
গোপন বন্দিশালায় নির্যাতনের প্রতীকী ছবি
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের বহু আগে থেকেই আলোচনার কেন্দ্রে ‘আয়নাঘর’সহ ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার নানা গোপন বন্দিশালা। যেখানে মানুষকে ধরে নিয়ে গুম করে রেখে চালানো হতো ভয়ানক নির্যাতন। তারই কিছু গা শিউরে ওঠা বর্ণনা উঠে এসেছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় প্রতিবেদনে।
গত ৪ জুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি তুলে দেওয়া হয়। সেখানে প্রায় ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ বিশ্লেষণ করে ২৫৩ জন গুমের শিকার ব্যক্তির তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের বরাতে ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বন্দি ব্যক্তিকে গামছা দিয়ে মুখ ঢেকে ঢালা হতো পানি। এতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসত। ভুক্তভোগীর মনে হতো, তিনি পানিতে ডুবে যাচ্ছেন। এমন ভয়ানক পরিস্থিতিতে আতঙ্ক আর শ্বাসরোধের যন্ত্রণায় কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে যেতেন। নির্যাতনের এ পদ্ধতির নাম ‘ওয়াটারবোর্ডিং’।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন- র্যাবের গোপন বন্দিশালায় গুমের শিকার ব্যক্তিদের ওপর ভয়াবহ এ নির্যাতন চালানো হতো বলে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে।
সেখানে আরও বলা হয়েছে, টার্গেটকে তুলে নিয়ে গুম করে অস্বাস্থ্যকর একটি সেলে বন্দি রাখা হতো। এরপর চাহিদামতো তথ্য না দিলে বা প্রশ্নের জবাব না পেলে চলতো উল্টো করে ঝুলিয়ে মারধর। একপর্যায়ে নখ উপড়ে ফেলা, বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, ঘূর্ণয়মান চেয়ারে বসানোসহ নানা পদ্ধতিতে চলতো অসহনীয় নির্যাতন।
আরও পড়ুন: বন্দিদের ভারতে পাঠাতেন হাসিনা!
গুমের ও নির্যাতনের শিকার হাবিব (২৭) নামে এক যুবকের বর্ণনা, ‘আমাকে গ্রিলের মধ্যে হ্যান্ডকাফ দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখত, যাতে বসতে না পারি। এভাবে থাকতে থাকতে আমার পা ফুলে যায়। হ্যান্ডকাফের কারণে হাত রক্তাক্ত হয় (দাগগুলো দেখিয়ে)। ওয়াশরুমে যেতে দিত না। একদিন টেবিলের ওপরে হাত রেখে আঙুলটা একজন প্লাস দিয়ে শক্ত করে ধরে, আরেকজন সুচ ঢোকায়।’
২০১৭ সালে ২৩ বছর বয়সি এক যুবককে অপহরণ করে র্যাব। ৭২ দিন গুম ছিলেন তিনি। তাকে বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার জেআইসিতে আটক রাখা হয়। যেখানে টর্চারের কারণে তার নাভির দুই পাশে আঘাতের চিহ্ন সৃষ্টি হয়।
ওই যুবক বলেন, ‘আমার পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। মাথা নিচের দিক, পা ওপরের দিক। আমার শরীরে কোনো পোশাক রাখে নাই তখন। তারপর আমাকে দুজন একসঙ্গে এলোপাথাড়ি পিটাতে থাকে। খুব সম্ভব বেতের লাঠি দিয়ে। পরবর্তীতে আমাকে অসংখ্যবার টর্চার করেছে এবং মারতে মারতে আমার এমন হয়েছে যে, চোখের কাপড়ও খুলে গেছে। নাকে-মুখে চড়ানো, থাপড়ানো। শুধু পেছনে মারছে। ওই সময়ে চামড়া ছিঁড়ে, মানে চামড়া ফেটে রক্ত ঝরেছে।
২০১৭ সালে র্যাব-১১ কর্তৃক অপহৃত হন ৫৬ বছর বয়সি এক ভুক্তভোগী। তিনি বলেন, ‘পরে নাম জানতে পেরেছি। তখন জানতাম না। সে (আলেপ উদ্দিন) লাঠি দিয়ে খুব টর্চার করত। একদিন আমাকেও বেশ টর্চার করে। টর্চার করে আর বলে যে, ‘তাকে টাঙায় রাখ, ঝুলায় রাখ।’ সেলের গ্রিলের সঙ্গে আমাকে ঝুলায় রাখল। সঙ্গে হাতকড়া ছিল। এইভাবে অনেক ঘণ্টা রাখার পর আমি আর পারছিলাম না। ওইদিনের পরে যখন টর্চার করল, আঙুলের নখটা পুরা উঠে গেছিল।’
২০১৭ সালে বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাব-২ কর্তৃক অপহৃত হন ২৮ বছর বয়সি এক যুবক। ২০৮ দিন গুম ছিলেন তিনি।
এই যুবকের ভাষ্য, ‘একটা মেশিনে উঠাইছিল। তার আগে চোখ বাঁধছে, হাত বাঁধছে, পা বাঁধছে মেশিন চালানোর পরে মনে হইছে, আমার হাড় সম্পূর্ণ যেন আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ওটার সেটিং এরকম যে, মেশিনটাই একটা আজব! ওরা বলতো যে, ‘তুমি পিঠ একেবারে লাগাইয়া রাখ। এখানে উঠলে কিন্তু সবাই পায়খানা করে দেয়।’এমন কঠিন অবস্থা ছিল ওইখানে। মেশিনটা ঘোরানো যায়। কখনো কখনো উল্টা করানো যায়। আবার এরকম ফ্ল্যাট শোয়ানো যায়। ওইখানে থাকা অবস্থায় হাঁটুর উপর বাড়িও দিছে। জিজ্ঞাসা করছে, ‘তুমি সরকারের বিরুদ্ধে কী কী ষড়যন্ত্র করতেছ?’
