১১:৩৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

প্রতিদিনই ঘটছে ‘পুশ-ইন’র ঘটনা

  • আপডেট সময়: ০৭:২৮:১৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ জুন ২০২৫
  • 14

পুশ-ইন ঠেকাতে টহল জোরদার করেছে বিজিবি। ছবি: সংগৃহীত


প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো সীমান্ত দিয়ে ‘পুশ-ইনের’ ঘটনা ঘটছে৷ বিশ্লেষকদের মতে, কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে৷

বুধবার (৪ জুন) সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ময়মনসিংহ, পঞ্চগড়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে আরও অন্তত ৭১ জনকে পুশ-ইন করা হয়েছে৷ পুশ-ইন করার জন্য সীমান্তবর্তী ১৮ জেলাকে বেছে নিয়েছে বিএসএফ৷ সবচেয়ে বেশি পুশ-ইনের ঘটনা ঘটেছে মৌলভীবাজার জেলার তিন সীমান্ত দিয়ে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘গত পহেলা জুন আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই বিষয়ে বৈঠক করেছি৷ সেখানে আমরা আলোচনার মাধ্যমে একমত হয়েছি, কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে৷ বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও অবহিত করা হয়েছে৷’

অবৈধ ভারতীয়দের পুশ-ব্যাক করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কিছু পুশ-ব্যাক করা হচ্ছে৷ তবে সেটা অফিশিয়ালি নয়’ এর কোনো পরিসংখ্যানও আমাদের কাছে নেই৷ তবে বাংলাদেশ যথাযথ নিয়ম মেনেই তাদের পুশ-ব্যাক করছে৷ আবার তারা ইউএনএর কার্ডধারী রোহিঙ্গাদেরও পুশ-ইন করছে৷ এটা তো তারা কোনোভাবেই করতে পারে না৷’

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারত সরকারকে এ ব্যাপারে চিঠি পাঠানো হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি৷ এমনকি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সঙ্গে ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) পতাকা বৈঠকেও কোনো সমাধান মিলছে না, বরং বিএসএফের এই তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে৷


আরো পড়ুন

ঠেকানো যাচ্ছে না ‘পুশ ইন’, দিল্লিকে ফের চিঠি দেবে ঢাকা


বিজিবির খাগড়াছড়ি সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল আব্দুল মোত্তাকিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘প্রথমদিকে বিএসএফ যখন খাগড়াছড়ি দিয়ে কিছু মানুষকে ঠেলে ভেতরে পাঠায় তখন আমরা তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি৷ ওই বৈঠকে বিষয়টি তারা অস্বীকার করেছে৷ তবে আমরা যখন তথ্য উপাত্ত দিয়ে তাদের বলেছি যে, এই মানুষগুলোকে বিএসএফই ঠেলে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে, তখন তারা কোনো জবাব দেয়নি৷ তখন থেকেই আমরা সীমান্তে নজরদারি জোরদার করেছি৷ টহল কার্যক্রমও আগের থেকে অনেক বেশি জোরদার করা হয়েছে৷ ফলে এই সীমান্ত দিয়ে তারা আর কাউকে পাঠাতে পারেনি৷ তবে অন্য সীমান্ত দিয়ে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে৷’

প্রতিদিনই ঘটছে পুশ-ইনের ঘটনা। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ সীমান্তের কিছু এলাকায় ঘন জঙ্গল ও দুর্গম পাহাড় থাকায় বিজিবির টহল কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিচ্ছে বিএসএফ৷ এ রকম ২৬টি সীমান্ত এলাকাকে ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিজিবি৷ ওই সব এলাকায় টহল জোরদার, সীমান্ত পাহারায় স্থানীয়দের যুক্ত করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷

নিরাপত্তা ও অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পুশ-ইনের ব্যাপারে অফিশিয়ালভাবে জানানোর পরেও তা ঠেকানো যাচ্ছে না৷ পুশ-ইন থামানো না গেলে ভারত আরও উৎসাহিত হয়ে পুশ-ইন বাড়িয়ে দিতে পারে৷ এতে সংকট আরও গভীর হতে পারে৷ পুশ-ইন বন্ধে প্রয়োজনে কূটনৈতিক পর্যায়ে দুই দেশের সরকার পর্যায়ে আলোচনা করতে হবে৷ এতেও কাজ না হলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জাতিসংঘের দ্বারস্থ হতে হবে৷ সেখান থেকে সমাধান খুঁজতে হবে৷

