
[শার্ল বোদলেয়ার (১৮২১-১৮৬২)(Charles Pierre Baudelaire) ছিলেন ফ্রান্সের প্রথম বিশ্ব কবি। মাত্র ৪৬ বছর বয়সে তার জীবনাবসান হয়। এই স্বল্পসময়েই তিনি কবিতার আঙ্গিকে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। তিনি ছিলেন ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম অনুবাদক, সমালোচক ও কবি। তার কাব্যগ্রন্থ les flour du mal (The Flower of Evil) বিশ্ব সাহিত্যে আজও আদৃত ও পঠিত। তিনি যখন লিখছিলেন তখন দু’টি মহাযুদ্ধ হয়ে গেছে, আর ইয়োরোপজুড়ে চলছিল প্লেগ, হারিয়ে গিয়েছিল রেনেসাঁ যুগের নৈতিকতা। তিনি অনুভব করলেন কবিতায় আঙ্গিকগত পরিবর্তনের। তাই তিনি জন্ম দিলেন এক আধুনিক নির্মাণশৈলীর। শাণিত করলেন প্রতীকবাদ। তিনি মনে করতেন মানুষের চরিত্র যুগপৎ ঈশ্বর ও শয়তানের সমন্বয়। ফ্রান্সে তার সমাধিস্থলে আজও ভিড় করে অজস্র কবি, কাব্যপেমিক ও ভ্রমণপিপাসুরা। -উত্তরাধুনিক]
অনুবাদ: বুদ্ধদেব বসু
লাল চুলের ভিখিরি মেয়েকে –
লাল চুলের, ফর্সা, একমুঠো
বালিকা, তোর ঘাঘরা – ভরা ফুটো
দেখায় তোকে অকিঞ্চন অতি
এবং রূপবতী ।
স্বাস্থ্যহীন তরুণ তনু তোর
ছুলির দাগে চোখে লাগায় ঘোর,
আমাকে দেয় মধুরতার ছবি –
আমি গরিব কবি ।
কাঠের জুতোর গরবে তোর, মানি,
লজ্জা পায় উপন্যাসের রানী ;
চলুন তিনি কিংখাবের জুতোয় ; –
ভঙ্গি তোকে জিতোয় ।
ন্যাকড়া – কানি ঢাকে না তোর লাজ ;
তার বদলে দরবারি এক সাজ
নিস্বনিত লম্বা ভাঁজে – ভাঁজে
পড়ুক পায়ের খাঁজে ;
রন্ধ্রময়, ছিন্ন মোজা জোড়া,
তার বদলে সোনার এক ছোরা
জঙ্ঘা তোর যেন মোহন রেখায়
লম্পটেরে দেখায়;
হালকা গেরো উন্মোচন করুক
দুটি চোখের মতো রে তোর বুক
দীপ্তিময় – লাবণ্যের চাপে
আমরা জ্বলি পাপে;
নির্বাসনের সময় বাহুযুগল
যেন অনেক আরজিতে হয় উতল,
ফিরিয়ে দিতে না যেন হয় ভুল
দুর্জনের আঙুল,
যত সনেট লিখে গেছেন বেলো,
বাছাই – করা মুক্তো ঝলোমলো,
বান্দারা তোর বন্দনাতে দান
দিক না অফুরান,
হতচ্ছাড়া কবির দল, খাতায়
নামটি তোর লিখুক প্রথম পাতায়,
কুড়িয়ে নিতে খুঁজুক ছলছুতো
সিঁড়ির চটিজুতো ;-
চটি তো নয়, কোমল এক নীড়,
তার লোভে যে বেয়ারাগুলোর ভিড়,
আড়ি পাতেন ওমরাহেরা নাচার,
এবং অনেক রঁসার !
ফুলের চেয়ে আরো অনেক বেশি
শয্যা তোর চুমোয় মেশামেশি,
তোর ক্ষমতার বিপুল পরিমানে
ভালোয়া হার মানে !
অবশ্য তুই এখন ভিখারিনী
ঐ যেখানে চলছে বিকিকিনি,
হাত বাড়িয়ে দাঁড়াস চৌকাঠে
সস্তা মালের হাটে ;
আহা রে তোর চক্ষু ভরে জ্বালায়
চোদ্দ আনা দামের মোতির মালায়,
সেটাও তোকে – মাপ করো গো মিতে –
পারি না আজ দিতে ।
তাহলে তুই এমনি চলে যা রে,
বিনা সাজে, গন্ধে, অলংকারে,
শীর্ণ দেহে নগ্নতাই শুধু
সাজাক তোকে বঁধু !
