ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শেখ মোহাম্মদ সাজ্জাত আলী
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা হবে বৃহস্পতিবার। গত ২৩ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে বিষয়টি জানানোর পর ঢাকাসহ দেশের কিছু জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে জনমনে কিছুটা উদ্বেগ দেখা দিলেও নগরবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শেখ মোহাম্মদ সাজ্জাত আলী। তিনি বলেছেন, ‘১৩ নভেম্বরের ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ দল আওয়ামী লীগ বড় ঘটনা ঘটাতে পারবে না।’
নগরবাসীকে আশ্বস্ত করে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘আমি আমার পক্ষ থেকে নগরবাসীর জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছি। কর্মকর্তারা মাঠে কাজ করছেন। নগরবাসীর উদ্দেশে একটাই কথা, অনুরোধ করব তারাও যেন আমাদের সঙ্গে থাকেন। যত বিপদই আসুক, যেকোনো বিপদ মোকাবিলায় আমি নগরবাসীকে পাশে চাই।’
বুধবার ঢাকা মেইলকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে ডিএমপি কমিশনার এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগের ডাকা বৃহস্পতিবারের ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ডিএমপির সার্বিক পরিকল্পনা, ককটেল বিস্ফোরণ, বাসে অগ্নিসংযোগসহ নাশকতার বিষয় নিয়েও কথা বলেন শেখ সাজ্জাত আলী। ডিএমপি হেডকোয়ার্টারে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা মেইলের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক বোরহান উদ্দিন এবং নিজস্ব প্রতিবেদক একে সালমান।
ঢাকা মেইল: শেখ হাসিনার মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ দল আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন স্থানে নাশকতার ঘটনাও ঘটছে। এতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখছেন?
শেখ সাজ্জাত আলী: নগরবাসীকে বলব সেন্স অব সিকিউরিটি ডেভেলপড করার কথা। আমি নগরবাসীকে বলেছি আপনারা আশ্বস্ত থাকেন। আমরা মাঠে আছি। তাদের আমার সঙ্গে থাকার জন্য অনুরোধ করছি। স্বৈরাচার বিদায় নিয়েছে এদেশের মানুষ দ্বারা। বড় ধরনের কোনো ঘটনা নিষিদ্ধ ঘোষিত দল ঘটাতে পারবে না। আবারও নগরবাসীকে বলেছি আপনারা আশ্বস্ত থাকেন।
ঢাকা মেইল: আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সামাজিক মাধ্যমে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে। বিষয়টি আপনাদের নজরে আছে কি না?
শেখ সাজ্জাত আলী: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে আমরা বসবাস করছি। একটি শক্তিশালী বাংলাদেশের মিডিয়ার যুগে আমরা বাস করি। আমরা এটাকে প্রশংসাই করি। ডেমোক্রেসি (গণতন্ত্র) দুর্নীতি দমন, সুশাসন এই সবকিছুর জন্য শক্তিশালী গণমাধ্যম, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা আছে। কিছু খারাপ দিকও আছে। যেমন যেকোনো একটি পুরানো ঘটনা, এআই দিয়ে কাহিনী তৈরি করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে মানুষের মধ্যে কিছু লোকজন একটা আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এগুলো বাদে শক্তিশালী গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুবই প্রয়োজন।

বুধবার মিরপুরে দিনেদুপুরে বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা
‘আমি অনুরোধ করব যেকোনো কিছু ঘটলে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টার আছে, কন্ট্রোল রুম আছে ফোন করে যাতে যাচাই করে নেয়। এটা সত্য না মিথ্যা। আমরা কোনো মিথ্যাচার করি না। কোনো কিছু লুকাব না। আমরা পূর্বের পুলিশ না। যেটা সত্য আমরা সেটাই বলব।’
ঢাকা মেইল: যারা সহিংসতায় জড়িত তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। গ্রেফতারকৃতদের থেকে বড় ধরণের কোনো নাশকতার পরিকল্পনার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে কি?
শেখ সাজ্জাত আলী: না এমনটি আমার কাছে এখনো আসে নাই, মনেও হয় না। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও আমাকে এমন কিছু বলেনি। তবে মুশকিল হলো ঢাকার বাইরে থেকে আসা লোকজন এসব করছে। যারা ধরা পড়েছে অধিকাংশ ঢাকার বাইরে থেকে আসা। এসে এখানে তারা হোটেলেও হয়তো ওঠে না, যেখানে সেখানে সুযোগ পায় থাকে। ঘনবসতিপূর্ণ জায়গায় রাত্রিযাপন করে। অনেকে আবার ঢাকায় ঘটনা ঘটিয়ে নাইট কোচে চলে যাচ্ছে। এসব ঘটনায় জড়িত ৯৫ ভাগ লোক ঢাকার বাইরে থেকে আসছে। মফস্বল শহরে তো চেনা জানা, ওখানে কিছু করতে পারে না। এরা সবাই ঢাকার বাইরে থেকে আসে।
ঢাকা মেইল: পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার ঘটনার পর দ্রুতই জড়িতদের অস্ত্রসহ গ্রেফ্তার করা হয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে শীর্ষ সন্ত্রাসী, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীরা সক্রিয় হচ্ছে এমন গুঞ্জন আছে।
শেখ সাজ্জাত আলী: এদেশে তো নির্বাচন যখনই আসে তখনই অবৈধ অস্ত্র ঢোকানোর চেষ্টা করে দুষ্কৃতিকারীরা। আন্ডারওয়ার্ল্ডকেও অনেকে হাতে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে লাভ হয় বলে মনে হয় না। এবারও হয়তো সেই চেষ্টা চলছে, ব্যতিক্রম নয়। তবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোকজন কিছু করতে সামর্থ্য হবে এমন অবস্থা আছে বলে আমি মনে করি না।
ঢাকা মেইল: নির্বাচন ঘিরে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার, অস্ত্র উদ্ধারে নামবেন কি না?
