১১:১৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

আজ কিংবদন্তি কন্ঠশিল্পী বশির আহমেদ-এর প্রয়াণ দিবস

  • আপডেট সময়: ১১:২৮:১৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫
  • 50

উত্তরাধুনিক ডেস্ক: বর্ণাঢ্য ও কর্মময় জীবনের এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি কিংবদন্তি কন্ঠশল্পিী বশির আহমেদ। তিনি যেখানেই বিচরণ করছেনে, সোনা ফলেছে সেখানে।

আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৪ সালরে  ১৯ এপ্রিল তিনি পরলোকগমন করেন।

এই গুণী শিল্পী ১৯৫৬ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে বাংলাদেশেরই আরেক কৃতী সন্তান শ্রীমতী গীতা দত্তের সঙ্গে বোম্বের (মুম্বাই) একটি ছবিতে কন্ঠ দেন। সেইসময় হিজ মাস্টার্স ভয়েস তার রেকর্ড বের করে।

তারপর ঢাকায় এসে তালাত মাহমুদের পাশাপাশি গজল পরিবেশন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন বশির আহমেদ। এই গজল অনুষ্ঠানে বশির আহমেদ কন্ঠটা এমন করে উপস্থাপন করলেন যে, শ্রোতা ও আয়োজকরা রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। যেন একই মঞ্চে দুই তালাত মাহমুদ!

‘তালাশ’  ছবির সাফল্যের পর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ, এর ভাষা ও সংস্কৃতি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলো। লাহোর, তথা পাকিস্তানের বিপুল সাফল্য, নেপালের পাহাড়ি ইশারা, জন্মভূমি ভারত–সবকিছু ফেলে তিনি স্থায়ীভাবে বসত করলেন ঢাকায়। উর্দু সাহিত্যে এমএ ডিগ্রিপ্রাপ্ত বশির আহমেদ বাংলা ভাষায় অসংখ্য গান গাইলেন। এমনকি বাংলায় গানও নিজে রচনা করেছেন বিএ দীপ ছদ্মনামে।

১৯৩৯ সালের ১৮ নভেম্বর কলকাতার খিদিরপুরে জন্মগ্রহণ করেন বশির আহমেদ। তার বাবার নাম নাসির আহমেদ। তার সংগীত শিক্ষা শুরু হয় ওস্তাদ বেলায়েত হোসেন খাঁ’র কাছে। পরে তিনি সংগীত শিক্ষা গ্রহণ করেন কিংবদন্তি গায়ক ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ’র কাছে।

গানের, সুরের জাদুকর বশির আহমেদ

কিংবদন্তি কন্ঠশিল্পী বশির আহমেদের দর্শন, অনুভব ও পাথেয়র সাথে কথাগুলো মিলে যায় দৈবক্রমে। গাছের শাখা-প্রশাখা নড়ে, পাতা নড়ে কিন্তু শেকড় নড়ে না। বশির আহমেদ একইভাবে দশকের পর দশক জুড়ে একই শেকড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বটবৃক্ষের মতো। তিনি ইহজগতে বিচরণ করেছেন তার নিজস্ব দর্শন, ধ্যান ও জ্ঞানে। কোনো শক্তি তাকে টলাতে পারেনি তার মস্তিষ্কে পূর্ব নির্ধারিত অসাধারণ শিল্পশৈলী থেকে।

“It is in the roots, not the branches, that a tree’s greatest strength lies. If you know where you are from, it is harder for people to stop you where you are going. A tree’s beauty lies in its branches, but its strength lies in its roots.”

কথাটা বলেছেন মাতশোনা ধলিওয়ায়ো ((Matshona Dhliwayo), যিনি ক্যানেডা-ভিত্তিক লেখক, উদ্যোক্তা ও দার্শনিক, এবং `The Art of Winning’ গ্রন্থের প্রণেতা।

বশির আহমেদের জীবনযাপন, তার করোটি নিঃসৃত ভাবনা, সৃষ্টির তাগাদা আর একাত্মতার সাথে উপর্যুক্ত কথাগুলোর সাযূজ্য আমাদেরকে রীতিমতো ভাবনায় ফেলে দেয়। ‘গ্রেট মেন থিংক অ্যালাইক’ কথাটা এখানে সার্বিক অর্থে প্রযোজ্য।

