০৫:২১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫

টার্গেট প্রবাসীরা: আতঙ্কের আরেক নাম বিমানবন্দর সড়ক

  • আপডেট সময়: ০৭:৪৪:২৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ অগাস্ট ২০২৫
  • 75

সড়কটিতে ডাকাতি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। ছবি: সংগৃহীত


রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কটি দিন দিন যেন আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে। পরপর বেশ কিছু ঘটনায় এই আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। প্রবাসীদের টার্গেট করে একটি চক্র ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটাচ্ছে। বিশেষ করে রাতে চলাচলের ক্ষেত্রে সড়কটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

চলতি বছর বেশ কিছু ঘটনা ঘটার পর র‌্যাব ও পুলিশ নড়েচড়ে বসে। তারা চক্রটির কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতারও করেছে। কিন্তু এরপরও থেমে নেই অপরাধ। চক্রটি বিমানবন্দর এলাকা থেকেই প্রবাসীদের টার্গেট করে। অনেক সময় প্রবাসীদের পাঠানো মূল্যবান মালামাল নিতে আসা স্বজনদের ওপরও চলে নজরদারি। তারা যে বাস বা প্রাইভেটকারে উঠেন এর পিছু নেয় চক্রটি। মাঝপথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সেই গাড়ি থামানো হয়। পরে তাদের কাছে স্বর্ণ ও স্বর্ণের বার রয়েছে অভিযোগ তুলে সবকিছু কেড়ে নিয়ে যায়।

এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। যদিও বেশির ভাগই গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় না। যারা সচেতন তারা ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে জানাচ্ছেন বা থানায় জিডি করছেন। তবে বেশির ভাগ সময় সেই জিডিও আমলে নিচ্ছে না পুলিশ।

“গত ৩০ জুলাইয়ের ঘটনায় আমরা দুজনকে গ্রেফতার করেছি। তারা আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন। এই সড়কে চক্রটির বাকি সদস্যদেরও আমরা শনাক্ত করেছি।”

জাহাঙ্গীর আলম, এডিসি, গুলশান জোন

তবে পুলিশের ভাষ্য ভিন্ন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, কিছু ঘটনা হয়ত এ ধরনের ঘটে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে প্রবাস থেকে আসা লোকজনও এই সড়কে ছিনতাই বা ডাকাতির  শিকার হয়েছেন বলে গুজব ছড়ান। যাতে তার কাছে প্রবাসীদের দেওয়া মালামাল গায়েব করা সহজ হয়। এমন ঘটনা তারা হাতেনাতে ধরেছেন। ফলে বিমানবন্দর সড়কে এমন ঘটনা নিয়ে কেউ অভিযোগ করলেই তাকে ডাকা হয় থানায়। এরপর চলে জিজ্ঞাসাবাদ।

ডিবি-র‌্যাব পরিচয়ে চলছে ডাকাতি ও ছিনতাই

চলতি বছরের জানুয়ারিতে দুবাই ফেরত এক প্রবাসীর পরিবার বিমানবন্দর সড়কে ডাকাতির শিকার হয়। পুলিশের পোশাক পরা একদল লোক তাদের গাড়ি থামিয়ে মূল্যবান জিনিসপত্র ও টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। প্রতিরোধের মুখে তারা গাড়ির গ্লাস ভেঙে এক নারীকে আহত করে পালিয়ে যায়।

গত ২১ মে  রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে মোটরসাইকেলে ফেরার পথে র‍্যাব পরিচয়ে ইমদাদ হোসাইন নামে এক সাংবাদিককে গভীর রাতে তুলে নেওয়া হয়। পরে তার পরিচয়ে পেয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি বিষয়টি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে নিজেই তুলে ধরেন।

ইমদাদ সেদিন তার মামা প্রবাসে যাবেন বলে তাকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বিদায় জানাতে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে পড়েন বিপদে। তিনি একটি ‘পাঠাও’ মোটরসাইকেল ভাড়া করে ফিরছিলেন। কিন্তু টার্গেটে পড়ে যান। পথে তাকে বহনকারী মোটরসাইকেলটি থামায় চক্রটি। এরপর তারা তাকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেয় এবং চোখ বেঁধে ফেলে। পরে সঙ্গে থাকা যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে বনানী এলাকায় তাকে নামিয়ে দেয়। ভয়ভীতিও দেখানো হয়। সবার গায়ে র‌্যাবের পোশাক ছিল বলে জানান ইমদাদ।