‘ভারত থেকে পুশ-ইন ঠেকানো সম্ভব না’- এমনটা উল্লেখ করে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গত মঙ্গলবার বলেছেন, ‘পুশ-ইন হচ্ছে, ফিজিক্যালি এটি ঠেকানো সম্ভব নয়৷ এটা নিয়ে ভারতের সঙ্গে আমাদের চিঠি আদান-প্রদান হচ্ছে৷ এ সমস্যা সমাধানে কনস্যুলার পদ্ধতির (কনস্যুলার ডায়ালগ) আওতায় ভারতের সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ৷’

তবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘সম্ভব নয় বলে’ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দায়িত্ব এড়াতে পারেন না৷ সম্ভব করার জন্যই তাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে৷ তার মানে তিনি কূটনৈতিক তৎপরতায় ফেল করেছেন৷ কিন্তু এই সমস্যার সামাধানে অন্য কোনো পথ খোলা নেই৷ এটা কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে৷ ভারত যেটা করছে সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ ভারতের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টার পাশাপাশি প্রতিবাদ জানানোও উচিত৷’

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘কূটনৈতিক তৎপরতা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান হবে না৷ এখন বাংলাদেশের চিঠির জবাব দিচ্ছে না ভারত, এই তো৷ এখানে থেমে থাকলে হবে না৷ বিকল্প আরও অনেক পথ খোলা আছে৷ বাংলাদেশে তাদের হাইকমিশন আছে৷ হাইকমিশনারকে ডেকে কথা বলতে হবে৷ আবার দিল্লিতে আমাদের যে দূতাবাস আছে, তারা প্রয়োজনে ওদের পররাষ্ট্র দফতরে গিয়ে কথা বলবে৷ একটা পর্যায়ে তো তারা কথা শুনবে৷ এখন তারা ঠেলে দিচ্ছে, আমরাও ঠেলে দেবো, এভাবে সমাধান হবে না৷’

ভারতে কাজ করা একজন কূটনীতিক পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে আলাপকালে বলছিলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হচ্ছে৷ ভারত সরকার নমনীয় হতে শুরু করেছে৷ শিগগিরই এর ফল পাওয়া যেতে পারে৷’

নির্যাতন করছে বিএসএফ

সেলিনা বেগম নামের ৪১ বছর বয়সি একজন বাংলাদেশি নারী অভিযোগ করেছেন, বিএসএফ গভীর রাতে তাকে ও তার তিন মেয়ের শরীরে খালি প্লাস্টিকের বোতল বেঁধে দেয়৷ এরপর ত্রিপুরার সাবরাং সীমান্তের কাছে ফেনী নদীতে তাদের ফেলে দেয়৷ ফেনী নদী ত্রিপুরার সাবরাং জেলা ও বাংলাদেশের খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার মাঝামাঝি সীমান্ত নির্দেশনা দেয়৷ বিএসএফ পুশ-ইন করার পর ফেনী নদীতে তারা সারা রাত ভেসেছিলেন৷ পরদিন সকালে বাংলাদেশের সীমান্তের বাসিন্দারা তাদের উদ্ধার করেন৷ সেলিনা বেগম বলেন, ‘আমার সন্তানরা বুঝতে পারেনি কী হচ্ছে৷ আমরা সারা রাত নদীতে ভেসে ছিলাম৷’