বশির আহমেদ সারাজীবন সংগীতে মগ্ন থেকেছেন ধ্যানরত সাধুর মতো। তার মধ্যে সেন্স অব হিউমার ছিলো অসাধারণ। একইসাথে তিনি ছিলেন সফল স্বামী ও পিতা। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও তিনি ছিলেন সংসারী–স্নেহবৎসল পিতা ও স্ত্রী অনুরাগী। জীবনের বিভিন্ন স্তরের সাফল্যের মধ্যে যে দুটিতে সাফল্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেই দুই জায়গাতেই তিনি ছিলেন সফলতম ব্যক্তি। ঘর-সংসার ও সাধনা নিয়েই তিনি আজীবন তার উর্বর সময়টাকে সযত্নে লালিত করে গেছেন।

নায়োকোচিত চেহারা, ব্যক্তিত্ব, স্বল্পভাষী ও পাণ্ডিত্য সহজেই অন্যান্য ব্যক্তিত্ব, এমনকি সমসাময়িক অনেক গায়কদের থেকে তাকে নিমিষেই চিনিয়ে দিতো তিনি বশির আহমেদ। তিনি রাগী স্বভাবের–এটা অনেকের চোখে পড়তো, কিন্তু ভেতরে যে তার কোমলতা ও পাহাড়সমান মানবতা লুকিয়ে ছিলো–এটা সহজে কারোর চোখে পড়তো না!

আজকালের মানুষের ভাসা ভাসা পর্যবেক্ষণ কী করে এতো বড়ো মাপের শিল্পীকে বুঝবেন; এতো সময় কোথায়। সময়টাই যে জীবনে সাফল্যের চাবিকাঠি, আমরা সেটা ভুলেই গেছি এই যুগে এসে। দৌড়ে এসে হারমোনিয়ামের রিডে গান তুলে যেনতেন সুর দিয়ে রাতারাতি একটা সংগীত তৈরি করে ফেলা এখন সময় বাঁচানো আর শতশত গান বানানোর মুখ্যমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বশির আহমেদ একটা গান তৈরি করতে বা গাইতে সময় নিতেন। তাতে একদিনের জায়গায় হয়তো সাতদিন লাগবে, গান টা তো চিরস্থায়ী হতে পারে। আমরা জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দিই ঘুম, খাওয়া ও টিকটক-ইন্টারনেট-মুঠোফোন ব্যবহার করে। তাহলে একদিনের একটা ক্ষণস্থায়ী গান তৈরির চেয়ে সাতদিনে একটি চিরস্থায়ী গান করা কি ভালো নয়?

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে–এমনকি বাংলাদেশের ষাট সত্তর আর আশির দশকের শেষদিক পর্যন্ত গায়ক গায়িকারা গান গাইতে সময় নিতেন। গীতিকার উৎকৃষ্ট লিরিক তৈরি করতেন, সুরকার সময় নিয়ে হারমোনিয়ামে সুর তুলতেন আর সেইসময়ের বাঘা বাঘা শিল্পীরা সময় নিয়ে সেই গানের বাণী, সুর ও গায়কী আত্মস্থ করতেন। বশির আহমেদ সেই কাতারের প্রথমদিকের একজন সাধক। তাই আজও তার গান অমর, আর তিনি অবিনশ্বর।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে–এমনকি বাংলাদেশের ষাট সত্তর আর আশির দশকের শেষদিক পর্যন্ত গায়ক গায়িকারা গান গাইতে সময় নিতেন। গীতিকার উৎকৃষ্ট লিরিক তৈরি করতেন, সুরকার সময় নিয়ে হারমোনিয়ামে সুর তুলতেন আর সেইসময়ের বাঘা বাঘা শিল্পীরা সময় নিয়ে সেই গানের বাণী, সুর ও গায়কী আত্মস্থ করতেন। বশির আহমেদ সেই কাতারের প্রথমদিকের একজন সাধক। তাই আজও তার গান অমর, আর তিনি অবিনশ্বর।

