রংপুরে ছড়িয়ে পড়ছে অ্যানথ্রাক্স রোগটি। ছবি: সংগৃহীত
দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় আটজনের শরীরে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। ওই এলাকার কিছু বাড়ির ফ্রিজে রাখা গরুর মাংসেও অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া আরও দুটি উপজেলা থেকে সন্দেহভাজন রোগীদের নমুনা আইইডিসিআরকে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন মো. রুহুল আমিন।
পীরগাছায় গত দেড় মাসে কয়েকটি ইউনিয়নের অন্তত ৩০ জন অ্যানথ্রাক্স উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন বলে জানিয়েছেন পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।
তবে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে দুজনের মৃত্যুর খবর সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন তিনি। যদিও অসুস্থ হয়ে তারা মারা গিয়েছিলেন ও অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ তাদের মধ্যেও কিছুটা ছিল।
অ্যানথ্রাক্স আক্রান্তের তথ্য পাওয়ার পর গত এক মাসে পীরগাছাসহ জেলার কয়েকটি উপজেলায় দেড় লাখের বেশি গবাদি পশুকে ভ্যাকসিন দেওয়ার পাশাপাশি বাজারগুলোর কসাই ও গরু চাষিদের অসুস্থ গরুর বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে বলে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে।
চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যানথ্রাক্সের চিকিৎসা সহজলভ্য এবং এতে মৃত্যুঝুঁকি তেমন একটা নেই। কিন্তু সংক্রমণ ঠেকাতে অসুস্থ গরু বা ছাগল জবাই বন্ধ করা নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি অসুস্থ প্রাণী মারা গেলে ঝুঁকি এড়াতে মাটির গভীরে পুতে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
“প্রাণীবাহিত এই রোগটি যাতে না হয় সেজন্য পশুকে নিয়মিত টিকা দিতে হবে। কেউ আক্রান্ত হলে চিকিৎসা নিতে হবে। না হলে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।”
মুশতাক হোসেন, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
অ্যানথ্রাক্স গরু, ছাগল, মহিষ- এই ধরনের প্রাণীর মধ্যে দেখা যায়। এসব পশুর মাংস স্পর্শ বা নাড়াচড়া করার মাধ্যমেই এটি মানুষের মধ্যে ছড়ায়।
দেশের কিছু এলাকায় এর আগেও অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হবার ঘটনা ঘটেছে। ২০১০ সালে অ্যানথ্রাক্স নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একটি জাতীয় সমন্বয় কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। এবার এখনো রংপুরের বাইরে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
এবার কিভাবে শনাক্ত হলো, পরিস্থিতি কেমন
মানুষের অ্যানথ্রাক্স মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে - একধরনের অ্যানথ্রাক্স হয় পরিপাকতন্ত্রে, আরেক ধরনের অ্যানথ্রাক্স শরীরের বাইরের অংশে সংক্রমণ ঘটায়।
অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গবাদিপশুর কাঁচা মাংস, শ্লেষ্মা, লালা, রক্ত, হাড় ও নাড়িভুঁড়ির সংস্পর্শে এলে মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

রংপুরে বেশ কয়েকজনের শরীরে শনাক্ত হয়েছে অ্যানথ্রাক্স। ছবি: সংগৃহীত
এ রোগ গবাদিপশু থেকে মানুষে ছড়ায়, তবে মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। শরীরে এ রোগের প্রধান উপসর্গ হলো চামড়ায় ঘা বা ক্ষত তৈরি হওয়া।
মানুষের পরিপাকতন্ত্রে অ্যানথ্রাক্স জীবাণুর সংক্রমণ হলে সাধারণত হালকা জ্বর, মাংসপেশিতে ব্যথা, গলা ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
তবে বাংলাদেশে যে অ্যানথ্রাক্স দেখা যায় তা শরীরের বাইরের অংশে প্রভাব ফেলে। এ ধরনের অ্যানথ্রাক্সে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ফোঁড়া বা গোটা হয়ে থাকে এবং চামড়ায় ক্ষত তৈরি হয়।
রংপুরের স্থানীয় প্রশাসন ও হাসপাতালের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আগস্টের শেষ দিক থেকেই অ্যানথ্রাক্স উপসর্গ নিয়ে পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীদের আসা শুরু হয়।
‘প্রায় দেড় মাস আগে থেকেই অ্যানথ্রাক্স উপসর্গ নিয়ে লোকজন হাসপাতালে আসছিল। মূলত তারা বহির্বিভাগেই চিকিৎসা নিয়েছে। যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন তাদের অনেকেই এখন সুস্থ,’ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মুহাম্মদ তানভীর হাসনাত রবিন।
