১১:৫৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ অগাস্ট ২০২৫

দাবি আদায়ের শহর হয়ে উঠছে ঢাকা, বাড়াচ্ছে নাগরিক ভোগান্তি

  • আপডেট সময়: ০৭:০২:০৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৩ অগাস্ট ২০২৫
  • 2

নানা কর্মসূচিতে দিনভর যানজটের ভোগান্তি। ছবি: ঢাকা মেইল


রাজধানী ঢাকা যেন এখন দাবি আদায়ের শহর। বিশেষ করে গত প্রায় এক বছর ধরে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দাবির মিছিল শুধু বেড়েই চলেছে। এমন কোনো দিন নেই যেদিন একাধিক দাবিতে কোনো কর্মসূচি থাকে না। আর দাবি আদায়ের প্রধান ক্ষেত্রস্থল রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র জাতীয় প্রেসক্লাব, পল্টন, বায়তুল মোকাররম ও সচিবালয় এলাকা। এখানে কেউ অল্প সময় রাস্তায় যান চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। যানজটের সেই ধাক্কা লাগে পুরো রাজধানীতে।

আজ বুধবারের (১৩ আগস্ট) সকালটাই ধরা যাক। এদিন জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকায় সমাবেশ করেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। টানা কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকে প্রেসক্লাবের সামনের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটি। এর মধ্যেই নয় দফা দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। মানববন্ধন করেন সরকারি ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক কলেজের শিক্ষার্থীরাও। ছোটখাটো আরও কর্মসূচি পালিত হয়েছে।

এভাবে রাস্তা আটকে ঢাকায় যানজট বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। কর্মদিবসে রাজধানীতে কোনো কর্মসূচিই এলাউ করা উচিত নয়।

ক্ষুব্ধ নগরবাসীর প্রতিক্রিয়া

এদিন বিকেলে বিজয়নগর পানির ট্যাংকের পাশে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ ডাকে জামায়াতে ইসলামী। দলটির কর্মসূচি বিকেল ৫টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এর দুই ঘণ্টা আগেই পল্টন মোড় থেকে বিজয়নগরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটি বন্ধ করে দেয়। হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিলসহ যোগ দেওয়ায় ওই এলাকায় যানজট অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছে। এই যানজটের ধাক্কা লাগে পুরো রাজধানীতে।

যানজট আর ভোগান্তির এই চিত্র শুধু একদিনেরই নয়, প্রায় প্রতিদিনই এভাবে ভোগান্তির শিকার হতে হয় রাজধানীবাসীকে। যেকোনো দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ার প্রবণতা দিন দিন শুধু বেড়েই চলেছে।

যানজট ছড়িয়ে পড়ে নগরজুড়ে। ছবি: সংগৃহীত

সকাল ৯টার দিকে রাজধানীর রায় সাহেব বাজার থেকে বাসে উঠেন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত ইফতি হাসান। যাবেন যমুনা ফিউচার পার্ক। তিনি যখন রামপুরায় পৌঁছেন তখন ঘড়িতে ১১টার কাঁটা পেরিয়ে গেছে। তিনি ক্ষোভের সুরে বলছিলেন, ‘এভাবে রাস্তা আটকে ঢাকায় যানজট বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। কর্মদিবসে রাজধানীতে কোনো কর্মসূচিই এলাউ করা উচিত নয়।’

অতিষ্ঠ নগরবাসী বলছেন ‘নিষ্কৃতি চাই’

নগরবাসী বলছেন, এই শহরে এভাবে বাস করা যায় না। এ থেকে নিষ্কৃতি দরকার। প্রতিদিনের মতো আজও অফিস, স্কুল বা জরুরি কাজে বেরিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ। পুরান ঢাকার বাসিন্দা আব্দুল কাদের ক্ষোভে বলেন, ‘এই শহর আসলে জিম্মি শহর। ফুটপাত আন্দোলনের, রাস্তা মিছিলে—সাধারণ মানুষের জন্য কিছুই নেই।’

আন্দোলন বা সমাবেশের কারণে ঢাকা শহরের প্রধান সড়কগুলোতে তৈরি হওয়া যানজট সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে বিশৃঙ্খল করে তোলে। অফিসগামী কর্মীরা সময়মতো পৌঁছাতে পারছেন না, শিক্ষার্থীরা ক্লাস বা পরীক্ষায় দেরি করছে, আর বাজারে যাওয়া সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে দীর্ঘ সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।