মা মিনা বশির ও বাবা বশির আহমেদের সাথে পুত্র রাজা বশির ও কন্যা হুমায়রা বশির

তার সহধর্মিণী মিনা বশির বাংলাদেশের সোনালি দিনের গানের জগৎ মাতিয়ে রেখেছিলেন তার মিঠে কন্ঠ দিয়ে। তিনিও পাড়ি দেন পরপারে তার স্বামী’র প্রয়াণের পর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে। বশির আহমেদ ও মিনা বশির অনেক জনপ্রিয় দ্বৈত গানের স্রষ্টা। সেসবের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় গান ‘ওগো প্রিয়মতমা, ওরা জানতে চেয়েছে’, ‘সবাই আমায় প্রেমিক বলে’, পাহাড়-নদী, ঝরনাধারা.’ –এসব গান বেতার ও টিভিতে প্রচারিত হতো নিয়মিত।

পরবর্তীতে এসবের কয়েকটি গান, আর ময়নামতি ছায়াছবির গান, ‘অনেক সাধের ময়না আমার’ ‘আমাকে পোড়াতে যদি এতো লাগে ভালো’ এবং আপনপর ছবিতে বশির আহমেদের সুপার হিট গান ‘যা রে, যাবি যদি যা’ প্রভৃতি গেয়ে এই কিংবদন্তি শিল্পী দম্পতির বড় কন্যা হুমায়রা বশির ও ছোটো ছেলে রাজা বশির দারুণভাবে গেয়ে শ্রোতাদের মনে ঠাঁই করে নেন।


https://www.youtube.com/watch?v=M5QvvehUhII


https://www.youtube.com/watch?v=GN-nbsnpuU8


এইদেশে স্থায়িভাবে বসবাসের আগে লাহোর মাত করে আসেন এই কিংবদন্তি। তার গাওয়া অনেক উর্দু গান তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানিদের মুখে মুখে ফিরত। তেমনি একটি গান─‘তুমহারে লিয়ে ইস দিলমে যিতনি মোহাব্বত হ্যায়।’

উল্লেখ্য যে, উত্তরাধুনিক সম্পাদক বরেণ্য কথাশিল্পী, সংগীতশিল্পী ও পরিবেশবিদ হাসান জাহিদ কিংবদন্তি বশির আহমেদ-এর কাছে ক্লাসিক্যাল সংগীতে তালিম নিয়েছিলেন। তিনি এখনও গেয়ে যাচ্ছেন তার ওস্তাদজীর গান।

এই গানটি বশির আহমেদ গেয়েছিলেন শবনম-রহমান অভিনীত ‘দর্শন’ ছবিতে। আর ‘কারোয়ান’ ছবিতে গেয়েছিলেন─‘যব তুম একেলে হোগে হাম ইয়াদ আয়েঙ্গে।’

 

দর্শন ছবির গান-ইতনি মোহাব্বাদ কোন্ কারায়ে গা…

এছাড়া আরো বেশকিছু উর্দু ছবিতে গান গেয়েছিলেন তিনি। তৎকালিন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে যে গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, সেটি ‘তালাশ’ ছবিতে গাওয়া ‘কিছু আপনি শোনান, কিছু আমার শুনে যান।’

এই ছবিটি উর্দুতেও নির্মিত হয়েছিল আর গানটি ছিল ‘কুছ আপনি কহিয়ে, কুছ মেরে শুনিয়ে।’

তালাশ ছবির বিখ্যাত গান

বর্তমানে হুমায়রা বশির ও রাজা বশির মৌলিক গান করে তুঙ্গে আছেন। রাজা বশির অস্ট্রেলিয়াতে সংগীতের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সের জন্য নির্মিত সিনেমায় সংগীত পরিচালনা করছেন প্রয়াত কিংবদন্তী সংগীতশিল্পী বশির আহমেদের ছেলে রাজা বশির। সিনেমার নাম ‘সান সার্ফ অ্যান্ড স্যান্ড’।

বাবা’র প্রতিষ্ঠিত সারগাম সাউন্ড স্টেশন আধুনিকায়ন করেছেন তার দুই ছেলেমেয়ে। সেইসাথে গানের স্কুলও চালাচ্ছেন।

অনেক অনুষ্ঠান, লাইভ ও অনেক টিভি চ্যানেলে হুমায়রা বশির ও রাজা বশিরের গান লাইভে প্রচার হয়েছে এবং তা পূর্ণোদ্যমে চলমান।  ভাইবোনের দ্বৈত গান শোতা-দর্শক মনে-প্রাণে ধারণ করেছেন।

আজকের এই শোকাবহ আবহে ওস্তাদজী বশির আহমেদ ও তার স্ত্রী মিনা বশির আত্মার মাগফেরাত কামনা কর

