
ছবি: ঢাকা মেইল
- ডলারের স্বস্তিতে বেড়েছে এলসি
- প্রায় সব খাতে এলসি খোলায় ইতিবাচক প্রবাহ
- মধ্যবর্তী পণ্যে এলসি খোলার হার উদ্বেগজনক
- মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে মন্থর গতি
- আশা জাগাচ্ছে শিল্প কাঁচামাল আমদানির হার
দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকে প্রবাসী আয়ের ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের শক্তিশালী অবস্থার কারণে আমদানিতে স্বস্তি দেখা দিয়েছে। প্রায় সব খাতে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার পরিমাণ বেড়েছে, ভোগ্যপণ্যের আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে শিল্পখাতে বিনিয়োগ ও উৎপাদন সম্প্রসারণে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানিতে। অর্থাৎ, দেশের ভোক্তা বাজারে সরবরাহ ঠিক থাকলেও উৎপাদন খাতে শঙ্কা বিরাজ করছে। এছাড়াও ব্যাপকহারে কমেছে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভোগ্যপণ্যের আমদানি বৃদ্ধি জনগণের চাহিদা মেটাতে ইতিবাচক হলেও উৎপাদন খাতে বিনিয়োগের ধীরগতি উদ্বেগজনক। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্যে স্থবিরতা মানে হলো নতুন কারখানা স্থাপন ও উৎপাদন সম্প্রসারণে আগ্রহ কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই (জুলাই–আগস্ট) আমদানি দায় মেটাতে ১ হাজার ১৪৮ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের ১,০৬০ কোটি ডলারের তুলনায় প্রায় ৮৮ কোটি ডলার বেশি। শতাংশের হিসাবে এই বৃদ্ধির হার ৮.২৮ শতাংশ।
একই সময়ে এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ১১২ কোটি ডলার, যা গতবছরের একই সময়ের ১,০৬৭ কোটি ডলারের তুলনায় ৪.২৩ শতাংশ বেড়েছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই–আগস্ট সময়ে ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা হয়েছে ৯৯ কোটি ডলারের, যা আগের অর্থবছরের ৯০ কোটি ডলারের তুলনায় ৯.১৪ শতাংশ বেশি। একই সময়ে এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ ৯১ কোটি ৯৮ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের ৮৫ কোটি ২৮ লাখ ডলারের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই খাতে প্রধানত খাদ্যপণ্য, ভোজ্যতেল, চিনি, ওষুধ, দুধজাত পণ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী অন্তর্ভুক্ত।
ভোগ্যপণ্যের এলসি বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ হলো—বিশ্ববাজারে দাম স্থিতিশীল থাকা এবং ডলার সংকট প্রশমিত হওয়া। এছাড়া চলতি বছরের শুরুতে টাকার মান তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকায় আমদানিকারকরা বেশি সক্রিয় হয়েছেন।
বিপরীতে, মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানিতে বৃদ্ধি সীমিত। প্রথম দুই মাসে এই খাতে এলসি খোলা হয়েছে ২৬ কোটি ৪১ লাখ ডলারের, যা আগের বছরে ছিল ২৬ কোটি ২২ লাখ ডলার, মাত্র ০.৭২ শতাংশ বৃদ্ধি। এ খাতে এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ ৩৫ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের ৩০ কোটি ডলারের তুলনায় সামান্য বেড়েছে।
মধ্যবর্তী পণ্যের খাতে এলসি খোলার হার ১১.৬২ শতাংশ কমে ৬৬ কোটি ৫৯ লাখ ডলারে নেমেছে। এই শ্রেণির পণ্য মূলত উৎপাদন শিল্পের কাঁচামাল ও আধা-প্রসেসড ইনপুটস। ফলে এ খাতে পতনকে উৎপাদনক্ষেত্রে মন্থরতার ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।

আমদানি-বাংলাদেশ ব্যাংক। ছবি- সংগৃহীত
আশার বিষয় হচ্ছে শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৩.৭২ শতাংশ। জুলাই–আগস্টে এই খাতে এলসি খোলা হয়েছে ৪০৩ কোটি ডলারের, যা আগের অর্থবছরের ৩৮৮ কোটি ডলারের তুলনায় ১৪ কোটি ডলার বেশি। একই সময়ে এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ ৩৮৪ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের ৩৭৪ কোটি ডলারের তুলনায় বেড়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই বৃদ্ধি নির্দেশ করে যে, দেশের তৈরি পোশাক, চামড়া, ফার্মাসিউটিক্যালসসহ রপ্তানিমুখী শিল্প ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধারের পথে এগোচ্ছে।
পেট্রোলিয়াম পণ্যের এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৩.০৭ শতাংশ। এ খাতে খোলা হয়েছে ১৪৪ কোটি ডলারের এলসি। ‘অন্যান্য পণ্য’ শ্রেণিতে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে—১৯.৭৮ শতাংশ। এ খাতে খোলা হয়েছে ৩৬১ কোটি ডলারের এলসি।
আসন্ন রমজান মাসে পণ্য আমদানির অবস্থা বজায় রাখতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দেশের শীর্ষ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন। সরকার চায়, আমদানি বাড়লেও মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে রাখা যাবে।
দেশে প্রবাসী আয়ের প্রবাহের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভ ৩১.৪২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসী আয় এসেছিল ২৬৮ কোটি ডলার। আগের মাস আগস্ট শেষে রিজার্ভ ছিল ৩১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। ওই মাসে প্রবাসী আয় এসেছিল ২৪২ কোটি ডলার।
অন্যদিকে, বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবাহ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু উদ্যোগে মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও ব্যাংক খাত থেকে পর্যাপ্ত ঋণ পাচ্ছে না বেসরকারি খাত।
উচ্চ সুদের বোঝা বহন করতে না পেরে উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এতে শিল্প, ব্যবসা ও উৎপাদন খাতের সম্প্রসারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
আগস্ট মাসে দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ, যা ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত জুলাইয়ে যা ছিল ৬.৫২ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগস্ট শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা, যা জুলাই মাসের ১৭ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার তুলনায় সামান্য বৃদ্ধি। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির হার নামমাত্র পর্যায়ে নেমে এসেছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতেই ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে ৬.৮২ শতাংশে নেমেছিল, যা তখনো ছিল নিম্নতম স্তর।
তবে আগস্টে তা আরও কমে নতুন রেকর্ড গড়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরেও প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.২৮ শতাংশ, জানুয়ারিতে কমে ৭.১৫ শতাংশ এবং ফেব্রুয়ারিতে ৬.৮২ শতাংশে নেমে আসে। পরে মে মাসে সামান্য বেড়ে ৭.১৭ শতাংশে দাঁড়ালেও আবার ধীরগতি ফিরে আসে আগস্টে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে বেসরকারি খাত। এই খাতে টাকার প্রবাহ কমে যাওয়ার মানে ধরে নিতে হবে অর্থনীতির কার্যক্রমের গতি কমে যাচ্ছে। দেশের বেকারদের কর্মসংস্থান এমনিতেই কমের দিকে। কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। এজন্য বেসরকারি খাতকে গুরুত্ব দিয়ে টাকার জোগান বাড়াতে হবে। শিল্প এগিয়ে গেলে অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। মুহা. তারিক আবেদীন ইমন, ঢাকা মেইল



























