
অপরাধমূলক নানা ঘটনায় বছরজুড়ে আলোচনায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর। বিশেষ করে কিশোর গ্যাং সদস্যদের দৌরাত্ম্যে দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে এলাকাটি। শুধু তাই নয়, কথা কাটাকাটি, খেলায় হার-জিত, আবার কখনো চায়ের দোকানে আড্ডার জেরে তর্ক থেকেও ঘটছে খুনের ঘটনা। তুচ্ছ ঘটনার কারণে এই হত্যাকাণ্ডগুলো শুধু পরিসংখ্যান বাড়াচ্ছে না, বরং সৃষ্টি করছে ভীতির পরিবেশ। গত ৭ মাসে মোহাম্মদপুর জোনে তুচ্ছ ঘটনায় ৯টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতি বছর এক-পঞ্চমাংশ হত্যার ঘটনাই ঘটছে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
রাজধানীর আদাবরের নবোদয় এলাকায় গত ১৬ জুলাই সন্ধ্যায় ডিম ভেঙে ফেলায় তার দোকানের কর্মচারী সুজন শিকদারকে নিয়ে বিচার সালিসে বসেন ডিম দোকানি সজীব। এক পর্যায়ে তর্কাতর্কির সময় কোমর থেকে পিস্তল বের করে ডিম দোকানের কর্মচারী সুজন শিকদারের চাচা প্রাইভেটকার চালক ইব্রাহীমকে (২৯) গুলি করে হত্যা করেন সজীব। এ ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দারা ঘটনাস্থল ঘেরাও করে সজীব ও রুবেল নামে দুই যুবককে আটক করে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে হস্তান্তর করে।
“মানুষের মনের মধ্যে প্রতিশোধ পরায়ণতা সবচেয়ে বেশি কাজ করে। যার ফলে কেউ প্রতিশোধ নিতে গিয়ে হত্যা করছে। এছাড়াও, বিদেশি সিনেমাগুলো দেখে দেশের তরুণ সমাজ নতুন গ্যাং বাহিনী তৈরি করছে।”
ড. তৌহিদুল হক, অপরাধ বিজ্ঞানী
একই দিন সন্ধ্যা সাতটার দিকে মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যানের লাউতলায় পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আল–আমিন (৩০) নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ দুটি ঘটনায় পুরো মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকা জুড়ে চরম আতঙ্ক দেখা দেয়। পাশাপাশি, এ বছরের ২৬ জুলাই মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী ১ নম্বর গেটে পূর্ব শত্রুতার জেরে ফজলে রাব্বী সুমন (২৬) নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এছাড়াও এ বছরের ৮ জুন রাজধানীর শনির আখড়ায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া নিয়ে তর্কের এক পর্যায়ে যাত্রীর মারধরে নাঈম হোসেন (২৫) নামে এক চালক নিহত হন। এ ঘটনায় একজনকে গ্রেফতার করে কদমতলী থানা পুলিশ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতে, এসব হত্যাকাণ্ডে সহজে ঘাতকরা জামিনে মুক্তি পেয়ে আবারও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। তারা এলাকায় সংক্ষুব্ধ সন্ত্রাসী গ্রুপ হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে, হত্যাকাণ্ড কিংবা ছিনতাই এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িতদের প্রায় সবাই মাদকাসক্ত। এছাড়া এসব সন্ত্রাসীকে গ্রেফতারের পর তাদের সাব আরেকটি গ্রুপ বেড়ে ওঠে। এজন্য এদের একেবারে দমন করা যাচ্ছে না। তবে, হঠাৎ কোনো ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযানে তারা কিছু দিন শান্ত থাকে।
পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য বলছে, ঢাকায় নামে বেনামে ৮০টি গ্যাং বাহিনীর খোঁজ পাওয়া গেছে। যেগুলোর বেশির ভাগ ‘কিশোর গ্যাং’ নামে পরিচিত। নামে কিশোর গ্যাং হলেও এসব বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্যের বয়স ১৮ বছরের বেশি। তারা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখলে সহায়তা, ইন্টারনেট সংযোগ, কেবল টিভি (ডিশ) ব্যবসা ও ময়লা–বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, উত্ত্যক্ত করা, যৌন হয়রানি করা, হামলা, মারধরসহ নানা অপরাধে জড়িত।
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের তথ্য বলছে, তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানা এলাকায় এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত ৯টি হত্যা মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ফেব্রুয়ারি ও জুলাই মাসে আদাবর থানায় একটি করে ২টি হত্যা মামলা এবং মোহাম্মদপুর থানায় জনুয়ারি মাসে একটি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ৩টি মামলা, মে মাসে একটি ও জুলাই মাসে ২টি মামলাসহ জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত এ থানায় মোট ৭টি হত্যা মামলা হয়েছে।

বেড়েই চলেছে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত। ছবি: সংগৃহীত
এ বিষয়ে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ইবনে মিজান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা সবসময় এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কাজ করে যাচ্ছি। এ এলাকায় প্রতিনিয়ত অভিযান করে সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হচ্ছে।’
মোহাম্মদপুরের পাশাপাশি, রাজধানীর আদাবর, দারুস সালাম, মিরপুর, পল্লবী, উত্তরাসহ প্রায় ১০টি এলাকায় সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। তবে, এদের মধ্যে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় সবচেয়ে বেশি তৎপর সন্ত্রাসী বাহিনী। এছাড়াও, ঢাকার প্রায় প্রতিটি থানা এলাকায় ৫০০ থেকে এক হাজার সদস্য রয়েছে।
এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দিন দিন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারাদেশে এক হাজার ৯৩০ জন খুন হয়েছেন এবং শুধু জুন মাসে দেশে সর্বোচ্চ ৩৪৩ জন খুন হয়েছেন। এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত ৭ মাসে দেশে প্রতিদিন খুনের সংখ্যা ৯ জনের অধিক।
দীর্ঘ সময় ধরে বিচার প্রক্রিয়া হত্যাকাণ্ড বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, আমাদের দেশে হত্যার যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, হত্যার ঘটনাগুলোতে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার না হওয়াটা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে। হত্যাকারীদের বাঁচাতে আমাদের দেশে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে শুরু করে অর্থের লেনদেনে রায়কে প্রভাবিত করা- এ ধরনের কাজগুলো একজন সন্ত্রাসীকে আরও ভয়ংকর হতে সবচেয়ে অনুপ্রেরণা দেয়।
এই অপরাধ বিজ্ঞানী বলেন, পাশাপাশি, আমাদের দীর্ঘদিনের সামাজিক আচরণের প্রেক্ষাপটে এখন সবাই ক্ষমতা দেখাতে চায়। সমাজে কাউকে ছোট করে হেয় প্রতিপন্ন করা এবং একজন আরেকজনকে ক্ষতি করার মন মানসিকতা তৈরি করে ক্ষমতা প্রদর্শন করতে এখন আমাদের আনন্দ দেয়। আবার মানুষের মনের মধ্যে প্রতিশোধ পরায়ণতা সবচেয়ে বেশি কাজ করে। যার ফলে কেউ প্রতিশোধ নিতে গিয়ে হত্যা করছে। এছাড়াও, বিদেশি সিনেমাগুলো দেখে দেশের তরুণ সমাজ নতুন গ্যাং বাহিনী তৈরি করছে। এ কারণে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।


