রাতের ঢাকায় অপরাধ বাড়ে। ছবি: সংগৃহীত

সেদিন তার সঙ্গে কী ঘটেছিল তা জানিয়ে ইমদাদ ঢাকা মেইলকে বলেন, তারা বারবার বলছিল, গোল্ড কই, বের কর। এসব বলেই তাদের একজন আমার মাথায় পিস্তল ধরে বলে- কোনো কথা বলবি না। মাইক্রোবাসটির ভেতরে পেছনের দিকে থাকা দুজন বলছিল- ‘এই ওর জামা চেক কর, পকেট চেক কর। সব জায়গায় চেক কর, ওরে পিডা। বেশি কিছু বললেই গুলি করে দেব।’

তখন ইমদাদ বলেন, আমি তো আমার মামাকে রিসিভ করার জন্য এসেছিলাম। আর আমি পেশায় একজন সাংবাদিক। আমার দেশ পত্রিকায় কর্মরত আছি। এ কথা শোনার পর তারা অনেকটা ভড়কে যায়। এরপর তারা ফিসফিস করে কিছু বলে সবাইকে সতর্ক করে। পরে তাকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়।

গত ৩০ জুলাই হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পর একটি প্রবাসী পরিবারের গতিপথ রোধ করে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে। চক্রটি অস্ত্রের মুখে লুটে নেয় প্রায় ৯ ভরি স্বর্ণালংকার, নগদ টাকা ও তিনটি মোবাইল ফোন। ভুক্তভোগী পলাশ কুমার দাস পরিবার নিয়ে লন্ডনে বসবাস করেন।


আরো পড়ুন 

অপরাধীদের ‘মিলনস্থল’ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান


তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি এ ঘটনার পর বনানী থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ করি। এমনকি তারা চক্রটির সন্ধান পেল কি না তাও জানায়নি।’

তবে এ ঘটনায় দুজনকে বনানী থানা পুলিশ গ্রেফতার করেছে বলে দাবি করেন ওসি রাসেল সরোয়ার। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এ ঘটনায় দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাদের একজন আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছে।’ তবে মামলাটি ডিবিতে পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায়ই বিদেশি বা প্রবাসী যাত্রীরা বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পরপরই টার্গেটের শিকার হন। ছিনতাইকারীরা তাদের গাড়ির পিছু নিয়ে নির্জন স্থানে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সর্বস্ব লুট করে। অনেক সময়ই ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাইকারীরা সক্রিয় থাকে। তারা চেকপোস্ট বসিয়ে বা গাড়িতে ওঠার পর যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা, মোবাইল ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নেয়।

বিমানবন্দর এলাকাতেই তাদের ঘোরাফেরা

গেল বছরের ৩ ডিসেম্বর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে র‍্যাব এবং পুলিশ পরিচয়ে প্রবাসীর মালামাল ডাকাতির চেষ্টা চালানোর সময় চারজন আটক হন। তারা হলেন— সার্জেন্ট ইকবাল, মো. মাকসুদ, পুসিদার হোসেন এবং আসাদুল হক। এর মধ্যে সার্জেন্ট ইকবাল এবং মো. মাকসুদ সেনাবাহিনীর সদস্য। বর্তমানে তারা র‍্যাবের সদস্য হিসেবে কর্মরত। পুলিশ কনস্টেবল পুসিদার হোসেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সদস্য এবং মো. আসাদুল হক নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।

তখন এপিবিএন জানিয়েছিল, বিমানবন্দরের ক্যানোপি এলাকার বাইরে মো. নাজমুল নামে একজনের কাছ থেকে তারা মালামাল ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। এরপর তাদের বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) হাতে তুলে দেওয়া হয়। বিমানবন্দর থানায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। থানা পুলিশ জানিয়েছে, আটকরা একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য, যারা দীর্ঘদিন ধরে একই কৌশলে বিমানবন্দরসহ আশপাশের এলাকায় যাত্রীদের মালামাল ছিনতাই করে।

