংকোচন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস ঘাটতি, শ্রমিক অসন্তোষ এবং ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ব্যয়- সব মিলিয়ে এ খাতে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
নানা সংকটের আবর্তে পোশাক খাত
গত প্রায় এক বছর ধরে দেশের পোশাক খাত নানা সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই খাত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। সরকারের কিছু উদ্যোগ দৃশ্যমান হলেও সেগুলোকে যথেষ্ট মনে করছেন না সংশ্লিষ্টরা।
বৈশ্বিক মন্দা ও অর্ডার সংকোচন: বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি পরবর্তী মন্দা এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অভিঘাত কিছুটা কাটিয়ে উঠলেও ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আবার এক অনিশ্চিত ধাঁধায় পড়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি। ফলে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মতো প্রধান আমদানিকারক দেশগুলোতে পোশাক কেনার হার কমে যায়।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া পোশাকের অর্ডার গত বছরের তুলনায় গড়ে ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। অনেক বড় বড় ব্র্যান্ড আগের মতো নিয়মিত অর্ডার না দিয়ে অপেক্ষা করছে বাজার স্বাভাবিক হওয়ার জন্য। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা।
শ্রমিক অসন্তোষ সংকটের অন্যতম কারণ। ছবি: সংগৃহীত
কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও আমদানি জটিলতা: দেশের পোশাক খাত মূলত আমদানিনির্ভর। তুলা, কাপড়, বোতাম, জিপারসহ অন্যান্য কাঁচামালের বড় একটি অংশ চীন, ভারত, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। কিন্তু ডলার সংকট এবং এলসি খুলতে ব্যাংকগুলোর টালবাহানার কারণে কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে।
ফলে অনেক কারখানা কাঁচামালের ঘাটতির কারণে নির্ধারিত সময়মতো উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারছে না। এমনকি কিছু কারখানায় উৎপাদন সাময়িকভাবে বন্ধও রাখতে হয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্যও বেড়েছে। তুলার দাম এক বছরে গড়ে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ বিদেশি ক্রেতারা সেই অনুপাতে মূল্য বাড়াতে রাজি হচ্ছেন না।
বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট: শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে দেশে সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি সংকট বিরাজমান। বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং গ্যাস চাপ কমে যাওয়ায় পোশাক কারখানাগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অনেক উদ্যোক্তা বিকল্প হিসেবে ডিজেলচালিত জেনারেটরের ওপর নির্ভর করছেন, যার খরচ বহুগুণ বেশি।
শ্রমিক অসন্তোষ ও মানবিক চ্যালেঞ্জ: দীর্ঘ সময় ধরে পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবি ছিল। শেষ পর্যন্ত সরকার ২০২৩ সালে মজুরি বোর্ড গঠন করে এবং নতুন ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে। তবে শ্রমিকরা এই পরিমাণ বেতনকে অপ্রতুল বলে দাবি করে আন্দোলনে নামে। শ্রমিক অসন্তোষ একাধিক এলাকায় সহিংস রূপ নেয়, কারখানা ভাঙচুর, বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে, মালিকপক্ষ দাবি করছে, ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় তারা নতুন মজুরি কাঠামো বহন করতে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে অনেক কারখানায় ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কিছু কারখানায় নিয়মিত বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রা সংকট ও ব্যাংকিং জটিলতা: দেশে বর্তমানে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফলে আমদানি ব্যয় মেটাতে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সময়মতো মিলছে না। অনেক ব্যাংক এখন পর্যন্ত বকেয়া এলসি খুলতে রাজি হচ্ছে না বা বিলম্ব করছে। এর ফলে উদ্যোক্তারা বাধ্য হচ্ছেন উচ্চ দামে কাঁচামাল কিনতে বা বিকল্প উৎসে যেতে, যা উৎপাদন খরচকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ি মনিটরিং, উচ্চ সুদের হার এবং নিয়ন্ত্রিত ডলার বিনিময় হারের কারণে উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সেই সঙ্গে রপ্তানি আয়ের অর্থ ফেরত আসতেও বিলম্ব হচ্ছে, যা নগদ প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
প্রতিযোগী দেশগুলোর অগ্রগতি: বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত একসময় চীনের বিকল্প হিসেবে দাঁড়ালেও বর্তমানে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, তুরস্ক ও মিয়ানমারের মতো দেশগুলো দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এই দেশগুলো তুলনামূলকভাবে দক্ষ শ্রমিক, উন্নত অবকাঠামো এবং সরকারের নানামুখী সহায়তার কারণে ক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। বিশ্লেষকদের মতে, যদি বাংলাদেশ ত্বরিত ও কার্যকর উদ্যোগ না নেয়, তবে আগামী কয়েক বছরে বৈশ্বিক বাজারে অবস্থান হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে।
পোশাক খাতের মন্দা প্রভাব ফেলবে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। ছবি: সংগৃহীত
সরকারি উদ্যোগ ও সীমাবদ্ধতা: সরকার সংকট নিরসনে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রফতানিকারকদের জন্য নগদ প্রণোদনা, রফতানি উন্নয়ন তহবিল থেকে সহজ ঋণ এবং এলসি প্রক্রিয়া সহজীকরণের চেষ্টা চলছে। শিল্প মালিকরা বলছেন, সরকারের নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন হলেও তা বাস্তবে সময়মতো হাতে আসে না। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিয়ে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, তারও বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। এই খাতে চলমান সংকট অব্যাহত থাকলে শুধু রফতানি আয় নয়, সামাজিক নিরাপত্তা, নারী কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হুমকির মুখে পড়বে। সরকারের উচিত হবে- সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে একটি সংকট ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. আব্দুর রাজ্জাক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে মাইক্রো ইকোনোমির সার্বিক অবস্থা আমাদের দেশে ভালো না। এখানে মূল্যস্ফীতির বড় একটা সমস্যা রয়েছে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলার ঘাটতি বিদ্যমান। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যতখানি উন্নতির দরকার ছিল ততখানি হয়নি।’
গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলেপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘তৈরি পোশাক খাতের জন্য জ্বালানি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটির ঘাটতি হলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। এনার্জি (জ্বালানি) আমাদের পুরোটাই ইনপোর্ট (আমদানি) করতে হয়। আগে আমাদের রিজার্ভ ঘাটতি থাকলেও এখন একটা পর্যায়ে এসেছে। তবে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়েছে, ডলারের দাম বেড়েছে, বিপরীতে আমাদের টাকার দাম কমেছে। ফলে আমাদের আমদানিটা কিছুটা অস্থিরতার মধ্যেই যাচ্ছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের সাবেক এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘সম্প্রতি ভারত আমাদের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে। এতেও কিন্তু একটা নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যে নতুন শুল্ক আরোপ করেছে তা কঠিন পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে। যদিও তা আলোচানা চলমান। সরকার চেষ্টা করছে একটা সমাধানে।’ মহিউদ্দিন রাব্বানি, ঢাকা মেইল