বিজিবি সূত্র জানায়, গত ২২ মে ভোর ৬টার দিকে রামগড়ের সোনাইপুল এলাকার কাছে স্থানীয়রা সেলিনা, তার স্বামী উম্মেদ আলী এবং তিন মেয়েকে ফেনী নদী থেকে উদ্ধার করে৷ পরে মহামুনি ক্যাম্প থেকে বিজিবির সদস্যরা তাদের উদ্ধার করে হেফাজতে নেন৷ পরিবারটি তাদের জানিয়েছে, তারা ভারতের হরিয়ানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন৷ হরিয়ানার স্থানীয় পুলিশ তাদের আটকের পর মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়৷ তাদের জমানো অর্থ কেড়ে নেয়৷ অনেকটা অভুক্ত অবস্থায় তাদের একটা ট্রেনে তোলা হয়৷ কয়েক দফা ট্রেন পরিবর্তন করার পর তাদের আনা হয় ত্রিপুরা রাজ্যে৷ সেখান থেকে গাড়িতে করে সাবরাং জেলা শহরের সীমান্তবর্তী বিএসএফের একটি ক্যাম্পে আনা হয়৷ এরপর তাদের প্রত্যেকের শরীরে খালি প্লাস্টিকের বোতল বেঁধে দেওয়া হয়৷

ভারতীয় নাগরিকদেরও ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

২৫ দিনে ১৮ জেলা দিয়ে এসেছে ১২২১ জন

বিজিবি থেকে ডয়চে ভেলেকে দেওয়া তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৭ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত এই ২৫ দিনে দুর্গম সীমান্ত দিয়ে এক হাজার ২২১ জনকে পুশ ইন করেছে বিএসএফ৷ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি পুশ-ইনের ঘটনা ঘটেছে মৌলভীবাজার জেলার তিন সীমান্ত দিয়ে৷ এ বিষয়ে বিজিবি কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ সীমান্তের কিছু এলাকায় ঘন জঙ্গল ও দুর্গম পাহাড় থাকায় বিজিবির টহল কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিচ্ছে বিএসএফ৷

বিশ্লেষকরা যা বলছেন

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এটা কিন্তু সাধারণ কোনো সমস্যা নয়, এটা রাজনৈতিক সমস্যা৷ ৫ আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর তারা চূড়ান্তভাবে এই সরকারকে অসহযোগিতা করছে৷ তারা এমন কিছু বাজিণ্য নীতি নিয়েছে যেটার জন্য তাদেরও ক্ষতি হবে৷ কিন্তু তারপরও তারা এটা নিয়েছে৷ বাংলাদেশে তারা পুশ-ইন কবে থেকে শুরু করল? সম্ভবত, যেদিন তারা পাকিস্তানে হামলা চালালো সেদিন থেকে৷ এখন তারা এটাও প্রচার করছে, বাংলাদেশ থেকে অনেক মুসলিম অবৈধভাবে ভারতে অবস্থান করছে৷ এটা বিজেপির নির্বাচনী পলিসি৷ বাংলাদেশকেও একই ধরনের পলিসি নিতে হবে৷ এখানেও অনেক ভারতীয় অবৈধভাবে চাকরি করছেন৷ তাদেরও সনাক্ত করে একইভাবে পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে৷ তাহলে যদি তারা আলোচনায় সাড়া দেয়৷ এর বাইরে তো কিছু দেখি না৷’


আরো পড়ুন

বিজিবি-জনতার বাধায় সীমান্তে ৩৮ জনকে পুশইনের চেষ্টা ব্যর্থ


অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘যাদের পুশ-ইন করছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশি যারা তারা কী উদ্দেশ্যে, কবে ভারতে গিয়েছিল, কোনভাবে গিয়েছিল, তাদের ভারতীয় বৈধ কোনো কাগজপত্র ছিল কি না? এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা দরকার৷ পুশ-ইন জোর করে হলেও দেখার বিষয় বিজিবির কাছে সর্বোচ্চ কী দিকনির্দেশনা দেওয়া ছিল৷ সে অনুযায়ী তারা (বিজিবি) উপস্থিত ছিল কি না৷’

কূটনৈতিকভাবে প্রতিবাদ বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন আসিফ মুনীর৷ তার মতে, প্রয়োজন হলে ভারতীয় হাইকমিশনের প্রতিনিধিকে ডেকে প্রতিবাদ জানানো উচিত৷ যদি পুশ-ইন চলমান থাকে তাহলে ভারতের কাছে এমন কোনো তালিকা আছে কী-না সেটাও খোঁজ নেয়া দরকার৷ সূত্র: ডয়চে ভেলে

