১২:৪৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫

উপকূলজুড়ে অদৃশ্য ছোবল, হুমকিতে প্রাণ ও প্রকৃতি!

  • আপডেট সময়: ১২:১৭:৪৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ অগাস্ট ২০২৫
  • 68

হুমকিতে দেশের উপকূলের প্রাণ-প্রকৃতি। ছবি কোলাজ: ঢাকা মেইল


-সমুদ্র দূষণের হটস্পট সেন্টমার্টিন

-হোটেল-মোটেলের ১৫০ টন বর্জ্য যাচ্ছে সমুদ্রে

-পৌর বর্জ্যও সমুদ্রে, শীর্ষে পর্যটনসৃষ্ট দূষণ

-বর্জ্যের তথ্য অস্বীকার কক্সবাজারের ডিসির

দেশের সমুদ্র উপকূল শুধু মাছ ধরা ও জীবিকার কেন্দ্র নয়, বরং দেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের প্রাণকেন্দ্রও। কক্সবাজারের সোনালি বালি থেকে সেন্টমার্টিনের নিখুঁত দ্বীপ, সন্দ্বীপের নৌকাঘাট থেকে ভোলার জলরাশির কোণে-সমস্ত উপকূলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে এক অদৃশ্য হুমকি। যার নাম মাইক্রোপ্লাস্টিক। এই ক্ষুদ্রতম প্লাস্টিক কণাগুলো চোখে না দেখলেও তাদের প্রভাব মারাত্মক। মাছের ফুলকা, পাকস্থলী থেকে শুরু করে মানুষের রক্তেও প্রবেশ করছে এটি। সমুদ্রের খাদ্য চক্রের প্রতিটি স্তরকে দূষিত করছে।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক গবেষণার তথ্য বলছে, উত্তর-পূর্ব ও মধ্য উপকূলের মাছের ফুলকা ও পাকস্থলীতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ভয়ংকর উপস্থিতি। প্রধানত মাইক্রো-ফাইবার, ফ্র্যাগমেন্ট ও ফোম আকারে এগুলো মাছের দেহে জমছে। কক্সবাজার উপকূলে পর্যটন ও শিল্প বর্জ্য, নদীবাহিত প্লাস্টিক এবং মাছ ধরার জাল-সব মিলিয়ে দূষণের হটস্পট তৈরি করেছে।

এদিকে, পানিতে থাকা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া এই ক্ষুদ্র কণাগুলোর সঙ্গে মিশে নতুন স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। সমুদ্রের এই অদৃশ্য বিষবিন্দু শুধু প্রকৃতি নয়, মানুষের স্বাস্থ্যকেও হুমকির মুখে ফেলেছে। একমাত্র সমন্বিত সচেতনতা, পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা ও কঠোর নিয়ন্ত্রণে এই নিঃশব্দ বিপর্যয়কে প্রতিহত করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) থেকে শুরু করে NOAA এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের Marine Strategy Framework Directive (MSFD)—সব আন্তর্জাতিক সংস্থাই একে ঘোষণা করেছে বৈশ্বিক সংকট হিসেবে। আকারে মাত্র ২০ থেকে ২০০ মাইক্রন। কখনো এক মিলিমিটারেরও কম-এমন ক্ষুদ্র কণাই হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের সমুদ্রের অন্তর্লীনের অদৃশ্য শত্রু।

অদৃশ্য ছোবলে দেশের সমুদ্রসীমা, গবেষণার ফলাফল

বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (BORI) ২০২১–২০২৪ সালের মধ্যে ধারাবাহিক গবেষণায় এই উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছে। গবেষণায় তারা উত্তর-পূর্ব উপকূলের ১৪১টি মাছের মধ্যে ২১ প্রজাতিতে ২৪২টি মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পেয়েছে। প্রতি মাছের পাকস্থলীতে গড়ে ১ দশমিক ৫টি, ফুলকায় শূন্য দশমিক ৪৫টি কণা পেয়েছে।

