০৭:২০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫

জুলাইয়ের রক্তাক্ত স্মৃতি: দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা দুই তরুণের গল্প

  • আপডেট সময়: ১০:৪২:১৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫
  • 2

২০২৪ সালের জুলাই মাস যেন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিভীষিকাময় স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে। ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন রূপ নেয় এক ভয়ংকর অভ্যুত্থানে। রাজধানীর রাজপথে ঝরে পড়ে একের পর এক তরুণ প্রাণ। সেই রক্তাক্ত সময়ের দুটি মুখ-ফয়জুল ইসলাম রাজন ও সাজিদুর রহমান ওমর। এখন শুধু স্মৃতির প্রতীক। যাদের মা-বাবা এখনও সন্তানদের ব্যবহৃত রক্তমাখা জামা কিংবা ল্যাপটপ জড়িয়ে ধরে দিন পার করেন।

রক্তমাখা টি-শার্টের বুকে রাজনের মা

মিরপুর-১০ নম্বর মোড়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন একাদশ শ্রেণির ছাত্র ফয়জুল ইসলাম রাজন। বুকের ডান পাশে বিদ্ধ হয়ে পিঠ ছুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল গুলি। সেই রক্তাক্ত টি-শার্ট আজও বুকে জড়িয়ে হাহাকার করে কাঁদেন তার মা মোছাম্মাৎ মাহমুদা।

কেরানীগঞ্জের উত্তর বাহের চরের ছোট্ট ঘরে বসে মাহমুদা বলেন, আমার ছেলে লেখাপড়া শেষ করে সংসার চালাবে। এই আশাতেই তো বেঁচে ছিলাম। ওর বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে বহু বছর হলো। বড় ছেলে লেখাপড়া করতে পারেনি, তাই ছোট ছেলেকে মানুষ করার স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু এখন তো সব শেষ। রাজনের রক্তে ভিজে আমার বুক খালি হয়ে গেছে।

মাহমুদা জানান, ১৯ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে রাজন ফোন করে বলেছিল, সে আন্দোলনে যায়নি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আরেকটি ফোনে সে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, মা, আমাকে ক্ষমা করে দিও।

তখনই মায়ের বুক কেঁপে উঠেছিল। এর এক ঘণ্টা পর খবর আসে, রাজন গুলিবিদ্ধ। আজমল হাসপাতালে যখন ভাই রাজীব ও বোন সেখানে পৌঁছান, তখন রাজনের নিথর দেহ পড়ে আছে হাসপাতালের বিছানায়। রাজীব নিজ হাতে ভাইয়ের লাশ গোসল করিয়েছেন।

রাজীব বলেন, গুলিবিদ্ধ শরীরের প্রতিটি ক্ষত আমার শরীরেও যেন বুলেটের মতো বিঁধেছিল। ভাইয়ের মৃতদেহ যখন গোসল করাচ্ছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, আমি নিজেকেই দাফন করছি।

রাজন ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি একটি দোকানে কাজ করত। পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই নিজের খরচ চালিয়ে বাসাতেও টাকা পাঠাত সে। বড় ভাই রাজীব একটি গার্মেন্টসে চাকরি করেন, যার অল্প আয়ে তিনজনের সংসার চলত না।

রাজনের মা বলেন, আমি শুধু চাই, আমার ছেলেকে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হোক। যে গুলি ছুড়েছে, যারা আদেশ দিয়েছে। তাদের বিচার চাই।

রাজনের পরিবারের পক্ষ থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলার প্রধান অভিযুক্ত করা হয়েছে রাষ্ট্রের তৎকালীন ক্ষমতাবানদের।

ল্যাপটপ খুললে ফিরে আসে ওমরের মুখ

ডেমরার ডগাইর বাজারের এক চিলতে ঘরে সাজিদুর রহমান ওমরের ল্যাপটপ, ভিজিটিং কার্ড আর পাসপোর্ট পড়ে আছে নিঃসঙ্গ সাক্ষী হয়ে। ল্যাপটপটি এখন ব্যবহার করেন ওমরের বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ল্যাপটপ খুললে ভাইয়ের গায়ের ঘ্রাণ পাই। যেন সে এখানেই আছে। ওর ছবিগুলো দেখি আর কান্না চেপে রাখি।