বিমানবন্দর থেকেই শুরু হয় টার্গেট ও নজরদারি

চক্রটি বিমানবন্দর থেকেই টার্গেট শুরু করে। যার প্রমাণও মিলেছে বিভিন্ন সময়ে। তাদের টার্গেট থাকে প্রবাসীরা। বিশেষ করে প্রবাসী অধ্যুষিত ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলের লোকদের টার্গেট করে। এছাড়া দূর-দূরান্তের প্রবাসীরাও তাদের টার্গেটে পড়ে। এজন্য তারা বেছে নেয় ঢাকার পূর্বাচল সড়ককে। বিমানবন্দর সড়ক থেকেই চলে নজরদারি।

বাড়ানো হয়েছে পুলিশের চেকপোস্ট। ছবি: সংগৃহীত

গত ৭ জানুয়ারি পূর্বাচলে ডাকাতির কবলে পড়েন দুবাই ফেরত এক প্রবাসী। ভোরে পুলিশ পরিচয়ে ৩০০ ফিট সড়কের কাদিরারটেক এলাকায় তাদের গাড়ি থামিয়ে এই ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এর আগে গত বছরের ২০ ডিসেম্বর সৌদি প্রবাসী আহসান হাবিব তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনায় যাওয়ার পথে ডাকাতির শিকার হন। তখন আনসার বাহিনীর পরিচয়ে গাড়ি থামায় ডাকাতরা। পরে চেকিংয়ের নামে তাকে প্রথমে মারধর ও পরে তারা তার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।


আরো পড়ুন 

‘সন্ত্রাসের জনপদ’ পল্লবী: আধিপত্য ধরে রাখতে সক্রিয় বিভিন্ন গ্রুপ


তারও আগে ২০২৩ সালের ২৪ মে চক্রটির খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারান দুই প্রবাসী। তাদের দেশে ফেরার পর প্রথমে বিমানবন্দর থেকেই টার্গেট করা হয়। পরে ঢাকা-মাওয়া সড়কে সুযোগ বুঝে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে গাড়ি থামিয়ে তল্লাশির নাম করে মালামাল লুট ও ছিনতাই করে নেয় চক্রটি। এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা হলে ঢাকা জেলা পুলিশ চার সদস্যকে গ্রেফতারও করে।

একই কায়দায় ২০২২ সালের ২ নভেম্বর রাত ৪টার দিকে ফরিদপুরের দেলোয়ার মাতব্বর তার মালেয়শিয়া প্রবাসী ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে একইভাবে ডিবি পরিচয়ে গাড়ি থামিয়ে ডাকাতি করে।

কী বলছে পুলিশ

এই সড়কে এত ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের বিষয়ে ডিএমপির উত্তরা বিভাগের ডিসি মহিদুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার বিভাগে যতগুলো ঘটনা ঘটছে প্রত্যেকটি ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়েছে। যেহেতু আমাদের সর্বশেষ এলাকা কাওলা পর্যন্ত, ফলে বেশির ভাগ ঘটনা কাওলা থেকে বনানী যাওয়ার মাঝপথে ঘটে। আর সেই এলাকাটি গুলশানের মধ্যে পড়েছে। তবে যেহেতু আপনি বলেছেন, আমি গুলশান বিভাগের সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি জানাবো। তারা যেন এই বিষয়টিতে নজর দেন। আমরা এমন অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিচ্ছি।

অন্যদিকে গুলশানের এডিসি জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, গত ৩০ জুলাইয়ের ঘটনায় আমরা দুজনকে গ্রেফতার করেছি। তারা আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন। এই সড়কে চক্রটির বাকি সদস্যদেরও আমরা শনাক্ত করেছি। তবে তারা কতজন এটা বলা মুশকিল। সেই মামলাটি এখন ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এই অবস্থায় সেই এলাকায় ছিনতাই বা ডাকাতি প্রতিরোধে গুলশান বিভাগ কী পদক্ষেপ বা উদ্যোগ নিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এই সড়কে টহল বাড়িয়েছে। প্রতি রাতেই চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চলে। মোস্তফা ইমরুল কায়েস, ঢাকা মেইল

 

উত্তরাধুনিক

Writer, Singer & Environmentalist

ভ্যাঙ্কি আংটি: ঐশ্বরিয়ার হাতের এই আংটি কখনও খোলেন না, জানেন এর পেছনের গল্প?

