অতীতের বদনাম আর গায়ে লাগাতে চায় না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী লীগ টানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতা ধরে রাখে বিতর্কিত তিনটি নির্বাচনের মাধ্যমে। ‘ভোটারবিহীন’, ‘রাতের ভোট’ ও ‘আমি-ডামি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সেই তিনটি নির্বাচন জাতির জন্য কলঙ্ক বয়ে আনে। তিনটি নির্বাচনই অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে যখন ত্রয়োদশ নির্বাচনের ডামাডোল বাজছে তখন স্বাভাবিকভাবে সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন বড় করে সামনে আসছে।
তবে ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। বিগত বিতর্কিত তিনটি নির্বাচনের ‘কলঙ্ক’ ঘোচাতে তারা আগামী নির্বাচনটি সুষ্ঠু করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে তাদের সেই অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা।
গতকাল সোমবার (২০ অক্টোবর) নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন কমিশনের। সেখানে আগামী নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু ও সুন্দর করা যায় সে ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
বৈঠকে অংশ নেওয়া ইসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা মেইলকে জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা বিতর্কিত তিন নির্বাচন নিয়ে তাদের যে ভূমিকা ছিল, তা আর নতুন করে আলোচনায় আনতে চাননি। তারা নিজেদের পুরো সক্ষমতা দিয়ে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করবেন বলে জানিয়েছেন। বৈঠকে তারা জানিয়েছেন, আগে তাদের সক্ষমতা থাকলেও সেটা তারা প্রয়োগ করেননি। এখন দেশের স্বার্থে বিগত সবকিছু ভুলে নিজেদের সঠিক দায়িত্ব পালনে পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করতে চান। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা করা প্রয়োজন তা তারা করতে রাজি।
বৈঠক সূত্র আরও জানিয়েছে, নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ কালো টাকার প্রভাব ও এআইয়ের অপব্যবহার রোধে বিভিন্ন বাহিনীকে স্ব স্ব সেলের মাধ্যমে কাজ করার জন্য বলেছেন।
অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্যে সিইসি সন্তুষ্ট হয়ে বলেছেন, এসব বাহিনীর ওপর কমিশন কোনো কিছু চাপিয়ে দেবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বাহিনীর যা করা দরকার তাই করবে। যেখানে যত ফোর্স প্রয়োজন হবে সেটাই অনুমোদন দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বৈঠক সূত্র।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ইসির বৈঠক। ছবি: সংগৃহীত
সূত্র আরও জানিয়েছে, বৈঠকে গণভোটের প্রস্তুতি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। শুধু সংসদ নির্বাচনকে সামনে কী কী ধরনের চ্যালেজ্ঞ মোকাবিলা করতে হবে এবং এগুলো কীভাবে সমাধান করা হবে তা আলোচনা হয়েছে।
বৈঠক শেষে ইসি সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, আজকে সূচনা হলো আলোচনার। কনক্লুসিভ কোনো কিছু না। এটা ধারাবাহিকভাবে আরও আগাবে। আরেকটা বড় জিনিস আছে যেটা বাজেট। প্রত্যেকটা অর্গানাইজেশন, প্রত্যেকটা ইউনিটে একটা বাজেট, তাদের খরচ আছে। সেটা আমাদের দেবেন। আমরা ইলেকশন বাজেটের সাথে যেটা সম্পর্কিত সেটা করব।
নির্বাচন নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনই কোনো ঝুঁকি দেখছে না জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের সময়সীমাটা আমাদের হচ্ছে- তফসিল ঘোষণা থেকে গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত। আমাদের আলোচনার পরিধিটা এটুকু ছিল। বাকিটুকু নিয়ে আমাদের আলোচনার এই মুহূর্তে সুযোগ নেই। আমি তাদের ভেতরে উদ্বেগ দেখিনি বরং এটা দেখেছি যে, একটা ভালো ইলেকশন করার মতো পরিবেশ আছে, সে ব্যাপারে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অবশ্যই নির্বাচন করার মতো পরিবেশ আছে এবং সেটা আরও সংহত করার জন্যই আলোচনা হয়েছে।
ভোটে তিন পর্যায়ে কাজ করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ মূলত তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছে নির্বাচন কমিশন। সেগুলো হলো তফসিল ঘোষণার আগে, ভোটের সময় এবং ভোটের পরে।

তিন নির্বাচনে মুখ্য ভূমিকায় ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ছবি: সংগৃহীত