আশ্চর্য মেঘদল
বলো আমাকে , রহস্যময় মানুষ, কাকে তুমি সবচেয়ে বেশী ভালবাস:
তোমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা অথবা ভগ্নীকে?
তোমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগ্নী–কিছুই নেই আমার।
তোমার বন্ধরা?
ঐ শব্দের অর্থ আমি কখনো জানিনি।
তোমার দেশ?
জানিনা কোন দ্রাঘিমায় তার অবস্থান।
সৌন্দর্য?
পারতাম বটে তাকে ভালবাসতে– দেবী তিনি, অমরা।
কাঞ্চন?
ঘৃণা করি কাঞ্চন, যেমন তোমরা ঘৃণা করো ভগবানকে।
বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কি ভালবাসো তুমি?
আমি ভালবাসি মেঘ…চলিঞ্চু মেঘ…ঐ উচুতে….ঐ উচুতে….
আমি ভালবাসি আশ্চর্য মেঘদল!
বিতৃষ্ণা
আমি যেন রাজা, যার সারা দেশ বৃষ্টিতে মলিন,
ধনবান, নষ্টশক্তি, যুবা, তবু অতীব প্রবীণ,
শিক্ষকের নমস্কার প্রত্যেহ যে দূরে ঠেলে রেখে
শিকারি কুকুর নিয়ে ক্লান্ত করে নিজেই নিজেকেই
কিছুই দেয় না সুখ-না মৃগয়া, না শ্যেনচালন,
না তার অলিন্দতলে মৃতপায় তারই প্রজাগণ!
মনঃপূত বিদূষক প্রহসনে যত গান গাঁথে
আনত ললাট থেকে রোগচ্ছায়া পারে না সরাতে;
ফুলচিহ্ন আঁকা তার শয্যা, তাও নেয় রুপান্তর
কবরে, এবং যার সাধনায় রাজারা সুন্দর,
জানে না সে-মেয়েরাও, লজ্জাহীন কোন প্রসাধনে
আমোদ ফোটানো যায় এ-তরুণ কঙ্কালের মনে।
করেন কাঞ্চনসৃষ্টি, সে-মুনিরও মেলেনি সন্ধান
কোন বিষময় দ্রব্যে অহোরাত্রি নষ্ট তার প্রাণ।
এমন কী রক্তস্নান, লিপ্ত যাতে সব ইতিহাস,
পুরাতনী রোমকের, অর্বাচীন দস্যুর বিলাস,
তাও এই মূঢ় শবে তাপলেপ পারে না জোগাতে,
লিথির সবুজ স্রোত-রক্ত নয়-বহে যে শিরাতে।
অ্যালবাট্রস
মাঝে মাঝে, সকৌতুকে, নাবিকেরা তাকে ধরে ফেলে ।
বিশাল আলবাট্রস, সমুদ্রের বিহঙ্গপুঙ্গব,
তিক্ত ফেনা পেরিয়ে যে চলে আসে মৃদুমন্দ তালে,
জাহাজের সহযাত্রী, সঙ্গদাতা, পথের বান্ধব ।
যে-মুহূর্তে ওরা তাকে ধরে এনে রাখে পাটাতনে,
লজ্জায় বিকল এই নীলিমার সম্রাট তখনই
বিরাট, করুন,শুভ্র ডানা তার, ক্ষুব্ধ নিপাতনে
নাড়ে, যেন দাঁড়-ভাঙ্গা, অসহায়, সন্ত্রস্ত তরণী ।
এই সে-আকাশযাত্রী, কত রূপ ছিল সম্প্রতি ও!
অপ্রতিভ কুশ্রীতায় প্রহসন-পুত্তলি এখন !
কারো বা খুড়িয়ে-চলা বিদ্রূপে সে অনুকরণীয়,
অথবা হুকোর নল চঞ্চুপুটে দেয় কন্ডুয়ন !
মেঘলোকে যুবরাজ ! এইমতো, কবিও হেলায়
তুফানে ঝাপট দেয়, ব্যর্থ করে কিরাতের ফলা ;
কিন্তু এই মৃত্তিকার নির্বাসনে, উল্লোল মেলায়
মহান ডানার ভারে অবরুদ্ধ হয় তার চলা ।