উত্তরাধুনিক

Writer, Singer & Environmentalist

প্রতিদিনই ঘটছে ‘পুশ-ইন’র ঘটনা

আপডেট সময়: ০৭:২৮:১৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ জুন ২০২৫

পুশ-ইন ঠেকাতে টহল জোরদার করেছে বিজিবি। ছবি: সংগৃহীত


প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো সীমান্ত দিয়ে ‘পুশ-ইনের’ ঘটনা ঘটছে৷ বিশ্লেষকদের মতে, কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে৷

বুধবার (৪ জুন) সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ময়মনসিংহ, পঞ্চগড়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে আরও অন্তত ৭১ জনকে পুশ-ইন করা হয়েছে৷ পুশ-ইন করার জন্য সীমান্তবর্তী ১৮ জেলাকে বেছে নিয়েছে বিএসএফ৷ সবচেয়ে বেশি পুশ-ইনের ঘটনা ঘটেছে মৌলভীবাজার জেলার তিন সীমান্ত দিয়ে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘গত পহেলা জুন আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই বিষয়ে বৈঠক করেছি৷ সেখানে আমরা আলোচনার মাধ্যমে একমত হয়েছি, কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে৷ বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও অবহিত করা হয়েছে৷’

অবৈধ ভারতীয়দের পুশ-ব্যাক করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কিছু পুশ-ব্যাক করা হচ্ছে৷ তবে সেটা অফিশিয়ালি নয়’ এর কোনো পরিসংখ্যানও আমাদের কাছে নেই৷ তবে বাংলাদেশ যথাযথ নিয়ম মেনেই তাদের পুশ-ব্যাক করছে৷ আবার তারা ইউএনএর কার্ডধারী রোহিঙ্গাদেরও পুশ-ইন করছে৷ এটা তো তারা কোনোভাবেই করতে পারে না৷’

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারত সরকারকে এ ব্যাপারে চিঠি পাঠানো হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি৷ এমনকি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সঙ্গে ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) পতাকা বৈঠকেও কোনো সমাধান মিলছে না, বরং বিএসএফের এই তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে৷


আরো পড়ুন

ঠেকানো যাচ্ছে না ‘পুশ ইন’, দিল্লিকে ফের চিঠি দেবে ঢাকা


বিজিবির খাগড়াছড়ি সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল আব্দুল মোত্তাকিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘প্রথমদিকে বিএসএফ যখন খাগড়াছড়ি দিয়ে কিছু মানুষকে ঠেলে ভেতরে পাঠায় তখন আমরা তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি৷ ওই বৈঠকে বিষয়টি তারা অস্বীকার করেছে৷ তবে আমরা যখন তথ্য উপাত্ত দিয়ে তাদের বলেছি যে, এই মানুষগুলোকে বিএসএফই ঠেলে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে, তখন তারা কোনো জবাব দেয়নি৷ তখন থেকেই আমরা সীমান্তে নজরদারি জোরদার করেছি৷ টহল কার্যক্রমও আগের থেকে অনেক বেশি জোরদার করা হয়েছে৷ ফলে এই সীমান্ত দিয়ে তারা আর কাউকে পাঠাতে পারেনি৷ তবে অন্য সীমান্ত দিয়ে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে৷’

প্রতিদিনই ঘটছে পুশ-ইনের ঘটনা। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ সীমান্তের কিছু এলাকায় ঘন জঙ্গল ও দুর্গম পাহাড় থাকায় বিজিবির টহল কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিচ্ছে বিএসএফ৷ এ রকম ২৬টি সীমান্ত এলাকাকে ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিজিবি৷ ওই সব এলাকায় টহল জোরদার, সীমান্ত পাহারায় স্থানীয়দের যুক্ত করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷

নিরাপত্তা ও অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পুশ-ইনের ব্যাপারে অফিশিয়ালভাবে জানানোর পরেও তা ঠেকানো যাচ্ছে না৷ পুশ-ইন থামানো না গেলে ভারত আরও উৎসাহিত হয়ে পুশ-ইন বাড়িয়ে দিতে পারে৷ এতে সংকট আরও গভীর হতে পারে৷ পুশ-ইন বন্ধে প্রয়োজনে কূটনৈতিক পর্যায়ে দুই দেশের সরকার পর্যায়ে আলোচনা করতে হবে৷ এতেও কাজ না হলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জাতিসংঘের দ্বারস্থ হতে হবে৷ সেখান থেকে সমাধান খুঁজতে হবে৷

