০২:৫৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের নামে ৮০০ কোটি টাকার বাণিজ্য!

  • আপডেট সময়: ০৮:০৬:১৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫
  • 76

কোচিং বাণিজ্য। ( প্রতীকী ছবি)


চলতি বছর উচ্চ মাধ্যমিকের (এইচএসসি) সব লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি কোচিংয়ের মুখরোচক বিজ্ঞাপনে ভরে গেছে রাজধানী। উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন ও আবেগকে পুঁজি করে ইচ্ছেমতো গলাকাটা হারে ভর্তি ফি আদায় করছে কোচিং সিন্ডিকেট।

গত পাঁচ বছরে কোচিং ফি বেড়েছে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার অংশগ্রহকারীর হিসেবে প্রতি বছর কোচিং বাণিজ্য হয় প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। দেশীয় আইনে সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ভর্তি কোচিং নিয়ে সেভাবে কিছু নেই। কোচিংনির্ভশীলতার জন্য প্রশ্ন প্যাটার্নকেই দায়ী করছেন শিক্ষকরা।

কোচিং সেন্টারগুলোর দাবি, ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনেকেই ভয় পান। তারা একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতিমূলক সেবা প্রদানের মাধ্যমে অর্থ নেন। অনেক সময় মেধাবী শিক্ষার্থীদের নামমাত্র ফি নিয়েও সেবা দেওয়া হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের একটি দৃশ্য। ছবি- সংগৃহীত।

শত শত কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য

২০১৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৩১ হাজার জন। যার মধ্যে পাস করে ১০ লাখ ৩৫ হাজার এবং জিপিএ-৫ পায় ১ লাখ ৪৫ হাজার শিক্ষার্থী। এই হিসেবে পাস করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা জিপিএ-৫ পায় তারা মূলত ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির প্রস্তুতি নেয়। বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের তথ্যমতে, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং ভর্তির ফি ১৮-২০ হাজার টাকা। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের ফি সর্বনিম্ন ১৫ হাজার টাকা।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দেন ২ লাখের বেশি, মেডিকেলে পরীক্ষা দেন ১ লাখ ৩১ হাজার, গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেন প্রায় আড়াই লাখ শিক্ষার্থী। এছাড়া বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দেন প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থী।

সব মিলিয়ে এইচএসসি পাস করা শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ৫ লাখ শিক্ষার্থী কোচিং করেছেন। যাদের থেকে সর্বনিম্ন ১৫ হাজার টাকা করে ফি নিলেও ৮০০ কোটি টাকার কাছাকাছি হয়। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে ঢাকার সাত কলেজ নিয়ে গঠিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত দেশের যেকোনো কলেজে ভর্তির জন্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। এতে কোচিংয়ের প্রবণতা আরও বাড়বে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। ফলে কোচিং বাণিজ্য এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং-এর একটি চিত্র। ফাইল ছবি।

৫ বছরে কোচিং ফি বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ

বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য রাজধানীতে প্রায় ২০টির মতো কোচিং সেন্টার রয়েছে। তবে ৮ থেকে ১০টি কোচিং সেন্টারের রাজধানীতে একাধিক শাখা থাকার পাশাপাশি দেশের প্রায় সব জেলায়ই শাখা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবেচেয় বেশি শাখার বিভিন্ন কোচিংয়ের এবারের ফি’র হার হলো-

উদ্ভাসের ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সের ফি ২৪ হাজার টাকা, ৫ বছর আগে ছিল ১৬ হাজার টাকা; উদ্ভাস ভার্সিটি কোচিং ফি ২২ হাজার টাকা, আগে ছিল ১৪ হাজার টাকা; উন্মেষ মেডিকেল কোচিং ফি ২৪ হাজার টাকা, আগে ছিল ১৬ হাজার টাকা; রেটিনা মেডিকেল + ডেন্টাল ফি ২৫ হাজার টাকা আগে ছিল ১৮ হাজার টাকা।

ইউসিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিটের ফি ১৮ হাজার টাকা, আগে ছিল ১৪ হাজার টাকা। ইউনিক মেডিকেল+ ডেন্টাল কোচিং ফি ২০ হাজার টাকা; ফোকাস বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন ইউনিটের ভর্তি কোচিং ফি ২০ হাজার, আগে ছিল ১৫ হাজার; আইকন প্লাস ভার্সিটি কোচিং ফি ১৬ হাজার টাকা, আগে ছিল ১২ হাজার টাকা।

