
প্রতীকী ছবি
মাথায় চেপেছে পাহাড় সমান ঋণের বোঝা। অথবা সাংসারিক চাপে বীতশ্রদ্ধ অবস্থা। কেউ আবার প্রেমে আঘাত পেয়ে হতাশ হয়ে জীবন শেষ করে দিতে চান। মনে হয় যদি সব কিছু ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়া যেত নিজের মতো করে।
এমন ভাবনাই সত্যি করে তুলেছে উদীয়মান সূর্যের দেশ জাপান।
সেখানে টাকা দিয়ে ইচ্ছামতো উধাও হয়ে যাওয়ার ‘পাসপোর্ট’ পাওয়া যায়। পরিষেবার আকারে, অর্থের বিনিময়ে ‘গুম’ করে দেওয়া হয় ইচ্ছুক ব্যক্তিদের। প্রতি বছরই এই দেশের লক্ষাধিক মানুষ স্বেচ্ছায় ‘নিখোঁজ’ হতে পছন্দ করেন।
জাপানের বহু মানুষ আছেন যারা তাদের জীবন, চাকরি, বাড়িঘর এবং পরিবার ত্যাগ করে উধাও হয়ে যান। জাপানে এমন কিছু সংস্থা রয়েছে, যারা এই ব্যক্তিদের টাকার বিনিময়ে এই কাজে সহায়তা করে।
জাপানে এই পরিষেবা বা ব্যবসা সম্পূর্ণ বৈধ। এই ধরনের মানুষকে অভিহিত করা হয় ‘জোহাৎসু’ নামে।
এই জাপানি শব্দের অর্থ সম্পূর্ণ উধাও হয়ে যাওয়া। যারা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে লুকাতে চান, তাদের বোঝাতে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
এরা তাদের নিজস্ব জীবন থেকে হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মাঝরাতে কাউকে কিছু না বলেই তাদের বাড়িঘর, চাকরি এবং পরিবার ছেড়ে দ্বিতীয় জীবন শুরু করেন। প্রায়শই তারা আর পিছনে ফিরে তাকাতে চান না।
প্রথম জীবনের সমস্ত পরিচয়ের খোলস ছেড়ে তারা প্রবেশ করেন জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ে।
সম্প্রতি একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্টে দাবি করা হয়েছে, প্রতি বছর এক লক্ষেরও বেশি মানুষ এভাবে নিখোঁজ হন। যে সংস্থাগুলো নিখোঁজ হওয়ার জন্য সহায়তা করে তাদের জাপানি ভাষায় ‘ইয়োনিগেয়া’ বলা হয়। ইংরেজিতে এদেরই নাম ‘নাইট মুভার্স’। পারিবারিক নির্যাতন বা ঋণের বোঝা থেকে পরিত্রাণ পেতে চাওয়া মানুষদের শেষ আশা এই সংস্থাগুলো।
হঠাৎ করে উধাও হয়ে যেতে চাওয়া মানুষগুলো কোথায় আছেন বা কী করছেন, সেই সমস্ত তথ্য গোপন রাখার সমস্ত বন্দোবস্ত করে সংস্থাগুলো। এই অজ্ঞাতবাস পর্ব চলতে পারে এক বছর থেকে শুরু করে কয়েক দশক পর্যন্ত। গোপন স্থানে থাকারও ব্যবস্থা করে দেয় সংস্থাটি।
ইচ্ছুক ব্যক্তিদের কাছে ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে সংস্থাটি। তাদের চাহিদা জানার পর খরচ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। সেই খরচ ২ লক্ষ টাকা থেকে ১৮ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। কার সমস্যা কতটা গভীর বা উধাও হওয়ার পদ্ধতি কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হবে তার ওপর খরচ নির্ভর করে।
এর পরে গ্রাহক ও সংস্থার একটি মুখোমুখি বৈঠক হয়। তার পর দু’পক্ষের সম্মতিতে স্থির হয় পরবর্তী কার্যপ্রণালী। কীভাবে আত্মগোপন করবেন ও কোথায় থাকবেন, সবই সংস্থার ব্যবস্থাপনায় সম্পন্ন হয়। নতুন পরিচয়পত্র পেতে সাহায্য করে ‘নাইট মুভার্স’ নামে পরিচিত সংস্থাগুলো।
জাপানে গোপনীয়তা অত্যন্ত মূল্যবান। অন্য কোনো কারণ না থাকলে পুলিশ হস্তক্ষেপ করবে না। অপরাধঘটিত কারণ খুঁজে না পেলে অথবা দুর্ঘটনা না ঘটলে সরকারিভাবে কোনো তত্ত্ব-তালাশ করা হয় না। যারা ‘জোহাৎসু’, পুরনো জীবন পিছনে ফেলে চলে এসেছেন তাদের সিসিটিভি ক্যামেরা বা এটিএম-এর মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করা নিয়ে সমস্যা নেই। কারণ প্রশাসনের নজরদারি বা অনুসরণ করা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না।
যারা সফলভাবে ‘জোহাৎসু’ হন তারা প্রায়শই শান্তিপূর্ণ এলাকায় চলে গিয়ে বসবাস করেন। কম জনবসতিপূর্ণ এলাকা বেছে নেন নতুন জীবনের জন্য। এমন ছোট ছোট চাকরি গ্রহণ করেন যেখানে তাদের পূর্বজীবনের পটভূমি পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয় না।
‘জোহাৎসু’দের সবাই যে দ্বিতীয় জীবন বা অজ্ঞাতবাসে গিয়ে সুখী হন তা নয়। কেউ কেউ সামাজিক চাপ থেকে মুক্ত হয়ে নতুন জীবনে স্বস্তি খুঁজে পান। আবার অনেকে একাকীত্বের অনুভূতিকে মেনে নিতে কষ্ট পান। মানসিক চাপ থেকে মুক্ত হতে সেই আবর্তের মধ্যেই পড়ে যান তারা।