১২:০৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ জুন ২০২৫

আল মাহমুদের ছোটোগল্পে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দেশপ্রেম ও রাষ্ট্রনায়কসুলভ গুণাবলি

  • আপডেট সময়: ০৬:৪৯:০৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩১ মে ২০২৫
  • 28

তৃষিত জলধি

আল মাহমুদ

আমি একটা বসার জায়গা খুঁজছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম চিমনির ওপাশটায়। সেখানে গিয়েই মনে হল চিমনির ছায়ার অন্ধকারে কে একজন ছায়ামূর্তি বসে আছে। আমার পদশব্দে ছায়ামূর্তিও সচকিত হয়ে উঠলো, ‘কে?’

আমি একটু এগিয়ে জবাব দিতে চমকে উঠে দেখলাম মহামান্য প্রেসিডেন্ট স্রেফ সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরে একটা টুলের ওপর বসে আছেন। আমি বললাম, ‘স্যার এত রাতে আপনি এখানে একা?’

‘ও কবি! না ঠিক একা নই ছাদের নীচে তো অনেক মানুষ ঘুমাচ্ছে। শুধু দেখছি আপনি আর আমিই জেগে আছি। বসুন।’

‘আপনার নিরাপত্তা রক্ষীরা?’

‘তারাও সম্ভবত ঘুমিয়েছে। তা না হলে আমাকে এখানে আসতে দেখে আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকতো নিশ্চয়।

‘আপনার কি এভাবে একা বেরুনো উচিত?’

‘সম্ভবত নয়। সমুদ্রে চাঁদের খেলা দেখবো বলে এসেছি। আমার ঘুম পাচ্ছে না। আচ্ছা, আজ কি পূর্ণিমা?’

‘আগামীকাল কলা পূর্ণ হবে।’ জবাব দিলাম আমি।

‘বসুন কবি।’

মহামান্য প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয়বার আমাকে বসার হুকুম দিলেন। আমি আশেপাশে তার সান্নিধ্যে বসার একটা টুল খুঁজছিলাম। একটি মাত্র টুলে তিনি নিজেই বসে আছেন। আমি একটু ইতস্তত করে তার টুলটার পাশে ছাদেই বসে পড়লাম। তিনি আপত্তি করলেন না।

‘আপনার কি ঘুমের অসুখ?’

‘ইনসমনিয়া।’ জবাব দিলাম আমি।

‘কবিদের, ভাবুকদের একটু অনিদ্রা রোগ থাকা মন্দ নয়। এই চাঁদ, এই সমুদ্র আর সীমাহীন ঢেউয়ের ছলৎকার শোনার জন্য এক ধরনের মানুষ দরকার। কী বলেন?’

আমি বললাম, ‘মহামান্য প্রেসিডেন্টের কি ঢেউ গোণা’র বাতিক আছে ?’

‘না আমার কোনো অনিদ্রা রোগ নেই। আমার ঘুম খুব সাউন্ড। আজই শুধু ঘুম পাচ্ছে না। শারীরিক শ্রমের কমতি পড়লেই আমার ঘুমের ব্যাঘাত হয়।’ বললেন তিনি।

আমরা উভয়ই কতক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম।

আকাশে তখন মেঘের স্তরটা অন্তর্হিত হয়ে আকাশ-সমুদ্রব্যাপী জোছনার একটি দীপ্তি ফুটে উঠেছে।

‘আপনি সাগরকে নিয়ে কয়টা কবিতা লিখেছেন?’

অকস্মাৎ নীরবতা ভেঙে তিনি প্রশ্ন করলেন।

আমি চুপ করে রইলাম। মনে মনে ভাবলাম, আমার সমুদ্রের ওপর একটাও রচনা নেই, আশ্চর্য!

‘একটাও লেখেননি, তাই না’

আমি লা-জবাব হয়ে থাকলাম।

‘অথচ সমুদ্র হলো অর্ধেকটা বাংলাদেশ। সমুদ্র না থাকলে আমাদের জীবন অর্থহীন হতো। এই সাগরের অভিজ্ঞতা নেই আমাদের একালের কবিদের। কী বেদনাদায়ক!

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘কাজী সাহেব লিখেছেন। ‘হে সিন্ধু বন্ধু মোর ….।’

‘নজরুল সমুদ্রকে বুঝতেন বলেই তার জীবন ছিল উত্তাল। নির্ভীকতা ছাড়া বড় হওয়া যায় না। আপনি নদীর ওপর অজস্র লিখেছেন। আমি পড়েছি। চমৎকার অন্তর্দৃষ্টি আপনার। এখন সমুদ্রের দিকে তাকাতে হবে। সমুদ্রই মানবহৃদয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়ে দেয়।’

বেশ উদ্দীপিতভাবে প্রেসিডেন্ট কথা বলছেন দেখে আমি বললাম, ‘কিন্তু আমার তো সমুদ্রের কোনো অভিজ্ঞতা কিংবা সমুদ্রের সঙ্গে জীবনযাপনের কোনো সস্পর্ক নেই মিস্টার প্রেসিডেন্ট।’

‘থাকা কি উচিত ছিল না?’