উত্তরাধুনিক

Writer, Singer & Environmentalist

আজ কিংবদন্তি কন্ঠশিল্পী বশির আহমেদ-এর প্রয়াণ দিবস

আপডেট সময়: ১১:২৮:১৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

উত্তরাধুনিক ডেস্ক: বর্ণাঢ্য ও কর্মময় জীবনের এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি কিংবদন্তি কন্ঠশল্পিী বশির আহমেদ। তিনি যেখানেই বিচরণ করছেনে, সোনা ফলেছে সেখানে।

আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৪ সালরে  ১৯ এপ্রিল তিনি পরলোকগমন করেন।

এই গুণী শিল্পী ১৯৫৬ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে বাংলাদেশেরই আরেক কৃতী সন্তান শ্রীমতী গীতা দত্তের সঙ্গে বোম্বের (মুম্বাই) একটি ছবিতে কন্ঠ দেন। সেইসময় হিজ মাস্টার্স ভয়েস তার রেকর্ড বের করে।

তারপর ঢাকায় এসে তালাত মাহমুদের পাশাপাশি গজল পরিবেশন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন বশির আহমেদ। এই গজল অনুষ্ঠানে বশির আহমেদ কন্ঠটা এমন করে উপস্থাপন করলেন যে, শ্রোতা ও আয়োজকরা রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। যেন একই মঞ্চে দুই তালাত মাহমুদ!

‘তালাশ’  ছবির সাফল্যের পর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ, এর ভাষা ও সংস্কৃতি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলো। লাহোর, তথা পাকিস্তানের বিপুল সাফল্য, নেপালের পাহাড়ি ইশারা, জন্মভূমি ভারত–সবকিছু ফেলে তিনি স্থায়ীভাবে বসত করলেন ঢাকায়। উর্দু সাহিত্যে এমএ ডিগ্রিপ্রাপ্ত বশির আহমেদ বাংলা ভাষায় অসংখ্য গান গাইলেন। এমনকি বাংলায় গানও নিজে রচনা করেছেন বিএ দীপ ছদ্মনামে।

১৯৩৯ সালের ১৮ নভেম্বর কলকাতার খিদিরপুরে জন্মগ্রহণ করেন বশির আহমেদ। তার বাবার নাম নাসির আহমেদ। তার সংগীত শিক্ষা শুরু হয় ওস্তাদ বেলায়েত হোসেন খাঁ’র কাছে। পরে তিনি সংগীত শিক্ষা গ্রহণ করেন কিংবদন্তি গায়ক ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ’র কাছে।

গানের, সুরের জাদুকর বশির আহমেদ

কিংবদন্তি কন্ঠশিল্পী বশির আহমেদের দর্শন, অনুভব ও পাথেয়র সাথে কথাগুলো মিলে যায় দৈবক্রমে। গাছের শাখা-প্রশাখা নড়ে, পাতা নড়ে কিন্তু শেকড় নড়ে না। বশির আহমেদ একইভাবে দশকের পর দশক জুড়ে একই শেকড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বটবৃক্ষের মতো। তিনি ইহজগতে বিচরণ করেছেন তার নিজস্ব দর্শন, ধ্যান ও জ্ঞানে। কোনো শক্তি তাকে টলাতে পারেনি তার মস্তিষ্কে পূর্ব নির্ধারিত অসাধারণ শিল্পশৈলী থেকে।

“It is in the roots, not the branches, that a tree’s greatest strength lies. If you know where you are from, it is harder for people to stop you where you are going. A tree’s beauty lies in its branches, but its strength lies in its roots.”

কথাটা বলেছেন মাতশোনা ধলিওয়ায়ো ((Matshona Dhliwayo), যিনি ক্যানেডা-ভিত্তিক লেখক, উদ্যোক্তা ও দার্শনিক, এবং `The Art of Winning’ গ্রন্থের প্রণেতা।

বশির আহমেদের জীবনযাপন, তার করোটি নিঃসৃত ভাবনা, সৃষ্টির তাগাদা আর একাত্মতার সাথে উপর্যুক্ত কথাগুলোর সাযূজ্য আমাদেরকে রীতিমতো ভাবনায় ফেলে দেয়। ‘গ্রেট মেন থিংক অ্যালাইক’ কথাটা এখানে সার্বিক অর্থে প্রযোজ্য।

