রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে ৫ কোটি এবং আহতদের পরিবারকে ২ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। একইসঙ্গে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, ন্যায়বিচার এবং আহতদের আজীবন চিকিৎসার দাবিও তুলেছেন তারা।
মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানান দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবকদের পরিবার। সংবাদ সম্মেলনের মূল বক্তা ছিলেন নিহত শিক্ষার্থী নাজিয়া-নাফির বাবা আশরাফুল ইসলাম। তার সঙ্গে ছিলেন আরও কয়েকজন হতাহত পরিবারের সদস্য।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২১ জুলাই দুপুর ১টা ১২ মিনিটে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হায়দার আলী ভবনের ওপর বিধ্বস্ত হয়। ঘটনাস্থলেই স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্টাফসহ অনেকের মৃত্যু হয়। এরপর হাসপাতালে মারা যান আরও অনেকে। ওই ঘটনায় পাইলটসহ ৩৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ২৮ জন শিক্ষার্থী, ৩ জন অভিভাবক, ৩ জন শিক্ষক এবং স্কুলের পরিচিত মুখ মাসুমা বেগম। আহতদের অনেকে এখনো মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। অনেকে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরলেও শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।
নিহত তাসনিয়া হকের বাবা নাজমুল হক বলেন, ২১ জুলাই দেশের ইতিহাসে একটি শোকাবহ দিন। সেই দিনটি যেন জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি পায়, এটাই আমাদের অনুরোধ। আমরা সন্তানদের আগুনে পুড়ে যাওয়া দেহ কবরে রেখে এসেছি। চোখের সামনে তাদের হারিয়েছি। এই বেদনা কোনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
তিনি বলেন, ঘটনার পর শুরুতে কিছু খোঁজখবর এলেও এখন সবাই নিশ্চুপ। প্রধান উপদেষ্টা তিনজন শিক্ষকের পরিবারের সঙ্গে দেখা করলেও বাকি পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াননি। শুধু স্কুল কর্তৃপক্ষ নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। রাষ্ট্র যেন আমাদের ভুলে না যায়।
সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগীরা ৮ দফা দাবি উত্থাপন করেন। দাবিগুলো হলো, নিহতদের পরিবারকে ৫ কোটি টাকা এবং আহতদের পরিবারকে ২ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ প্রদান, আহতদের আজীবন সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে চিকিৎসা ও হেলথ কার্ড প্রদান, ২১ জুলাইকে জাতীয়ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘শোক দিবস’ হিসেবে পালন, নিহতদের কবর সংরক্ষণে সরকারি উদ্যোগ, নিহত পাইলট, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্টাফদের শহীদী মর্যাদা দিয়ে গেজেট প্রকাশ, দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে উত্তরায় একটি আধুনিক মসজিদ নির্মাণ, ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো।
আহত রায়ান তৌফিকের বাবা সুমন বলেন, আমার ছেলে এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। মানসিকভাবে সে ভেঙে পড়েছে। প্রতিটি রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে ওঠে। একটাই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে, ওর কী দোষ ছিল? সে তো শুধু ক্লাসে ছিল।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন নিহত সামিউলের বাবা রেজাউল করিম শামীম, আহত শিক্ষার্থী সানজিদা বেলায়েতের মা জায়ানা মাহবুবসহ আরও অনেকে। তারা বলেন, সরকার এই দায় এড়াতে পারে না। বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান যদি আবাসিক এলাকায়, তাও আবার একটি স্কুল ভবনের ওপর পড়ে, তাহলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।
ভুক্তভোগীদের বক্তব্য, আমাদের সন্তানরা স্কুলে গিয়েছিল পড়তে। সেদিন কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে ছিল না। স্কুলের ছাদের ওপর বিমান পড়বে, এটা কল্পনাও করিনি। পৃথিবীর কোনো দেশেই এমন ঘটনা ঘটলে দায় রাষ্ট্রই নেয়। আমরাও সে দাবি করছি।
সংবাদ সম্মেলনের আয়োজক পরিবারগুলো সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে, এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। একইসঙ্গে যেন আর কোনো শিশুর জীবনে এমন ট্র্যাজেডি না নামে, সেজন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত পরিবারগুলোর চোখেমুখে ছিল গভীর শোক ও ক্ষোভের ছাপ। তারা জানান, ক্ষতিপূরণ দাবি করলেও এটা অর্থমূল্যের বিষয় নয়, এটি স্বীকৃতি, দায় গ্রহণ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর ন্যূনতম মানবিক চেষ্টার প্রতিফলন।