মধ্য উপকূল-হাতিয়া, সন্দ্বীপ ও ভোলায় সংগৃহীত ১৫০টি মাছের শরীরে পাওয়া গেছে ২৪৮টি কণা। সেখানে পাকস্থলীতে গড়ে ২ দশমিক ২৫টি এবং ফুলকায় শূণ্য দশমিক ৩৮টি কণা পেয়েছে।

প্লাস্টিক বর্জে্য ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। ছবি: সংগৃহীত

গবেষণায় ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়- ৭০ শতাংশ মাইক্রো-ফাইবার (টেক্সটাইল বর্জ্য থেকে), ২৫ শতাংশ ফ্র্যাগমেন্ট (বোতল, প্যাকেজিং), ৫ শতাংশ ফোম (ফিশিং নেট ও প্যাকেজিংয়ের অবশেষ) থেকে এসেছে।

গবেষণায় আরও একটি উদ্বেগজনক চিত্র হলো, সবচেয়ে ছোট আকারের কণাই সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ, চোখে অদৃশ্য কণাই সবচেয়ে বেশি প্রবেশ করছে জ্বলজ প্রাণিদেহে। ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে কণার আকার ৫০–১০০ মাইক্রোন, ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে ১০০–২০০ মাইক্রোন এবং ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে ২০–৫০ মাইক্রোন। এছাড়া কালো রংয়ের মাইক্রোপ্লাস্টিক ৪৫ শতাংশ এবং ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে স্বচ্ছ রংয়ের মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যায়। মাইক্রোপ্লাস্টিকের ৬৫ শতাংশই ফাইবার। ফ্রাগমেন্ট ২৫ শতাংশ এবং ফিল্ম ১০ শতাংশ। ৬-৬ এর নাইলন ৫০ শতাংশ, পলিইথিলিন ৩০ শতাংশ এবং পলিপ্রোপিলিন ২০ শতাংশ।

এনভায়রনমেন্টাল ওশানোগ্রাফি ও ক্লাইমেট বিভাগের সাইন্টিফিক অফিসার সুলতান আল নাহিয়ান জানান, এই গবেষণায় কুতুবদিয়া, সাঙ্গু, চট্রোগ্রাম, হাতিয়া, ভোলা ও সন্দ্বীপের নতুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। যেখানে স্থানীয় জেলেদের নৌকায় সরাসরি অংশগ্রহণ করে অগভীর জল থেকে মাছ সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষণার জন্য ২৫ প্রজাতির মাছ ও শেলফিশ সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত প্রজাতিগুলোর মধ্যে ৯টি মাটির কাছাকাছি এবং ১৬টি মধ্য ও উপরিস্তরের থাকে।

তিনি বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে একবার ব্যবহার করা প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করা জরুরি। একইসঙ্গে প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহারে উৎসাহসহ আরও বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

দূষণের হটস্পট সেন্টমার্টিন! 

শুধু মাইক্রোপ্লাস্টিক নয়, জৈব ও অজৈব্য দূষণের ভয়াবহ চিত্র কক্সবাজারে। এরমধ্যে হটস্পট হিসেবে উঠে আসছে সেন্টমার্টিনের নাম। পৃথক আরেকটি গবেষণায় এই চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণার তথ্য বলছে, কক্সবাজার উপকূলে পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউজ ও হ্যাচারির প্রায় দেড়শ টন বর্জ্য সমুদ্রে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া পর্যটকদের ফেলে যাওয়া বর্জ্যও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গবেষণায় কক্সবাজারের ইনানি, সুগন্ধা, সেন্টমার্টিন, মহেলশাখী, সোনাদিয়াসহ মোট ২৭টি এলাকা থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। যেখানে প্রতি বর্গমিটারে ১৬টি কোয়াট্রেড স্থাপন করে দূষণকারী পদার্থ শনাক্ত করা হয়েছে।