বশির আহমেদ সারাজীবন সংগীতে মগ্ন থেকেছেন ধ্যানরত সাধুর মতো। তার মধ্যে সেন্স অব হিউমার ছিলো অসাধারণ। একইসাথে তিনি ছিলেন সফল স্বামী ও পিতা। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও তিনি ছিলেন সংসারী–স্নেহবৎসল পিতা ও স্ত্রী অনুরাগী। জীবনের বিভিন্ন স্তরের সাফল্যের মধ্যে যে দুটিতে সাফল্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেই দুই জায়গাতেই তিনি ছিলেন সফলতম ব্যক্তি। ঘর-সংসার ও সাধনা নিয়েই তিনি আজীবন তার উর্বর সময়টাকে সযত্নে লালিত করে গেছেন।

নায়োকোচিত চেহারা, ব্যক্তিত্ব, স্বল্পভাষী ও পাণ্ডিত্য সহজেই অন্যান্য ব্যক্তিত্ব, এমনকি সমসাময়িক অনেক গায়কদের থেকে তাকে নিমিষেই চিনিয়ে দিতো তিনি বশির আহমেদ। তিনি রাগী স্বভাবের–এটা অনেকের চোখে পড়তো, কিন্তু ভেতরে যে তার কোমলতা ও পাহাড়সমান মানবতা লুকিয়ে ছিলো–এটা সহজে কারোর চোখে পড়তো না!

আজকালের মানুষের ভাসা ভাসা পর্যবেক্ষণ কী করে এতো বড়ো মাপের শিল্পীকে বুঝবেন; এতো সময় কোথায়। সময়টাই যে জীবনে সাফল্যের চাবিকাঠি, আমরা সেটা ভুলেই গেছি এই যুগে এসে। দৌড়ে এসে হারমোনিয়ামের রিডে গান তুলে যেনতেন সুর দিয়ে রাতারাতি একটা সংগীত তৈরি করে ফেলা এখন সময় বাঁচানো আর শতশত গান বানানোর মুখ্যমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বশির আহমেদ একটা গান তৈরি করতে বা গাইতে সময় নিতেন। তাতে একদিনের জায়গায় হয়তো সাতদিন লাগবে, গান টা তো চিরস্থায়ী হতে পারে। আমরা জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দিই ঘুম, খাওয়া ও টিকটক-ইন্টারনেট-মুঠোফোন ব্যবহার করে। তাহলে একদিনের একটা ক্ষণস্থায়ী গান তৈরির চেয়ে সাতদিনে একটি চিরস্থায়ী গান করা কি ভালো নয়?

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে–এমনকি বাংলাদেশের ষাট সত্তর আর আশির দশকের শেষদিক পর্যন্ত গায়ক গায়িকারা গান গাইতে সময় নিতেন। গীতিকার উৎকৃষ্ট লিরিক তৈরি করতেন, সুরকার সময় নিয়ে হারমোনিয়ামে সুর তুলতেন আর সেইসময়ের বাঘা বাঘা শিল্পীরা সময় নিয়ে সেই গানের বাণী, সুর ও গায়কী আত্মস্থ করতেন। বশির আহমেদ সেই কাতারের প্রথমদিকের একজন সাধক। তাই আজও তার গান অমর, আর তিনি অবিনশ্বর।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে–এমনকি বাংলাদেশের ষাট সত্তর আর আশির দশকের শেষদিক পর্যন্ত গায়ক গায়িকারা গান গাইতে সময় নিতেন। গীতিকার উৎকৃষ্ট লিরিক তৈরি করতেন, সুরকার সময় নিয়ে হারমোনিয়ামে সুর তুলতেন আর সেইসময়ের বাঘা বাঘা শিল্পীরা সময় নিয়ে সেই গানের বাণী, সুর ও গায়কী আত্মস্থ করতেন। বশির আহমেদ সেই কাতারের প্রথমদিকের একজন সাধক। তাই আজও তার গান অমর, আর তিনি অবিনশ্বর।