এর দ্বারা জরুরি সেবা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস বা পুলিশ বাহিনী কখনো কখনো বিলম্বে পৌঁছায়, যা স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করে। গণপরিবহন প্রায় অচল হয়ে যায়, যাত্রীরা হেঁটে বা বিপজ্জনকভাবে গাড়ির ফাঁক দিয়ে চলতে বাধ্য হয়।

কর্মদিবসে রাজনৈতিক কর্মসূচি ভোগান্তি বাড়ায় কয়েক গুণ। ছবি: সংগৃহীত

ফুটপাতও আন্দোলনকারীদের ব্যানার ও মঞ্চের দ্বারা দখল হওয়ায় পথচারীদের জন্য বিপদ সৃষ্টি হয়। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা, গরম বা বৃষ্টির মধ্যে অপেক্ষা করা মানসিক চাপ এবং শারীরিক ক্লান্তি বাড়ায়। তাদের আন্দোলন আর দাবি-দাওয়ার দ্বন্দ্বে ‘বিশৃঙ্খল’ হয়ে উঠে জনজীবন!

এক কথায়, আন্দোলনকেন্দ্রিক যানজট শুধু সময়ের ক্ষতি নয়, এটি নগর জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহকে ব্যাহত করে, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডকে থমকে দেয় এবং শহরের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঢাকার মতো ঘনবসতি শহরে যেকোনো বড় আন্দোলন বা সমাবেশের কারণে প্রধান সড়কগুলো বন্ধ হয়ে গেলে শুধু যানজট নয়, নগরের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রমও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ধরনের যানজট ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদনশীলতা এবং শ্রমিকদের কার্যক্ষমতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। জরুরি সেবা যেমন অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস বা পুলিশ দ্রুত পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, যা জীবন ও সম্পদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

তারা বলছেন, শহরের নিরাপদ চলাচল, ব্যবসায়িক কার্যক্রম এবং জরুরি সেবা নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে বিকল্প সমাবেশ এলাকা নির্ধারণের প্রয়োজন। সমাবেশের অধিকার অবশ্যই রক্ষা করতে হবে, তবে তা যেন সাধারণ মানুষের চলাচল ও নগর জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত না করে। সমন্বিত পরিকল্পনা, সময় নির্ধারণ এবং পথনির্ধারণের মাধ্যমে এই দ্বৈত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী জিল্লুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পেশাজীবীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া থাকতেই পারে, তবে সেগুলো উপস্থাপনের উপযুক্ত কিছু মাধ্যম থাকা জরুরি। এ বিষয়টি আমাদের নীতি নির্ধারকদের গুরুত্ব সহকারে ভাবা উচিত, যাতে করে এসব কার্যক্রমে জনদুর্ভোগ তৈরি না হয়। এটি আমাদের অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।’

তার মতে, ‘ঢাকায় বসবাসকারী প্রত্যেক মানুষই কোনো না কোনো দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত। এসব কাজ সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে করতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ে কাজে যাওয়া, কোনো অফিসের ভাইভায় অংশ নেওয়া—এ ধরনের শিডিউল মেনে চলার নিশ্চয়তা কর্তৃপক্ষের দিক থেকে নিশ্চিত করা জরুরি। বিভিন্ন শ্রেণির পেশাজীবীরা যখন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করেন, তখন তা এমনভাবে আয়োজন করা উচিত যাতে নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হলেও জনজীবনে তীব্র ভোগান্তি ও ক্ষতি না হয়। এ নিয়ে এখনই চিন্তাভাবনা শুরু করতে হবে; সময় চলে এসেছে, দেরি করার আর সুযোগ নেই।’

প্রেসক্লাব এলাকায় প্রতিদিনই থাকে কর্মসূচি। ছবি: সংগৃহীত

তিনি আরও বলেন, ‘একজন সাধারণ মানুষ ও সচেতন পথচারী হিসেবে আমি বুঝি—যদি ১০ হাজার মানুষ মাত্র এক ঘণ্টার জন্যও এ ধরনের বিড়ম্বনায় পড়েন, তাহলে ১০ হাজার শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়। এর ফলে অর্থনীতিতে যে ক্ষতি হয়, তা দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) থেকে বঞ্চিত হওয়ার সমান। এভাবে অর্থনৈতিক পিছিয়ে পড়া এড়াতে আমাদের এখনই বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।’

ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে,  সমাবেশের সময় সড়ক খোলা রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। ভিড়, নিরাপত্তা, মঞ্চ স্থাপন—সব মিলিয়ে বিকল্প রুটই ভরসা। কিন্তু সেগুলোও আটকে যায়। রাজধানীর প্রধান সড়কে বড় সমাবেশ বা কর্মসূচি শুরু হওয়া মানেই শহরের স্বাভাবিক চলাচলে মারাত্মক ধাক্কা। সড়ক বন্ধ হয়ে গেলে প্রথমেই আশেপাশের বিকল্প রুটগুলোতে চাপ বাড়তে থাকে। খুব দ্রুতই সেই রাস্তাগুলোতেও দীর্ঘ সারি তৈরি হয়, যা কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় এই যানজট কাটতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যায়, আর ততক্ষণে অফিসযাত্রী, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী—সবাই নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

তাদের মতে, যান চলাচল সচল রাখতে সমাবেশের স্থান নির্ধারণ ও সময় বাছাইয়ে সমন্বয় জরুরি। যদি কর্মসূচি প্রধান সড়ক এড়িয়ে নির্দিষ্ট খোলা জায়গা বা পূর্বনির্ধারিত স্থানে সীমাবদ্ধ রাখা যায়, তবে নগরের গতি কিছুটা হলেও বজায় রাখা সম্ভব হবে। শুধু ট্রাফিক পুলিশের প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়; সাধারণ মানুষ, পরিবহন চালক এবং কর্মসূচির আয়োজকদের যৌথ সহযোগিতা থাকলেই কেবল এই ধরনের অচলাবস্থা কমানো যাবে।

নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘আমাদের সংবিধান-স্বীকৃত অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো চলাচলের অধিকার। আমরা যেকোনো জায়গায় যেতে পারি—এটাই আমাদের মৌলিক অধিকার। একইভাবে, নাগরিক হিসেবে সমাবেশ করার অধিকারও আমাদের রয়েছে। তবে সেই অধিকার যেন অন্যের চলাচলের অধিকারকে খণ্ডিত না করে, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি। আমরা নাগরিক হিসেবে সমাবেশ করতে পারি, কিন্তু তা হতে হবে এমনভাবে যাতে অন্য নাগরিকের চলাচলে বিঘ্ন না ঘটে। রাষ্ট্রের আইন, নীতি ও দিকনির্দেশনা অনুযায়ী এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে নির্ধারিত থাকা উচিত। আমাদের দেশে কোথায় সমাবেশ করা যাবে আর কোথায় যাবে না—এর জন্য একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, বিগত সরকারের সময় বা অন্য সময় দেখা গেছে, সমাবেশের জন্য অনুমোদন নিতে হতো। কিন্তু এখনো পর্যন্ত আমরা এমন কোনো উদ্যোগ দেখি না- যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। এই নীতিমালার উদ্দেশ্য হবে জনদুর্ভোগ এড়ানো, যাতে সমাবেশের কারণে রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার না হয়। বিশেষ করে নগর এলাকায় সমাবেশের জন্য নির্দিষ্ট স্থান চিহ্নিত (ডিমার্কেশন) করে দেওয়া দরকার। সামনে নির্বাচন আসছে, ফলে রাজনৈতিক সমাবেশের চাহিদা বাড়বে। নির্দিষ্ট এলাকা ও নীতিমালা থাকলে জনদুর্ভোগ অনেকটা কমানো সম্ভব।’

তিনি আরও বলেন, ‘যারা সমাবেশ করে বা রাজনৈতিক দলগুলোর মনে রাখা উচিত—সমাবেশের মাধ্যমে যদি মানুষের কষ্ট বাড়ে, তাহলে সেই বার্তা জনগণের কাছে ইতিবাচকভাবে পৌঁছায় না। হঠাৎ করে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ মানুষের বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। তাই ভেবে দেখা দরকার, কীভাবে জনগণের কাছে পৌঁছে তাদের কাছে রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায়—যাতে অধিকারও বজায় থাকে এবং জনদুর্ভোগও কমে।’ আব্দুল হাকিম, ঢাকা মেইল

