১০:৪৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫

‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বলায় ভারতীয় মুসলিমদের ওপর কেন দমন–পীড়ন বাড়ছে?

  • আপডেট সময়: ১১:৪৩:৩৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
  • 29

ভারতের উত্তর প্রদেশ ও অন্যান্য বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর পুলিশ এক মাস ধরে ‘আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)’ লেখাকে কেন্দ্র করে অভিযানে নেমেছে। বাড়ি-ঘরে হানা দেওয়া হচ্ছে, মুসলিম পুরুষদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, কখনও কখনও বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ধারাবাহিক ব্যাপারটি শুধু আইন প্রয়োগ নয়, প্রকাশ হয়ে উঠেছে ধর্ম ও রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রতি গভীর উত্তেজনা ও নিয়ন্ত্রণচেষ্টার এক নতুন অধ্যায়।

ঘটনার শুরুয়াত ঘটে ৪ সেপ্টেম্বর উত্তর প্রদেশের কানপুরে। মহানবী (সা.)–এর জন্মদিন উপলক্ষে এক মহল্লায় ‘আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)’ লেখা একটি বোর্ড টাঙানো হয়। কিছু হিন্দু বাসিন্দা এই বোর্ডকে ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে ‘নতুন সংযোজন’ বলে দাবি করেন, যা স্থানীয় আইন লঙ্ঘন করেছে, এভাবে তাদের অভিযোগ। কানপুরের এই ঘটনার পর পুলিশ অভিযোগ আনে, বোর্ডটি ‘ধর্মকে ব্যবহার করে বিদ্বেষ ছড়ানোর উপাদান’ এবং ‘নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে’।

এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ভারতে। ইমামরা বিক্ষোভের ডাক দেন, রাখঢাক ছাড়াই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এক ধাপে বেরেলিতে ৭৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ইমামের, তার পরিবারের ও সহযোগীদের বাড়ি-ঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। পোস্টার, টি-শার্ট বা অনলাইন পোস্টে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা থাকলেই অভিযুক্ত করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধ হিসেবে আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ, ধর্মীয় উত্তেজনা উসকে দেওয়া, জনসমাগমের বাজে উদ্দেশ্য—এই ধরনের ধারা লাগানো হচ্ছে।

কেন্দ্রীয়ভাবে প্রশ্ন উঠে, ‘আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)’ বলা কি বেআইনি? ভারতের সংবিধান ধর্ম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। ধারা ২৫ অনুযায়ী ধর্ম পালন, ধারা ১৯(১)(ক) অনুযায়ী মতপ্রকাশের অধিকার। যদি কোনো কথাবার্তা সরাসরি সহিংসতা বা ঘৃণা উসকে না দেয়, তবে আইনশৃঙ্খলায় অভিযুক্ত করা যায় না। কিন্তু এসব মামলায় সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন বলছে, এই বাক্য ‘হুমকি’ তৈরি করছে, উত্তেজনা গ্রামে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

অলাভজনক সংস্থা এপিসিআর বলেছে, এসব রাজ্যে ইতিমধ্যেই ২২টি মামলা করা হয়েছে। দুই হাজারেরও বেশি মুসলিমকে আসামি করা হয়েছে, এবং অন্তত ৪০ জন গ্রেফতার করা হয়েছে। এপিসিআর-এর সমন্বয়ক নাদিম খান বলছেন, কর্তৃপক্ষ জানে, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ নিজে অপরাধ নয়। কিন্তু তারা বিভিন্ন আইন প্রয়োগ করে ব্যক্তিদের দমন করছে। তিনি যুক্তি দেন, হিন্দু দেবতার ছবি হাতে রাখলে তা কি সব মুসলিমদের জন্য ‘হুমকি’ বলা হবে?

মানবাধিকার সংস্থা ও বিশ্লেষকরা বলছেন, মোদির নেতৃত্বে ভারত সামাজিক ও সাংবিধানিক সূচকে ধাপে ধাপে সরে যাচ্ছে। ‘আই লাভ মুহাম্মদ’–এর মতো শান্তিপূর্ণ অভিব্যক্তি দমন করা ভারতীয় সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতির পরিপন্থী। আইনশৃঙ্খলা সুরক্ষার নামে ধর্মীয় চর্চা ও বিশ্বাসকে দমন করা গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্রের কাজ হলো মানুষকে তার মানবিক অধিকার দেওয়া, বিশ্বাসের ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা না।

অন্য অনেক সময়েও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণাপূর্ণ বক্তব্য ও সহিংসতা ডিজাইন করা হয়েছে। ২০২৩ সালে এ ধরনের ঘটনা ছিল ৬৬৮টি। ২০২৪ সালে তা বেড়ে হয় ১,১৬৫টি। বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’–এর ক্ষোভ ও ধরনের দমন ব্যবস্থা স্থানীয় বিরোধগুলোকে দ্রুত ‘জাতীয় ধর্ম-রাজনৈতিক ইস্যু’ হিসেবে তুলে ধরছে। উদাহরণস্বরূপ, কানপুর ঘটনার পরে বারানসীতে ‘আই লাভ বুলডোজার’ লেখা পোস্টার লাগিয়ে দমনকারীদের সমর্থন প্রকাশ করা হয়েছে। সূত্র: আল জাজিরা

 

উত্তরাধুনিক

Writer, Singer & Environmentalist

যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘতম শাটডাউনের অবসান হতে যাচ্ছে, সিনেটে বিল পাস

‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বলায় ভারতীয় মুসলিমদের ওপর কেন দমন–পীড়ন বাড়ছে?

