
সিসা বার ঘিরে আলোর আড়ালে অন্ধকার এক জগৎ। ঢাকা মেইলের তৈরিকৃত প্রতীকী ছবি
-অবৈধ সিসা বার ঘিরে ভয়াবহ অপরাধ চক্র
-বনানীর এক সড়কেই ১৫ সিসা বার
-প্রকাশ্যে রেস্তোরাঁ, আড়ালে সিসা বার
-শিগগির অভিযান চালানোর ঘোষণা
রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান ও বনানী রাতের ঝলমলে আলোয় আলোকিত হলেও এর আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ অন্ধকার। বিভিন্ন অভিজাত ক্যাফে, ক্লাব ও রেস্তোরাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ‘অপরাধীদের অভয়ারণ্য’। রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে এখানকার অপরাধী চক্র। তারা বুঁদ হয় মাদক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে।
বিশেষ করে, গুলশান-বনানী এলাকায় রেস্তোরাঁর আড়ালে উচ্চবিত্তদের চাহিদায় গড়ে উঠেছে অপরাধীদের অভয়ারণ্য খ্যাত বার ও সিসা বার। এসব বারকে কেন্দ্র করে ভয়ংকর অপরাধী চক্র গড়ে ওঠেছে।
বনানী এলাকার একটি সড়কেই অবৈধভাবে ১৫টি সিসা বার রয়েছে। এ সড়ক ছাড়াও বিভিন্ন বৈধ বার এবং রেস্তোরাঁর আড়ালে অবৈধভাবে বেশ কয়েকটি সিসা বার গড়ে ওঠেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও স্থায়ী কোনো সমাধান মিলছে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। একাধিক গোয়েন্দা তথ্যমতে, প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় এ ধরনের অপরাধ বাড়ায় তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

বনানীতে ৩৬০ ডিগ্রি সিসা বারে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যার সিসি টিভি ফুটেজ। ছবি- সংগৃহীত।
গত ১৪ আগস্ট ভোরে বনানীতে ‘৩৬০ ডিগ্রি’ সিসা বারে খুন হন ইন্টারনেট ব্যবসায়ী রাহাত হোসেন রাব্বি (৩১)। এ ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সিসা বারটিতে আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে এই হত্যাকাণ্ড হয় বলে জানায় র্যাব। এরপরই সিসা বারগুলোতে অবৈধ কার্যক্রমের চিত্র সামনে আসতে থাকে। এর আগে এটি ছিল ‘এরাবিয়ান কজি’ নামে একটি সিসা বার, যা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অভিযানে বন্ধ হয়ে যায়। পরে কৌশলে ‘৩৬০ ডিগ্রি’ নাম দিয়ে একই ধরনের অবৈধ ব্যবসা নতুন করে শুরু হয়।
স্থানীয়দের মতে, রাত ১২টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত গুলশান ও বনানীর নির্দিষ্ট সড়কগুলোতে সক্রিয় থাকে অপরাধ সিন্ডিকেট। তরুণ-তরুণী, প্রবাস ফেরত যুবক, এমনকি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে প্রভাবশালীদের অনেকেই এই অন্ধকার জগতের গ্রাহক। একদিকে চলছে নেশার আগুনে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংস, অন্যদিকে বেড়েছে ছিনতাই ও সহিংসতা। অনেক তরুণ এখানে প্রথমে গল্প করার নামে আসে, কিন্তু ধীরে ধীরে নেশার ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মতে, ডিএনসির রাসায়নিক পরীক্ষাগারে সিসা লাউঞ্জের যতগুলো আলামত পরীক্ষা করা হয়েছে কোনোটিতেই ০.২ শতাংশের নিচে নিকোটিন পাওয়া যায়নি। আইন অনুযায়ী ০.২ শতাংশের বেশি নিকোটিনযুক্ত সিসা অবৈধ। সিসা বারগুলোতে লেডি কিলার, লাভ সিক্সটি সিক্স, হ্যাভানা লাইট, অরেঞ্জ মিন্ট ও স্ট্রবেরি নামক যেসব ফ্লেভার ব্যবহার হয়। তার মধ্যে ০.৫ শতাংশ নিকোটিন রয়েছে।