গবেষণায় ৩০ প্রকার দূষণকারী পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এরমধ্যে জৈব দূষক ৯ ধরনের এবং অজৈব ২১ ধরনের দূষক। দূষণের ১৫ শতাংশ মানবসৃষ্ট, ৭ শতাংশ প্রকৃতিসৃষ্ট, মার্কেটজাত ২০ শতাংশ, মৎস্যজাত ১৯ শতাংশ, মেডিকেল ৩ শতাংশ এবং ৩৬ শতাংশই পর্যটনসৃষ্ট।

গবেষণায় সোনাদিয়া ও সেন্টমার্টিনে মারাত্মক দূষণের চিত্র উঠে এসেছে। সেন্টমার্টিনে দূষক বস্তু পাওয়া গেছে ১৪ হাজার ১৩০ থেকে ১৮ হাজার ৩৮১ পর্যন্ত। দূষণের এর কাছাকাছি রয়েছে মহেশখালী। নাজিরারটেকে নাইট্রেটের মাত্রা পাওয়া গেছে ২২ দশমিক ১ মিলিগ্রাম। যা জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

মৎস্যসংক্রান্ত দূষণের ৫৬ শতাংশ কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপের। পর্যটনসংক্রান্ত দূষণের আধিক্য পাওয়া গেছে নজিরারটেক, হিমছড়ি ও শামলাপুরে। মোট দূষণের ৩৩ শতাংশই মহেশখালী, ফিশারি ঘাট ও নাজিরারটেকে।

উঠে এসেছে আরও এক ভয়াবহ চিত্র

গবেষণায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তারের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণার তথ্য বলছে, পানি ও মাইক্রোপ্লাস্টিকসহ অন্যান্য দূষণকারী পদার্থের উপস্থিতি একত্রে নতুন স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন কেবল পরিবেশগত দূষণ নয়। এটি মানবস্বাস্থ্যের জন্য নতুন অদৃশ্য বাহক। জলজ পরিবেশে প্রবাহিত এই ক্ষুদ্র কণাগুলোতে যে ব্যাকটেরিয়া বাসা বাঁধছে, তারা সহজে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করছে। পরিণামে, সাধারণ ব্যাকটেরিয়া থেকে ভয়ানক অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী স্ট্রেইনগুলো দ্রুত বিস্তার পাচ্ছে, যা মানুষের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করছে।

পর্যটন বর্জে্য হুমকিতে কক্সবাজার। ছবি: সংগৃহীত

এটি একটি জটিল চিত্র। যেখানে প্লাস্টিক দূষণ, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য, খাদ্যচক্র এবং মানব স্বাস্থ্য একসাথে সংযুক্ত হয়ে নিঃশব্দ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ছগীর আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, গবেষণাগুলো বাংলাদেশের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার ওপর আলোকপাত করেছে। এখানে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ ও সামুদ্রিক মাছের ওপর এর প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে। এটি মানবস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় হুমকি। দূষণ নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। এখানে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার যে চিত্র উঠে এসেছে, এটি মানবস্বাস্থ্যের জন্য অশনি সংকেত। মেটাজিনোমিক্স ও জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মতো উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভবিষ্যতে এই সমস্যার গভীরতা বুঝতে আরও গবেষণা প্রয়োজন। পরিবেশগত সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে পরিবেশ, সমাজ ও অর্থনীতির সমন্বয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দূষণ রোধে বাস্তবিক কর্মপরিকল্পনাও প্রয়োজন।

এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. সালাহউদ্দীন ঢাকা মেইলকে বলেন, এমন গবেষণা রিপোর্ট সম্পর্কে জানি না। আমাকে খোঁজ নিতে হবে। কারণ পৌর বর্জ্য কখনোই সমুদ্রে পড়ে না। পৌর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আমাদের আছে।

এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীনের মোবাইলফোনে একাধিক কল করলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামানের মোবাইলফোনে একাধিক কল করে বন্ধ পাওয়া যায়। একারণে বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মাহাবুল ইসলাম, ঢাকা মেইল

 

উত্তরাধুনিক

Writer, Singer & Environmentalist

ভ্যাঙ্কি আংটি: ঐশ্বরিয়ার হাতের এই আংটি কখনও খোলেন না, জানেন এর পেছনের গল্প?

