ঢাকা শহরের আকাশের দিকে তাকালে এখন দেখা যায় না নীল আকাশ, দেখা যায় শুধু তারের জঙ্গল। রাস্তাঘাট, ফুটপাত, অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়ক পর্যন্ত সর্বত্র ঝুলছে টেলিফোন, ইন্টারনেট, ক্যাবল টিভি, বিদ্যুৎ ও বিভিন্ন সংস্থার অসংখ্য তার। এই ঝুলন্ত তারগুলো শুধু শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করছে না, বরং প্রতিনিয়ত জীবননাশের ভয়ও তৈরি করছে।
বর্ষাকালে যখন শহরের অনেক সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়, তখন এই তারগুলোর মাধ্যমে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কখনো ফুটপাথে হাঁটতে গিয়ে, কখনো দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে—অব্যবস্থাপনার এই দায় নিচ্ছে না কেউ।
অগোছালো তারে ঢাকা নগরীর চিত্র
রাজধানীর যে কোনো এলাকায় গেলেই চোখে পড়ে বিশৃঙ্খলভাবে ঝুলন্ত তারের জট। গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, মিরপুর, পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী—সব জায়গাতেই একই চিত্র। কোথাও বিদ্যুতের তারের সঙ্গে ঝুলছে ইন্টারনেট ও ক্যাবল টিভির তার, আবার কোথাও তার কেটে রাস্তায় পড়ে আছে।
ডেসকো ও ডিপিডিসির তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় বর্তমানে প্রায় ৮০ লাখের বেশি বৈদ্যুতিক সংযোগ রয়েছে। এর বাইরে আছে ৬০০-র বেশি ইন্টারনেট ও ক্যাবল অপারেটর, যারা নিজেদের সুবিধামতো বিদ্যুতের খুঁটিতে তার ঝুলিয়ে রেখেছে। এতে তারের ওজন বেড়ে গিয়ে অনেক খুঁটি হেলে পড়ছে, কোথাও আবার ভেঙে পড়ছে পুরো তারের জট।
ফলাফল—রাস্তায় চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে, অগ্নিকাণ্ড বা বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা ঘটছে, আবার শহরের নান্দনিক সৌন্দর্যও সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বৃষ্টির দিনে মৃত্যুর ফাঁদ
ঢাকায় বর্ষা মানেই সড়কে জলাবদ্ধতা। আর সেই জলাবদ্ধতার সঙ্গে যখন যুক্ত হয় বিদ্যুতের তার, তখন তা পরিণত হয় মৃত্যুর ফাঁদে।
২০২৪ সালের আগস্টে মতিঝিল, রামপুরা, শ্যামলীসহ বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টির সময় তিনজন মানুষ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। এর মধ্যে দুজন ছিলেন রিকশাচালক, একজন পথচারী। তদন্তে জানা যায়, ভেজা তার ও পানিতে ছোঁয়া খুঁটির সংস্পর্শেই ঘটে এই দুর্ঘটনা।

এমন ঘটনা প্রতি বছরই ঘটে, কিন্তু স্থায়ী সমাধান দেখা যায় না। কোনো সংস্থা দায় স্বীকার করে না। ওয়াসা বলে এটি বিদ্যুতের সংস্থা ডিপিডিসির কাজ, ডিপিডিসি বলে এটি ক্যাবল অপারেটরদের দোষ। শেষ পর্যন্ত দায় ঝুলে থাকে—তারের মতোই।
অব্যবস্থাপনার ইতিহাস
রাজধানীতে তার ঝুলে থাকার সংস্কৃতি নতুন নয়। ১৯৯০-এর দশকে যখন ক্যাবল টিভি ও ইন্টারনেট সংযোগ শুরু হয়, তখন থেকেই বেসরকারি অপারেটররা সহজ পথে বিদ্যুতের খুঁটিতে তার টানতে শুরু করে।
সেই থেকে এখন পর্যন্ত কোনো একক নীতিমালা বা সমন্বিত কর্তৃপক্ষ গড়ে ওঠেনি, যারা এই তারের ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করবে।
ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন বহুবার ঘোষণা দিয়েছে ‘আকাশ তারমুক্ত ঢাকা’ প্রকল্প চালুর, কিন্তু বাস্তবে খুব অল্প কিছু এলাকাতেই—যেমন গুলশান-২ ও ধানমন্ডির একটি অংশে—ভূগর্ভস্থ তারের কাজ হয়েছে।
নগরীর সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে ভয়াবহভাবে
রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে সাজানো আলোকসজ্জা, ফুটপাতের গাছপালা, বিলবোর্ড—সবই যেন হারিয়ে গেছে তারের আড়ালে। বিদেশি পর্যটক কিংবা নতুন কেউ ঢাকায় এলেই প্রথম চোখে পড়ে এই বিশৃঙ্খলা।
নগর বিশেষজ্ঞদের মতে, শহরের চেহারা বদলে দিতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন তারের শৃঙ্খলা।
বৈদ্যুতিক ঝুঁকি ও অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা
তারের জট শুধু নান্দনিক সমস্যা নয়, এটি সরাসরি প্রাণহানির ঝুঁকিও তৈরি করছে।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় প্রতিবছর প্রায় ৩০ শতাংশ বৈদ্যুতিক অগ্নিকাণ্ড ঘটে তারের জট বা শর্ট সার্কিটের কারণে। অনেক সময় বিদ্যুৎ ও ক্যাবল তার একসঙ্গে বাঁধা থাকায় একটি লাইনে শর্ট হলে সেটি ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়।
২০১৯ সালের চকবাজার অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই এই ঝুঁকি নতুন করে আলোচনায় আসে। কিন্তু তারপরও এখনো বেশিরভাগ এলাকায় পুরোনো ও অনিরাপদ তার ব্যবহৃত হচ্ছে।
সরকারি উদ্যোগ ও বাস্তবতা
২০২১ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ‘আকাশ তারমুক্ত প্রকল্প’ হাতে নেয়। পরিকল্পনা ছিল—পুরান ঢাকাসহ পুরো দক্ষিণ সিটির পাঁচটি ওয়ার্ডে সব তার ভূগর্ভে নেওয়া হবে।

কিন্তু বাস্তবে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি ১০ শতাংশও। কারণ, সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও অপারেটরদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, অনুমতির জটিলতা এবং খরচের অজুহাতে প্রকল্প বারবার স্থবির হয়ে পড়েছে।
ডিএসসিসির এক প্রকৌশলী জানান, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সংস্থার অনুমোদন ও অংশগ্রহণ না থাকায় প্রকল্প এগোচ্ছে না।
নাগরিক ভোগান্তি ও দুর্ঘটনার ভয়
এই তারগুলো শুধু বিদ্যুৎস্পৃষ্টের ভয়ই বাড়াচ্ছে না, বরং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন চলাচলেও বাধা সৃষ্টি করছে। অনেক জায়গায় ফুটপাত দখল করে রাখা তারে মাথা ঠেকে যায়, মোটরসাইকেল আরোহীরা প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়েন।
মিরপুর ১০ নম্বর এলাকার বাসিন্দা মো. ফয়সাল বলেন, প্রায়ই দেখি রাস্তার মাঝে তার পড়ে থাকে। বৃষ্টি হলে ভয় হয়—না জানি বিদ্যুৎ আছে কি না। অনেক সময় বাচ্চারা খেলতে গিয়ে ওই তারে ছোঁয়, এটা খুবই ভয়াবহ।
