
ইসরায়েল সফরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কাতারে গত সপ্তাহের হামলার পর হামাস নেতাদের উপর আরো হামলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি। তিনি বলেছেন, হামাস নেতারা যেখানেই থাকুক না কেন কোনো ধরনের দায়মুক্তি পাবেন না।
জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও-র সঙ্গে এক সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহু বলেন, প্রত্যেক দেশেরই নিজের সীমান্তের বাইরে গিয়েও আত্মরক্ষার অধিকার আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র কাতারে হামাস নেতাদের টার্গেট করে ইসরায়েলি হামলার ঘটনাটি ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। ওই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও সমালোচনার মুখে পড়েন। হামাস জানায়, ওই হামলায় ছয়জন নিহত হয়েছে, তবে তাদের শীর্ষ নেতারা বেঁচে গেছেন।
হোয়াইট হাউস সম্প্রতি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘ট্রাম্প কাতারকে আশ্বস্ত করেছেন যে এমন ঘটনা আর তাদের ভূখণ্ডে ঘটবে না’।
ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র ওই হামলায় কোনোভাবে জড়িত ছিল কিনা? এর জবাবে নেতানিয়াহু সাংবাদিকদের বলেন “আমরা নিজেরাই এটা করেছি। সময় এসেছে।”
এই হামলার ফলে ওই অঞ্চলের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্কের অবনতি হয়েছে কি-না, বিবিসির এক প্রশ্নের জবাবে রুবিও বলেন, ওয়াশিংটন আমাদের উপসাগরীয় মিত্রদের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল সম্পর্কে কিছুটা টানাপোড়েন দেখা গেলেও এই যৌথ সংবাদ সম্মেলনে রুবিও দুই দেশের প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের প্রশংসা করেন। আর নেতানিয়াহু বলেন, ইসরায়েলের যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ভালো কোনো মিত্র নেই।
তাদের এই বৈঠক এমন সময়ে হচ্ছে, যখন আরব নেতারা কাতারের প্রতি সংহতি জানাতে বৈঠকে বসেছেন। কাতারের প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ‘দ্বৈত নীতি’ পরিহার করার আহ্বান জানিয়েছে এবং একই সাথে ইসরায়েলের শাস্তিও দাবি করেছেন।
পরে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় যে ইসরায়েল আবার দেশটিতে হামলা করবে না, তার নিশ্চয়তা আছে কিনা, তখন রুবিও বলেন, ‘ট্রাম্প দু’বার নেতানিয়াহুকে বলেছেন কাতারে আর হামলা চালাবেন না’।
কাতারে একটি বড় মার্কিন বিমানঘাঁটি রয়েছে এবং দেশটি গাজা যুদ্ধের কূটনৈতিক সমাধান আনতে মধ্যস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনার মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও কাজ করছে। কাতারে ২০১২ সাল থেকেই হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরো অফিস রয়েছে।

ছবির উৎস,AFP via Getty Images
সপ্তাহ খানেক ধরে হাজার হাজার গাজাবাসীকে দক্ষিণের দিকে পালিয়ে যেতে দেখা গেছে
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক জন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রুবিও ইসরায়েল সফরের পরই কাতার সফর করবেন।
রোববার, নেতানিয়াহু সাংবাদিকদের জানান যে মার্কিন ইসরায়েল সম্পর্ক ওয়েস্টার্ন ওয়ালের পাথরের মতো টেকসই। সফরে এসে রুবিও জেরুজালেমের পুরাতন শহর ও পবিত্র স্থানগুলো ভ্রমণও করেন।
এসময় যেখানে তাদের সঙ্গে ছিলেন ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি। ঘুরতে গিয়ে রুবিও একটি নোট লিখে ঐ দেয়ালে লাগিয়ে দেন। সেখানে বিদেশি অতিথি যারাই আসেন তারাই এই ঐতিহ্যটি অনুসরণ করেন।
নেতানিয়াহু ও রুবিও-র মধ্যে বৈঠকে গাজা শহর দখলের ইসরায়েলি সামরিক পরিকল্পনা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের বসতি সম্প্রসারণের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সপ্তাহ খানেক হলো ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজা সিটিতে আঞ্চলিক আবাসিক ভবন ধ্বংসের কাজ শুরু করেছে এবং স্থানীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী; এখন শহরের পশ্চিম অঞ্চলের এলাকাগুলোতে অপারেশন শুরু করা হতে পারে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী, গাজা সিটির বাসিন্দাদের দক্ষিণের কেন্দ্রীয় এলাকার দিকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
