
গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা ও পূর্ণাঙ্গ চিত্র প্রকাশ করা জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তাদের মতে, গুম কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়— এটি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য গভীর সংকটের প্রতীক। এ ধরনের ঘটনার সঠিক তথ্য গোপন করা হলে ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হয়, জবাবদিহিতা দুর্বল হয় এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়ে।
শুক্রবার (২৯ আগস্ট) জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) আয়োজিত ‘গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস–২০২৫’ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা এসব মত প্রকাশ করেন।
বক্তারা সতর্ক করে বলেন, গুমের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ না করা হলে ভুক্তভোগী পরিবারের ন্যায়বিচারের পথ দীর্ঘ হবে এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে। তাই গুম বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, দায়ীদের বিচার এবং ভুক্তভোগী পরিবারের নিরাপত্তা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
অনুষ্ঠানে এইচআরএসএস সাত দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করে। প্রস্তাবগুলো হলো— নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা ও পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশ, ভুক্তভোগী পরিবারের নিরাপত্তা ও আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক আইন বাস্তবায়ন, গুম তদন্ত কমিশনকে শক্তিশালী ও স্থায়ী করা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জবাবদিহির আওতায় আনা, দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং গুম সংস্কৃতি বন্ধে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ।
সভায় ২০১৫ সালে গুমের শিকার হওয়া মো. আল আমিন ও জেসমিন নাহার দম্পতি তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। জেসমিন জানান, গুমকারীদের পরিচয় র্যাব–১৩ হিসেবে জানতে পারলেও ধরা পড়ে যাওয়ার পর প্রতিদিন নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়— ব্লেড দিয়ে শরীর কেটে তাতে লবণ লাগানোসহ নানা অমানবিক শাস্তি দেওয়া হতো। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এখনও কোনো বিচার পাইনি; বরং নিয়মিত প্রাণনাশের হুমকি পাচ্ছি।
মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতা ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা সভায় একে একে বক্তব্য রাখেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, গুম কমিশনের কিছু কার্যক্রম শিগগির ফল দিতে পারে, তবে ফ্যাসিবাদী মানসিকতা দূর না হলে এই সংস্কৃতি বিলুপ্ত হবে না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর এস এম মঈনুল করিম মনে করেন, গুমের শিকারদের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা এখনও নেওয়া হয়নি; অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া জরুরি।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জোবায়ের বলেন, গুমের প্রকৃত চিত্র খুব কমই প্রকাশিত হয়, যা কোনো সভ্য সমাজ মেনে নিতে পারে না।
তিনি ভুক্তভোগীদের আইনি, আর্থিক ও সামাজিক সহায়তার প্রতিশ্রুতিও দেন। জাতিসংঘের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান বলেন, গুমের শিকার পরিবারগুলো এখনও বঞ্চনার মধ্যে রয়েছে। সরকারকে দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নিয়ে এই সংস্কৃতি রোধ করতে হবে।
আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, বিচার চাইতে গিয়ে ভুক্তভোগীরা যেন নতুন অবিচারের শিকার না হন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম অভিযোগ করেন, গোয়েন্দা সংস্থার সংস্কার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তার মতে, যারা খুন-গুমে জড়িত, তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। একইসঙ্গে বিএনপির নীরব ভূমিকারও সমালোচনা করেন তিনি।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন বলেন, ভবিষ্যতে বিএনপি সরকার গঠন করলে মানবাধিকার, আইনের শাসন ও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি গুম ও শহীদ পরিবারের আর্থিক সহায়তা এবং তাদের নামে স্থাপনা নির্মাণের প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।
সভায় আরও বক্তব্য দেন মানবাধিকার কর্মী, নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা। তাদের অভিন্ন দাবি— গুমের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের নিশ্চয়তা ছাড়া দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও নাগরিক নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।



