শেখ সাজ্জাত আলী: আমাদের এমন পরিকল্পনা অব্যাহত আছে। ন্যাশনাল মেডিকেলের সামনে হত্যাকাণ্ডের পরপরই জড়িতদের দ্রুত অস্ত্রসহ গ্রেফতারের পরও যদি পুলিশ প্রশংসিত না হয় তাহলে পুলিশ কাজ করবে কীভাবে? এর চেয়ে প্রশংসিত কাজ আর হতে পারে? ঢাকায় এই ঘটনার পরে সেই কোথায় গিয়ে অস্ত্রসহ এত দ্রুত গ্রেফতার করা হলো, এর চেয়ে আর কি চান পুলিশের কাছ থেকে? যেটা একটা ভঙ্গুর বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। সেই পুলিশ এই কাজ করেছে। আরও অনেক কাজ করেছি আমরা। মৌচাকের ফরচুন মার্কেটের বোরকা পরে সোনার দোকানে চুরির ঘটনায় ২৫০ ভরি সোনা উদ্ধার করা হয়েছে। আরও অনেক ঘটনা আছে।

রাজধানীতে ১২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে
ঢাকা মেইল: চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ার করার নির্দেশনা দিয়েছেন। সন্ত্রাসীদের বিষয়ে ডিএমপির নির্দেশনা কী?
শেখ সাজ্জাত আলী: আমি চট্টগ্রামের ঘটনা মিডিয়াতে দেখেছি। আমি ঠিক এইভাবে বলতে চাই না। আমি তাকেই গুলি করতে চাই যে ককটেল মারে, গুলি করে, গ্রেনেড মারে, পেট্রোল বোমা মারে। আমার লোকজনদের বলেছি, যারা ককটেল মারে, পেট্রোল বোমা মারে তাদের বিষয়ে তোমরা ঝুঁকি নেবে না। তাদের বিরুদ্ধে তোমার যে অস্ত্র আছে সেটা ব্যবহার করবে। কারণ একপক্ষ গুলি করবে, ককটেল মারবে, গ্রেনেড মারবে আর আমরা দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে বসে থাকব সেটাও হবে না। সেটা ঠিকও না। আমরা সাধারণ মানুষের মিছিল, মিটিং এসব জায়গায় মারণাস্ত্র ব্যবহার করবে না। গত একবছরে ব্যবহার করি নাই। দুই হাজারের মতো আন্দোলন কর্মসূচি মোকাবেলা করেছি।
‘শিক্ষকদের আন্দোলনে আমাদের সদস্যরা পানি মেরেছিল। পরে একজন শিক্ষক বলেছিলেন যে, তারা পুলিশের ছেলেমেয়ে পড়াবেন না। আমি বলতে চাই আপনারা না পড়ালেও আমরা নিজেরা তার (শিক্ষকের) ছেলেমেয়েকে পাহারা দেব। রাত জেগে আমরা ওই শিক্ষকের বাড়িতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব।’
ঢাকা মেইল: নির্বাচনকে ঘিরে সার্বিক পরিস্থিতিতে ডিএমপি আগের চেয়ে নিরাপত্তা জোরদার করছে কি না?
শেখ সাজ্জাত আলী: আমরা তো ইতোমধ্যে ১৩ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে মাঠে বিজিবি নামিয়েছি, সঙ্গে সেনাবাহিনীও আছে। তাদের অনুরোধ করার পর মাঠে আছে। সঙ্গে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট দিয়ে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং এটা চলবে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভিন্ন কিছু পরিকল্পনা হবে।
ঢাকা মেইল: ঢাকায় ভাড়াটিয়াদের জন্য ফরম পূরণ করে ভাড়া দেওয়ার বিষয়টি এখন অনেকটা শিথিল হয়ে গেছে। এরমধ্যে নাশকতার ঘটনা ঘটছে, সামনে নির্বাচন। এ অবস্থায় ভাড়াটিয়াদের জন্য ফরম পূরণের কাজ আবারও জোরদার করার চিন্তা আছে কি না?
শেখ সাজ্জাত আলী: এটা চলমান আছে। তবে দুদিন আগে আবারও চালু করেছি। এটা অব্যাহত থাকবে।
ঢাকা মেইল: সার্বিক পরিস্থিতিতে নগরবাসীর উদ্দেশে ডিএমপি কমিশনার হিসেবে কী বলতে চান?
শেখ সাজ্জাত আলী: ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ নগরবাসীরই পুলিশ। আমরা তাদের নিরাপত্তার জন্য কাজ করছি। অক্লান্ত পরিশ্রম করছি এবং এখন পর্যন্ত ছোটখাটো নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। ককটেল বিস্ফোরণ, বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ককটেল খুব বেশি না। আমি আমার পক্ষ থেকে নগরবাসীর জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছি। কর্মকর্তারা মাঠে কাজ করছেন। নগরবাসীর উদ্দেশে একটাই কথা, অনুরোধ তারাও যেন আমাদের সঙ্গে থাকেন। যত বিপদই আসুক, যেকোনো বিপদ মোকাবিলায় আমি নগরবাসীকে পাশে চাই। বোরহান উদ্দিন ও একে সালমান, ঢাকা মেইল