এছাড়া সানরাইজ, ওমেকা, ম্যাক, ম্যাবস, প্যারাগন, অ্যাডমিশন অ্যাইড, প্রাইমেট, মেডিকো, থ্রি ডক্টরস, এথিনা, বীকন, কনফিডেন্স, মেডিকো, ইথিকা, কর্ণিয়া, ওরাকল কোচিংগুলোর ফি’ও কাছাকাছি। তবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আকৃষ্ট করতে দ্রুত ভর্তিতে ছাড় দেওয়া হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কোচিং স্টাফ বলেন, ‘কোচিং সেন্টারগুলোতে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু থেকে শেষ হওয়ার মধ্যে ভর্তির জন্য একটা ডিসকাউন্ট থাকে। এছাড়া পরীক্ষা শেষ হওয়ার ১৫ দিন পর্যন্তও ডিসকাউন্ট চলে। কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমেও শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। অর্থাৎ কোচিংয়ের নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকায় কেউ শিক্ষার্থী ভর্তি করালে তাকে ১ থেকে ৩ হাজার টাকা কমিশনও দেওয়া হয়।’

ইউসিসি কোচিংয়ের সাবেক একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘নানাভাবে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে ভর্তি করানো হয়। কোচিংয়ে একজন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন ম্যাটারিয়ালস দিতে প্রায় ২ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এছাড়া শিক্ষকদের বেতন, জায়গার ভাড়াসহ বড় একটা অ্যামাউন্ট শিক্ষার্থীদের পেছনেও ব্যয় হয়।’

প্রশ্নের প্যাটার্নেই কোচিংনির্ভর শিক্ষার্থীরা

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পর কোচিং সেন্টারগুলো থেকে দাবি করা হয়, তাদের বই থেকে ৭০ বা ৮০ শতাংশ প্রশ্ন কমন এসেছে। বাণিজ্যিক কারণে কোচিং সেন্টার এসব প্রচার করলেও তাদের দাবিকে পুরোপুরি মিথ্যা বলা সম্ভব নয়। কারণ আসলেই ৫০ শতাংশের বেশি প্রশ্ন কোচিংয়ের বিভিন্ন শিট ও বই থেকে আসে বলে বিশ্লেষণে দেখা যায়। এজন্য কোচিংনির্ভরতা কমিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীর প্রস্তুতির জন্য এ ক্ষেত্রে বড় সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সোমবার (২৫ আগস্ট) ফার্মগেট মোড়ে দেখা হয় আনিস আহমেদের সঙ্গে। তার ছেলে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন। এরইমধ্যে ইঞ্জিনিংয়িারিং প্রস্তুতির জন্য তিনি কোচিংয়ে ছেলের ভর্তির ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন। শুধু কোচিং নয়, বরং তিনি গণিতে বিশেষ প্রাইভেট ব্যাচেও পড়াতে চান বলে জানান। এছাড়া ফার্মগেটের ফোকাস, ইউসিসি, আইকন প্লাসসহ বিভিন্ন কোচিংয়ের অফিসে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের ভিড় দেখা গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কমিটির একজন জ্যৈষ্ঠ অধ্যাপক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ভর্তি পরীক্ষাকে সেভাবে গুরুত্ব দেন না। প্রশ্ন করার সময় সৃজনশীলতাকে গুরুত্ব না দিয়ে বাজারের বিভিন্ন বইয়ের সাহায্যে প্রশ্ন প্রণয়ন করে দেন। এছাড়া অনেকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক কোচিংয়ের পরামর্শদাতা হিসেবেও গোপনে যুক্ত রয়েছেন।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে শিক্ষার্থীদের কোচিংনির্ভরশীলতার প্রধান কারণ হলো প্রশ্ন প্যাটার্ন। আমাদের গতানুগতিক প্রশ্নের কারণে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী কোচিংনির্ভর এবং সফলও হচ্ছে। কিন্তু এমন হওয়া উচিত ছিল না। বরং এইচএসসির বিষয়ভিত্তিক রিফলেকটিভ প্রশ্ন হওয়া দরকার। এতে শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণধর্মী চিন্তার সক্ষমতাও বাড়ে। যেমনটা আন্তর্জাতিক জিম্যাট ও জিআরই পরীক্ষায় প্রশ্ন করা হয়।’

২০২০ সালের খসড়া শিক্ষা আইন অনুসারে সরকারি ও বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষকরা নিজেদের প্রতিষ্ঠান ছেড়ে অন্যত্র প্রাইভেট কোচিং দিতে পারবেন না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো বিশেষ আইন নেই, যা এটিকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও সীমিত রূপরেখা, খসড়া আইন ও নীতিমালামূলক উদ্যোগ আছে যা ভবিষ্যতে কোচিং কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ বা সংস্কারে সাহায্য করতে পারে। মো. আব্দুস সবুর (লোটাস), ঢাকা মেইল

উত্তরাধুনিক

Writer, Singer & Environmentalist

ভ্যাঙ্কি আংটি: ঐশ্বরিয়ার হাতের এই আংটি কখনও খোলেন না, জানেন এর পেছনের গল্প?