‘ভারত থেকে পুশ-ইন ঠেকানো সম্ভব না’- এমনটা উল্লেখ করে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গত মঙ্গলবার বলেছেন, ‘পুশ-ইন হচ্ছে, ফিজিক্যালি এটি ঠেকানো সম্ভব নয়৷ এটা নিয়ে ভারতের সঙ্গে আমাদের চিঠি আদান-প্রদান হচ্ছে৷ এ সমস্যা সমাধানে কনস্যুলার পদ্ধতির (কনস্যুলার ডায়ালগ) আওতায় ভারতের সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ৷’

তবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘সম্ভব নয় বলে’ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দায়িত্ব এড়াতে পারেন না৷ সম্ভব করার জন্যই তাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে৷ তার মানে তিনি কূটনৈতিক তৎপরতায় ফেল করেছেন৷ কিন্তু এই সমস্যার সামাধানে অন্য কোনো পথ খোলা নেই৷ এটা কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে৷ ভারত যেটা করছে সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ ভারতের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টার পাশাপাশি প্রতিবাদ জানানোও উচিত৷’

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘কূটনৈতিক তৎপরতা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান হবে না৷ এখন বাংলাদেশের চিঠির জবাব দিচ্ছে না ভারত, এই তো৷ এখানে থেমে থাকলে হবে না৷ বিকল্প আরও অনেক পথ খোলা আছে৷ বাংলাদেশে তাদের হাইকমিশন আছে৷ হাইকমিশনারকে ডেকে কথা বলতে হবে৷ আবার দিল্লিতে আমাদের যে দূতাবাস আছে, তারা প্রয়োজনে ওদের পররাষ্ট্র দফতরে গিয়ে কথা বলবে৷ একটা পর্যায়ে তো তারা কথা শুনবে৷ এখন তারা ঠেলে দিচ্ছে, আমরাও ঠেলে দেবো, এভাবে সমাধান হবে না৷’

ভারতে কাজ করা একজন কূটনীতিক পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে আলাপকালে বলছিলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হচ্ছে৷ ভারত সরকার নমনীয় হতে শুরু করেছে৷ শিগগিরই এর ফল পাওয়া যেতে পারে৷’

নির্যাতন করছে বিএসএফ

সেলিনা বেগম নামের ৪১ বছর বয়সি একজন বাংলাদেশি নারী অভিযোগ করেছেন, বিএসএফ গভীর রাতে তাকে ও তার তিন মেয়ের শরীরে খালি প্লাস্টিকের বোতল বেঁধে দেয়৷ এরপর ত্রিপুরার সাবরাং সীমান্তের কাছে ফেনী নদীতে তাদের ফেলে দেয়৷ ফেনী নদী ত্রিপুরার সাবরাং জেলা ও বাংলাদেশের খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার মাঝামাঝি সীমান্ত নির্দেশনা দেয়৷ বিএসএফ পুশ-ইন করার পর ফেনী নদীতে তারা সারা রাত ভেসেছিলেন৷ পরদিন সকালে বাংলাদেশের সীমান্তের বাসিন্দারা তাদের উদ্ধার করেন৷ সেলিনা বেগম বলেন, ‘আমার সন্তানরা বুঝতে পারেনি কী হচ্ছে৷ আমরা সারা রাত নদীতে ভেসে ছিলাম৷’