উপকূলজুড়ে অদৃশ্য ছোবল, হুমকিতে প্রাণ ও প্রকৃতি!

আপডেট সময়: ১২:১৭:৪৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ অগাস্ট ২০২৫

হুমকিতে দেশের উপকূলের প্রাণ-প্রকৃতি। ছবি কোলাজ: ঢাকা মেইল


-সমুদ্র দূষণের হটস্পট সেন্টমার্টিন

-হোটেল-মোটেলের ১৫০ টন বর্জ্য যাচ্ছে সমুদ্রে

-পৌর বর্জ্যও সমুদ্রে, শীর্ষে পর্যটনসৃষ্ট দূষণ

-বর্জ্যের তথ্য অস্বীকার কক্সবাজারের ডিসির

দেশের সমুদ্র উপকূল শুধু মাছ ধরা ও জীবিকার কেন্দ্র নয়, বরং দেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের প্রাণকেন্দ্রও। কক্সবাজারের সোনালি বালি থেকে সেন্টমার্টিনের নিখুঁত দ্বীপ, সন্দ্বীপের নৌকাঘাট থেকে ভোলার জলরাশির কোণে-সমস্ত উপকূলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে এক অদৃশ্য হুমকি। যার নাম মাইক্রোপ্লাস্টিক। এই ক্ষুদ্রতম প্লাস্টিক কণাগুলো চোখে না দেখলেও তাদের প্রভাব মারাত্মক। মাছের ফুলকা, পাকস্থলী থেকে শুরু করে মানুষের রক্তেও প্রবেশ করছে এটি। সমুদ্রের খাদ্য চক্রের প্রতিটি স্তরকে দূষিত করছে।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক গবেষণার তথ্য বলছে, উত্তর-পূর্ব ও মধ্য উপকূলের মাছের ফুলকা ও পাকস্থলীতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ভয়ংকর উপস্থিতি। প্রধানত মাইক্রো-ফাইবার, ফ্র্যাগমেন্ট ও ফোম আকারে এগুলো মাছের দেহে জমছে। কক্সবাজার উপকূলে পর্যটন ও শিল্প বর্জ্য, নদীবাহিত প্লাস্টিক এবং মাছ ধরার জাল-সব মিলিয়ে দূষণের হটস্পট তৈরি করেছে।

এদিকে, পানিতে থাকা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া এই ক্ষুদ্র কণাগুলোর সঙ্গে মিশে নতুন স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। সমুদ্রের এই অদৃশ্য বিষবিন্দু শুধু প্রকৃতি নয়, মানুষের স্বাস্থ্যকেও হুমকির মুখে ফেলেছে। একমাত্র সমন্বিত সচেতনতা, পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা ও কঠোর নিয়ন্ত্রণে এই নিঃশব্দ বিপর্যয়কে প্রতিহত করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) থেকে শুরু করে NOAA এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের Marine Strategy Framework Directive (MSFD)—সব আন্তর্জাতিক সংস্থাই একে ঘোষণা করেছে বৈশ্বিক সংকট হিসেবে। আকারে মাত্র ২০ থেকে ২০০ মাইক্রন। কখনো এক মিলিমিটারেরও কম-এমন ক্ষুদ্র কণাই হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের সমুদ্রের অন্তর্লীনের অদৃশ্য শত্রু।

অদৃশ্য ছোবলে দেশের সমুদ্রসীমা, গবেষণার ফলাফল

বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (BORI) ২০২১–২০২৪ সালের মধ্যে ধারাবাহিক গবেষণায় এই উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছে। গবেষণায় তারা উত্তর-পূর্ব উপকূলের ১৪১টি মাছের মধ্যে ২১ প্রজাতিতে ২৪২টি মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পেয়েছে। প্রতি মাছের পাকস্থলীতে গড়ে ১ দশমিক ৫টি, ফুলকায় শূন্য দশমিক ৪৫টি কণা পেয়েছে।