এ প্রশ্নের কোনো জবাব খুঁজে না পেয়ে চুপ করেই থাকলাম।

‘অথচ উপকূলবাসী অসংখ্য মানুষ, নাবিক, জেলেদের রয়েছে রূপকথার চেয়েও চাঞ্চল্যকর জীবনধারা যা সমুদ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। আপনি তো এদেশেরই কবি।

‘সমুদ্র সম্বন্ধে এখন থেকে আমার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হবে। আপনার কথাগুলো আমার খুবই ভালো লেগেছে মি. প্রেসিডেন্ট।’

বেশ গাঢ়স্বরে কথাগুলো বললাম আমি। তিনি হাসলেন কিংবা প্রীত হলেন কিছুই বোঝা গেল না। বাইরে বহুদূরে একটা দূরাগত জাহাজের আলো দরিয়ার ঢেউয়ে হাতড়ে বেড়াতে লাগলো। প্রেসিডেন্ট সেদিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। মনে হল আমার উপস্থিতি তিনি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছেন।

আমি সাহস করে বললাম, ‘এখন আপনার ঘুমাতে যাওয়া উচিত।’

‘আপনি যান। আমি আরও  কিছুক্ষণ বসব। যান ঘুমান গিয়ে। কাল সকালে নৌ-মহড়া দেখবেন।’

আমি উঠে দাঁড়ালাম। তাকে সালাম জানিয়ে সিঁড়ির কাছে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকে আবার দেখার জন্য পেছন ফিরলাম। এখান থেকে তার চেহারাটা পরিষ্কার দেখা না গেলেও চাঁদের স্পষ্ট আলোয় নিঃসঙ্গ অবস্থানটি বোঝা যাচ্ছে, বসে আছেন তিনি বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গের দিকে মুখ করে।

নিঃসঙ্গ একজন মানুষ!

এখন তার চোখে কালো চশমা জোড়া থাকার কথা নয় তবুও আমার মনে হলো তার ভিন্ন চোখ দু’টি বুঝি এখনো কোনো কালো আবরণের ভেতর থেকে সন্ধানী দৃষ্টি ফেলে জলের ভেতর জেগে উঠা বাংলাদেশের নতুন কোনো মাটিকে দেখছে। নতুন পলির মানচিত্র তৈরি হচ্ছে তার হৃদয়ে।

( “তৃষিত জলধি” কবি আল মাহমুদের একটি ছোটোগল্প। যেখানে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দেশপ্রেম ও রাষ্ট্রনায়কসুলভ গুণাবলীর ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।)

উত্তরাধুনিক

Writer, Singer & Environmentalist

আল মাহমুদের ছোটোগল্পে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দেশপ্রেম ও রাষ্ট্রনায়কসুলভ গুণাবলি

আপডেট সময়: ০৬:৪৯:০৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩১ মে ২০২৫

তৃষিত জলধি

আল মাহমুদ

আমি একটা বসার জায়গা খুঁজছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম চিমনির ওপাশটায়। সেখানে গিয়েই মনে হল চিমনির ছায়ার অন্ধকারে কে একজন ছায়ামূর্তি বসে আছে। আমার পদশব্দে ছায়ামূর্তিও সচকিত হয়ে উঠলো, ‘কে?’

আমি একটু এগিয়ে জবাব দিতে চমকে উঠে দেখলাম মহামান্য প্রেসিডেন্ট স্রেফ সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরে একটা টুলের ওপর বসে আছেন। আমি বললাম, ‘স্যার এত রাতে আপনি এখানে একা?’

‘ও কবি! না ঠিক একা নই ছাদের নীচে তো অনেক মানুষ ঘুমাচ্ছে। শুধু দেখছি আপনি আর আমিই জেগে আছি। বসুন।’

‘আপনার নিরাপত্তা রক্ষীরা?’

‘তারাও সম্ভবত ঘুমিয়েছে। তা না হলে আমাকে এখানে আসতে দেখে আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকতো নিশ্চয়।

‘আপনার কি এভাবে একা বেরুনো উচিত?’

‘সম্ভবত নয়। সমুদ্রে চাঁদের খেলা দেখবো বলে এসেছি। আমার ঘুম পাচ্ছে না। আচ্ছা, আজ কি পূর্ণিমা?’

‘আগামীকাল কলা পূর্ণ হবে।’ জবাব দিলাম আমি।

‘বসুন কবি।’

মহামান্য প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয়বার আমাকে বসার হুকুম দিলেন। আমি আশেপাশে তার সান্নিধ্যে বসার একটা টুল খুঁজছিলাম। একটি মাত্র টুলে তিনি নিজেই বসে আছেন। আমি একটু ইতস্তত করে তার টুলটার পাশে ছাদেই বসে পড়লাম। তিনি আপত্তি করলেন না।

‘আপনার কি ঘুমের অসুখ?’

‘ইনসমনিয়া।’ জবাব দিলাম আমি।

‘কবিদের, ভাবুকদের একটু অনিদ্রা রোগ থাকা মন্দ নয়। এই চাঁদ, এই সমুদ্র আর সীমাহীন ঢেউয়ের ছলৎকার শোনার জন্য এক ধরনের মানুষ দরকার। কী বলেন?’