গ্রাফিক ডিজাইন, নেটওয়ার্কিং ও সাইবার সিকিউরিটিতে পারদর্শী ওমর স্বপ্ন দেখতেন বিদেশে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবেন। ফ্রিল্যান্সিং করতেন, একটি ব্রডব্যান্ড কোম্পানিতে কাজ করতেন। নিজস্ব আইটি ফার্মও গড়ার চেষ্টা করছিলেন।

কিন্তু ২১ জুলাই আন্দোলনের সময় যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের গুলিতে তিনি গুরুতর আহত হন। মাথায় গুলি লাগে, মাথার খুলির দুটি অংশ আলাদা হয়ে যায়। ২৪ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে তার মৃত্যু হয়।

সিরাজুল বলেন, ২১ জুলাই দুপুরে যখন জানলাম, ভাইকে গুলি লেগেছে, তখন আমি দৌঁড়ে ঢাকা মেডিকেলে যাই। ভাই তখন লাইফ সাপোর্টে, মুখ নিথর। ওর মাথা বাঁধা, চোখ বন্ধ। আমার মনে হচ্ছিল, সে আর ফিরবে না।

চোখের জল চাপা দিয়ে তিনি আরও বলেন, ওমর বলত, গুলি আমাকে আঘাত করুক, আমি শহীদ হব। আজ সে সত্যিই শহীদ হলো, কিন্তু এভাবে দেখতে হবে ভাবিনি।

তার বাবা মো. শাহজাহান বর্তমানে অসুস্থ, কোনো কাজ করতে পারেন না। পরিবারটির একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য ছিলেন ওমর। এখন পরিবারটির অবস্থা চরম সংকটাপন্ন। বাড়িভাড়া দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। মা মোস্ত পারভিন এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন নি।

শাহজাহান বলেন, আমার ছেলে খুব স্বপ্নবাজ ছিল। আমাদের রোজগার করে দিত, আমাদের সম্মান দিত। আজ তাকে হারিয়ে মনে হচ্ছে, যেন একটা আলো নিভে গেছে। আমার ছেলেকে যারা মেরেছে, তাদের বিচার চাই। আমি চাই, এই হত্যার জন্য দায়ীদের ফাঁসি হোক।#

 

উত্তরাধুনিক

Writer, Singer & Environmentalist

জুলাইয়ের রক্তাক্ত স্মৃতি: দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা দুই তরুণের গল্প

আপডেট সময়: ১০:৪২:১৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫

২০২৪ সালের জুলাই মাস যেন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিভীষিকাময় স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে। ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন রূপ নেয় এক ভয়ংকর অভ্যুত্থানে। রাজধানীর রাজপথে ঝরে পড়ে একের পর এক তরুণ প্রাণ। সেই রক্তাক্ত সময়ের দুটি মুখ-ফয়জুল ইসলাম রাজন ও সাজিদুর রহমান ওমর। এখন শুধু স্মৃতির প্রতীক। যাদের মা-বাবা এখনও সন্তানদের ব্যবহৃত রক্তমাখা জামা কিংবা ল্যাপটপ জড়িয়ে ধরে দিন পার করেন।

রক্তমাখা টি-শার্টের বুকে রাজনের মা

মিরপুর-১০ নম্বর মোড়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন একাদশ শ্রেণির ছাত্র ফয়জুল ইসলাম রাজন। বুকের ডান পাশে বিদ্ধ হয়ে পিঠ ছুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল গুলি। সেই রক্তাক্ত টি-শার্ট আজও বুকে জড়িয়ে হাহাকার করে কাঁদেন তার মা মোছাম্মাৎ মাহমুদা।

কেরানীগঞ্জের উত্তর বাহের চরের ছোট্ট ঘরে বসে মাহমুদা বলেন, আমার ছেলে লেখাপড়া শেষ করে সংসার চালাবে। এই আশাতেই তো বেঁচে ছিলাম। ওর বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে বহু বছর হলো। বড় ছেলে লেখাপড়া করতে পারেনি, তাই ছোট ছেলেকে মানুষ করার স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু এখন তো সব শেষ। রাজনের রক্তে ভিজে আমার বুক খালি হয়ে গেছে।

মাহমুদা জানান, ১৯ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে রাজন ফোন করে বলেছিল, সে আন্দোলনে যায়নি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আরেকটি ফোনে সে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, মা, আমাকে ক্ষমা করে দিও।