 

উত্তরাধুনিক

Writer, Singer & Environmentalist

দাবি আদায়ের শহর হয়ে উঠছে ঢাকা, বাড়াচ্ছে নাগরিক ভোগান্তি

আপডেট সময়: ০৭:০২:০৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৩ অগাস্ট ২০২৫

নানা কর্মসূচিতে দিনভর যানজটের ভোগান্তি। ছবি: ঢাকা মেইল


রাজধানী ঢাকা যেন এখন দাবি আদায়ের শহর। বিশেষ করে গত প্রায় এক বছর ধরে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দাবির মিছিল শুধু বেড়েই চলেছে। এমন কোনো দিন নেই যেদিন একাধিক দাবিতে কোনো কর্মসূচি থাকে না। আর দাবি আদায়ের প্রধান ক্ষেত্রস্থল রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র জাতীয় প্রেসক্লাব, পল্টন, বায়তুল মোকাররম ও সচিবালয় এলাকা। এখানে কেউ অল্প সময় রাস্তায় যান চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। যানজটের সেই ধাক্কা লাগে পুরো রাজধানীতে।

আজ বুধবারের (১৩ আগস্ট) সকালটাই ধরা যাক। এদিন জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকায় সমাবেশ করেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। টানা কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকে প্রেসক্লাবের সামনের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটি। এর মধ্যেই নয় দফা দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। মানববন্ধন করেন সরকারি ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক কলেজের শিক্ষার্থীরাও। ছোটখাটো আরও কর্মসূচি পালিত হয়েছে।

এভাবে রাস্তা আটকে ঢাকায় যানজট বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। কর্মদিবসে রাজধানীতে কোনো কর্মসূচিই এলাউ করা উচিত নয়।

ক্ষুব্ধ নগরবাসীর প্রতিক্রিয়া

এদিন বিকেলে বিজয়নগর পানির ট্যাংকের পাশে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ ডাকে জামায়াতে ইসলামী। দলটির কর্মসূচি বিকেল ৫টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এর দুই ঘণ্টা আগেই পল্টন মোড় থেকে বিজয়নগরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটি বন্ধ করে দেয়। হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিলসহ যোগ দেওয়ায় ওই এলাকায় যানজট অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছে। এই যানজটের ধাক্কা লাগে পুরো রাজধানীতে।

যানজট আর ভোগান্তির এই চিত্র শুধু একদিনেরই নয়, প্রায় প্রতিদিনই এভাবে ভোগান্তির শিকার হতে হয় রাজধানীবাসীকে। যেকোনো দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ার প্রবণতা দিন দিন শুধু বেড়েই চলেছে।

যানজট ছড়িয়ে পড়ে নগরজুড়ে। ছবি: সংগৃহীত

সকাল ৯টার দিকে রাজধানীর রায় সাহেব বাজার থেকে বাসে উঠেন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত ইফতি হাসান। যাবেন যমুনা ফিউচার পার্ক। তিনি যখন রামপুরায় পৌঁছেন তখন ঘড়িতে ১১টার কাঁটা পেরিয়ে গেছে। তিনি ক্ষোভের সুরে বলছিলেন, ‘এভাবে রাস্তা আটকে ঢাকায় যানজট বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। কর্মদিবসে রাজধানীতে কোনো কর্মসূচিই এলাউ করা উচিত নয়।’

অতিষ্ঠ নগরবাসী বলছেন ‘নিষ্কৃতি চাই’

নগরবাসী বলছেন, এই শহরে এভাবে বাস করা যায় না। এ থেকে নিষ্কৃতি দরকার। প্রতিদিনের মতো আজও অফিস, স্কুল বা জরুরি কাজে বেরিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ। পুরান ঢাকার বাসিন্দা আব্দুল কাদের ক্ষোভে বলেন, ‘এই শহর আসলে জিম্মি শহর। ফুটপাত আন্দোলনের, রাস্তা মিছিলে—সাধারণ মানুষের জন্য কিছুই নেই।’

আন্দোলন বা সমাবেশের কারণে ঢাকা শহরের প্রধান সড়কগুলোতে তৈরি হওয়া যানজট সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে বিশৃঙ্খল করে তোলে। অফিসগামী কর্মীরা সময়মতো পৌঁছাতে পারছেন না, শিক্ষার্থীরা ক্লাস বা পরীক্ষায় দেরি করছে, আর বাজারে যাওয়া সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে দীর্ঘ সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।