টার্গেট প্রবাসীরা: আতঙ্কের আরেক নাম বিমানবন্দর সড়ক

আপডেট সময়: ০৭:৪৪:২৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ অগাস্ট ২০২৫

সড়কটিতে ডাকাতি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। ছবি: সংগৃহীত


রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কটি দিন দিন যেন আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে। পরপর বেশ কিছু ঘটনায় এই আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। প্রবাসীদের টার্গেট করে একটি চক্র ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটাচ্ছে। বিশেষ করে রাতে চলাচলের ক্ষেত্রে সড়কটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

চলতি বছর বেশ কিছু ঘটনা ঘটার পর র‌্যাব ও পুলিশ নড়েচড়ে বসে। তারা চক্রটির কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতারও করেছে। কিন্তু এরপরও থেমে নেই অপরাধ। চক্রটি বিমানবন্দর এলাকা থেকেই প্রবাসীদের টার্গেট করে। অনেক সময় প্রবাসীদের পাঠানো মূল্যবান মালামাল নিতে আসা স্বজনদের ওপরও চলে নজরদারি। তারা যে বাস বা প্রাইভেটকারে উঠেন এর পিছু নেয় চক্রটি। মাঝপথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সেই গাড়ি থামানো হয়। পরে তাদের কাছে স্বর্ণ ও স্বর্ণের বার রয়েছে অভিযোগ তুলে সবকিছু কেড়ে নিয়ে যায়।

এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। যদিও বেশির ভাগই গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় না। যারা সচেতন তারা ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে জানাচ্ছেন বা থানায় জিডি করছেন। তবে বেশির ভাগ সময় সেই জিডিও আমলে নিচ্ছে না পুলিশ।

“গত ৩০ জুলাইয়ের ঘটনায় আমরা দুজনকে গ্রেফতার করেছি। তারা আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন। এই সড়কে চক্রটির বাকি সদস্যদেরও আমরা শনাক্ত করেছি।”

জাহাঙ্গীর আলম, এডিসি, গুলশান জোন

তবে পুলিশের ভাষ্য ভিন্ন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, কিছু ঘটনা হয়ত এ ধরনের ঘটে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে প্রবাস থেকে আসা লোকজনও এই সড়কে ছিনতাই বা ডাকাতির  শিকার হয়েছেন বলে গুজব ছড়ান। যাতে তার কাছে প্রবাসীদের দেওয়া মালামাল গায়েব করা সহজ হয়। এমন ঘটনা তারা হাতেনাতে ধরেছেন। ফলে বিমানবন্দর সড়কে এমন ঘটনা নিয়ে কেউ অভিযোগ করলেই তাকে ডাকা হয় থানায়। এরপর চলে জিজ্ঞাসাবাদ।

ডিবি-র‌্যাব পরিচয়ে চলছে ডাকাতি ও ছিনতাই

চলতি বছরের জানুয়ারিতে দুবাই ফেরত এক প্রবাসীর পরিবার বিমানবন্দর সড়কে ডাকাতির শিকার হয়। পুলিশের পোশাক পরা একদল লোক তাদের গাড়ি থামিয়ে মূল্যবান জিনিসপত্র ও টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। প্রতিরোধের মুখে তারা গাড়ির গ্লাস ভেঙে এক নারীকে আহত করে পালিয়ে যায়।

গত ২১ মে  রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে মোটরসাইকেলে ফেরার পথে র‍্যাব পরিচয়ে ইমদাদ হোসাইন নামে এক সাংবাদিককে গভীর রাতে তুলে নেওয়া হয়। পরে তার পরিচয়ে পেয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি বিষয়টি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে নিজেই তুলে ধরেন।

ইমদাদ সেদিন তার মামা প্রবাসে যাবেন বলে তাকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বিদায় জানাতে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে পড়েন বিপদে। তিনি একটি ‘পাঠাও’ মোটরসাইকেল ভাড়া করে ফিরছিলেন। কিন্তু টার্গেটে পড়ে যান। পথে তাকে বহনকারী মোটরসাইকেলটি থামায় চক্রটি। এরপর তারা তাকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেয় এবং চোখ বেঁধে ফেলে। পরে সঙ্গে থাকা যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে বনানী এলাকায় তাকে নামিয়ে দেয়। ভয়ভীতিও দেখানো হয়। সবার গায়ে র‌্যাবের পোশাক ছিল বলে জানান ইমদাদ।