রাজধানীতে সিসা বারগুলোতে বসে এভাবেই চলে মাদক সেবন। ছবি- সংগৃহীত।
এসব সিসা গ্রহণ একেবারে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। যার ফলে, স্বাস্থ্য অধিদফতর এসব সিসা বারকে অবৈধ বলছে। যার মধ্যে দেশে কোনো সিসা লাউঞ্জ চালানোর জন্য বৈধ অনুমতি দেয়নি স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু উচ্চবিত্তদের চাওয়ায় একদল ‘অসাধু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী’ অতি লাভের আশায় এই ব্যবসায় ঝুঁকে পড়ছে। অভিজাত এলাকাগুলোতে তারা রেস্তোরাঁর আড়ালে গোপনে সিসা লাউঞ্জ চালাচ্ছে।
বনানীতে যেসব অবৈধ সিসা বার
বনানীর ১১ নম্বর রোডের ৪৩ নম্বর ভবনটিতে তিনটি সিসা লাউঞ্জ ও ‘প্ল্যান বি’ নামক একটি বার আছে। যে বারের মালিক আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য আসিফ মো. নূর। তার এ বারের আড়ালে একই ভবনের লিফট-৯ এ সিসা লাউঞ্জ গড়ে ওঠেছে। তার পাশাপাশি, একই ভবনে আরও তিনটি সিসা লাউঞ্জ রয়েছে। ‘৩৬০ ডিগ্রি’ সিসা বারে হত্যাকাণ্ডের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের ভয়ে এখানকার সিসা লাউঞ্জগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে।
এগুলোর পাশাপাশি, বনানী ১১ নম্বর রোডে সেলসিয়াস, এক্সোটিক, কিউডিএস, সিগনেচার, অরা, ৩৬০ ডিগ্রি, আরগেলা, ৩২ ডিগ্রি, সিলভার, গ্রিসিনো, মারবেলা, হাবিবি, এক্সাইল, হেইগ, হবনব নামে আরও প্রায় ১৫টি সিসা লাউঞ্জের খোঁজ পাওয়া গেছে। বনানীর পাশাপাশি প্রায় প্রকাশ্যেই গুলশান এলাকায় ‘মন্টানা’ ও ‘কর্টিয়র বাজার’ নামে দুটি সিসা লাউঞ্জ রয়েছে।

রাজধানীর গুলশানের একটি সিসা বারের ভেতরের দৃশ্য। ছবি- সংগৃহীত
সিসা বারের গ্রাহক কারা
এসব সিসা বারে নিয়য়িত স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা গভীর রাত পর্যন্ত ভিড় জমায়। শিক্ষার্থী ছেলে-মেয়ের পাশাপাশি চাকরিজীবীরাও নিয়মিত যাতায়াত করেন। বাইরে টানানো রঙিন সাইনবোর্ডের নেপথ্যে নামমাত্র খাবারের আড়ালে সিসার সঙ্গে বসে ভয়ংকর মাদক আইস, ইয়াবা,ফেনসিডিল, হিরোইন, লিকুইড কোকেন ও গাঁজার আসর।
অনেক সিসা বারে বিশেষ কেবিন বানানো হয়েছে। সেই কেবিনগুলোতে রাতভর চলে অনৈতিক কর্মকাণ্ড। এছাড়া অবৈধ এসব সিসা বারে প্রতিনিয়ত ঢাকার অপরাধজগতের সন্ত্রাসী ও তাদের দলের সদস্যরা এসে ভিড় জমায়। যার ফলে প্রতিনিয়ত এসব সিসা বার থেকে অপরাধ কর্মকাণ্ডের নির্দেশনা এসে অপরাধ বেড়ে চলছে।
কী বলছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) অতিরিক্ত মহাপরিচালক গোলাম আজম জানিয়েছেন, দেশের কোথাও বৈধ কোনো সিসা বার নেই। রেস্তোরাঁর আড়ালে অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে এসব বার পরিচালনা করে আসছে।

গুলশানে অবস্থিত ‘মন্টানা’ নামে একটি সিসা বারের ভেতরের দৃশ্য। ছবি- সংগৃহীত।
তিনি জানান, বনানীতে সিসা বারে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ঢাকায় বৈধ কোনো সিসা বার নেই। তারপরও বনানীতে ২১টি সিসা বার রয়েছে। এছাড়া ধানমন্ডিতে একটি বার ছিল, যা অভিযানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, সিসায় যদি ০.২ শতাংশ নিকোটিন থাকে, তবে তা ‘খ’ শ্রেণির মাদক হিসেবে গণ্য হয়। আমরা সেক্ষেত্রে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। কিন্তু কিছু ব্যবসায়ী উচ্চ আদালতে রিট করে আমাদের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করেন। আমরা খুব শিগগির এসব সিসা বারে অভিযান চালিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব।
অবৈধ সিসা বার নিয়ে র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাকায় অবৈধ সিসা লাউঞ্জগুলোর বিরুদ্ধে খুব দ্রুত অভিযান চালানো হবে। আমরা এসব সিসা লাউঞ্জগুলোতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছি।


