মধ্য উপকূল-হাতিয়া, সন্দ্বীপ ও ভোলায় সংগৃহীত ১৫০টি মাছের শরীরে পাওয়া গেছে ২৪৮টি কণা। সেখানে পাকস্থলীতে গড়ে ২ দশমিক ২৫টি এবং ফুলকায় শূণ্য দশমিক ৩৮টি কণা পেয়েছে।

প্লাস্টিক বর্জে্য ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। ছবি: সংগৃহীত

গবেষণায় ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়- ৭০ শতাংশ মাইক্রো-ফাইবার (টেক্সটাইল বর্জ্য থেকে), ২৫ শতাংশ ফ্র্যাগমেন্ট (বোতল, প্যাকেজিং), ৫ শতাংশ ফোম (ফিশিং নেট ও প্যাকেজিংয়ের অবশেষ) থেকে এসেছে।

গবেষণায় আরও একটি উদ্বেগজনক চিত্র হলো, সবচেয়ে ছোট আকারের কণাই সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ, চোখে অদৃশ্য কণাই সবচেয়ে বেশি প্রবেশ করছে জ্বলজ প্রাণিদেহে। ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে কণার আকার ৫০–১০০ মাইক্রোন, ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে ১০০–২০০ মাইক্রোন এবং ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে ২০–৫০ মাইক্রোন। এছাড়া কালো রংয়ের মাইক্রোপ্লাস্টিক ৪৫ শতাংশ এবং ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে স্বচ্ছ রংয়ের মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যায়। মাইক্রোপ্লাস্টিকের ৬৫ শতাংশই ফাইবার। ফ্রাগমেন্ট ২৫ শতাংশ এবং ফিল্ম ১০ শতাংশ। ৬-৬ এর নাইলন ৫০ শতাংশ, পলিইথিলিন ৩০ শতাংশ এবং পলিপ্রোপিলিন ২০ শতাংশ।

এনভায়রনমেন্টাল ওশানোগ্রাফি ও ক্লাইমেট বিভাগের সাইন্টিফিক অফিসার সুলতান আল নাহিয়ান জানান, এই গবেষণায় কুতুবদিয়া, সাঙ্গু, চট্রোগ্রাম, হাতিয়া, ভোলা ও সন্দ্বীপের নতুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। যেখানে স্থানীয় জেলেদের নৌকায় সরাসরি অংশগ্রহণ করে অগভীর জল থেকে মাছ সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষণার জন্য ২৫ প্রজাতির মাছ ও শেলফিশ সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত প্রজাতিগুলোর মধ্যে ৯টি মাটির কাছাকাছি এবং ১৬টি মধ্য ও উপরিস্তরের থাকে।

তিনি বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে একবার ব্যবহার করা প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করা জরুরি। একইসঙ্গে প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহারে উৎসাহসহ আরও বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

দূষণের হটস্পট সেন্টমার্টিন! 

শুধু মাইক্রোপ্লাস্টিক নয়, জৈব ও অজৈব্য দূষণের ভয়াবহ চিত্র কক্সবাজারে। এরমধ্যে হটস্পট হিসেবে উঠে আসছে সেন্টমার্টিনের নাম। পৃথক আরেকটি গবেষণায় এই চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণার তথ্য বলছে, কক্সবাজার উপকূলে পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউজ ও হ্যাচারির প্রায় দেড়শ টন বর্জ্য সমুদ্রে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া পর্যটকদের ফেলে যাওয়া বর্জ্যও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গবেষণায় কক্সবাজারের ইনানি, সুগন্ধা, সেন্টমার্টিন, মহেলশাখী, সোনাদিয়াসহ মোট ২৭টি এলাকা থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। যেখানে প্রতি বর্গমিটারে ১৬টি কোয়াট্রেড স্থাপন করে দূষণকারী পদার্থ শনাক্ত করা হয়েছে।