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের নামে ৮০০ কোটি টাকার বাণিজ্য!

আপডেট সময়: ০৮:০৬:১৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫

কোচিং বাণিজ্য। ( প্রতীকী ছবি)


চলতি বছর উচ্চ মাধ্যমিকের (এইচএসসি) সব লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি কোচিংয়ের মুখরোচক বিজ্ঞাপনে ভরে গেছে রাজধানী। উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন ও আবেগকে পুঁজি করে ইচ্ছেমতো গলাকাটা হারে ভর্তি ফি আদায় করছে কোচিং সিন্ডিকেট।

গত পাঁচ বছরে কোচিং ফি বেড়েছে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার অংশগ্রহকারীর হিসেবে প্রতি বছর কোচিং বাণিজ্য হয় প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। দেশীয় আইনে সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ভর্তি কোচিং নিয়ে সেভাবে কিছু নেই। কোচিংনির্ভশীলতার জন্য প্রশ্ন প্যাটার্নকেই দায়ী করছেন শিক্ষকরা।

কোচিং সেন্টারগুলোর দাবি, ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনেকেই ভয় পান। তারা একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতিমূলক সেবা প্রদানের মাধ্যমে অর্থ নেন। অনেক সময় মেধাবী শিক্ষার্থীদের নামমাত্র ফি নিয়েও সেবা দেওয়া হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের একটি দৃশ্য। ছবি- সংগৃহীত।

শত শত কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য

২০১৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৩১ হাজার জন। যার মধ্যে পাস করে ১০ লাখ ৩৫ হাজার এবং জিপিএ-৫ পায় ১ লাখ ৪৫ হাজার শিক্ষার্থী। এই হিসেবে পাস করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা জিপিএ-৫ পায় তারা মূলত ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির প্রস্তুতি নেয়। বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের তথ্যমতে, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং ভর্তির ফি ১৮-২০ হাজার টাকা। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের ফি সর্বনিম্ন ১৫ হাজার টাকা।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দেন ২ লাখের বেশি, মেডিকেলে পরীক্ষা দেন ১ লাখ ৩১ হাজার, গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেন প্রায় আড়াই লাখ শিক্ষার্থী। এছাড়া বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দেন প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থী।

সব মিলিয়ে এইচএসসি পাস করা শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ৫ লাখ শিক্ষার্থী কোচিং করেছেন। যাদের থেকে সর্বনিম্ন ১৫ হাজার টাকা করে ফি নিলেও ৮০০ কোটি টাকার কাছাকাছি হয়। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে ঢাকার সাত কলেজ নিয়ে গঠিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত দেশের যেকোনো কলেজে ভর্তির জন্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। এতে কোচিংয়ের প্রবণতা আরও বাড়বে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। ফলে কোচিং বাণিজ্য এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং-এর একটি চিত্র। ফাইল ছবি।

৫ বছরে কোচিং ফি বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ

বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য রাজধানীতে প্রায় ২০টির মতো কোচিং সেন্টার রয়েছে। তবে ৮ থেকে ১০টি কোচিং সেন্টারের রাজধানীতে একাধিক শাখা থাকার পাশাপাশি দেশের প্রায় সব জেলায়ই শাখা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবেচেয় বেশি শাখার বিভিন্ন কোচিংয়ের এবারের ফি’র হার হলো-

উদ্ভাসের ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সের ফি ২৪ হাজার টাকা, ৫ বছর আগে ছিল ১৬ হাজার টাকা; উদ্ভাস ভার্সিটি কোচিং ফি ২২ হাজার টাকা, আগে ছিল ১৪ হাজার টাকা; উন্মেষ মেডিকেল কোচিং ফি ২৪ হাজার টাকা, আগে ছিল ১৬ হাজার টাকা; রেটিনা মেডিকেল + ডেন্টাল ফি ২৫ হাজার টাকা আগে ছিল ১৮ হাজার টাকা।

ইউসিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিটের ফি ১৮ হাজার টাকা, আগে ছিল ১৪ হাজার টাকা। ইউনিক মেডিকেল+ ডেন্টাল কোচিং ফি ২০ হাজার টাকা; ফোকাস বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন ইউনিটের ভর্তি কোচিং ফি ২০ হাজার, আগে ছিল ১৫ হাজার; আইকন প্লাস ভার্সিটি কোচিং ফি ১৬ হাজার টাকা, আগে ছিল ১২ হাজার টাকা।