ইসরায়েলি বাহিনীর ধারণা, প্রায় আড়াই লাখ ফিলিস্তিনি সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছে। যদিও হাজার হাজার মানুষ এখনো ওই এলাকায় থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গাজায় অবস্থানরত ফিলিস্তিনিদের কেউ কেউ বলছেন যে দক্ষিণে যাওয়ার সাধ্য তাদের নেই। আবার অনেকে বলছেন, দক্ষিণ গাজা নিরাপদ নয়, কারণ ইসরায়েল সেখানেও বিমান হামলা চালিয়েছে।
কেউ আবার গাজার দক্ষিণে যাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন কারণ সেখানে তাঁবু স্থাপন করতে পারেননি, তাই গাজা শহরে ফিরে এসেছেন।
“তারা আমাদের বাড়ি ছেড়ে যেতে বলছে, যেন তারা আমাদের ভ্রমণে যেতে বলেছে”, বলছিলেন গাজা শহরের বাসিন্দা হাফেজ হাবসু।
“এখানে গাজায় আমরা একটিই কারণে মরবো, আমাদের কাছে টাকা নেই, কোনো তাঁবু নেই, কোনো জায়গা নেই, পরিবহনও পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি যদি কোনো চালকের কাছে দক্ষিণে যাওয়ার জন্য বলেন, সে ৩০০ শেকেল চায়”।
“এটা কীভাবে সম্ভব, আমার কাছে তো ১০০ শেকেলও নেই। ভোরের খাবারের জন্যও টাকা নেই। তাহলে আমরা কীভাবে দক্ষিণ গাজায় যাবো?”, বলছিলেন মি. হাবসু।

ছবির উৎস,Anadolu via Getty Images
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে গাজার বহুতল ভবন
জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়েছে যে, এমন একটি এলাকায় আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে বেসামরিক নাগরিকদের জীবন আরো গভীর বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে।
নেতানিয়াহু ও রুবিও-র বৈঠকটি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আগামী সপ্তাহের অধিবেশনের আগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যেখানে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও বেলজিয়ামসহ যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি প্রধান মিত্র রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই প্রত্যাশিত স্বীকৃতি ইসরায়েলের ভেতরে পশ্চিম তীরের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিতর্ক বাড়িয়ে তুলেছে। সরকারের কঠোরপন্থী অংশ বলছে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের পথ রোধ করতে একমাত্র উপায় হলো পশ্চিম তীর দখল।
গত অগাস্টের শেষ দিকে, ইসরায়েলি সরকার জেরুজালেমের পূর্বে ই-১ সেটেলমেন্ট প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। এই প্রকল্প কার্যকর হলে পশ্চিম তীরকে দুইভাগে বিভক্ত করে উত্তরের সাথে দক্ষিণ ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
গত বৃহস্পতিবার প্রকল্পটির জন্য চুক্তিতে সই করার সময় নেতানিয়াহু বলেন, “আমরা আমাদের অঙ্গীকার পূরণ করতে যাচ্ছি যে এখানে কোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র হবে না। এই ভূমি আমাদের।”
এ মাসের শুরুর দিকে, ইসরায়েলের অতি-ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ প্রায় পাঁচভাগের চারভাগ পশ্চিম তীর দখলের প্রস্তাব দেন।
ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম দখলের পর থেকে প্রায় ১৬০টি বসতি গড়ে তুলেছে। যেখানে প্রায় সাত লাখ ইহুদি বসবাস করছে।
ওই ভূমি গাজাসহ ফিলিস্তিনিরা তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে দাবি করে। বর্তমানে ওই অঞ্চলে প্রায় ৩৩ লাখ ফিলিস্তিনি বসবাস করে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এসব বসতি অবৈধ।
সোমবার সন্ধ্যায় রুবিও-র সিটি অব ডেভিড প্রত্নতাত্ত্বিক পার্কে যাওয়ার কথা রয়েছে। এটি পূর্ব জেরুজালেমের দখলকৃত সিলওয়ান ফিলিস্তিনি পাড়ায় একটি ইসরায়েলি বসতি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে।
তিনি সেখানে “পিলগ্রিমেজ রোড” উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। এটি একটি সুড়ঙ্গ, যা ফিলিস্তিনি বাড়ির নিচ দিয়ে খনন করা হয়েছে।
ধারণা করা হয়, রোমান যুগের এই পথ দিয়েই ভক্তরা একসময় বাইবেলীয় মন্দিরে যেতেন। ইহুদিরা যেটিকে ‘টেম্পল মাউন্ট’ বলে আর মুসলমানদের কাছে যা আল-হারাম আল-শরিফ বা মসজিদুল আকসা।
সমালোচকরা বলছেন, সিটি অব ডেভিড পার্ক প্রত্নতত্ত্বকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার একটি প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। বিবিসি