মা মিনা বশির ও বাবা বশির আহমেদের সাথে পুত্র রাজা বশির ও কন্যা হুমায়রা বশির

তার সহধর্মিণী মিনা বশির বাংলাদেশের সোনালি দিনের গানের জগৎ মাতিয়ে রেখেছিলেন তার মিঠে কন্ঠ দিয়ে। তিনিও পাড়ি দেন পরপারে তার স্বামী’র প্রয়াণের পর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে। বশির আহমেদ ও মিনা বশির অনেক জনপ্রিয় দ্বৈত গানের স্রষ্টা। সেসবের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় গান ‘ওগো প্রিয়মতমা, ওরা জানতে চেয়েছে’, ‘সবাই আমায় প্রেমিক বলে’, পাহাড়-নদী, ঝরনাধারা.’ –এসব গান বেতার ও টিভিতে প্রচারিত হতো নিয়মিত।

পরবর্তীতে এসবের কয়েকটি গান, আর ময়নামতি ছায়াছবির গান, ‘অনেক সাধের ময়না আমার’ ‘আমাকে পোড়াতে যদি এতো লাগে ভালো’ এবং আপনপর ছবিতে বশির আহমেদের সুপার হিট গান ‘যা রে, যাবি যদি যা’ প্রভৃতি গেয়ে এই কিংবদন্তি শিল্পী দম্পতির বড় কন্যা হুমায়রা বশির ও ছোটো ছেলে রাজা বশির দারুণভাবে গেয়ে শ্রোতাদের মনে ঠাঁই করে নেন।


https://www.youtube.com/watch?v=M5QvvehUhII


https://www.youtube.com/watch?v=GN-nbsnpuU8


এইদেশে স্থায়িভাবে বসবাসের আগে লাহোর মাত করে আসেন এই কিংবদন্তি। তার গাওয়া অনেক উর্দু গান তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানিদের মুখে মুখে ফিরত। তেমনি একটি গান─‘তুমহারে লিয়ে ইস দিলমে যিতনি মোহাব্বত হ্যায়।’

উল্লেখ্য যে, উত্তরাধুনিক সম্পাদক বরেণ্য কথাশিল্পী, সংগীতশিল্পী ও পরিবেশবিদ হাসান জাহিদ কিংবদন্তি বশির আহমেদ-এর কাছে ক্লাসিক্যাল সংগীতে তালিম নিয়েছিলেন। তিনি এখনও গেয়ে যাচ্ছেন তার ওস্তাদজীর গান।

এই গানটি বশির আহমেদ গেয়েছিলেন শবনম-রহমান অভিনীত ‘দর্শন’ ছবিতে। আর ‘কারোয়ান’ ছবিতে গেয়েছিলেন─‘যব তুম একেলে হোগে হাম ইয়াদ আয়েঙ্গে।’

 

দর্শন ছবির গান-ইতনি মোহাব্বাদ কোন্ কারায়ে গা…

এছাড়া আরো বেশকিছু উর্দু ছবিতে গান গেয়েছিলেন তিনি। তৎকালিন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে যে গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, সেটি ‘তালাশ’ ছবিতে গাওয়া ‘কিছু আপনি শোনান, কিছু আমার শুনে যান।’

এই ছবিটি উর্দুতেও নির্মিত হয়েছিল আর গানটি ছিল ‘কুছ আপনি কহিয়ে, কুছ মেরে শুনিয়ে।’

তালাশ ছবির বিখ্যাত গান

বর্তমানে হুমায়রা বশির ও রাজা বশির মৌলিক গান করে তুঙ্গে আছেন। রাজা বশির অস্ট্রেলিয়াতে সংগীতের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সের জন্য নির্মিত সিনেমায় সংগীত পরিচালনা করছেন প্রয়াত কিংবদন্তী সংগীতশিল্পী বশির আহমেদের ছেলে রাজা বশির। সিনেমার নাম ‘সান সার্ফ অ্যান্ড স্যান্ড’।

বাবা’র প্রতিষ্ঠিত সারগাম সাউন্ড স্টেশন আধুনিকায়ন করেছেন তার দুই ছেলেমেয়ে। সেইসাথে গানের স্কুলও চালাচ্ছেন।

অনেক অনুষ্ঠান, লাইভ ও অনেক টিভি চ্যানেলে হুমায়রা বশির ও রাজা বশিরের গান লাইভে প্রচার হয়েছে এবং তা পূর্ণোদ্যমে চলমান।  ভাইবোনের দ্বৈত গান শোতা-দর্শক মনে-প্রাণে ধারণ করেছেন।

আজকের এই শোকাবহ আবহে ওস্তাদজী বশির আহমেদ ও তার স্ত্রী মিনা বশির আত্মার মাগফেরাত কামনা কর