আপডেট সময়: ১১:৪৩:৩৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫

ভারতের উত্তর প্রদেশ ও অন্যান্য বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর পুলিশ এক মাস ধরে ‘আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)’ লেখাকে কেন্দ্র করে অভিযানে নেমেছে। বাড়ি-ঘরে হানা দেওয়া হচ্ছে, মুসলিম পুরুষদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, কখনও কখনও বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ধারাবাহিক ব্যাপারটি শুধু আইন প্রয়োগ নয়, প্রকাশ হয়ে উঠেছে ধর্ম ও রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রতি গভীর উত্তেজনা ও নিয়ন্ত্রণচেষ্টার এক নতুন অধ্যায়।

ঘটনার শুরুয়াত ঘটে ৪ সেপ্টেম্বর উত্তর প্রদেশের কানপুরে। মহানবী (সা.)–এর জন্মদিন উপলক্ষে এক মহল্লায় ‘আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)’ লেখা একটি বোর্ড টাঙানো হয়। কিছু হিন্দু বাসিন্দা এই বোর্ডকে ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে ‘নতুন সংযোজন’ বলে দাবি করেন, যা স্থানীয় আইন লঙ্ঘন করেছে, এভাবে তাদের অভিযোগ। কানপুরের এই ঘটনার পর পুলিশ অভিযোগ আনে, বোর্ডটি ‘ধর্মকে ব্যবহার করে বিদ্বেষ ছড়ানোর উপাদান’ এবং ‘নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে’।

এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ভারতে। ইমামরা বিক্ষোভের ডাক দেন, রাখঢাক ছাড়াই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এক ধাপে বেরেলিতে ৭৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ইমামের, তার পরিবারের ও সহযোগীদের বাড়ি-ঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। পোস্টার, টি-শার্ট বা অনলাইন পোস্টে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা থাকলেই অভিযুক্ত করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধ হিসেবে আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ, ধর্মীয় উত্তেজনা উসকে দেওয়া, জনসমাগমের বাজে উদ্দেশ্য—এই ধরনের ধারা লাগানো হচ্ছে।

কেন্দ্রীয়ভাবে প্রশ্ন উঠে, ‘আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)’ বলা কি বেআইনি? ভারতের সংবিধান ধর্ম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। ধারা ২৫ অনুযায়ী ধর্ম পালন, ধারা ১৯(১)(ক) অনুযায়ী মতপ্রকাশের অধিকার। যদি কোনো কথাবার্তা সরাসরি সহিংসতা বা ঘৃণা উসকে না দেয়, তবে আইনশৃঙ্খলায় অভিযুক্ত করা যায় না। কিন্তু এসব মামলায় সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন বলছে, এই বাক্য ‘হুমকি’ তৈরি করছে, উত্তেজনা গ্রামে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

অলাভজনক সংস্থা এপিসিআর বলেছে, এসব রাজ্যে ইতিমধ্যেই ২২টি মামলা করা হয়েছে। দুই হাজারেরও বেশি মুসলিমকে আসামি করা হয়েছে, এবং অন্তত ৪০ জন গ্রেফতার করা হয়েছে। এপিসিআর-এর সমন্বয়ক নাদিম খান বলছেন, কর্তৃপক্ষ জানে, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ নিজে অপরাধ নয়। কিন্তু তারা বিভিন্ন আইন প্রয়োগ করে ব্যক্তিদের দমন করছে। তিনি যুক্তি দেন, হিন্দু দেবতার ছবি হাতে রাখলে তা কি সব মুসলিমদের জন্য ‘হুমকি’ বলা হবে?

মানবাধিকার সংস্থা ও বিশ্লেষকরা বলছেন, মোদির নেতৃত্বে ভারত সামাজিক ও সাংবিধানিক সূচকে ধাপে ধাপে সরে যাচ্ছে। ‘আই লাভ মুহাম্মদ’–এর মতো শান্তিপূর্ণ অভিব্যক্তি দমন করা ভারতীয় সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতির পরিপন্থী। আইনশৃঙ্খলা সুরক্ষার নামে ধর্মীয় চর্চা ও বিশ্বাসকে দমন করা গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্রের কাজ হলো মানুষকে তার মানবিক অধিকার দেওয়া, বিশ্বাসের ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা না।

অন্য অনেক সময়েও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণাপূর্ণ বক্তব্য ও সহিংসতা ডিজাইন করা হয়েছে। ২০২৩ সালে এ ধরনের ঘটনা ছিল ৬৬৮টি। ২০২৪ সালে তা বেড়ে হয় ১,১৬৫টি। বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’–এর ক্ষোভ ও ধরনের দমন ব্যবস্থা স্থানীয় বিরোধগুলোকে দ্রুত ‘জাতীয় ধর্ম-রাজনৈতিক ইস্যু’ হিসেবে তুলে ধরছে। উদাহরণস্বরূপ, কানপুর ঘটনার পরে বারানসীতে ‘আই লাভ বুলডোজার’ লেখা পোস্টার লাগিয়ে দমনকারীদের সমর্থন প্রকাশ করা হয়েছে। সূত্র: আল জাজিরা