
গত এক বছরে দেশের ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও, অনেক সংকট এখনও পুরোপুরি কাটেনি। ব্যাংক লুটপাট থেমেছে, কিন্তু ফেরত আসেনি লোপাটের অর্থ। দুর্বল ব্যাংকগুলো এখনও বিপদের মধ্যে এবং খেলাপি ঋণের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিও উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে।
গত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপে ব্যাংক খাতের অবস্থা কিছুটা সুরক্ষিত হয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বড় ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তার পরও দুর্বল ব্যাংকগুলো নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা কাটেনি। ফেরত আনা যায়নি লুটপাট ও পাচারের টাকা। এ অবস্থায় অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। সেই সঙ্গে ব্যাংক লুটেরা ও তাদের সহায়তাকারী অনেকেই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষ্য, কঠোর নজরদারি, তারল্য সহায়তা, সংস্কার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যাংক খাতকে ইতোমধ্যে খাদের কিনার থেকে বের করে আনা সম্ভব হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটে এক প্রকার বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল ব্যাংক খাত। এ কারণে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সংস্কারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় এ খাত। বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নিয়েই ব্যাংক খাতের লুটপাট বন্ধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নেন। গত এক বছরে ১৪টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করা হয়। এর মধ্যে ১০টির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত ছিল বহুল আলোচিত চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠন ও আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী করতে গঠন করা হয় টাস্কফোর্স। এ টাস্কফোর্স অনিয়মের শিকার ব্যাংকগুলোর সম্পদের প্রকৃত মান বের করছে। এ ছাড়া দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণে প্রণয়ন করা হয় ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশ। এর অধীন ব্যাংক একীভূত, অধিগ্রহণ ও অবসায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে একটি বিভাগও গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ব্যাংক কোম্পানি আইন এবং বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডারেও। সেই সঙ্গে বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের দুর্নীতি ও লুটপাটে অর্থনীতির যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তার ফিরিস্তি জনগণের সামনে তুলে ধরে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সুশাসন নিশ্চিতে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব উদ্যোগ ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সহায়ক হবে বলে জানান অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, গত এক বছরে লক্ষণীয়ভাবে যে জিনিসগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক করেছে, সেটা হচ্ছে, অনেক ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করে দিয়েছে। এর ফলে ব্যাংকের সুশাসনে অনেক উন্নতি হয়েছে। আবার দুর্বল ব্যাংকগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্স প্রণয়ন করা হয়েছে। খেলাপি ঋণের হিসাবও আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী করা হচ্ছে। এসব পদক্ষেপ ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সহায়ক হচ্ছে। তবে ঋণের নামে যারা ব্যাংক ডাকাতি করেছে এবং তাদের সহায়তা করেছে,
তাদেরও আইনের আওতায় আনা দরকার। সেই সঙ্গে লোপাট ও পাচারের অর্থ উদ্ধারেও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। সবকিছু অবশ্য রাতারাতি হবে, তা নয়।
দেশের ব্যাংকিং খাত গত এক বছরে খাদের কিনারা থেকে ফিরে এসেছে বলে গত রবিবার এক সেমিনারে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। গভর্নর বলেন, গত বছরের আগস্টে সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় এ খাত একেবারে তলানিতে চলে গিয়েছিল। তার দায়িত্বগ্রহণের পর থেকে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে এই খাত ধ্বংসের মুখ থেকে ফিরতে পেরেছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর আমাদের দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল- অর্থনীতি স্থিতিশীল করা এবং আর্থিক খাত সংস্কার। এক বছরে পূর্ণ সংস্কার সম্ভব নয়, তবে প্রতিটি খাতে সংস্কার শুরু করেছি।
ধরাছোঁয়ার বাইরে ব্যাংক লুটেরা, ফেরেনি টাকাও : আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একাধিক ব্যাংক দখল করে ঋণের নামে বিপুল অর্থ লুট করা হয়। সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে অর্থ বের করে নেওয়া হয়। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, মাত্র ১০টি ব্যবসায়ী ও শিল্প গ্রুপ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণের নামে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। এসব লুটপাটে জড়িতদের অনেকেই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। ফলে ফেরত আনা যায়নি লোপাটের অর্থও। তথ্যানুয়ায়ী, আওয়ামী সরকারের আমলে ব্যাংক দখল ও লুটপাটে সবার শীর্ষে ছিল বিতর্কিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলম। এ গ্রুপ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে একাই নিয়েছে সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা, যার ১ লাখ কোটি টাকার বেশি নেওয়া হয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ থেকে। এ ছাড়া বেক্সিমকো গ্রুপের সালমান এফ রহমান নামে-বেনামে অর্থ বের করে নিয়েছেন ৫৩ হাজার কোটি টাকা। নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদার নামে-বেনামে নিয়েছেন ২১ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শিকদার গ্রুপ ৬ হাজার কোটি, সামিট গ্রুপ ৭ হাজার কোটি, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান বাবুর কোম্পানি আরামিট গ্রুপ ৮০০ কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। এসব অর্থের বেশির ভাগই দেশ থেকে পাচার করে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি জেনেও সে সময় নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউ। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব গ্রুপের অবৈধ অর্থ অর্জন, কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার খতিয়ে দেখতে যৌথ তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। সেই সঙ্গে গ্রুপগুলোর পাচার করা অর্থ শনাক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পাচারের ঘটনা তদন্ত করতে বিশ্বের বড় তিনটি অডিট ফার্মকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
দুর্বল ব্যাংক নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি : এখন পর্যন্ত ১৪টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে দুটি ব্যাংক ছাড়া বাকিগুলোর আর্থিক অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে শরিয়াভিত্তিক দুর্বল ৫টি ব্যাংকে একীভূত করার পরিকল্পনার কথা জানানো হয়। তবে একটি ব্যাংকের বিরোধিতার কারণে একীভূত করার এই কার্যক্রমও এগোচ্ছে ধীরগতিতে। আবার একীভূত হওয়ার খবর জানার পর থেকে এসব ব্যাংকের কর্মীরা চাকরি হারানোর ভয়ে আছেন। আমানত ফেরতের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত আমানতকারীরাও। এরই মধ্যে কিছু ব্যাংক থেকে আমানত উত্তোলন বেড়েছে। ব্যাংকগুলো হলো- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। এর মধ্যে প্রথম চারটি এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল, আর এক্সিম ব্যাংক ছিল নাসা গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে।
অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে খেলাপি ঋণ : লোপাটের টাকা ফেরত না আসা ও খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যাংক খাতে অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। ব্যাংক খাতে গত মার্চ পর্যন্ত বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা বা ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। জানুয়ারি-মার্চ এই তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা বা ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এ অবস্থায় ছয় মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা। এদিকে গত বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। ফলে গত এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। -জিয়াদুল ইসলাম, আমাদের সময়