ইঞ্জিনিয়ার মিজানুর রহমান বলেন, তারের জট শুধু দেখার জন্যই বিশ্রী নয়, এটি বিদ্যুৎ ব্যবস্থার অদক্ষতার প্রতীক। উন্নত দেশে প্রতিটি সংস্থা নিজস্ব ক্যাবল সিস্টেমের জন্য আলাদা পাইপলাইন ব্যবহার করে। ঢাকায় তা নেই বলেই এই বিপর্যয়। অবিলম্বে সমন্বিত ক্যাবল ব্যবস্থাপনা চালু করা প্রয়োজন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ও নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বিগত সময়ে সিটি করপোরেশন কিছু কিছু এলাকায় ঝুলন্ত তার মাটির নিচে নেওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তা পরে মুখ থুবড়ে পড়ে। কারণ, পুরো ঢাকাজুড়ে ঝুলন্ত তার নিচে নিতে হলে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন, যা করপোরেশনগুলোর বর্তমান সক্ষমতার বাইরে। তারপরও যে উদ্যোগগুলো ছিল, সেগুলো পরবর্তীতে সমন্বয়ের অভাবে থেমে গেছে।
তিনি আরও বলেন, এখন ঝুলন্ত তারের দুটি বিকল্প আছে—একটি হচ্ছে ভূগর্ভস্থে নেওয়া, আরেকটি হচ্ছে উপরের তারগুলোকে শৃঙ্খলায় আনা। যদি নিচ দিয়ে নেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তত উপরের তারগুলোকে সংগঠিতভাবে রাখা যেতে পারে। বিশ্বের অনেক শহর এই পদ্ধতি অনুসরণ করছে, কিন্তু আমরা এখনো শুরু করতে পারিনি।

অধ্যাপক আদিল বলেন, আমাদের বাস্তবতা মেনে বিকল্প সমাধান খোঁজা দরকার। নতুন যে সব পরিকল্পিত এলাকা তৈরি হচ্ছে—তা আবাসিক হোক বা বাণিজ্যিক—সেখানকার নকশাতেই ভূগর্ভস্থ তারের ব্যবস্থা আগে থেকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
পথচারী শারমিন আক্তার বলেন, বৃষ্টির দিনে হাঁটতে ভয় লাগে। কোথায় যে বিদ্যুতের তার ঝুলছে, বোঝা যায় না। কয়েক বছর আগে আমাদের পাশের গলিতে এক শিশু মারা গিয়েছিল। কিন্তু কেউ ব্যবস্থা নেয়নি।
ভূগর্ভস্থ তারের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাধান একটাই—তারের জট আকাশ থেকে নামিয়ে ভূগর্ভে নেওয়া।
তবে এতে খরচ হবে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি, সময় লাগবে কমপক্ষে পাঁচ বছর। এছাড়া বিভিন্ন সংস্থা—ডিপিডিসি, বিটিসিএল, ওয়াসা, এলজিইডি, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার—একসঙ্গে কাজ না করলে প্রকল্প সফল হবে না।
চীন, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের বড় শহরগুলো ইতিমধ্যে এই মডেল বাস্তবায়ন করেছে। সেখানে সরকার ও বেসরকারি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে ভূগর্ভস্থ নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হয়েছে, যাতে প্রতিটি সংস্থা নির্দিষ্ট চ্যানেল ব্যবহার করে।
ঝুলন্ত তারের জট শুধু একটি প্রযুক্তিগত বা সৌন্দর্যগত সমস্যা নয়—এটি ঢাকা শহরের দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার প্রতিচ্ছবি। প্রতিবছর বৃষ্টির সময় মানুষ মারা যাচ্ছে, ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, আর শহরের চেহারা ক্রমেই কুৎসিত হয়ে উঠছে।
যদি এখনই উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তবে আগামী প্রজন্মের জন্য ঢাকা হয়ে উঠবে আরও বিপজ্জনক ও বসবাসের অনুপযুক্ত।
সময় এসেছে, নগর কর্তৃপক্ষ, বিদ্যুৎ সংস্থা ও বেসরকারি অপারেটর সবাইকে একসঙ্গে বসে পরিকল্পনা করার—যাতে আকাশে ঝুলে না থাকে মৃত্যু ও বিশৃঙ্খলার এই জাল, বরং দৃশ্যমান হয় এক সুন্দর, নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল ঢাকা। মাহফুজুর রহমান