সিটিটিসি কর্তৃক ২০২৩ সালে অপহৃত হন ৪৭ বছর বয়সি এক ব্যক্তি। ১৬ দিন গুম ছিলেন তিনি। তার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ছাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে বন্দিদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হতো। নির্যাতনকারীরা বলছে, ‘এভাবে হবে না। এরে লটকা। টানাইতে হবে।’ তো একজন এএসআই (পুলিশে সহকারী উপপরিদর্শক) বলে, হবে। সে আমার দুই হাতে রশি লাগায়। এরপর ফ্যানের হুকের সঙ্গে রশি দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়। শুধু পায়ের বুড়ো আঙুলটা লাগানো থাকে মেঝেতে, পুরা শরীরটা ঝুলানো।’
গুম হওয়া ব্যক্তিরা নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যেতেন। বমি করে দিতেন। কেউ কেউ আবার চোখ বাঁধা অবস্থায় নিজের শরীরের মাংস পোড়ার গন্ধ পেতেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারীরাও বাদ যাননি র্যাব ও বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার ভয়াবহ নির্যাতনের হাত থেকে। তাদের ঝুলিয়ে বিকৃত উল্লাস করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেন বাহিনীর সদস্যরা। সেসব নির্যাতিত নারীদের মধ্যে কেউ হয়তো বেঁচে আছেন, কেউ মারাও গেছেন।
২৪ দিন ধরে নিখোঁজ থাকা ২৫ বছর বয়সি তেমনই এক ভুক্তভোগী নারী গুম কমিশনের কাছে বর্ণনা দিয়েছেন, ‘অনেকটা ক্রুসিফাইড হওয়ার মতো করে হাত দুই দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখে। ওরা আমাদের ওড়না নিয়ে নেয়, আমার গায়ে ওড়না ছিল না। আর যেহেতু জানালার দিকে মুখ করা ছিল, অহরহ পুরুষ মানুষরা এসে আমাদের দেখছিল। এটা বলার বাহিরে! মানে তারা একটা মজা পাচ্ছিল। বলাবলি করতেছিল যে, ‘এমন পর্দাই করছে, এখন সব পর্দা ছুটে গেছে।’
আরও পড়ুন: শব্দনিরোধক ঘরে যমটুপি পরিয়ে ১০ কায়দায় নির্যাতন
ওই নারী আরও বলেন, ‘আমার পিরিয়ড হওয়ার ডেট ছিল অনেক লেটে। কিন্তু যেই টর্চার করে তাতে আমি এত পরিমাণ অসুস্থ হয়ে পড়ি যে, সঙ্গে সঙ্গে আমার পিরিয়ড আরম্ভ হয়ে যায়। তারপর উনাদেরকে বলি যে, ‘আমার তো প্যাড লাগবে’। এটা নিয়েও ওরা অনেক হাসাহাসি করে।’
আরও বলা হয়েছে, র্যাব-২ ও সিপিসি-৩ এর ব্যবহৃত ঘূর্ণায়মান চেয়ার, টিএফআই সেলে (র্যাবের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন সেল) মানুষ ঝুলিয়ে রাখার জন্য ব্যবহৃত পুলি-সিস্টেম এবং একাধিক স্থানে শব্দনিরোধক ব্যবস্থা, যা নির্যাতনের সময় ভুক্তভোগীদের চিৎকার বাইরের কেউ না শুনতে পারে সেজন্য ব্যবহৃত হতো।
নির্যাতনের দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রচলিত পদ্ধতি ছিল বৈদ্যুতিক শক দেওয়া। সম্ভবত যন্ত্রপাতি সহজলভ্য ও সহজে বহনযোগ্য হওয়ার কারণে এর ব্যবহার এত ব্যাপক ছিল। এটি প্রায় সব স্থানেই ব্যবহৃত হতো। এমনকি অপহরণকারী যানবাহনেও।