এর মধ্যে পীরগাছা সদর ও পারুল ইউনিয়নে একজন পুরুষ ও একজন নারীর 'অ্যানথ্রাক্স উপসর্গ' নিয়ে মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর প্রাণিসম্পদ বিভাগ মাংসের নমুনা পরীক্ষা করে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু পাওয়ার বিষয়টি জানায়। যদিও ওই দুজনের একজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং অন্যজন হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন বলেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানিয়েছেন। ‘অ্যানথ্রাক্স উপসর্গ ছিল, কিন্তু পরে পরীক্ষায় তাদের শরীরে অ্যানথ্রাক্স জীবাণু পাওয়া যায়নি,’ বলছিলেন তিনি।
কিন্তু এর মধ্যেই অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত অনেকে চিকিৎসা নেওয়ায় আইইডিসিআর-এর বিশেষজ্ঞরা ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর ওই এলাকায় গিয়ে ১২ জনের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। ‘এই ১২ জনের মধ্যে ৮ জনের নমুনা অ্যানথ্রাক্স জীবাণু পাওয়া গেছে। গরুর মাংস থেকে তারা আক্রান্ত হয়েছেন। সেখানকার দুটি ইউনিয়ন থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল,’ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরীন।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. একরামুল হক মন্ডল বলছেন, তারা দুই ইউনিয়নের বারটি বাড়ির ফ্রিজ থেকে মাংসের নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন এবং তাতে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু পাওয়া গিয়েছিল।
মূলত আগস্টের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে অন্তত পাঁচটি অসুস্থ গরু জবাইয়ের তথ্য স্থানীয়দের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে প্রশাসন। এর মধ্যে দুটি গরু জবাইয়ের পর মাংস এলাকাবাসীর মধ্যে বিতরণও করা হয়েছিল।
যারা অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত হয়েছেন তারা মূলত এসব গরু জবাই ও মাংস কাটাকাটির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং আক্রান্তদের কেউ কেউ বাসা বাড়িতে কাঁচা মাসের সংস্পর্শে এসেছিলেন বলে মন্ডল বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন।

প্রাণীবাহিত রোগটির ব্যাপারে সতর্ক করেছেন চিকিৎসকরা। ছবি: সংগৃহীত
আক্রান্তদের অনেকের হাতের চামড়ায় ক্ষত তৈরি হওয়ার পর তারা চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন। তবে সদর ও পারুল ইউনিয়নের বাইরে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত হওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা অবশ্য বলছেন, প্রতিদিন কসাইখানা গুলো চেক করা হচেছ এবং নতুন করে আর কেউ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য আসেনি।
এদিকে অ্যানথ্রাক্স রোগীরা নিয়মিত সেখানকার হাসপাতালে আসার কথা জানার পর প্রায় ৫৩ হাজার গরুকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। যদিও স্থানীয় কয়েকজন জানিয়েছেন, গত দুই মাসে অনেক জায়গায় গরু অসুস্থ হতে দেখা গেছে।
রংপুর জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন মো. রুহুল আমিন জানিয়েছেন, পীরগাছা ছাড়া মিঠাপুকুর ও কাউনিয়া উপজেলায় অ্যানথ্রাক্স উপগর্স দেখা দেওয়ায় দুই জায়গা থেকেই নমুনা আইইডিসিআরকে পাঠানো হয়েছে। তবে সেগুলোর রিপোর্ট এখনো আসেনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বলছেন, অ্যানথ্রাক্সের চিকিৎসা আছে, তবে অসুস্থ গরুর মাংস জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ‘গরু অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাতে হবে। আর অসুস্থ গরু মারা গেলে মাটির গভীরে পুতে ফেলতে হবে। কাক শকুনের খাওয়ার জন্যও বাইরে রাখা যাবে না। প্রাণীবাহিত এই রোগটি যাতে না হয় সেজন্য পশুকে নিয়মিত টিকা দিতে হবে। কেউ আক্রান্ত হলে চিকিৎসা নিতে হবে। না হলে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে যেভাবে রান্না করে মাংস খাওয়া হয়, তাতে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু থাকার সম্ভাবনা খুব একটা থাকে না। তবে রান্নার আগে যারা কাঁচা মাংসের সংস্পর্শে যান তাদের অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি থাকে। সূত্র: বিবিসি বাংলা