রাতের ঢাকায় অপরাধ বাড়ে। ছবি: সংগৃহীত

সেদিন তার সঙ্গে কী ঘটেছিল তা জানিয়ে ইমদাদ ঢাকা মেইলকে বলেন, তারা বারবার বলছিল, গোল্ড কই, বের কর। এসব বলেই তাদের একজন আমার মাথায় পিস্তল ধরে বলে- কোনো কথা বলবি না। মাইক্রোবাসটির ভেতরে পেছনের দিকে থাকা দুজন বলছিল- ‘এই ওর জামা চেক কর, পকেট চেক কর। সব জায়গায় চেক কর, ওরে পিডা। বেশি কিছু বললেই গুলি করে দেব।’

তখন ইমদাদ বলেন, আমি তো আমার মামাকে রিসিভ করার জন্য এসেছিলাম। আর আমি পেশায় একজন সাংবাদিক। আমার দেশ পত্রিকায় কর্মরত আছি। এ কথা শোনার পর তারা অনেকটা ভড়কে যায়। এরপর তারা ফিসফিস করে কিছু বলে সবাইকে সতর্ক করে। পরে তাকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়।

গত ৩০ জুলাই হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পর একটি প্রবাসী পরিবারের গতিপথ রোধ করে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে। চক্রটি অস্ত্রের মুখে লুটে নেয় প্রায় ৯ ভরি স্বর্ণালংকার, নগদ টাকা ও তিনটি মোবাইল ফোন। ভুক্তভোগী পলাশ কুমার দাস পরিবার নিয়ে লন্ডনে বসবাস করেন।


আরো পড়ুন 

অপরাধীদের ‘মিলনস্থল’ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান


তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি এ ঘটনার পর বনানী থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ করি। এমনকি তারা চক্রটির সন্ধান পেল কি না তাও জানায়নি।’

তবে এ ঘটনায় দুজনকে বনানী থানা পুলিশ গ্রেফতার করেছে বলে দাবি করেন ওসি রাসেল সরোয়ার। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এ ঘটনায় দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাদের একজন আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছে।’ তবে মামলাটি ডিবিতে পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায়ই বিদেশি বা প্রবাসী যাত্রীরা বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পরপরই টার্গেটের শিকার হন। ছিনতাইকারীরা তাদের গাড়ির পিছু নিয়ে নির্জন স্থানে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সর্বস্ব লুট করে। অনেক সময়ই ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাইকারীরা সক্রিয় থাকে। তারা চেকপোস্ট বসিয়ে বা গাড়িতে ওঠার পর যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা, মোবাইল ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নেয়।

বিমানবন্দর এলাকাতেই তাদের ঘোরাফেরা

গেল বছরের ৩ ডিসেম্বর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে র‍্যাব এবং পুলিশ পরিচয়ে প্রবাসীর মালামাল ডাকাতির চেষ্টা চালানোর সময় চারজন আটক হন। তারা হলেন— সার্জেন্ট ইকবাল, মো. মাকসুদ, পুসিদার হোসেন এবং আসাদুল হক। এর মধ্যে সার্জেন্ট ইকবাল এবং মো. মাকসুদ সেনাবাহিনীর সদস্য। বর্তমানে তারা র‍্যাবের সদস্য হিসেবে কর্মরত। পুলিশ কনস্টেবল পুসিদার হোসেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সদস্য এবং মো. আসাদুল হক নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।

তখন এপিবিএন জানিয়েছিল, বিমানবন্দরের ক্যানোপি এলাকার বাইরে মো. নাজমুল নামে একজনের কাছ থেকে তারা মালামাল ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। এরপর তাদের বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) হাতে তুলে দেওয়া হয়। বিমানবন্দর থানায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। থানা পুলিশ জানিয়েছে, আটকরা একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য, যারা দীর্ঘদিন ধরে একই কৌশলে বিমানবন্দরসহ আশপাশের এলাকায় যাত্রীদের মালামাল ছিনতাই করে।