এছাড়া সানরাইজ, ওমেকা, ম্যাক, ম্যাবস, প্যারাগন, অ্যাডমিশন অ্যাইড, প্রাইমেট, মেডিকো, থ্রি ডক্টরস, এথিনা, বীকন, কনফিডেন্স, মেডিকো, ইথিকা, কর্ণিয়া, ওরাকল কোচিংগুলোর ফি’ও কাছাকাছি। তবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আকৃষ্ট করতে দ্রুত ভর্তিতে ছাড় দেওয়া হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কোচিং স্টাফ বলেন, ‘কোচিং সেন্টারগুলোতে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু থেকে শেষ হওয়ার মধ্যে ভর্তির জন্য একটা ডিসকাউন্ট থাকে। এছাড়া পরীক্ষা শেষ হওয়ার ১৫ দিন পর্যন্তও ডিসকাউন্ট চলে। কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমেও শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। অর্থাৎ কোচিংয়ের নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকায় কেউ শিক্ষার্থী ভর্তি করালে তাকে ১ থেকে ৩ হাজার টাকা কমিশনও দেওয়া হয়।’

ইউসিসি কোচিংয়ের সাবেক একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘নানাভাবে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে ভর্তি করানো হয়। কোচিংয়ে একজন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন ম্যাটারিয়ালস দিতে প্রায় ২ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এছাড়া শিক্ষকদের বেতন, জায়গার ভাড়াসহ বড় একটা অ্যামাউন্ট শিক্ষার্থীদের পেছনেও ব্যয় হয়।’

প্রশ্নের প্যাটার্নেই কোচিংনির্ভর শিক্ষার্থীরা

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পর কোচিং সেন্টারগুলো থেকে দাবি করা হয়, তাদের বই থেকে ৭০ বা ৮০ শতাংশ প্রশ্ন কমন এসেছে। বাণিজ্যিক কারণে কোচিং সেন্টার এসব প্রচার করলেও তাদের দাবিকে পুরোপুরি মিথ্যা বলা সম্ভব নয়। কারণ আসলেই ৫০ শতাংশের বেশি প্রশ্ন কোচিংয়ের বিভিন্ন শিট ও বই থেকে আসে বলে বিশ্লেষণে দেখা যায়। এজন্য কোচিংনির্ভরতা কমিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীর প্রস্তুতির জন্য এ ক্ষেত্রে বড় সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সোমবার (২৫ আগস্ট) ফার্মগেট মোড়ে দেখা হয় আনিস আহমেদের সঙ্গে। তার ছেলে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন। এরইমধ্যে ইঞ্জিনিংয়িারিং প্রস্তুতির জন্য তিনি কোচিংয়ে ছেলের ভর্তির ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন। শুধু কোচিং নয়, বরং তিনি গণিতে বিশেষ প্রাইভেট ব্যাচেও পড়াতে চান বলে জানান। এছাড়া ফার্মগেটের ফোকাস, ইউসিসি, আইকন প্লাসসহ বিভিন্ন কোচিংয়ের অফিসে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের ভিড় দেখা গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কমিটির একজন জ্যৈষ্ঠ অধ্যাপক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ভর্তি পরীক্ষাকে সেভাবে গুরুত্ব দেন না। প্রশ্ন করার সময় সৃজনশীলতাকে গুরুত্ব না দিয়ে বাজারের বিভিন্ন বইয়ের সাহায্যে প্রশ্ন প্রণয়ন করে দেন। এছাড়া অনেকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক কোচিংয়ের পরামর্শদাতা হিসেবেও গোপনে যুক্ত রয়েছেন।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে শিক্ষার্থীদের কোচিংনির্ভরশীলতার প্রধান কারণ হলো প্রশ্ন প্যাটার্ন। আমাদের গতানুগতিক প্রশ্নের কারণে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী কোচিংনির্ভর এবং সফলও হচ্ছে। কিন্তু এমন হওয়া উচিত ছিল না। বরং এইচএসসির বিষয়ভিত্তিক রিফলেকটিভ প্রশ্ন হওয়া দরকার। এতে শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণধর্মী চিন্তার সক্ষমতাও বাড়ে। যেমনটা আন্তর্জাতিক জিম্যাট ও জিআরই পরীক্ষায় প্রশ্ন করা হয়।’

২০২০ সালের খসড়া শিক্ষা আইন অনুসারে সরকারি ও বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষকরা নিজেদের প্রতিষ্ঠান ছেড়ে অন্যত্র প্রাইভেট কোচিং দিতে পারবেন না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো বিশেষ আইন নেই, যা এটিকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও সীমিত রূপরেখা, খসড়া আইন ও নীতিমালামূলক উদ্যোগ আছে যা ভবিষ্যতে কোচিং কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ বা সংস্কারে সাহায্য করতে পারে। মো. আব্দুস সবুর (লোটাস), ঢাকা মেইল