বিজিবি সূত্র জানায়, গত ২২ মে ভোর ৬টার দিকে রামগড়ের সোনাইপুল এলাকার কাছে স্থানীয়রা সেলিনা, তার স্বামী উম্মেদ আলী এবং তিন মেয়েকে ফেনী নদী থেকে উদ্ধার করে৷ পরে মহামুনি ক্যাম্প থেকে বিজিবির সদস্যরা তাদের উদ্ধার করে হেফাজতে নেন৷ পরিবারটি তাদের জানিয়েছে, তারা ভারতের হরিয়ানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন৷ হরিয়ানার স্থানীয় পুলিশ তাদের আটকের পর মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়৷ তাদের জমানো অর্থ কেড়ে নেয়৷ অনেকটা অভুক্ত অবস্থায় তাদের একটা ট্রেনে তোলা হয়৷ কয়েক দফা ট্রেন পরিবর্তন করার পর তাদের আনা হয় ত্রিপুরা রাজ্যে৷ সেখান থেকে গাড়িতে করে সাবরাং জেলা শহরের সীমান্তবর্তী বিএসএফের একটি ক্যাম্পে আনা হয়৷ এরপর তাদের প্রত্যেকের শরীরে খালি প্লাস্টিকের বোতল বেঁধে দেওয়া হয়৷

ভারতীয় নাগরিকদেরও ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

২৫ দিনে ১৮ জেলা দিয়ে এসেছে ১২২১ জন

বিজিবি থেকে ডয়চে ভেলেকে দেওয়া তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৭ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত এই ২৫ দিনে দুর্গম সীমান্ত দিয়ে এক হাজার ২২১ জনকে পুশ ইন করেছে বিএসএফ৷ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি পুশ-ইনের ঘটনা ঘটেছে মৌলভীবাজার জেলার তিন সীমান্ত দিয়ে৷ এ বিষয়ে বিজিবি কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ সীমান্তের কিছু এলাকায় ঘন জঙ্গল ও দুর্গম পাহাড় থাকায় বিজিবির টহল কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিচ্ছে বিএসএফ৷

বিশ্লেষকরা যা বলছেন

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এটা কিন্তু সাধারণ কোনো সমস্যা নয়, এটা রাজনৈতিক সমস্যা৷ ৫ আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর তারা চূড়ান্তভাবে এই সরকারকে অসহযোগিতা করছে৷ তারা এমন কিছু বাজিণ্য নীতি নিয়েছে যেটার জন্য তাদেরও ক্ষতি হবে৷ কিন্তু তারপরও তারা এটা নিয়েছে৷ বাংলাদেশে তারা পুশ-ইন কবে থেকে শুরু করল? সম্ভবত, যেদিন তারা পাকিস্তানে হামলা চালালো সেদিন থেকে৷ এখন তারা এটাও প্রচার করছে, বাংলাদেশ থেকে অনেক মুসলিম অবৈধভাবে ভারতে অবস্থান করছে৷ এটা বিজেপির নির্বাচনী পলিসি৷ বাংলাদেশকেও একই ধরনের পলিসি নিতে হবে৷ এখানেও অনেক ভারতীয় অবৈধভাবে চাকরি করছেন৷ তাদেরও সনাক্ত করে একইভাবে পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে৷ তাহলে যদি তারা আলোচনায় সাড়া দেয়৷ এর বাইরে তো কিছু দেখি না৷’


আরো পড়ুন

বিজিবি-জনতার বাধায় সীমান্তে ৩৮ জনকে পুশইনের চেষ্টা ব্যর্থ


অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘যাদের পুশ-ইন করছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশি যারা তারা কী উদ্দেশ্যে, কবে ভারতে গিয়েছিল, কোনভাবে গিয়েছিল, তাদের ভারতীয় বৈধ কোনো কাগজপত্র ছিল কি না? এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা দরকার৷ পুশ-ইন জোর করে হলেও দেখার বিষয় বিজিবির কাছে সর্বোচ্চ কী দিকনির্দেশনা দেওয়া ছিল৷ সে অনুযায়ী তারা (বিজিবি) উপস্থিত ছিল কি না৷’

কূটনৈতিকভাবে প্রতিবাদ বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন আসিফ মুনীর৷ তার মতে, প্রয়োজন হলে ভারতীয় হাইকমিশনের প্রতিনিধিকে ডেকে প্রতিবাদ জানানো উচিত৷ যদি পুশ-ইন চলমান থাকে তাহলে ভারতের কাছে এমন কোনো তালিকা আছে কী-না সেটাও খোঁজ নেয়া দরকার৷ সূত্র: ডয়চে ভেলে