গবেষণায় ৩০ প্রকার দূষণকারী পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এরমধ্যে জৈব দূষক ৯ ধরনের এবং অজৈব ২১ ধরনের দূষক। দূষণের ১৫ শতাংশ মানবসৃষ্ট, ৭ শতাংশ প্রকৃতিসৃষ্ট, মার্কেটজাত ২০ শতাংশ, মৎস্যজাত ১৯ শতাংশ, মেডিকেল ৩ শতাংশ এবং ৩৬ শতাংশই পর্যটনসৃষ্ট।

গবেষণায় সোনাদিয়া ও সেন্টমার্টিনে মারাত্মক দূষণের চিত্র উঠে এসেছে। সেন্টমার্টিনে দূষক বস্তু পাওয়া গেছে ১৪ হাজার ১৩০ থেকে ১৮ হাজার ৩৮১ পর্যন্ত। দূষণের এর কাছাকাছি রয়েছে মহেশখালী। নাজিরারটেকে নাইট্রেটের মাত্রা পাওয়া গেছে ২২ দশমিক ১ মিলিগ্রাম। যা জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

মৎস্যসংক্রান্ত দূষণের ৫৬ শতাংশ কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপের। পর্যটনসংক্রান্ত দূষণের আধিক্য পাওয়া গেছে নজিরারটেক, হিমছড়ি ও শামলাপুরে। মোট দূষণের ৩৩ শতাংশই মহেশখালী, ফিশারি ঘাট ও নাজিরারটেকে।

উঠে এসেছে আরও এক ভয়াবহ চিত্র

গবেষণায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তারের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণার তথ্য বলছে, পানি ও মাইক্রোপ্লাস্টিকসহ অন্যান্য দূষণকারী পদার্থের উপস্থিতি একত্রে নতুন স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন কেবল পরিবেশগত দূষণ নয়। এটি মানবস্বাস্থ্যের জন্য নতুন অদৃশ্য বাহক। জলজ পরিবেশে প্রবাহিত এই ক্ষুদ্র কণাগুলোতে যে ব্যাকটেরিয়া বাসা বাঁধছে, তারা সহজে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করছে। পরিণামে, সাধারণ ব্যাকটেরিয়া থেকে ভয়ানক অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী স্ট্রেইনগুলো দ্রুত বিস্তার পাচ্ছে, যা মানুষের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করছে।

পর্যটন বর্জে্য হুমকিতে কক্সবাজার। ছবি: সংগৃহীত

এটি একটি জটিল চিত্র। যেখানে প্লাস্টিক দূষণ, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য, খাদ্যচক্র এবং মানব স্বাস্থ্য একসাথে সংযুক্ত হয়ে নিঃশব্দ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ছগীর আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, গবেষণাগুলো বাংলাদেশের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার ওপর আলোকপাত করেছে। এখানে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ ও সামুদ্রিক মাছের ওপর এর প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে। এটি মানবস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় হুমকি। দূষণ নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। এখানে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার যে চিত্র উঠে এসেছে, এটি মানবস্বাস্থ্যের জন্য অশনি সংকেত। মেটাজিনোমিক্স ও জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মতো উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভবিষ্যতে এই সমস্যার গভীরতা বুঝতে আরও গবেষণা প্রয়োজন। পরিবেশগত সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে পরিবেশ, সমাজ ও অর্থনীতির সমন্বয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দূষণ রোধে বাস্তবিক কর্মপরিকল্পনাও প্রয়োজন।

এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. সালাহউদ্দীন ঢাকা মেইলকে বলেন, এমন গবেষণা রিপোর্ট সম্পর্কে জানি না। আমাকে খোঁজ নিতে হবে। কারণ পৌর বর্জ্য কখনোই সমুদ্রে পড়ে না। পৌর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আমাদের আছে।

এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীনের মোবাইলফোনে একাধিক কল করলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামানের মোবাইলফোনে একাধিক কল করে বন্ধ পাওয়া যায়। একারণে বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মাহাবুল ইসলাম, ঢাকা মেইল