তফসিল ঘোষণার আগের কাজের মধ্যে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির জন্য চিহ্নিত অপরাধী ও সন্ত্রাসী এবং নির্বাচনে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে এমন দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও এর অন্তর্ভুক্ত।
তফসিল ঘোষণা থেকে নির্বাচন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে- অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা। সব প্রার্থী যাতে বিধিসম্মতভাবে প্রচার চালাতে পারেন এবং ভোটাররা যেন নির্ভয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন—তা নিশ্চিত করা।
নির্বাচনি এলাকায় সন্দেহভাজন বা বহিরাগত অনুপ্রবেশ রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্ব পালন। ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা ও সামগ্রিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশ, আনসার ও গ্রাম পুলিশ মোতায়েন।
এছাড়া রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার, জুডিসিয়াল ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে মোবাইল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, আমর্ড পুলিশ, ব্যাটালিয়ন আনসার, কোস্টগার্ড এবং ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল ক্ষমতাসহ সশস্ত্র বাহিনীর দায়িত্ব পালন।
নির্বাচন পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে- নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতা রোধে ভোটের পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় মোবাইল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েন। এ সময় আইনগত নির্দেশনা প্রদানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করে। পাশাপাশি জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও ইলেক্ট্রোরাল ইনকোয়ারি কমিটির সংক্ষিপ্ত বিচার কার্যক্রম পরিচালনা।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সংখ্যা উল্লেখ করে ইসি সচিব বলেন, স্বরাষ্ট্র সচিব বলেছেন-দেড় লাখ পুলিশ থাকবে এবং আনাসর থেকে সবচেয়ে বেশি জনবল আসবে। বডি ক্যামেরা ও ড্রোন থাকবে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সব বাহিনীর প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন সবার লক্ষ্য।

অতীতের বদনাম ঘোচাতে চায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ছবি: ঢাকা মেইল
বৈঠকে অন্য নির্বাচন কমিশনার ও ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি, পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম, সেনাবাহিনী প্রধানের প্রতিনিধি লেফট্যানেন্ট জেনারেল মিজানুর রহমান শামীম, বিমান বাহিনীর প্রধানের প্রতিনিধি এয়ার ভাইস মার্শাল রুশাদ দিন আসাদ, নৌবাহিনী প্রধানের প্রতিনিধি রিয়ার অ্যাডমিরাল মীর এরশাদ আলী, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এসএম কামরুল হাসান, এনএসআইর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবু মোহাম্মদ সরোয়ার ফরিদ, ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম, বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, আনসার ভিডিপি অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আব্দুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ, কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল মো. জিয়াউল হক, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল কাইয়ুম মোল্লা, র্যাবের মহাপরিচালক একেএ মশহিদুর রহমান, এসবির অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (প্রশাসন ও অর্থ) জিএম আজিজুর রহমান এবং সিআইডির অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. ছিবগাত উল্ল্যাহ অংশ নিয়েছিলেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়ে যান। বিএনপিসহ প্রধান দলগুলোর বর্জন করা সেই সংসদ ‘বিনা ভোটের সংসদ’ হিসেবে আখ্যা পায়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দল অংশ নিলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। বেশির ভাগ স্থানে ভোট আগের রাতে হয়ে যাওয়ায় সেটি ‘রাতের ভোট’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল বর্জন করে। সেই নির্বাচনে একচেটিয়া জয় পায় আওয়ামী লীগ। তবে সেই নির্বাচন ‘আমি ও ডামি’ নির্বাচিন হিসেবে পরিচিতি পায়। মো. মেহেদী হাসান হাসিব