এর দ্বারা জরুরি সেবা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস বা পুলিশ বাহিনী কখনো কখনো বিলম্বে পৌঁছায়, যা স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করে। গণপরিবহন প্রায় অচল হয়ে যায়, যাত্রীরা হেঁটে বা বিপজ্জনকভাবে গাড়ির ফাঁক দিয়ে চলতে বাধ্য হয়।

কর্মদিবসে রাজনৈতিক কর্মসূচি ভোগান্তি বাড়ায় কয়েক গুণ। ছবি: সংগৃহীত

ফুটপাতও আন্দোলনকারীদের ব্যানার ও মঞ্চের দ্বারা দখল হওয়ায় পথচারীদের জন্য বিপদ সৃষ্টি হয়। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা, গরম বা বৃষ্টির মধ্যে অপেক্ষা করা মানসিক চাপ এবং শারীরিক ক্লান্তি বাড়ায়। তাদের আন্দোলন আর দাবি-দাওয়ার দ্বন্দ্বে ‘বিশৃঙ্খল’ হয়ে উঠে জনজীবন!

এক কথায়, আন্দোলনকেন্দ্রিক যানজট শুধু সময়ের ক্ষতি নয়, এটি নগর জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহকে ব্যাহত করে, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডকে থমকে দেয় এবং শহরের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঢাকার মতো ঘনবসতি শহরে যেকোনো বড় আন্দোলন বা সমাবেশের কারণে প্রধান সড়কগুলো বন্ধ হয়ে গেলে শুধু যানজট নয়, নগরের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রমও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ধরনের যানজট ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদনশীলতা এবং শ্রমিকদের কার্যক্ষমতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। জরুরি সেবা যেমন অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস বা পুলিশ দ্রুত পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, যা জীবন ও সম্পদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

তারা বলছেন, শহরের নিরাপদ চলাচল, ব্যবসায়িক কার্যক্রম এবং জরুরি সেবা নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে বিকল্প সমাবেশ এলাকা নির্ধারণের প্রয়োজন। সমাবেশের অধিকার অবশ্যই রক্ষা করতে হবে, তবে তা যেন সাধারণ মানুষের চলাচল ও নগর জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত না করে। সমন্বিত পরিকল্পনা, সময় নির্ধারণ এবং পথনির্ধারণের মাধ্যমে এই দ্বৈত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী জিল্লুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পেশাজীবীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া থাকতেই পারে, তবে সেগুলো উপস্থাপনের উপযুক্ত কিছু মাধ্যম থাকা জরুরি। এ বিষয়টি আমাদের নীতি নির্ধারকদের গুরুত্ব সহকারে ভাবা উচিত, যাতে করে এসব কার্যক্রমে জনদুর্ভোগ তৈরি না হয়। এটি আমাদের অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।’

তার মতে, ‘ঢাকায় বসবাসকারী প্রত্যেক মানুষই কোনো না কোনো দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত। এসব কাজ সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে করতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ে কাজে যাওয়া, কোনো অফিসের ভাইভায় অংশ নেওয়া—এ ধরনের শিডিউল মেনে চলার নিশ্চয়তা কর্তৃপক্ষের দিক থেকে নিশ্চিত করা জরুরি। বিভিন্ন শ্রেণির পেশাজীবীরা যখন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করেন, তখন তা এমনভাবে আয়োজন করা উচিত যাতে নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হলেও জনজীবনে তীব্র ভোগান্তি ও ক্ষতি না হয়। এ নিয়ে এখনই চিন্তাভাবনা শুরু করতে হবে; সময় চলে এসেছে, দেরি করার আর সুযোগ নেই।’

প্রেসক্লাব এলাকায় প্রতিদিনই থাকে কর্মসূচি। ছবি: সংগৃহীত

তিনি আরও বলেন, ‘একজন সাধারণ মানুষ ও সচেতন পথচারী হিসেবে আমি বুঝি—যদি ১০ হাজার মানুষ মাত্র এক ঘণ্টার জন্যও এ ধরনের বিড়ম্বনায় পড়েন, তাহলে ১০ হাজার শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়। এর ফলে অর্থনীতিতে যে ক্ষতি হয়, তা দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) থেকে বঞ্চিত হওয়ার সমান। এভাবে অর্থনৈতিক পিছিয়ে পড়া এড়াতে আমাদের এখনই বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।’

ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে,  সমাবেশের সময় সড়ক খোলা রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। ভিড়, নিরাপত্তা, মঞ্চ স্থাপন—সব মিলিয়ে বিকল্প রুটই ভরসা। কিন্তু সেগুলোও আটকে যায়। রাজধানীর প্রধান সড়কে বড় সমাবেশ বা কর্মসূচি শুরু হওয়া মানেই শহরের স্বাভাবিক চলাচলে মারাত্মক ধাক্কা। সড়ক বন্ধ হয়ে গেলে প্রথমেই আশেপাশের বিকল্প রুটগুলোতে চাপ বাড়তে থাকে। খুব দ্রুতই সেই রাস্তাগুলোতেও দীর্ঘ সারি তৈরি হয়, যা কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় এই যানজট কাটতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যায়, আর ততক্ষণে অফিসযাত্রী, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী—সবাই নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

তাদের মতে, যান চলাচল সচল রাখতে সমাবেশের স্থান নির্ধারণ ও সময় বাছাইয়ে সমন্বয় জরুরি। যদি কর্মসূচি প্রধান সড়ক এড়িয়ে নির্দিষ্ট খোলা জায়গা বা পূর্বনির্ধারিত স্থানে সীমাবদ্ধ রাখা যায়, তবে নগরের গতি কিছুটা হলেও বজায় রাখা সম্ভব হবে। শুধু ট্রাফিক পুলিশের প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়; সাধারণ মানুষ, পরিবহন চালক এবং কর্মসূচির আয়োজকদের যৌথ সহযোগিতা থাকলেই কেবল এই ধরনের অচলাবস্থা কমানো যাবে।

নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘আমাদের সংবিধান-স্বীকৃত অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো চলাচলের অধিকার। আমরা যেকোনো জায়গায় যেতে পারি—এটাই আমাদের মৌলিক অধিকার। একইভাবে, নাগরিক হিসেবে সমাবেশ করার অধিকারও আমাদের রয়েছে। তবে সেই অধিকার যেন অন্যের চলাচলের অধিকারকে খণ্ডিত না করে, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি। আমরা নাগরিক হিসেবে সমাবেশ করতে পারি, কিন্তু তা হতে হবে এমনভাবে যাতে অন্য নাগরিকের চলাচলে বিঘ্ন না ঘটে। রাষ্ট্রের আইন, নীতি ও দিকনির্দেশনা অনুযায়ী এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে নির্ধারিত থাকা উচিত। আমাদের দেশে কোথায় সমাবেশ করা যাবে আর কোথায় যাবে না—এর জন্য একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, বিগত সরকারের সময় বা অন্য সময় দেখা গেছে, সমাবেশের জন্য অনুমোদন নিতে হতো। কিন্তু এখনো পর্যন্ত আমরা এমন কোনো উদ্যোগ দেখি না- যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। এই নীতিমালার উদ্দেশ্য হবে জনদুর্ভোগ এড়ানো, যাতে সমাবেশের কারণে রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার না হয়। বিশেষ করে নগর এলাকায় সমাবেশের জন্য নির্দিষ্ট স্থান চিহ্নিত (ডিমার্কেশন) করে দেওয়া দরকার। সামনে নির্বাচন আসছে, ফলে রাজনৈতিক সমাবেশের চাহিদা বাড়বে। নির্দিষ্ট এলাকা ও নীতিমালা থাকলে জনদুর্ভোগ অনেকটা কমানো সম্ভব।’

তিনি আরও বলেন, ‘যারা সমাবেশ করে বা রাজনৈতিক দলগুলোর মনে রাখা উচিত—সমাবেশের মাধ্যমে যদি মানুষের কষ্ট বাড়ে, তাহলে সেই বার্তা জনগণের কাছে ইতিবাচকভাবে পৌঁছায় না। হঠাৎ করে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ মানুষের বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। তাই ভেবে দেখা দরকার, কীভাবে জনগণের কাছে পৌঁছে তাদের কাছে রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায়—যাতে অধিকারও বজায় থাকে এবং জনদুর্ভোগও কমে।’ আব্দুল হাকিম, ঢাকা মেইল