২০১০ সালে বিশেষ গোয়েন্দা শাখা ২৯ বছর বয়সি এক যুবককে গুম করে। তার ভাষ্যমতে, ‘পায়ে দুইটা ক্লিপ লাগায় দিল, ফার্স্ট সেবার শক খাওয়ার অভিজ্ঞতা। যখন শক দেয়, টোটাল শরীরটা আমার ফুটবলের মতো গোল হয়ে যায়। এরকম আট থেকে দশবার আমাকে শক দিছে। শকটা হয়তো তিন-চার সেকেন্ড সর্বোচ্চ থাকে। তাৎক্ষণিক শরীরটা গোল হয়ে যায়, রগগুলো চেপে ধরে। একেকটা প্রশ্ন করে আর শক দেয়।’
আরও পড়ুন: গুম কমিশনের প্রতিবেদনে নির্যাতনের বিভীষিকাময় চিত্র
৪৬ দিন গুম থাকা ওই যুবক আরও জানান, ‘‘একপর্যায়ে তারা আমার কাপড় খোলে, আবার ওই একই ক্লিপ লাগায় দেয় আমার গোপন দুইটা অঙ্গে। একই জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে। যখনই সুইচ দেয়, মনে হয় আমার সেই অঙ্গগুলো পুড়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে গোস্ত পুড়লে যেরকম একটা গন্ধ লাগে, সেই গন্ধটা পাইতাম আর কি!’
২০১৭ সালে ৩৯ দিন গুম ছিলেন এক ভুক্তভোগী। তিনি গুম কমিশনকে জানান ওয়াটারবোর্ডিং (জলপীড়ন) দিয়ে নির্যাতনের অভিজ্ঞতা।
ভুক্তভোগী বলেন, ‘মুখের উপরে গামছা দিয়া উপরে দিয়া পানি মারা শুরু করে দিছে। জগভর্তি পানি দিতেছে, আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাইতেছে। তারপর ওরা ওই গামছা সরাইয়া বলে, ‘বল কী করছিস’। স্যার, কী কমু…, আপনি আমারে বলেন, কী জানতে চান? আপনি আমারে কেন ধইরা আনছেন?” তখন বলে, ‘না, ওরে হইত না। আবার গামছা দে, আবার গামছা দে, আবার পানি দে।’ এইভাবে তিন-চারবার পানি দেওয়ার পরে বলে, ‘ওরে নিয়া রাইখা আয়।’
প্রতিবেদন বলছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের ‘গুম’ করা হতো। তাদের আটকের কোনো আনুষ্ঠানিক রেকর্ড থাকত না। নির্যাতিতদের জনসম্মুখে হাজির করার আগে নির্যাতনের চিহ্ন লুকাতে কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের ওষুধ বা মলম দেওয়া হতো, যাতে ক্ষতচিহ্ন সহজে নজরে না আসে। অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনের চিহ্ন মুছে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে তাদের মুক্তি দেওয়া হতো।
গুম থেকে মুক্তি মিললেও ভুক্তভোগীর ওপর দীর্ঘ মেয়াদের প্রভাব পরিলক্ষিত হতো বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তাদের মধ্যে মানসিক ট্রমার স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যেত। ফলে তাদের চলমান চিকিৎসা ও মনোস্বাস্থ্য সহায়তার প্রয়োজন হয়। অনেকের শিক্ষা ও কর্মজীবন ব্যাহত হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর দায়ের করা ভুয়া মামলার আইনি লড়াইয়ের ব্যয়।
প্রতিবেদন আরও বলছে, প্রতিটি মামলার জন্য একজন ভুক্তভোগীর গড়ে প্রায় সাত লাখ টাকা খরচ হয়েছে। অনেকের পারিবারিক জীবন যেমন- বিয়ে ও সন্তান-সম্পর্কিত বিষয়, মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবারগুলো এই চাপ সহ্য করতে পারে না। ফলে ভুক্তভোগীরা এক অনিশ্চয়তা ও প্রান্তিকতার জীবনে আটকে পড়েন। ঢাকা মেইল