তখনই মায়ের বুক কেঁপে উঠেছিল। এর এক ঘণ্টা পর খবর আসে, রাজন গুলিবিদ্ধ। আজমল হাসপাতালে যখন ভাই রাজীব ও বোন সেখানে পৌঁছান, তখন রাজনের নিথর দেহ পড়ে আছে হাসপাতালের বিছানায়। রাজীব নিজ হাতে ভাইয়ের লাশ গোসল করিয়েছেন।

রাজীব বলেন, গুলিবিদ্ধ শরীরের প্রতিটি ক্ষত আমার শরীরেও যেন বুলেটের মতো বিঁধেছিল। ভাইয়ের মৃতদেহ যখন গোসল করাচ্ছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, আমি নিজেকেই দাফন করছি।

রাজন ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি একটি দোকানে কাজ করত। পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই নিজের খরচ চালিয়ে বাসাতেও টাকা পাঠাত সে। বড় ভাই রাজীব একটি গার্মেন্টসে চাকরি করেন, যার অল্প আয়ে তিনজনের সংসার চলত না।

রাজনের মা বলেন, আমি শুধু চাই, আমার ছেলেকে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হোক। যে গুলি ছুড়েছে, যারা আদেশ দিয়েছে। তাদের বিচার চাই।

রাজনের পরিবারের পক্ষ থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলার প্রধান অভিযুক্ত করা হয়েছে রাষ্ট্রের তৎকালীন ক্ষমতাবানদের।

ল্যাপটপ খুললে ফিরে আসে ওমরের মুখ

ডেমরার ডগাইর বাজারের এক চিলতে ঘরে সাজিদুর রহমান ওমরের ল্যাপটপ, ভিজিটিং কার্ড আর পাসপোর্ট পড়ে আছে নিঃসঙ্গ সাক্ষী হয়ে। ল্যাপটপটি এখন ব্যবহার করেন ওমরের বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ল্যাপটপ খুললে ভাইয়ের গায়ের ঘ্রাণ পাই। যেন সে এখানেই আছে। ওর ছবিগুলো দেখি আর কান্না চেপে রাখি।

গ্রাফিক ডিজাইন, নেটওয়ার্কিং ও সাইবার সিকিউরিটিতে পারদর্শী ওমর স্বপ্ন দেখতেন বিদেশে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবেন। ফ্রিল্যান্সিং করতেন, একটি ব্রডব্যান্ড কোম্পানিতে কাজ করতেন। নিজস্ব আইটি ফার্মও গড়ার চেষ্টা করছিলেন।

কিন্তু ২১ জুলাই আন্দোলনের সময় যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের গুলিতে তিনি গুরুতর আহত হন। মাথায় গুলি লাগে, মাথার খুলির দুটি অংশ আলাদা হয়ে যায়। ২৪ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে তার মৃত্যু হয়।

সিরাজুল বলেন, ২১ জুলাই দুপুরে যখন জানলাম, ভাইকে গুলি লেগেছে, তখন আমি দৌঁড়ে ঢাকা মেডিকেলে যাই। ভাই তখন লাইফ সাপোর্টে, মুখ নিথর। ওর মাথা বাঁধা, চোখ বন্ধ। আমার মনে হচ্ছিল, সে আর ফিরবে না।

চোখের জল চাপা দিয়ে তিনি আরও বলেন, ওমর বলত, গুলি আমাকে আঘাত করুক, আমি শহীদ হব। আজ সে সত্যিই শহীদ হলো, কিন্তু এভাবে দেখতে হবে ভাবিনি।

তার বাবা মো. শাহজাহান বর্তমানে অসুস্থ, কোনো কাজ করতে পারেন না। পরিবারটির একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য ছিলেন ওমর। এখন পরিবারটির অবস্থা চরম সংকটাপন্ন। বাড়িভাড়া দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। মা মোস্ত পারভিন এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন নি।

শাহজাহান বলেন, আমার ছেলে খুব স্বপ্নবাজ ছিল। আমাদের রোজগার করে দিত, আমাদের সম্মান দিত। আজ তাকে হারিয়ে মনে হচ্ছে, যেন একটা আলো নিভে গেছে। আমার ছেলেকে যারা মেরেছে, তাদের বিচার চাই। আমি চাই, এই হত্যার জন্য দায়ীদের ফাঁসি হোক।#