
তোফায়েল হোসেন জাকির, গাইবান্ধা
বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী ধারা লোকগান। আর এসব গানের অবিচ্ছেদ্য অংশ দোতারা। কালের পরিক্রমায় এ যন্ত্রের ব্যবহার কমে গেলেও ২৮ বছর আঁকড়ে ধরে দোতারা তৈরি করে তা বাজারজাত করে চলেছেন বৃদ্ধ আতাউর রহমান মণ্ডল। ইতোমধ্যে নিজ জেলার গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার লাখো শিল্পগোষ্ঠীর কাঁধে এই দোতারার সুরে মাতোয়ারা দর্শক শ্রোতা।
এই উদ্যোক্তা আতাউর রহমান মণ্ডলের বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার পাচঁগাছী ইউনিয়নের দশমৌজা পানেয়া গ্রামে। গাইবান্ধার সীমান্তবর্তী ওই গ্রামের মৃত আমির উদ্দিন মণ্ডলের ছেলে তিনি।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) সরেজমিনে দেখা গেছে- সবুজে ঘেরা নিভৃত পানেয়া গ্রামের বাড়িতে একাধিক শ্রমিক নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে তুলেছেন দোতারা তৈরি কারখানা। এসময় উদ্যোক্তা আতাউর রহমান মণ্ডল তার শ্রমিকদের নিয়ে আপন খেয়ালে দোতারা বানাচ্ছেন। নিপুণ হাতে কাঠে নকশা এঁকে বাটালের ওপর হাতুড়ি পিটিয়ে দোতারা ফুটিয়ে তুলছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রংপুর জেলায় প্রচলিত লোকসংগীতের মধ্যে ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি এবং বাউল সঙ্গীত প্রধান। এসব সঙ্গীদের আসর এখন আর খুব বেশি নজরে পড়ে না। লোকগানের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হাতে তৈরি দোতারার চাহিদা আগে সারাবছরই লেগেই থাকতো। আর এ যন্ত্রের কারিগরদের জীবনও চলতো একই গতিতে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে যেমন লোকগানের ধারা বদলেছে, তেমনি আধুনিক প্রযুক্তি ও নিত্য নতুন যন্ত্রের ভিড়ে চাহিদা কমেছে দেশীয় দোতারার। বর্তমানে অনেক কারিগরই আর্থিক অভাবে পড়ে জীবন ও জীবিকার তাগিদে পূর্বপুরুষের এই পেশা ছেড়ে বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা। কিন্তু পেশা ছাড়তে নারাজ আতাউর রহমান মণ্ডল। আর্থিক সংকট আর নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও বাণিজ্যিকভাবে দোতারা তৈরি করে তা বিক্রি করে চলেছেন। ইতোমধ্যে তার হাতে তৈরি দোতারা নিজ এলাকার গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকা, সিলেট, খুলনা, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। এসব জেলার অর্ধশত পাইকার এসে আতাউরের বাড়িতে থেকে দোতারা কিনে তা বাজারজাত করছে বলে জানা গেছে।
স্থানীয় ভাওয়াইয়া শিল্পী হায়দার আলী বলেন, আমরা যারা আছি সবাই আতাউর ভাইয়ের কাছ থেকে দোতারা কিনে থাকি। তার তৈরি দোতারা সুরে মাতোয়ারা হয়ে উঠেন দর্শক শ্রোতা। তবে শারীরিক অসুস্থ আর আর্থিক সংকটের কারণে তার কারখানাটি প্রসারিত হচ্ছে না।
এ বিষয়ে শ্রমিক লাভলু মণ্ডল ও রুমন মণ্ডল জানান, উদ্যোক্তা আতাউর রহমান মণ্ডলের দোতারা কারখানায় প্রায় দুইযুগ ধরে কাজ করছেন। সেই সময়ে ৫০ টাকা মজুরি পাওয়ার পর ধীরে ধীরে বেড়ে এখন ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা পারিশ্রমিক পাচ্ছেন। এ দিয়ে চলছে তাদের সংসার।
উদ্যোক্তা আতাউর রহমান মণ্ডল জানান, দিনাজপুর জেলাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে নিম ও কাঁঠাল কাঁঠ কিনে তা দিয়ে দোতারা তৈরি করছেন। এতে চামড়া, তার, ফরমিকাসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে ফুটিয়ে তুলছেন আকর্ষণীয় দোতারা। প্রতিটি দোতারা মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার টাকা থেকে ৮ হাজার টাকায়। এতে প্রায় মাসিক লাভ লাখ টাকা থাকে তার।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় দেশীয় বাদ্যযন্ত্র বিলুপ্তির পথে। তবুও এই পেশাকে আঁকড়ে ধরে দোতারা বানানো কাজ অব্যাহত রেখেছি। কিন্তু অর্থাভাবে এখন এই কারখানাটি ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই দেশীয় সংস্কৃতিসহ বাদ্যযন্ত্রগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। আর তা না হলে বাংলার ঐতিহ্যবাহী দোতারা একদিন হারিয়ে যাবে।
পাঁচগাছী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া জানান, বহু বছর ধরে দোতারা তৈরি করছেন আতাউর। এ পেশায় স্বাবলম্বী হয়েছেন। ইদানীং এ যন্ত্রের চাহিদা কমের কারণে কিছুটা হিমসিম অবস্থায় আছেন। তাকে পরিষদের পক্ষ থেকে সহযোগিতার চেষ্টা করা হবে। ঢাকা মেইল