আমি বললাম, ‘মহামান্য প্রেসিডেন্টের কি ঢেউ গোণা’র বাতিক আছে ?’

‘না আমার কোনো অনিদ্রা রোগ নেই। আমার ঘুম খুব সাউন্ড। আজই শুধু ঘুম পাচ্ছে না। শারীরিক শ্রমের কমতি পড়লেই আমার ঘুমের ব্যাঘাত হয়।’ বললেন তিনি।

আমরা উভয়ই কতক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম।

আকাশে তখন মেঘের স্তরটা অন্তর্হিত হয়ে আকাশ-সমুদ্রব্যাপী জোছনার একটি দীপ্তি ফুটে উঠেছে।

‘আপনি সাগরকে নিয়ে কয়টা কবিতা লিখেছেন?’

অকস্মাৎ নীরবতা ভেঙে তিনি প্রশ্ন করলেন।

আমি চুপ করে রইলাম। মনে মনে ভাবলাম, আমার সমুদ্রের ওপর একটাও রচনা নেই, আশ্চর্য!

‘একটাও লেখেননি, তাই না’

আমি লা-জবাব হয়ে থাকলাম।

‘অথচ সমুদ্র হলো অর্ধেকটা বাংলাদেশ। সমুদ্র না থাকলে আমাদের জীবন অর্থহীন হতো। এই সাগরের অভিজ্ঞতা নেই আমাদের একালের কবিদের। কী বেদনাদায়ক!

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘কাজী সাহেব লিখেছেন। ‘হে সিন্ধু বন্ধু মোর ….।’

‘নজরুল সমুদ্রকে বুঝতেন বলেই তার জীবন ছিল উত্তাল। নির্ভীকতা ছাড়া বড় হওয়া যায় না। আপনি নদীর ওপর অজস্র লিখেছেন। আমি পড়েছি। চমৎকার অন্তর্দৃষ্টি আপনার। এখন সমুদ্রের দিকে তাকাতে হবে। সমুদ্রই মানবহৃদয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়ে দেয়।’

বেশ উদ্দীপিতভাবে প্রেসিডেন্ট কথা বলছেন দেখে আমি বললাম, ‘কিন্তু আমার তো সমুদ্রের কোনো অভিজ্ঞতা কিংবা সমুদ্রের সঙ্গে জীবনযাপনের কোনো সস্পর্ক নেই মিস্টার প্রেসিডেন্ট।’

‘থাকা কি উচিত ছিল না?’

এ প্রশ্নের কোনো জবাব খুঁজে না পেয়ে চুপ করেই থাকলাম।

‘অথচ উপকূলবাসী অসংখ্য মানুষ, নাবিক, জেলেদের রয়েছে রূপকথার চেয়েও চাঞ্চল্যকর জীবনধারা যা সমুদ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। আপনি তো এদেশেরই কবি।

‘সমুদ্র সম্বন্ধে এখন থেকে আমার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হবে। আপনার কথাগুলো আমার খুবই ভালো লেগেছে মি. প্রেসিডেন্ট।’

বেশ গাঢ়স্বরে কথাগুলো বললাম আমি। তিনি হাসলেন কিংবা প্রীত হলেন কিছুই বোঝা গেল না। বাইরে বহুদূরে একটা দূরাগত জাহাজের আলো দরিয়ার ঢেউয়ে হাতড়ে বেড়াতে লাগলো। প্রেসিডেন্ট সেদিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। মনে হল আমার উপস্থিতি তিনি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছেন।

আমি সাহস করে বললাম, ‘এখন আপনার ঘুমাতে যাওয়া উচিত।’

‘আপনি যান। আমি আরও  কিছুক্ষণ বসব। যান ঘুমান গিয়ে। কাল সকালে নৌ-মহড়া দেখবেন।’

আমি উঠে দাঁড়ালাম। তাকে সালাম জানিয়ে সিঁড়ির কাছে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকে আবার দেখার জন্য পেছন ফিরলাম। এখান থেকে তার চেহারাটা পরিষ্কার দেখা না গেলেও চাঁদের স্পষ্ট আলোয় নিঃসঙ্গ অবস্থানটি বোঝা যাচ্ছে, বসে আছেন তিনি বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গের দিকে মুখ করে।

নিঃসঙ্গ একজন মানুষ!

এখন তার চোখে কালো চশমা জোড়া থাকার কথা নয় তবুও আমার মনে হলো তার ভিন্ন চোখ দু’টি বুঝি এখনো কোনো কালো আবরণের ভেতর থেকে সন্ধানী দৃষ্টি ফেলে জলের ভেতর জেগে উঠা বাংলাদেশের নতুন কোনো মাটিকে দেখছে। নতুন পলির মানচিত্র তৈরি হচ্ছে তার হৃদয়ে।

( “তৃষিত জলধি” কবি আল মাহমুদের একটি ছোটোগল্প। যেখানে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দেশপ্রেম ও রাষ্ট্রনায়কসুলভ গুণাবলীর ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।)