
সৌহার্দ্য থেকে বিষোদগারে প্রার্থী-সমর্থকরা
- ভোট ঘনিয়ে আসার সঙ্গে বাড়ছে উদ্বেগ
- এক রিটে ক্যাম্পাসের ভেতরে–বাইরে ছড়ায় উত্তাপ
- সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ চান সাধারণ শিক্ষার্থীরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। ৯ সেপ্টেম্বরের ভোটকে ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে ক্যাম্পাসের রাজনীতি। আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরুর পর ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের প্রার্থীদের মধ্যে শুরুতে সৌহার্দ্য দেখা গেলেও ধীরে ধীরে সেটি রূপ নিয়েছে বিরোধে।
সাম্প্রতিক সময়ে একে অপরের বিরুদ্ধে ‘ধর্ষণের হুমকি’ দেওয়ার অভিযোগ তুলে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি করেছে সংগঠন দুটি। কর্মসূচিতে হুমকি–ধামকি আর বিষোদগারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে। শুধু ছাত্রদল–শিবির নয়, অন্য সংগঠনের প্রার্থীরাও একে অপরের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণায় নেমেছেন।
নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদল ও শিবিরের প্রার্থীরা অনেক ক্ষেত্রেই একসঙ্গে অবস্থান করতে দেখা যায়। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক মতাদর্শে ভিন্নতা থাকলেও অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক অবস্থান দেখা গিয়েছিল জুলাই–আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সক্রিয় থাকা ছাত্র সংগঠন দুটির নেতাদের।
তবে ডাকসু নির্বাচন ঘিরে একাধিক বিতর্কিত ইস্যু সামনে আসার পর থেকে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। ছাত্রশিবিরের ফেস্টুন ভাঙা, একজন প্রার্থীর সাধারণ শিক্ষার্থীকে আহত করা নিয়ে উত্তাপ বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে ছাত্রদলের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়, শিবিরের কয়েকজন কর্মী তাদের নারী প্রার্থীদের ‘ধর্ষণের হুমকি’ দিয়েছে। এ নিয়ে উত্তাল হয়ে ওঠে সামাজিক মাধ্যম এবং ক্যাম্পাসের রাজনীতি।
তবে শিবিরের পক্ষ থেকে এই অভিযোগকে ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ ও ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। পাল্টা বিবৃতি দিয়ে সংগঠনটি অভিযোগ করে, প্রকৃতপক্ষে ছাত্রদলের একটি পক্ষই শিবিরের কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অপপ্রচার চালাচ্ছে এবং নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে চাচ্ছে।
এছাড়া দুই সংগঠনের শীর্ষ নেতারা একে অন্যের বিরুদ্ধে নেতিবাচক বক্তব্য দিতে থাকলে বাড়তে থাকে উত্তেজনা। এ ঘটনায় উভয়পক্ষই আলাদা করে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, প্রতিবাদ কর্মসূচি করেছে।
ছাত্রদল হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, তারা নারীর প্রতি সহিংসতার হুমকি কোনোভাবেই মেনে নেবে না এবং এ বিষয়ে প্রমাণসহ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানায় সংগঠনটি।
অন্যদিকে শিবির জানিয়েছে, তারা এই ‘মিথ্যা অভিযোগ’ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে প্রয়োজনে প্রশাসনের দ্বারস্থ হবে। ছাত্রদল কর্মসূচিতে নারীদের জোর করে নিয়ে এসেছে বলেও অভিযোগ তোলা হয়।
এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি না দিলেও ভোটকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানা গেছে।
তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আশঙ্কা ডাকসু নির্বাচন বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে দীর্ঘদিন পর একটি বড় ধাপ। তবে ব্যক্তিগত আক্রমণ, হুমকি এবং পাল্টাপাল্টি অভিযোগের সংস্কৃতি নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশকে বাধাগ্রস্ত করছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যথাযথ পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছেন শিক্ষার্থীরা।
অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী ঢাকা মেইলকে বলেন, শুরুর দিকে সুন্দর পরিবেশ নিয়ে আমরা ভালো কিছু আশা করেছিলাম। কিন্তু দিন দিন পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাদের সাধারণ শিক্ষার্থীরা আতঙ্কে আছে। এখনই পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে ভোটের আগে আরও খারাপ হতে পারে।
এদিকে বড় সংগঠনগুলোর প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে এমন টানটান উত্তেজনা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় আছেন স্বতন্ত্র প্যানেলের প্রার্থীরাও। নাম না করার শর্তে সম্পাদকীয় পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা একজন নারী প্রার্থী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। সাহস নিয়ে একা একা অনেক সময় প্রচারণা চালাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত ভোট সুষ্ঠুভাবে হবে কি না, সেটা নিয়ে টেনশন হচ্ছে। ভোটারদের মধ্যেও উদ্বেগ আছে।’
তিনি বলেন, আশা করি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভীতিকর পরিস্থিতি দূর করতে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।
এদিকে নির্বাচনে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদের প্রার্থিতা চ্যালেঞ্জ করে করা রিট নিয়েও উত্তেজনা ছড়িয়েছে ক্যাম্পাসের ভেতরে-বাইরে। প্রথম দিনে নির্বাচন স্থগিতের আদেশের পর ক্যাম্পাসজুড়ে প্রতিবাদ মিছিল হয়। পরে আদেশ স্থগিত হওয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়।
বুধবার ডাকসু নির্বাচন নিয়ে তৈরি আইনি জটিলতার নিষ্পত্তি করে আপিল বিভাগ। রায়ে হাইকোর্টের রায় স্থগিত করে দিয়ে চেম্বার আদালতের আদেশ বহাল রাখা হয়। ফলে ৯ সেপ্টেম্বরের ডাকসু নির্বাচনের বাধা কেটে যায়।
এতে স্বস্তি ফিরলেও একইদিনে নির্বাচনে প্রার্থিতা ও ব্যালট নম্বর পুনর্বহালের নির্দেশনা চেয়ে রিট করেছেন স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী মো. জুলিয়াস সিজার তালুকদার। চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় নাম ও ব্যালট নম্বর পুনর্বহাল না করা পর্যন্ত ডাকসু নির্বাচন স্থগিতের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। নির্বাচনের পাশাপাশি ডাকসু হল সংসদ নির্বাচনও স্থগিত করার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত আবারও কোনো আইনি জটিলতা তৈরি হয় কিনা সেই শঙ্কা করছেন অনেকে।
৯ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত আটটি কেন্দ্রে ভোট হবে। নির্বাচনের দিন সকল ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকবে।
চূড়ান্ত তালিকা অনুযায়ী এবার মোট ৪৭১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ভিপি পদে ৪৫ জন, জিএস পদে ১৯ জন, এজিএস পদে ২৫ জন, আর বিভিন্ন সম্পাদক ও সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বাকিরা। বোরহান উদ্দিন, ঢাকা মেইল



