বিমানবন্দর থেকেই শুরু হয় টার্গেট ও নজরদারি

চক্রটি বিমানবন্দর থেকেই টার্গেট শুরু করে। যার প্রমাণও মিলেছে বিভিন্ন সময়ে। তাদের টার্গেট থাকে প্রবাসীরা। বিশেষ করে প্রবাসী অধ্যুষিত ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলের লোকদের টার্গেট করে। এছাড়া দূর-দূরান্তের প্রবাসীরাও তাদের টার্গেটে পড়ে। এজন্য তারা বেছে নেয় ঢাকার পূর্বাচল সড়ককে। বিমানবন্দর সড়ক থেকেই চলে নজরদারি।

বাড়ানো হয়েছে পুলিশের চেকপোস্ট। ছবি: সংগৃহীত

গত ৭ জানুয়ারি পূর্বাচলে ডাকাতির কবলে পড়েন দুবাই ফেরত এক প্রবাসী। ভোরে পুলিশ পরিচয়ে ৩০০ ফিট সড়কের কাদিরারটেক এলাকায় তাদের গাড়ি থামিয়ে এই ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এর আগে গত বছরের ২০ ডিসেম্বর সৌদি প্রবাসী আহসান হাবিব তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনায় যাওয়ার পথে ডাকাতির শিকার হন। তখন আনসার বাহিনীর পরিচয়ে গাড়ি থামায় ডাকাতরা। পরে চেকিংয়ের নামে তাকে প্রথমে মারধর ও পরে তারা তার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।


আরো পড়ুন 

‘সন্ত্রাসের জনপদ’ পল্লবী: আধিপত্য ধরে রাখতে সক্রিয় বিভিন্ন গ্রুপ


তারও আগে ২০২৩ সালের ২৪ মে চক্রটির খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারান দুই প্রবাসী। তাদের দেশে ফেরার পর প্রথমে বিমানবন্দর থেকেই টার্গেট করা হয়। পরে ঢাকা-মাওয়া সড়কে সুযোগ বুঝে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে গাড়ি থামিয়ে তল্লাশির নাম করে মালামাল লুট ও ছিনতাই করে নেয় চক্রটি। এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা হলে ঢাকা জেলা পুলিশ চার সদস্যকে গ্রেফতারও করে।

একই কায়দায় ২০২২ সালের ২ নভেম্বর রাত ৪টার দিকে ফরিদপুরের দেলোয়ার মাতব্বর তার মালেয়শিয়া প্রবাসী ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে একইভাবে ডিবি পরিচয়ে গাড়ি থামিয়ে ডাকাতি করে।

কী বলছে পুলিশ

এই সড়কে এত ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের বিষয়ে ডিএমপির উত্তরা বিভাগের ডিসি মহিদুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার বিভাগে যতগুলো ঘটনা ঘটছে প্রত্যেকটি ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়েছে। যেহেতু আমাদের সর্বশেষ এলাকা কাওলা পর্যন্ত, ফলে বেশির ভাগ ঘটনা কাওলা থেকে বনানী যাওয়ার মাঝপথে ঘটে। আর সেই এলাকাটি গুলশানের মধ্যে পড়েছে। তবে যেহেতু আপনি বলেছেন, আমি গুলশান বিভাগের সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি জানাবো। তারা যেন এই বিষয়টিতে নজর দেন। আমরা এমন অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিচ্ছি।

অন্যদিকে গুলশানের এডিসি জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, গত ৩০ জুলাইয়ের ঘটনায় আমরা দুজনকে গ্রেফতার করেছি। তারা আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন। এই সড়কে চক্রটির বাকি সদস্যদেরও আমরা শনাক্ত করেছি। তবে তারা কতজন এটা বলা মুশকিল। সেই মামলাটি এখন ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এই অবস্থায় সেই এলাকায় ছিনতাই বা ডাকাতি প্রতিরোধে গুলশান বিভাগ কী পদক্ষেপ বা উদ্যোগ নিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এই সড়কে টহল বাড়িয়েছে। প্রতি রাতেই চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চলে। মোস্তফা ইমরুল কায়েস, ঢাকা মেইল